ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ বাড়ছে: ৯ মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে ধার ৪০ হাজার কোটি টাকা by এমএম মাসুদ
দীর্ঘদিন
কমতির ধারায় থাকার পর সমপ্রতি আবার বাড়তে শুরু করেছে সরকারের ব্যাংক ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, এই অর্থবছরে গত জুলাই থেকে ২১শে মে পর্যন্ত
ব্যাংক থেকে সরকার ১১ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। অন্যদিকে চলতি
অর্থবছরের ৯ মাসে সরকারের সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার
মতো। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে
পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল, তার চেয়েও ৫২ শতাংশ বেশি নেয়া হয়েছে ৯
মাসেই। সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আসন্ন বাজেটে সঞ্চয়পত্র খাতে বড় ধরনের
সংস্কার আনা হচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া কমছে বেচাকেনার লক্ষ্যমাত্রা।
অপরিবর্তিত থাকছে সুদহার ও ১লা জুলাই থেকে দেশব্যাপী অনলাইনে লেনদেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখছে সরকার। এই বরাদ্দ চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে ৫৭ হাজার কোটি ব্যয় হবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে। বাকি ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেটে সুদ পরিশোধে বরাদ্দ দেয়া অর্থের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে সঞ্চয়পত্র এবং মেয়াদী ঋণের সুদ পরিশোধে। এছাড়া সরকারি কর্মচারিদের ভবিষ্যৎ তহবিল বা জিপিএফ, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ, চলতি ঋণ এবং জীবন বীমা ও অন্যান্য ঋণের সুদ পরিশোধে এই অর্থ ব্যয় করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত এবং সুদের হার বেশি হওয়ায় এখানে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে যেভাবে বাড়ছে এটা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কারণ এটা বন্ধ করা কিংবা সুদের হার কমিয়ে আনা কোনোটাই সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হলো বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়া। এতে করে সরকারকে অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রির সুদের বোঝা টানতে হবে না।
ঋণের বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাংকের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারের ঋণ নেয়া বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর জন্য আরো কঠিন হবে। আবার নতুন আমানত পর্যাপ্ত পরিমাণে আসছে না। এতে বেশির ভাগ ব্যাংকই নগদ টাকার সংকটে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, এই অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকার ১১ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৭ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৩ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ ও ট্রেজারি বিল খাতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত ২১শে মে পর্যন্ত সরকারের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নেয়া আছে ৭১ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ২৭ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, গত অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে কোনও ঋণই নিতে হয়নি সরকারকে। বরং ওই অর্থবছরে আগের বাকি থাকা ১৮ হাজার ২৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল সরকার।
সরকারের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়া হয়। যদি ৯১ দিন, ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ঋণ নেয়, তাহলে সেটা স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ধরনের ঋণের বিপরীতে সুদহার হচ্ছে সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। আর বন্ডের মাধ্যমে সরকার ২ বছর, ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি ঋণ নেয়। এ ধরনের ঋণে সুদহার ৬.৩২ থেকে ৮ শতাংশ।
এদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল ১২.০৭ শতাংশ। যা গত ৫৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল ১১.৩৯ শতাংশ। প্রতিবেদন বলছে, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮ লাখ ৮১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, জাতীয় সঞ্চয় স্কীমগুলোর মুনাফার হার বেশি হওয়ায় এ খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ বেশি আসছিল। যে কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণনির্ভরতা কমছিল। এখনও সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বজায় থাকলেও অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কেনাবেচা চালুর পর সমপ্রতি সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বড় ধরনের সংস্কারের আওতায় আসছে সঞ্চয়পত্র খাত। এরই অংশ হিসেবে ১লা জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে সারা দেশে অনলাইনে লেনদেন। এছাড়া স্থাপন করা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের তথ্য সংক্রান্ত ডাটাবেজ। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের ক্রেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হচ্ছে কঠোর নীতিমালা। যার মধ্য দিয়ে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনায় নিরুৎসায়ী করা হচ্ছে।
