এতিম ঢাকা নগরের অভিভাবক চাই by এ কে এম জাকারিয়া

অভিভাবকহীন এক এতিম নগরের নাম ঢাকা
ছয় বছর ধরে ঢাকা বিশ্বের বসবাসের সবচেয়ে অনুপযুক্ত শহরগুলোর একটি। বসবাসের জন্য দুনিয়ার কোন শহর কতটা উপযুক্ত, তার একটি তালিকা বছর বছর প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। ২০০৯ সালে সেই তালিকায় ১৪০টি দেশের মধ্যে ঢাকার স্থান ছিল ১৩৯তম। ২০১২ সালে ঢাকা বসবাসের জন্য সবচেয়ে নিকৃষ্ট শহর হিসেবে বিবেচিত হয়। মানে ১৪০টি দেশের মধ্যে ১৪০ নম্বর। এক বছরের মধ্যে ঢাকার বাসযোগ্যতায় কোনো পরিবর্তন না হলেও ২০১৩ সালে ঢাকা আবার এক ধাপ এগিয়ে যায়। যুদ্ধের কারণে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের অবস্থা এত শোচনীয় হয়ে পড়ে যে ঢাকাকে ওপরে জায়গা না দিয়ে আর কোনো উপায় ছিল না। এখনো সেই ১৩৯ নম্বরেই স্থির আছে ঢাকা শহর। দামেস্কে যুদ্ধ যে এখনো থামেনি!
মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ ভালো করছে, আমরা গর্ব করি। আবার অনেক সূচকেই বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। দুর্নীতির সূচকে একসময় এক নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। এখন নিচের দিক থেকে ১৪ নম্বরে। এটা বাংলাদেশে দুর্নীতি কমেছে বলে নয়, অন্য দেশগুলোতে দুর্নীতি বেড়েছে বলে বাংলাদেশ এগিয়েছে। গণতন্ত্র, মানবাধিকার বা আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। এ ধরনের রিপোর্টগুলো যখন বের হয়, তখন যেগুলোতে বাংলাদেশ ভালো করছে তার কৃতিত্ব নেয় সরকার। আর যেগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ, সেই রিপোর্টগুলো হয় প্রত্যাখ্যান করা হয় অথবা প্রশ্ন তোলা হয় এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে। কিন্তু এই যে বছর বছর আমাদের প্রিয় ঢাকা নিকৃষ্ট শহরের খেতাব পেয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে সরকার বা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি। বোঝা যায় ঢাকা আসলে কারও না, ঢাকার দায়দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই। অভিভাবকহীন এক এতিম নগরের নাম ঢাকা।
আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি, তারা টের পাচ্ছি কীভাবে দিনে দিনে ঢাকা এক অচল শহরে পরিণত হচ্ছে। এই শহরটি নিয়ে কেউ কোনো আশার কথা শোনাতে পারছেন না। প্রথম আলোর এক প্রতিবেদন (১২ জুলাই) বলছে, রাজধানী ঢাকার যানচলাচল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ট্রাফিক পুলিশ থেকে নগর বিশেষজ্ঞ—সবাই তা স্বীকার করে নিয়েছেন। এখন যেভাবে চলছে, সেভাবে পরিস্থিতির উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই। ঢাকার দুই মেয়র যানজট দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করলেও এই সমস্যা সমাধানে তাঁদের কিছু করার নেই বলেই জানিয়ে দিয়েছেন। বলা যায়, এটা তাঁদের অসহায় আত্মসমর্পণ। পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোহান্মদ সামছুল হকের ভাষায়, ঢাকা এক মৃত নগরে পরিণত হতে চলেছে। ঢাকাবাসীর এই হাহাকার কে শুনবে? মুমূর্ষু দশা থেকে কে বাঁচাবে ঢাকা নগরকে?
