আতঙ্ক কাটছে না কোটা আন্দোলনকারীদের by ফররুখ মাহমুদ
কোটা
সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে আতঙ্ক কাটছে না। প্রশাসনের
একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে এই আতঙ্ক আরো বাড়ছে। শিক্ষাবিদরা প্রশাসনের
বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বলছেন, আন্দোলনকে রাজনৈতিক দিক থেকে
নয়, গুরুত্ব মূল্যায়ন করতে হবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি সহনশীল
হতে হবে। একই সঙ্গে কেউ যদি ধ্বংসাত্মক কাজ করে এবং সেটি প্রমাণিত হয় তার
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ
মনজুরুল ইসলাম বলেন, আন্দোলনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ঠিক নয়। এটি
শিক্ষার্থীদের উদ্বিগ্নতা, ক্ষোভ থেকে হয়েছে। সেটাকে সেভাবে দেখাই উচিত
ছিল। শুরু থেকে যারাই করুক না কেন এখন খুঁজে খুঁজে বের করছেন তারা শিবির,
ছাত্রদল বা হাবিজাবি- এ কাজটা আমার পছন্দ হয় না। আন্দোলনের মেরিট হিসেবে
তাদের মূল্যায়ন করা উচিত। তিনি আরো বলেন, কেউ যদি সেখানে সরকারকে বিপদে
ফেলার জন্য অর্ন্তঘাতমূলক কিছু করে সেটার বিচার আপনারা করেন। সেটার জন্যও
তো কেউ আপনাকে আটকাচ্ছে না। ঢালাওভাবে সব শিক্ষার্থীর অপদস্ত করার কারণ তো
আমি দেখি না। আর গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষার্থীদের অধিকার থাকবে না একটা
আন্দোলন করার? তারা তো ধ্বংসাত্মক কাজ করেনি। ভিসির বাসভবনে যারা ধ্বংসযজ্ঞ
চালিয়েছে তাদের খুঁজে বের করুন। এরা তো অনুপ্রবেশকারী। যারা চারুকলাতেও
আগুন দিয়েছে। এর অপবাদ সবার ওপর দেয়া উচিত হবে না। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
বলেন, যারা আন্দোলন করেছে তাদের খুঁজে বের করা মোটেও উচিত হচ্ছে না। এটা
অশিক্ষকসুলভ আচরণ। রাতের বেলায় হল থেকে বের করতে হবে কেন? ধামরাই থেকে
বাবাকে সকালে আসতে বলতে পারতেন। ছাত্রীরা বের হয়ে গেছে সেটা শুনে
প্রধানমন্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়েছেন। হল প্রশাসন হলো না। প্রশাসনের আরো বেশি
সহনশীল হওয়া উচিত ছিল। তিনি আরো বলেন, তদন্তের নামে যা চলছে, এটা হল
প্রশাসন করতে পারে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী করতে পারে। এভাবে একটা ছাত্রীর ফোন
জব্দ করা অমানবিক ব্যাপার। আপনি যদি নিশ্চিত হোন ছাত্রী দোষ করেছে তাহলে
প্রক্টরের সহযোগিতা নেন। আশা করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিবার। এটাতে
ভাঙন তারা চাইবেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত যথাযথ মনে হয়নি। আরো দূরদর্শিতার প্রয়োজন ছিল। কাউন্সেলিংয়ের দরকার হলে সেটা হল প্রশাসন করবে। টিএসসিতে একটি কাউন্সেলিং সেন্টার রয়েছে। তিনি বলেন, মামলার বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। প্রশাসনকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তবে ভিসির বাসায় হামলার বিষয়ে যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। এ ধরনের সংকটের ক্ষেত্রে প্রশাসন ধারাবাহিকভাবে বা ঐতিহ্যগতভাবে যে ধরনের ভূমিকা পালন করে সেরকম ভূমিকা এখনো দেখছি না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে এমন একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন শুধু প্রশাসকই নয়, শিক্ষকও বটে। শিক্ষকসুলভ আচারণ, শিক্ষকসুলভ আলোচনা বা কথাবার্তার প্রয়োজন ছিল সেগুলোর প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। সে ঘাটতির কারণেই শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থীদের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সুফিয়া কামাল হলে যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে প্রভোস্টের যে ভূমিকা সেটি খুবই অনভিপ্রেত এবং শিক্ষক সুলভ না। এটা অপরাজনীতি চর্চার একটি বহিঃপ্রকাশ। এ সংকটকে আরো জটিল করে তুলছে। এখানে দূরদর্শিতা এবং শিক্ষকসুলভ আচরণ খুবই প্রয়োজন। এটাই কাম্য। শিক্ষার্থীরাও এমন আচরণ প্রত্যাশা করে। তিনি আরো বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের একধরনের বোধের যে প্রকাশ সেটা শুধু কোটা সংস্কারের অবস্থান না। আমাদের আবাসিক হলগুলোতে যেরকম মিনি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করে