এর ধারাবাহিকতায় আসন্ন বাজেটে তা কমিয়ে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা চলতি বাজেটে ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের তুলনায় ১২ হাজার কোটি টাকা কম। তবে সঞ্চয়পত্রের বর্তমান সুদহার অপরিবর্তিত থাকছে। সঞ্চয়পত্র খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ রোধ, ধনী ও করপোরেট শ্রেণীর হাত থেকে সঞ্চয়পত্রকে রক্ষা, ঋণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরানো ও অধিক সুদ পরিশোধে বাজেটের ওপর সৃষ্ট অতিরিক্ত চাপকে হ্রাস করতেই মূলত নানামুখী সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সঞ্চয়পত্রসহ সব ধরনের জাতীয় সঞ্চয় স্কিম থেকে সরকারের নিট ঋণ এসেছে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য ঠিক করেছিল।
প্রসঙ্গত সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের কমপক্ষে প্রতি দুই মাস অন্তর সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। সে হিসাবে ৯ মাসে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি ২১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের বিপরীতে গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২১,৭৫১ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৫,৬২৫ কোটি টাকা সুদ গুনতে হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বছরে সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ-আসল বাবদ সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তার থেকেও এ ব্যয় ১ হাজার কোটি টাকা বেশি। তাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের লাগাম টানতে এ খাতে বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।
সমপ্রতি অনুষ্ঠিত প্রাক-বাজেট বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদে হাত দেব না। সুদের হার কমাবো না। তবে এই খাতে কিছু সংস্কার করা হবে। কারণ কিছু অবৈধ টাকা এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে। এর পরপরই পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে চলতি মাস থেকে অনলাইনে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত নিয়ম অনুযায়ী, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ক্রেতাদের টিআইএন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও মোবাইল ফোন নম্বর সংযুক্ত করা। এতে সঞ্চয়পত্র কেনাবেচায় ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। যা আগামীতে সঞ্চয়পত্র খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৮,৯৫৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩,৩২৭ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৪,৩১০ কোটি, ৪২,৬৬০ কোটি এবং ৫৩,৭১২ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৫,১৩৫ কোটি টাকা। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিক্রি হয় ৭৮,৭৮৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।
আগামী ১৩ই জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করা হবে। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ৬০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখছে সরকার। এই বরাদ্দ চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। এর মধ্যে ৫৭ হাজার কোটি ব্যয় হবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে। বাকি ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধে। বাজেটে সুদ পরিশোধে বরাদ্দ দেয়া অর্থের প্রায় ৮০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে সঞ্চয়পত্র এবং মেয়াদী ঋণের সুদ পরিশোধে। এছাড়া সরকারি কর্মচারিদের ভবিষ্যৎ তহবিল বা জিপিএফ, বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ, চলতি ঋণ এবং জীবন বীমা ও অন্যান্য ঋণের সুদ পরিশোধে এই অর্থ ব্যয় করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত এবং সুদের হার বেশি হওয়ায় এখানে সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ বাড়ছে। তবে যেভাবে বাড়ছে এটা নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। কারণ এটা বন্ধ করা কিংবা সুদের হার কমিয়ে আনা কোনোটাই সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে সরকারের করণীয় হলো বাজেটে সঞ্চয়পত্র বিক্রির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়, তা পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ করে দেয়া। এতে করে সরকারকে অতিরিক্ত সঞ্চয়পত্র বিক্রির সুদের বোঝা টানতে হবে না।
ঋণের বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, সরকারের ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণে ব্যাংকের সক্ষমতা কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারের ঋণ নেয়া বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি খাতে ঋণ দেয়া ব্যাংকগুলোর জন্য আরো কঠিন হবে। আবার নতুন আমানত পর্যাপ্ত পরিমাণে আসছে না। এতে বেশির ভাগ ব্যাংকই নগদ টাকার সংকটে পড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, এই অর্থবছরে ব্যাংক থেকে সরকার ১১ হাজার ৭০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৭ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৩ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সরকার সবচেয়ে বেশি ঋণ নিয়েছে গভর্নমেন্ট সিকিউরিটিজ ও ট্রেজারি বিল খাতে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, গত ২১শে মে পর্যন্ত সরকারের কাছে ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ৯৯ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে নেয়া আছে ৭১ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নিয়েছে ২৭ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
প্রসঙ্গত, গত অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে সরকার ৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ব্যাংক খাত থেকে কোনও ঋণই নিতে হয়নি সরকারকে। বরং ওই অর্থবছরে আগের বাকি থাকা ১৮ হাজার ২৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছিল সরকার।
