নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী by মোয়াজ্জেম হোসেন নান্নু
এক হাতে জুতা অন্য হাতে ইটা, দেখতে মন্দ লাগছে না। ছাত্রলীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাকেও হামলায় অংশ নিতে দেখা গেছে |
বিএনপি
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ৩ ঘণ্টা আগে কারওয়ান বাজার ওয়াসা
ভবনের পেছনে জড়ো হয়েছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও
স্বেচ্ছাসেবক লীগের ৩০ থেকে ৪০ নেতাকর্মী। সোমবার বিকালে খালেদা জিয়া
নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে ওই এলাকায় আসবেন- এমন খবর পাওয়ার পরপরই সকাল
থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন তারা। প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খালেদা
জিয়াকে শান্তিপূর্ণভাবে কালো পতাকা দেখানোর কথা ছিল। কিন্তু ঘটনার
একপর্যায়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে লাঠিসোটা নিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে
ঝাঁপিয়ে পড়েন তারা। এ ঘটনার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য
আল আমিন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জাকিরসহ রাজু, তুহিন,
মাহমুদ, রাহিম রাহমান ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের খোকন।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ করে এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় তেজগাঁও থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার বিএনপির পক্ষ থেকে চেয়ারপারসনের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর এবং সোমবার রাতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জহিরুল হক জিল্লু মামলাটি করেন। তবে সোমবার রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে মামলা করার জন্য তেজগাঁও থানায় যান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। দুটি মামলায় আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনার জন্য তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী সিএসএফের বাড়াবাড়িকে দায়ী করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, তাদের বাড়াবাড়ির কারণেই কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, এরই মধ্যে এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় সিএসএফের বাড়াবাড়ির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনতা তাদের কালো পতাকা দেখালে সিএসএফ জনগণের ওপরে হামলা চালায় এবং একজনকে টেনে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। তখন উত্তেজিত জনতা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত নন দাবি করলেও এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় ২৬নং ওয়ার্ডের এক আওয়ামী লীগ নেতা আহত হয়েছেন। তিনি মামলাও করেছেন। এর আগে সকালে রাজধানীর সদরঘাটে সুন্দরবন-১১ লঞ্চ উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে ঘটনাটি শতভাগ সত্যি নয়। ৯২ দিন অবরোধ-হরতালে ওই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির ছিল। তাই খালেদা জিয়া ওই এলাকায় গেলে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের তাড়া করে। এ সময় তার নিরাপত্তা কর্মীরা জনতার ওপর চড়াও হলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে বিশৃঙ্খলা ঘটে।’ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেছি। মামলার আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করবেন। পাশাপাশি আমাদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ এবং পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি থেকে হামলাকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তাকে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
বিএনপির মামলা : মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া এবং তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ মামলার কপি তেজগাঁও থানায় জমা দেন। পরে পুলিশ মামলাটি রেকর্ড করে। মামলা নং ৪০। এতে অজ্ঞাতনামা শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় বলা হয়েছে, আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ঢাকা সিটি (উত্তর) মেয়র প্রার্থী তাবিথ আওয়ালের পক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। প্রচারের অংশ হিসেবে সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কারওয়ান বাজার বাপেক্স ভবনের সামনে পথসভায় অংশ নেন। এ সময় তার চারপাশে চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনী সিএসএফ সদস্যসহ দলীয় সমর্থক ও বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ ছিলেন। এ সময় ‘শাসক দল সমর্থিত সন্ত্রাসীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে এবং তার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীদের হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়।’ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র, লাঠি ও লোহার রড দিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়ির পেছন দিক দিয়ে ভাংচুর শুরু করা হয়। এ সময় চেয়ারপারসনের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়। খালেদা জিয়ার গাড়িটি বুলেটপ্রুফ হওয়ায় তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তবে ওই গাড়িতে থাকা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিনা রহমান আহত হন। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যসহ কমপক্ষে সাতজন আহত হন। সন্ত্রাসীরা ভাংচুর চালায় বেশ কয়েকটি গাড়িতে।