রাখা হয়েছে, হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো। যেখানে একজন শিক্ষার্থীর ন্যূনতম পরিবেশ দরকার পড়াশোনার জন্য, তার সুস্থ জীবনযাপনের জন্য সেটা আমরা আবাসিক শিক্ষকরা নিশ্চিত করতে পারিনি। নিশ্চিত করতে পারিনি বলেই আমরা হাফিজুরের মৃত্যু দেখেছি, আবু বকরের মৃত্যু দেখেছি, আমরা এহসানকে দেখলাম একটা ক্যালকুলেটরের জন্য চোখ অন্ধ করে দিলো প্রায়। ফলে হলগুলোর অব্যবস্থাপনাও শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তার প্রকাশটাও কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘটেছে। আমাদের আগে থেকেই সচেতন হওয়ার কথা ছিল। হাফিজুর, এহসানদের ঘটনার পরও আমরা নির্লিপ্ত ছিলাম। বিশেষ করে হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্ট বেশির ভাগ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। ব্যতিক্রমও রয়েছেন। তানজিম উদ্দিন খান বলেন, রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দূরে ঠেলে দিই এবং অবহেলা করি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব ছিল না। তারা সরব ছিল একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি। সেটাই পরিস্থিতিকে আরো বেসামাল করে। যারা সরকারি দল করে সেটা যে সময়ই হোক না কেন তারা ক্যাম্পাসে অনেক শক্তিশালী থাকে। প্রশাসনের দায়িত্ব এই শক্তির ভারসাম্য আনা; বিশেষ করে আইনি দিক থেকে, নিয়মনীতির দিক থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত সেভাবে পরিচালনা করে এ শক্তির ভারসাম্য এনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
গত ১৯শে এপ্রিল গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রোকেয়া হলে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে চার ছাত্রীর বিক্ষোভের মুখে পড়েন ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বের করে দেয়া ছাত্রীদের শুক্রবার বিকালে ও রাতে আবারো হলে তুলে নেয় প্রশাসন। এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা বলেন, কাউকে হল থেকে বের করা হয়নি। তাদের ওইদিন রাতে তাদের স্থানীয় অভিভাবকের কাছে দেয়া হয়েছে। যাতে তারা তাদের সন্তানদের কাউন্সেলিং করে। শুক্রবার তারা সবাই হলে ফিরেছেন। তিন ছাত্রীর দুজন হলের খেলায়ও অংশ নিয়েছেন। একজন সন্ধ্যায় হলের ছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সাধারণসভায় বক্তৃতা করেছেন। যেখানে হলের প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক ছাত্রী অংশ নিয়েছিল। তিনি বলেন, এদের তাদের পরিবার আবার বাসায় নিতে পারেন। বাসায় ও হলে আমরা তাদের কাউন্সেলিং করবো। এ ঘটনায় ছাত্রীদের মাঝে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সেটি এখনো কাটেনি। একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ছাত্রী বলেন, প্রভোস্ট দুই হাজার ছাত্রীর ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি দেয়ায় আমরা ভয়ে আছি। হলে এখনো হয়রানি করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। সব মেয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছে। ছাত্রী হলের এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে ছাত্র হলগুলোতেও। একই সঙ্গে ভিসির ভবন ভাঙচুরসহ অন্য মামলাগুলোর কারণে শিক্ষার্থীরা ভীতির মধ্যে রয়েছেন। আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নূর বলেন, অজ্ঞাতনামা মামলা দিয়ে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের হয়রানির চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীরা ভীতির মধ্যে রয়েছে। আমরা দাবি জানিয়েছি, মামলা প্রত্যাহার করার। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, দায়ের করা ৪টি মামলার মধ্যে তিনটি করেছে পুলিশ। অপরটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পুলিশ জানায়, বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। তবে এখন পর্যন্ত কারা জড়িত সে সর্ম্পকে কোনো তথ্য দেয়নি তারা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে পুলিশ ক্যাম্পাসেও তদন্ত শুরু করবে বলে জানা গেছে। এদিকে ভিসির বাসায় হামলার ঘটনার তদন্ত এগুচ্ছে ধীরগতিতে। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। নিজেরাও কয়েকটি সভা করেছি। কাজ এগুচ্ছে। এখনই কিছু বলা যাবে না। আরেকটু সময় লাগবে। পরে আমরা বিস্তারিত জানাবো।