সরকারের প্রয়োজন মেটাতে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়া হয়। যদি ৯১ দিন, ১৮২ দিন ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ঋণ নেয়, তাহলে সেটা স্বল্পমেয়াদি ঋণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই ধরনের ঋণের বিপরীতে সুদহার হচ্ছে সাড়ে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। আর বন্ডের মাধ্যমে সরকার ২ বছর, ৫ বছর, ১০ বছর, ১৫ বছর ও ২০ বছর মেয়াদি ঋণ নেয়। এ ধরনের ঋণে সুদহার ৬.৩২ থেকে ৮ শতাংশ।
এদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছে না বেসরকারি খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল ১২.০৭ শতাংশ। যা গত ৫৭ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০১৪ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ ছিল ১১.৩৯ শতাংশ। প্রতিবেদন বলছে, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ৯২৯ কোটি টাকা। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৮ লাখ ৮১ হাজার ৫১০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, জাতীয় সঞ্চয় স্কীমগুলোর মুনাফার হার বেশি হওয়ায় এ খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ বেশি আসছিল। যে কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণনির্ভরতা কমছিল। এখনও সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বজায় থাকলেও অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সরাসরি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে কেনাবেচা চালুর পর সমপ্রতি সরকারের ব্যাংক ঋণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বড় ধরনের সংস্কারের আওতায় আসছে সঞ্চয়পত্র খাত। এরই অংশ হিসেবে ১লা জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে সারা দেশে অনলাইনে লেনদেন। এছাড়া স্থাপন করা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ক্রেতাদের তথ্য সংক্রান্ত ডাটাবেজ। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের ক্রেতাদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে প্রণয়ন করা হচ্ছে কঠোর নীতিমালা। যার মধ্য দিয়ে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনায় নিরুৎসায়ী করা হচ্ছে।
এর ধারাবাহিকতায় আসন্ন বাজেটে তা কমিয়ে সঞ্চয়পত্র খাত থেকে মাত্র ৩০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যা চলতি বাজেটে ছিল ৪২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বছরের তুলনায় ১২ হাজার কোটি টাকা কম। তবে সঞ্চয়পত্রের বর্তমান সুদহার অপরিবর্তিত থাকছে। সঞ্চয়পত্র খাতে কালো টাকা বিনিয়োগ রোধ, ধনী ও করপোরেট শ্রেণীর হাত থেকে সঞ্চয়পত্রকে রক্ষা, ঋণ ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরানো ও অধিক সুদ পরিশোধে বাজেটের ওপর সৃষ্ট অতিরিক্ত চাপকে হ্রাস করতেই মূলত নানামুখী সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সঞ্চয়পত্রসহ সব ধরনের জাতীয় সঞ্চয় স্কিম থেকে সরকারের নিট ঋণ এসেছে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্য ঠিক করেছিল।
প্রসঙ্গত সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের কমপক্ষে প্রতি দুই মাস অন্তর সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। সে হিসাবে ৯ মাসে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি ২১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে। এই ঋণের বিপরীতে গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ২১,৭৫১ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৫,৬২৫ কোটি টাকা সুদ গুনতে হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বছরে সঞ্চয়পত্রের ঋণের সুদ-আসল বাবদ সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বছরে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তার থেকেও এ ব্যয় ১ হাজার কোটি টাকা বেশি। তাই সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের লাগাম টানতে এ খাতে বিনিয়োগে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে।
সমপ্রতি অনুষ্ঠিত প্রাক-বাজেট বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদে হাত দেব না। সুদের হার কমাবো না। তবে এই খাতে কিছু সংস্কার করা হবে। কারণ কিছু অবৈধ টাকা এখানে বিনিয়োগ হচ্ছে। এর পরপরই পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে শুধু ঢাকা শহরে চলতি মাস থেকে অনলাইনে সঞ্চয়পত্র বেচাকেনা শুরু হয়েছে। প্রস্তাবিত নিয়ম অনুযায়ী, বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ক্রেতাদের টিআইএন ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও মোবাইল ফোন নম্বর সংযুক্ত করা। এতে সঞ্চয়পত্র কেনাবেচায় ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সূত্র।
অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। যা আগামীতে সঞ্চয়পত্র খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৮,৯৫৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩,৩২৭ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৪,৩১০ কোটি, ৪২,৬৬০ কোটি এবং ৫৩,৭১২ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৫,১৩৫ কোটি টাকা। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিক্রি হয় ৭৮,৭৮৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।
আগামী ১৩ই জুন জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপন করা হবে। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার মতো।
No comments