এটা পরিষ্কার যে ঢাকার মূল সমস্যা এখন এসে ঠেকেছে অভিভাবকহীনতার সমস্যায়। বর্তমানে নগরে সেবা দেওয়ার বিভিন্ন সংস্থা ও নানা মন্ত্রণালয়ের খবরদারি, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা দুই মেয়রের যে কাঠামো কার্যকর রয়েছে, তা দিয়ে ঢাকার মতো শহরকে আর চালানো যাবে না। ঢাকার ওপর বিভিন্ন সময়ে অনেক সমীক্ষা হয়েছে। সব সমীক্ষাতেই ঢাকার ব্যবস্থাপনায় নানা কর্তৃপক্ষের ভূমিকা, সমন্বয়হীনতা এবং একই কাজে নানা প্রতিষ্ঠানের যুক্ততার সমস্যার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো সমস্যা বা ব্যর্থতার দায় কেউ নিতে চায় না। পারস্পরিক দোষারোপেই সব সমস্যা চাপা পড়ে যায়। ঢাকার জন্য ২০ বছর মেয়াদি যে স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (২০০৪-২০২৪) করা হয়েছে, সেখানে যে ৭১টি কৌশল ঠিক করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নের জন্য একটি ‘একক কর্তৃপক্ষের’ কথা বলা হয়েছে।
অথচ ঢাকাকে ‘আরও ভালোভাবে’ পরিচালনার দোহাই দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ—এ দুই ভাগে বিভক্ত ঢাকা এখন দুজন মেয়র পেয়েছে। বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় না নিয়ে একেবারে রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ করে ঢাকাকে ভাগ করা উল্টো পথে হাঁটারই শামিল। ঢাকার এই বিভক্তি ‘একক কর্তৃপক্ষ’ ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। শহর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভক্তি পরিস্থিতিকে জটিল করে। আধুনিক শহর ব্যবস্থাপনায় বরং সবকিছু এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার নীতি নেওয়া হয়। আর আমরা এমন ব্যবস্থা বেছে নিয়েছি, যাতে গাজীপুর থেকে যে রাস্তা বা গণপরিবহনব্যবস্থা সদরঘাট পর্যন্ত চলবে, সেটিও চলবে দুটি কর্তৃপক্ষের অধীনে। দুই ঢাকার একক পয়োনিষ্কাশন-ব্যবস্থার আবর্জনা পরিষ্কার করবে দুটি সিটি করপোরেশন!
ঢাকায় নানা ‘উন্নয়ন’ কার্যক্রম চলছে এবং প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। ফ্লাইওভার, বাস, র্যা পিড ট্রানজিট, মেট্রোরেল বা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে—কয়েকটির কাজ চলছে, কিছু শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। এসব কোনো কিছুই ঢাকা শহরের যানজট পরিস্থিতি সহনীয় করার ভরসা দিতে পারছে না। ঢাকার চারপাশের ওয়াটারওয়ে নানা উদ্যোগ নিয়েও কার্যকর করা যায়নি। কারণ, এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা রয়েছে। এমনকি একটি অন্যটির সঙ্গে সাংঘর্ষিকও। একটি একক কর্তৃপক্ষের অধীনে সামগ্রিক ও সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কোনো প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, কোনোটি রাজউক বা সিটি করপোরেশন, কোনোটির পরিকল্পনা করছে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়, আবার কোনোটি পরিচালনা করছে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়। যে যার যার মতো কাজ করছে, সমস্যার দায়দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই।
আমরা যারা ঢাকায় বসবাস করি, তারা টের পাচ্ছি কীভাবে দিনে দিনে ঢাকা এক অচল শহরে পরিণত হচ্ছে। এই শহরটি নিয়ে কেউ কোনো আশার কথা শোনাতে পারছেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা শহরে পিক আওয়ারে যানবাহনের যে চাপ, তাতে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা কাজ করার কথা নয়। এসব কোনো কিছুই বিবেচনায় না নিয়ে ঢাকায় আবার নতুন করে ট্রাফিক সিগন্যাল-ব্যবস্থা বসানো হয়েছে। এ ধরনের সিগন্যাল-ব্যবস্থার কোনো সুফল যদি ঢাকা না পায়, তবে কেন এই অর্থের অপচয়? দেখা যাচ্ছে, নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে, খরচও ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু তা কাজে দিচ্ছে না