ভীতি ছড়াচ্ছে ছাত্রলীগ: আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এখনো হুমকি দিচ্ছে ছাত্রলীগ এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এস এম ইয়াসিন আরাফাতকে। আরাফাত ছাত্রীদের বের করে দেয়ার খবর শুনে ওই দিন রাতেই একা সুফিয়া কামাল হলের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করে। হলে ফিরলে হল সভাপতি হাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ বিষয়ে এস এম ইয়াসিন আরাফাত বলেন, আমাকে ছাত্রলীগের নেতারা আন্দোলনে যাওয়ার কারণে হুমকি দেন। হল থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। হলে থাকলে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার তারা নেবেন না বলে জানান। আমার রুমমেটকেও শাসান তারা।
শিক্ষকদের কর্মসূচি: আজ সকাল ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে মানববন্ধন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সচেতন শিক্ষকবৃন্দের ব্যানারে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত যথাযথ মনে হয়নি। আরো দূরদর্শিতার প্রয়োজন ছিল। কাউন্সেলিংয়ের দরকার হলে সেটা হল প্রশাসন করবে। টিএসসিতে একটি কাউন্সেলিং সেন্টার রয়েছে। তিনি বলেন, মামলার বিষয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। প্রশাসনকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। তবে ভিসির বাসায় হামলার বিষয়ে যারা জড়িত তাদের বিচার হওয়া উচিত।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। এ ধরনের সংকটের ক্ষেত্রে প্রশাসন ধারাবাহিকভাবে বা ঐতিহ্যগতভাবে যে ধরনের ভূমিকা পালন করে সেরকম ভূমিকা এখনো দেখছি না। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে এমন একটি ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন শুধু প্রশাসকই নয়, শিক্ষকও বটে। শিক্ষকসুলভ আচারণ, শিক্ষকসুলভ আলোচনা বা কথাবার্তার প্রয়োজন ছিল সেগুলোর প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে। সে ঘাটতির কারণেই শিক্ষকদের ওপর শিক্ষার্থীদের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে সুফিয়া কামাল হলে যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে প্রভোস্টের যে ভূমিকা সেটি খুবই অনভিপ্রেত এবং শিক্ষক সুলভ না। এটা অপরাজনীতি চর্চার একটি বহিঃপ্রকাশ। এ সংকটকে আরো জটিল করে তুলছে। এখানে দূরদর্শিতা এবং শিক্ষকসুলভ আচরণ খুবই প্রয়োজন। এটাই কাম্য। শিক্ষার্থীরাও এমন আচরণ প্রত্যাশা করে। তিনি আরো বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের একধরনের বোধের যে প্রকাশ সেটা শুধু কোটা সংস্কারের অবস্থান না। আমাদের আবাসিক হলগুলোতে যেরকম মিনি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি করে রাখা হয়েছে, হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের মতো। যেখানে একজন শিক্ষার্থীর ন্যূনতম পরিবেশ দরকার পড়াশোনার জন্য, তার সুস্থ জীবনযাপনের জন্য সেটা আমরা আবাসিক শিক্ষকরা নিশ্চিত করতে পারিনি। নিশ্চিত করতে পারিনি বলেই আমরা হাফিজুরের মৃত্যু দেখেছি, আবু বকরের মৃত্যু দেখেছি, আমরা এহসানকে দেখলাম একটা ক্যালকুলেটরের জন্য চোখ অন্ধ করে দিলো প্রায়। ফলে হলগুলোর অব্যবস্থাপনাও শিক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তার প্রকাশটাও কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘটেছে। আমাদের আগে থেকেই সচেতন হওয়ার কথা ছিল। হাফিজুর, এহসানদের ঘটনার পরও আমরা নির্লিপ্ত ছিলাম। বিশেষ করে হলের দায়িত্বে থাকা প্রভোস্ট বেশির ভাগ দায়িত্বহীনতার পরিচয় দেন। ব্যতিক্রমও রয়েছেন। তানজিম উদ্দিন খান বলেন, রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দূরে ঠেলে দিই এবং অবহেলা করি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নীরব ছিল না। তারা সরব ছিল একটি নির্দিষ্ট দলের প্রতি। সেটাই পরিস্থিতিকে আরো বেসামাল করে। যারা সরকারি দল করে সেটা যে সময়ই হোক না কেন তারা ক্যাম্পাসে অনেক শক্তিশালী থাকে। প্রশাসনের দায়িত্ব এই শক্তির ভারসাম্য আনা; বিশেষ করে আইনি দিক থেকে, নিয়মনীতির দিক থেকে, বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত সেভাবে পরিচালনা করে এ শক্তির ভারসাম্য এনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
