র‌্যাব-সেনা পোশাকে ডাকাতি আতঙ্ক

র‌্যাব-সেনাবাহিনীর পোশাক পরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এক ব্যবসায়ীর বাসায় ডাকাতি করে টাকা ও স্বর্ণালংকার লুটের ঘটনায় শহর জুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। ওই ঘটনায় ডাকাতদলের ১১ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পরও নগরবাসীর মধ্যে আরও বেশি আতঙ্ক কাজ করছে। কারণ গ্রেপ্তারদের মধ্যে ৫ জনই বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ওই সদস্যরা চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন। তবে তারা থেমে যাননি। নতুন করে আবার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন। এ ছাড়া র‌্যাব-সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতির ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি বাড়ছে। কারণ এভাবে যে কারও বাসায় এসব পোশাকের আড়ালে ডাকাতি করার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই মোহাম্মদপুরের ঘটনার পর ঢাকার বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখন আতঙ্কিত। যদিও সকল শঙ্কাকে উড়িয়ে দিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এ বিষয়ে তৎপরতা শুরু করেছেন। ঘটনার পর র‌্যাব ডাকাতদলের ৮ সদস্য ও ডিবি ৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মোহাম্মদপুর থানায় ডাকাতি মামলাও হয়েছে। সকল সংস্থাই এটিকে গুরুত্বসহকারে নিয়ে তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাজে ফিরলেও এখনো থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম, টহল, মামলা গ্রহণ, আসামি গ্রেপ্তার, তালিকাভুক্ত অপরাধীদের গ্রেপ্তার, নজদারিতে পুলিশ পুরোদমে সক্রিয় নয়। অপরাধীরা এই সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে। যদিও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এখন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সব জায়গায় পুলিশ সক্রিয়।

শুক্রবার রাত ৩টার দিকে মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তার মোড় বেড়িবাঁধ এলাকায় আবু বকর নামের ব্যবসায়ীর বাসায় র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ২০ থেকে ২৫ জন প্রবেশ করে। বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেয়া হয়নি এমন অভিযোগে তারা বাসায় প্রবেশ করে। আবু বকরের বাসায় ও অফিসে ঘণ্টাখানেক অবস্থানের পর তারা সাড়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে চলে যায়। ভুক্তভোগী আবু বকর বলেন, দু’টি মাইক্রোবাস ও দু’টি প্রাইভেটকার নিয়ে বাসার ভেতরে ২৫-৩০ জন ঢুকেছিল বাইরেও তাদের লোকজন ছিল। বাসায় ঢুকে বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেইনি তাই তারা অস্ত্র নিতে এসেছে এমন অভিযোগ করে। আমি অস্ত্র আগেই থানায় জমা দিয়েছি এমন কথা জানানোর পরও তারা বাসার আলমারি খুলে তছনছ শুরু করে। পরে তারা ফ্ল্যাটের একপাশে আমার অফিসে যায় এবং একইভাবে অস্ত্র আছে বলে সিন্দুক ও আলমারি খুলে টাকা নিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যায়। প্রায় ঘণ্টাখানেক অবস্থান করে ভোর সোয়া ৪টার দিকে বের হয়ে যায়। আবু বকর আরও বলেন, আমার বাসা-অফিস মিলে নগদ ৭৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং স্ত্রী, কন্যা, ছেলের বউয়ের প্রায় ৬০ ভরির বেশি স্বর্ণালংকার নিয়ে যায়। নগদ টাকার মধ্যে বড় অংশ ছিল জমি বিক্রির টাকা। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান জানান, মুখে মাস্ক লাগিয়ে সেনাবাহিনীর পোশাক পরে আসা লোকজনকে দেখে দারোয়ান গেট খুলে দেয়। এরপর তারা তিনতলায় আবু বকরের ফ্ল্যাটে যায়। র‌্যাবের জ্যাকেট পরা ও সাদা পোশাকের লোকজনও ছিল তাদের সঙ্গে। র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, গ্রেপ্তার ১১ জনের মধ্যে পাঁচজন বিভিন্ন বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্য। বাকি তিনজন সাধারণ মানুষ। তাদের কাছ থেকে সোনার একটি ব্রেসলেট ও আংটি উদ্ধার করা হয়েছে। ডাকাতির এ ঘটনায় কোনো বাহিনীর কেউ জড়িত থাকলেও তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। ডিবি মোহাম্মদপুরে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর ডাকাতি মামলায় সরাসরি জড়িত যে তিন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে তারা হলো- শরীফুল ইসলাম তুষার (৩৫), জাকির হোসেন (৩৭) এবং মো. মাসুদুর রহমান (৪৭)। এ সময় গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে দুই লাখ ২০ হাজার নগদ টাকা, প্রায় ৪ ভরি ওজনের স্বর্ণালংকার ও দুটি আইফোন উদ্ধার করা হয়। ডিএমপি মিডিয়ার উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুল রহমান বলেন, ডাকাতির ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি ডাকাতি মামলা রুজু করা হয়েছে।

এদিকে গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনে দুর্গাপূজা মণ্ডপ পরিদর্শন শেষে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম বলেছেন, দুর্গাপূজার পর সারা দেশে ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, মাদক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে। মাঝে মাঝে আপনাদের যে শঙ্কা তৈরি হয় এবং আমাদের কাছে যে অভিযোগ আসে আমরা সেগুলোকে আমলে নিতে চাই। আমরা যেন আইনশৃঙ্খলা অবনতির ঘটনাগুলো প্রতিহত করতে পারি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, মোহাম্মদপুরের ঘটনাটি সবদিক দিয়েই আমাদের অবাক করেছে। অতীতেও ভুয়া পুলিশ, র‌্যাব ও ডিবির পরিচয় দিয়ে ডাকাতি- অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এই ঘটনা পূর্বের ঘটনার সঙ্গে নতুন কিছু মাত্রা যোগ করেছে। অতীতের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক কোনো ব্যবস্থা না করায় এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে এবং প্রতিবারের ঘটনায় নতুন কিছু মাত্রা যোগ হচ্ছে। মোহাম্মদপুরে যেটা দেখলাম বিভিন্ন বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ও আরও কিছু লোক মিলে একটি গ্যাং তৈরি করে র‌্যাব-সেনাবাহিনীর পোশাক পরে ডাকাতি করেছে। আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে আছি সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হতে আরও অনেক সময় লাগবে। এই সময় এসে এ ধরনের ডাকাতি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

mzamin

No comments

Powered by Blogger.