আওয়ামী লীগের মামলা : নির্বাচনী প্রচার চালানোকালীন কারওয়ান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় স্থানীয় ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জহিরুল হক জিল্লু সোমবার রাতে বিএনপির অজ্ঞাতনামা ১০০ নেতাকর্মীকে আসামি করে তেজগাঁও থানায় মামলাটি করেন। মামলা নম্বর ৩৯।
মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সির প্রার্থী শামীম হাসানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর লক্ষ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন নিয়ে কারওয়ানবাজার এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন। বিকালে বাপেক্স ভবনের সামনে প্রচার চালানোর সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহর সেখানে এসে থামে। সেখানে পথসভার নামে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তিনি সবাইকে শান্ত করে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এবং ছাত্র ও যুবদলের কিছু নেতাকর্মী তাদের ওপর হামলা করে। এতে তিনিসহ ৫ জন নেতাকর্মী আহত হন। এ সময় সিএসএফ সদস্যরা তাদের নেতাকর্মীদের হত্যার উদ্দেশে ছয় রাউন্ড গুলি ছুড়ে।
পুলিশের বক্তব্য : তেজগাঁও থানার ওসি মাজরুল ইসলাম বলেছেন, তারা দুটি অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ড করেছেন। ইতিমধ্যে মামলা দুটির তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা কী, তা জানার পাশাপাশি ছবি দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি ও টেলিভিশনের ফুটেজ দেখে ইতিমধ্যে কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
ওসি জানান, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সোমবার ওই এলাকায় পথসভা করবেন, এমন কোনো তথ্য তাদের জানা ছিল না। আগে থেকে পুলিশকে এ ধরনের কোনো তথ্যও দেয়া হয়নি। এ কারণে ওই এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি পর্যাপ্ত ছিল না। তবে খবর পেয়েই দায়িত্বরত একটি টহল টিম ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
যারা জড়িত : ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ করে এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে ওই হামলার ঘটনায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের নাম ও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের মধ্যে মূল ভূমিকায় ছিলেন তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের কার্যকরী সদস্য ও এক নম্বর ইউনিটের সহ-সভাপতি আল আমিন, ২৬ ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জাকির, স্থানীয় বাউলবাগ ইউনিট ছাত্রলীগের সভাপতি রনি খন্দকার, ছাত্রলীগ নেতা তুহিন মাহমুদ, রাহিম রহমান, রাজু ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা খোকন। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার সময় আল আমিন ও জাকিরকে সামনের কাতারে দেখা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতা আল আমিন মঙ্গলবার দুপুরে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় জড়িতদের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’ জড়িত না থাকলে কিভাবে ছবি এলো, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। কিছুক্ষণ পর নিজেই ফোন করে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি সেদিন কারওয়ানবাজারে বাজার করতে গিয়েছিলাম। ওই সময় ওইখানে গণ্ডগোল হলে একটা ইটের টুকরা এসে পড়ে। এতে আমি হাতে ব্যথা পাই।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জনান, তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই বলেন, তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত আছেন। তেজগাঁও কলেজে অনার্সে পড়ছেন বলেও তিনি দাবি করেন।
এ ঘটনায় জড়িত অপর একজন ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জাকির। যুগান্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি ছাত্রলীগ করেন বলে স্বীকার করেন। হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবা অসুস্থ। তাকে নিয়ে ব্যস্ত আছি, পরে কথা হবে।’ একথা বলেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
