ব্যাকফুটে চুন্নু, গ্রেপ্তার নাকি পুনর্বাসন! by আশরাফুল ইসলাম

বাংলাদেশের রাজনীতির এক আলোচিত-সমালোচিত চরিত্র জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। অন্য একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হয়েও বিগত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে আওয়ামী শাসনামলে ছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে। এমপি থেকে শুরু করে মন্ত্রিত্ব পর্যন্ত সব স্বাদই নিয়েছেন। আলোচনা রয়েছে, ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন থেকে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যখন নির্বাচন বয়কট বা বর্জনের পথে হাঁটে, তখন জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নেয়ার ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা রাখেন মুজিবুল হক চুন্নু। মহাজোটের অংশীদার হিসেবে তখন তিনি হাসিনা সরকারের যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন। ওই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে চুন্নু তার নিজ আসন কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) এর প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে আওয়ামী লীগকে সরিয়ে দেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত ড. মিজানুল হক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে সরকারি দলের সহযোগিতায় ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির মাধ্যমে তাকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন মুজিবুল হক চুন্নু। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর পুরস্কার হিসেবে মুজিবুল হক চুন্নু মন্ত্রিসভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর রাতের ভোটের নির্বাচনেও মুজিবুল হক চুন্নুর কৌশলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মহাজোটের সঙ্গী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয় পার্টি।

মহাজোট প্রার্থী হিসেবে চুন্নু ‘লাঙ্গল’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। সে নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরার স্বীকারোক্তি তিনি নিজেই দিয়েছেন। ২০২২ সালের ৩১শে জুলাই নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে জাতীয় পার্টির সংলাপে তিনি বলেছিলেন, ‘রাতে কিন্তু কাজটা (ভোট দেয়া) হয়। হয় মানে কী, আমরাই করাইছি। কী বলবো এটা হয়। এটা হয় না, ঠিক না।’ এর আগে ২০২১ সালের ৯ই অক্টোবর জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিব করা হয়। তাকে মহাসচিব করার ব্যাপারেও সরকারি দল আওয়ামী লীগ এবং রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তদবির ছিল বলে গুঞ্জন রয়েছে। জাতীয় পার্টির একাধিক সূত্র বলছে, সর্বশেষ গত ৭ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে মহাসচিব হিসেবে প্রায় একক সিদ্ধান্তে চুন্নু জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিয়ে যান। এমনকি গত ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সময় মুজিবুল হক চুন্নু তার নির্বাচনী পোস্টারে নিজেকে ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ প্রার্থী হিসেবে উল্লেখ করেন। সে সময় বিষয়টি বেশ সমালোচিত হয়। এদিকে গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর শুরুর দিকে বেশ স্বস্তিতেই ছিলেন মুজিবুল হক চুন্নু। ৫ই আগস্ট সেনাপ্রধানের সঙ্গে জাতীয় পার্টির বৈঠক এবং ৩১শে আগস্ট প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি দলে ছিলেন মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বিরোধিতার মুখে পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকে ডাক পায়নি জাতীয় পার্টি। এতে জাতীয় পার্টির পাশাপাশি দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বিপাকে পড়েন। এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেই গত ৬ই অক্টোবর রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের হওয়া একটি হত্যা মামলায় মুজিবুল হক চুন্নুকে আসামি করা হয়।

 বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিকে ঘিরে গত ৫ই আগস্ট রাজধানীর আজমপুর এলাকায় গুলিতে নিহত আলমগীর হোসেন (৩৪) এর মা মোসা. আলেয়া বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে করা এ মামলায় ৬নং আসামি করা হয়েছে মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে। ৫ই আগস্ট পরবর্তী সময়ে এটি মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া প্রথম ও একমাত্র মামলা। এরপর থেকেই অনেকটা ব্যাকফুটে রয়েছেন মুজিবুল হক চুন্নু। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার বিষয়টি তার নিজ জেলা কিশোরগঞ্জে জানাজানি হওয়ার পর সেখানে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া তার নিজ এলাকার মানুষ মুজিবুল হক চুন্নুকে এ মামলায় অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। এ পরিস্থিতি চুন্নু কীভাবে সামাল দিবেন, সেটিই এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে শনিবার (১২ই অক্টোবর) জাতীয় পার্টি আয়োজিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সকল থানা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ বরাবরই আমাদের অনৈতিকভাবে বিভিন্ন চাপে রেখে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করেছে। তাদের কাছে অনেক সময় আমরা জিম্মিও ছিলাম।

এখন কোনো চাপ নেই তাই আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের রাজনৈতিক কর্মকৌশল প্রণয়ন করে জনগণকে প্রকৃত সেবা দেয়ার লক্ষ্যে আগামী নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হবো। জনগণ আমাদেরকেই সমর্থন করবে। এজন্য ধৈর্য্য ধারণ করে কারও কোনো উস্কানিতে বিভ্রান্ত না হয়ে পার্টির সকল সাংগঠনিক কার্যক্রমে একাগ্রতার সহিত অংশগ্রহণ করতে হবে এবং জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় ফোরামে চুন্নু যাই বলেন না কেন, আওয়ামী লীগকে সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল জাতীয় পার্টি এবং এক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকায় ছিলেন মুজিবুল হক চুন্নু। তাই বর্তমান পরিস্থিতি জাতীয় পার্টি কিংবা চুন্নু কারওরই অনুকূলে নয়।
বিশেষ করে চুন্নুর বিরুদ্ধে বেশি সরব আলোচনা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হবেন কি-না, সেটি নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে তিনি পুনর্বাসিত হন কি-না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.