যথাযথ সমন্বিত পরিকল্পনা এবং একটি একক বাস্তবায়ন ও পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের অভাবে। মনে পড়ে, নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বছর দু-এক আগে এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘দেশ পরিচালনার জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী আছেন, তিনি সবকিছুর সমন্বয় করেন। ঢাকা আমাদের রাজধানী ও অন্যতম জনবহুল একটি শহর। এটি পরিচালনার জন্যও একজন নেতা দরকার, যাঁর ক্ষমতা থাকবে, যিনি সব কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করবেন এবং একটি শহর পরিচালনার যোগ্যতা ও ভিশন থাকবে।’ তিনি ঢাকার জন্য একজন যোগ্য নেতার নেতৃত্বে এ ধরনের ‘সুপার অথোরিটি’ দেখতে চান।
বিশ্বের উন্নত ও আধুনিক নগরগুলোর পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার কাঠামো বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে যে বর্তমানে সবচেয়ে পরীক্ষিত ও কার্যকর কাঠামো হচ্ছে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একক ও নির্বাচিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা। এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার অভাবকেই বর্তমানে ঢাকার সবচেয়ে বড় সংকট বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক মোহাম্মদ সামছুল হক। এ ধরনের কোনো ব্যবস্থায় যাওয়া ছাড়া ঢাকাকে সচল ও বাসযোগ্য রাখা যাবে না। তিনি মনে করেন, অবকাঠামো উন্নয়নের কাজে নেমে পড়ার আগে নগর উন্নয়ন ও কার্যকর যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে ভূমির ব্যবহার, সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
প্রথমে পরিকল্পনা প্রণয়ন, পরে বাস্তবায়ন। এটা একটা বড় কর্মযজ্ঞ এবং তা শুরু করতে হবে একটি একক কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নগর পরিকল্পনা, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে যা বের হয়ে এসেছে তা হচ্ছে একটি শক্তিশালী নগর কর্তৃপক্ষ। প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় বিশ্বের বড় শহরগুলো এ ধরনের কর্তৃপক্ষের দিকে গেছে। ঢাকারও এখন এমন একটি কর্তৃপক্ষ বা অভিভাবক দরকার, যে কর্তৃপক্ষ এই শহরটি নিয়ে পরিকল্পনা করবে; এর ভূমির ব্যবহার, অবকাঠামো উন্নয়ন ও বাস্তবায়নের কাজ করবে; বহুমাত্রিক গণপরিবহনব্যবস্থা কার্যকর ও পরিচালনা করবে; নগর ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করবে; সব ধরনের পরিষেবা নিশ্চিত করবে।
ইআইইউ বছর বছর বিশ্বের বিভিন্ন শহরের বাসযোগ্যতার যে তালিকা তৈরি করে, তা মূলত করা হয় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য। কোনো শহরে কোনো কর্মী নিয়োগ দিতে হলে তাঁকে কী পরিমাণ হার্ডশিপ ভাতা (কষ্টকর বা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করার জন্য অতিরিক্ত ভাতা) দিতে হবে, তা নির্ধারণ করা হয় এই রিপোর্ট ধরে। বিনিয়োগকারীরাও কোনো দেশে বিনিয়োগ করার আগে সেখানকার শহরগুলোর বাসযোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় নেন এই রিপোর্টের ভিত্তিতে। বিশ্বে বসবাসের সবচেয়ে অনুপযোগী একটি শহর যে দেশের রাজধানী, সেই দেশ বিনিয়োগ আকর্ষণের আশা করবে কীভাবে? দিনে দিনে অচল হয়ে পড়া ঢাকা নগরকে নিয়ে সরকারগুলোর নির্বিকার অবস্থান সত্যিই বিস্ময়কর।
ঢাকাকে ঠিকভাবে চালাতে ও সচল রাখতে একক ক্ষমতার অভিভাবক লাগবে। নগর সরকার, মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট বা অন্য যে নামেই হোক, লাগবে একটি একক কর্তৃপক্ষ। নানা সমস্যা ও বাস্তব পরিস্থিতি মোকাবিলা করে বিশ্বের আধুনিক শহরগুলো নগর ব্যবস্থাপনার যেসব কাঠামো গ্রহণ করেছে, সেগুলো পরীক্ষিত। ঢাকার জন্য এ ধরনের একটি মডেল নিতে আমরা যত অপেক্ষা করব, শহরটি ততই বাসযোগ্যহীন হয়ে পড়ার দিকে এগোবে।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.