গত ১৯শে এপ্রিল গভীর রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রোকেয়া হলে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে চার ছাত্রীর বিক্ষোভের মুখে পড়েন ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বের করে দেয়া ছাত্রীদের শুক্রবার বিকালে ও রাতে আবারো হলে তুলে নেয় প্রশাসন। এ বিষয়ে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা বলেন, কাউকে হল থেকে বের করা হয়নি। তাদের ওইদিন রাতে তাদের স্থানীয় অভিভাবকের কাছে দেয়া হয়েছে। যাতে তারা তাদের সন্তানদের কাউন্সেলিং করে। শুক্রবার তারা সবাই হলে ফিরেছেন। তিন ছাত্রীর দুজন হলের খেলায়ও অংশ নিয়েছেন। একজন সন্ধ্যায় হলের ছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত সাধারণসভায় বক্তৃতা করেছেন। যেখানে হলের প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাধিক ছাত্রী অংশ নিয়েছিল। তিনি বলেন, এদের তাদের পরিবার আবার বাসায় নিতে পারেন। বাসায় ও হলে আমরা তাদের কাউন্সেলিং করবো। এ ঘটনায় ছাত্রীদের মাঝে যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে সেটি এখনো কাটেনি। একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেও তারা এসব বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক ছাত্রী বলেন, প্রভোস্ট দুই হাজার ছাত্রীর ছাত্রত্ব বাতিলের হুমকি দেয়ায় আমরা ভয়ে আছি। হলে এখনো হয়রানি করা হচ্ছে বিভিন্নভাবে। সব মেয়ে আতঙ্কের মধ্যে আছে। ছাত্রী হলের এ ঘটনায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে ছাত্র হলগুলোতেও। একই সঙ্গে ভিসির ভবন ভাঙচুরসহ অন্য মামলাগুলোর কারণে শিক্ষার্থীরা ভীতির মধ্যে রয়েছেন। আন্দোলনকারীদের নেতা নুরুল হক নূর বলেন, অজ্ঞাতনামা মামলা দিয়ে প্রশাসন শিক্ষার্থীদের হয়রানির চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীরা ভীতির মধ্যে রয়েছে। আমরা দাবি জানিয়েছি, মামলা প্রত্যাহার করার। পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, দায়ের করা ৪টি মামলার মধ্যে তিনটি করেছে পুলিশ। অপরটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পুলিশ জানায়, বেশ কিছু ভিডিও ফুটেজ দেখে আসামিদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। তবে এখন পর্যন্ত কারা জড়িত সে সর্ম্পকে কোনো তথ্য দেয়নি তারা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে পুলিশ ক্যাম্পাসেও তদন্ত শুরু করবে বলে জানা গেছে। এদিকে ভিসির বাসায় হামলার ঘটনার তদন্ত এগুচ্ছে ধীরগতিতে। এ বিষয়ে কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, আমরা কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। নিজেরাও কয়েকটি সভা করেছি। কাজ এগুচ্ছে। এখনই কিছু বলা যাবে না। আরেকটু সময় লাগবে। পরে আমরা বিস্তারিত জানাবো।
ভীতি ছড়াচ্ছে ছাত্রলীগ: আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের এখনো হুমকি দিচ্ছে ছাত্রলীগ এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এস এম ইয়াসিন আরাফাতকে। আরাফাত ছাত্রীদের বের করে দেয়ার খবর শুনে ওই দিন রাতেই একা সুফিয়া কামাল হলের সামনে গিয়ে প্রতিবাদ করে। হলে ফিরলে হল সভাপতি হাফিজুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে তাকে হল থেকে বের করে দেয়া হয়। এ বিষয়ে এস এম ইয়াসিন আরাফাত বলেন, আমাকে ছাত্রলীগের নেতারা আন্দোলনে যাওয়ার কারণে হুমকি দেন। হল থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। হলে থাকলে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার তারা নেবেন না বলে জানান। আমার রুমমেটকেও শাসান তারা।
শিক্ষকদের কর্মসূচি: আজ সকাল ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে মানববন্ধন করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সচেতন শিক্ষকবৃন্দের ব্যানারে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
No comments