প্রসঙ্গত, সোমবার বিকালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় খালেদা জিয়ার ওপর হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারা। এ সময় খালেদা জিয়ার বেশ কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী আহত হন। আওয়ামী লীগ কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করছে বিএনপি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বলছে, ঘটনার সময় ওই এলাকায় তারাও তাদের মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী শামীম হাসানের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য এবং যুব ও ছাত্রদলের কর্মীরা প্রথম তাদের ওপর হামলা চালায়।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ করে এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে জানা গেছে উল্লিখিত সব তথ্য। এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় তেজগাঁও থানায় পাল্টাপাল্টি মামলা হয়েছে। মঙ্গলবার বিএনপির পক্ষ থেকে চেয়ারপারসনের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রধান সমন্বয়কারী মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর এবং সোমবার রাতে আওয়ামী লীগের পক্ষে ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জহিরুল হক জিল্লু মামলাটি করেন। তবে সোমবার রাতে বিএনপির পক্ষ থেকে মামলা করার জন্য তেজগাঁও থানায় যান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু পুলিশ মামলা নেয়নি বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। দুটি মামলায় আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনার জন্য তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী সিএসএফের বাড়াবাড়িকে দায়ী করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, তাদের বাড়াবাড়ির কারণেই কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, এরই মধ্যে এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় সিএসএফের বাড়াবাড়ির বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনতা তাদের কালো পতাকা দেখালে সিএসএফ জনগণের ওপরে হামলা চালায় এবং একজনকে টেনে গাড়িতে তোলার চেষ্টা করে। তখন উত্তেজিত জনতা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে।
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলায় আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত নন দাবি করলেও এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, এ ঘটনায় ২৬নং ওয়ার্ডের এক আওয়ামী লীগ নেতা আহত হয়েছেন। তিনি মামলাও করেছেন। এর আগে সকালে রাজধানীর সদরঘাটে সুন্দরবন-১১ লঞ্চ উদ্বোধনকালে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলা হয়েছে ঘটনাটি শতভাগ সত্যি নয়। ৯২ দিন অবরোধ-হরতালে ওই এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির ছিল। তাই খালেদা জিয়া ওই এলাকায় গেলে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের তাড়া করে। এ সময় তার নিরাপত্তা কর্মীরা জনতার ওপর চড়াও হলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়ে বিশৃঙ্খলা ঘটে।’ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপির গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকজনকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করেছি। মামলার আইও (তদন্তকারী কর্মকর্তা) ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করবেন। পাশাপাশি আমাদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ এবং পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি থেকে হামলাকারীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে। এ ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তাকে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।’
বিএনপির মামলা : মঙ্গলবার বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন ও খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া এবং তাহেরুল ইসলাম তৌহিদ মামলার কপি তেজগাঁও থানায় জমা দেন। পরে পুলিশ মামলাটি রেকর্ড করে। মামলা নং ৪০। এতে অজ্ঞাতনামা শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
মামলায় বলা হয়েছে, আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ঢাকা সিটি (উত্তর) মেয়র প্রার্থী তাবিথ আওয়ালের পক্ষে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রচারে অংশ নিচ্ছেন। প্রচারের অংশ হিসেবে সোমবার বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে কারওয়ান বাজার বাপেক্স ভবনের সামনে পথসভায় অংশ নেন। এ সময় তার চারপাশে চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনী সিএসএফ সদস্যসহ দলীয় সমর্থক ও বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ ছিলেন। এ সময় ‘শাসক দল সমর্থিত সন্ত্রাসীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে এবং তার সঙ্গে থাকা নেতাকর্মীদের হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়।’ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র, লাঠি ও লোহার রড দিয়ে খালেদা জিয়ার গাড়ির পেছন দিক দিয়ে ভাংচুর শুরু করা হয়। এ সময় চেয়ারপারসনের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়। খালেদা জিয়ার গাড়িটি বুলেটপ্রুফ হওয়ায় তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। তবে ওই গাড়িতে থাকা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিনা রহমান আহত হন। এছাড়া সন্ত্রাসীদের হামলায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত সদস্যসহ কমপক্ষে সাতজন আহত হন। সন্ত্রাসীরা ভাংচুর চালায় বেশ কয়েকটি গাড়িতে।
আওয়ামী লীগের মামলা : নির্বাচনী প্রচার চালানোকালীন কারওয়ান বাজারে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় স্থানীয় ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি জহিরুল হক জিল্লু সোমবার রাতে বিএনপির অজ্ঞাতনামা ১০০ নেতাকর্মীকে আসামি করে তেজগাঁও থানায় মামলাটি করেন। মামলা নম্বর ৩৯।
মামলায় তিনি উল্লেখ করেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সির প্রার্থী শামীম হাসানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর লক্ষ্যে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন নিয়ে কারওয়ানবাজার এলাকায় নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছিলেন। বিকালে বাপেক্স ভবনের সামনে প্রচার চালানোর সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার গাড়িবহর সেখানে এসে থামে। সেখানে পথসভার নামে আওয়ামী লীগকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করায় দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে তিনি সবাইকে শান্ত করে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা বাহিনীর কিছু সদস্য এবং ছাত্র ও যুবদলের কিছু নেতাকর্মী তাদের ওপর হামলা করে। এতে তিনিসহ ৫ জন নেতাকর্মী আহত হন। এ সময় সিএসএফ সদস্যরা তাদের নেতাকর্মীদের হত্যার উদ্দেশে ছয় রাউন্ড গুলি ছুড়ে।
পুলিশের বক্তব্য : তেজগাঁও থানার ওসি মাজরুল ইসলাম বলেছেন, তারা দুটি অভিযোগ মামলা হিসেবে রেকর্ড করেছেন। ইতিমধ্যে মামলা দুটির তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা কী, তা জানার পাশাপাশি ছবি দেখে হামলাকারীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি ও টেলিভিশনের ফুটেজ দেখে ইতিমধ্যে কয়েকজনকে শনাক্ত করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
ওসি জানান, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া সোমবার ওই এলাকায় পথসভা করবেন, এমন কোনো তথ্য তাদের জানা ছিল না। আগে থেকে পুলিশকে এ ধরনের কোনো তথ্যও দেয়া হয়নি। এ কারণে ওই এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি পর্যাপ্ত ছিল না। তবে খবর পেয়েই দায়িত্বরত একটি টহল টিম ঘটনাস্থলে ছুটে গিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করেছে বলে দাবি করেন তিনি।
যারা জড়িত : ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র বিশ্লেষণ করে এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা থেকে ওই হামলার ঘটনায় যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশের নাম ও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদের মধ্যে মূল ভূমিকায় ছিলেন তেজগাঁও থানা ছাত্রলীগের কার্যকরী সদস্য ও এক নম্বর ইউনিটের সহ-সভাপতি আল আমিন, ২৬ ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জাকির, স্থানীয় বাউলবাগ ইউনিট ছাত্রলীগের সভাপতি রনি খন্দকার, ছাত্রলীগ নেতা তুহিন মাহমুদ, রাহিম রহমান, রাজু ও স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা খোকন। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার সময় আল আমিন ও জাকিরকে সামনের কাতারে দেখা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগ নেতা আল আমিন মঙ্গলবার দুপুরে টেলিফোনে যুগান্তরকে বলেন, ‘ওই ঘটনায় জড়িতদের সঙ্গে আমি জড়িত নই।’ জড়িত না থাকলে কিভাবে ছবি এলো, এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। কিছুক্ষণ পর নিজেই ফোন করে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি সেদিন কারওয়ানবাজারে বাজার করতে গিয়েছিলাম। ওই সময় ওইখানে গণ্ডগোল হলে একটা ইটের টুকরা এসে পড়ে। এতে আমি হাতে ব্যথা পাই।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জনান, তিনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। অবশ্য কিছুক্ষণ পরই বলেন, তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত আছেন। তেজগাঁও কলেজে অনার্সে পড়ছেন বলেও তিনি দাবি করেন।
এ ঘটনায় জড়িত অপর একজন ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জাকির। যুগান্তরের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে তিনি ছাত্রলীগ করেন বলে স্বীকার করেন। হামলার ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাবা অসুস্থ। তাকে নিয়ে ব্যস্ত আছি, পরে কথা হবে।’ একথা বলেই তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন।
প্রসঙ্গত, সোমবার বিকালে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের পক্ষে প্রচার চালানোর সময় খালেদা জিয়ার ওপর হামলা চালায় ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের নেতারা। এ সময় খালেদা জিয়ার বেশ কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী আহত হন। আওয়ামী লীগ কর্মীরা এ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ করছে বিএনপি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগ বলছে, ঘটনার সময় ওই এলাকায় তারাও তাদের মেয়র প্রার্থী আনিসুল হক ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী শামীম হাসানের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের নিরাপত্তা সংস্থার সদস্য এবং যুব ও ছাত্রদলের কর্মীরা প্রথম তাদের ওপর হামলা চালায়।
No comments