ট্রানজিট নিয়ে তাড়াহুড়ো কেন? by আসজাদুল কিবরিয়া
প্রতিবেশী ভারতকে ট্রানজিট-সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের ভেতরে বেশ তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। তাঁরা ট্রানজিট দেওয়ার বিভিন্ন সুফলের কথা তুলে ধরছেন। বোঝাতে চাইছেন, ইতিমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও অপেক্ষার পালা শেষ হয়নি। এতে করে বাংলাদেশই পিছিয়ে গেছে। কাজেই এখন এই অপেক্ষার পালা শেষ করতে হবে এবং তা খুব দ্রুত।
তবে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতার আলোকে কতটা গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত তা বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই একটা বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার, ভারতকে কিংবা নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট-সুবিধা দেওয়ায় নীতিগতভাবে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা জোরদার হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির মধ্যে যোগাযোগ বিস্তৃত হওয়ার পথ তৈরি হবে। শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বা ভারতবিরোধিতার নামে ট্রানজিটের তথা আঞ্চলিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এ ধরনের বিরোধিতা দীর্ঘ মেয়াদে লোকসান ছাড়া লাভ বয়ে আনবে না।
প্রশ্ন হলো, নীতিগতভাবে সম্মত হলেই কি সব কাজ শেষ হয়ে যায়? নিশ্চয়ই নয়। বরং নীতিগতভাবে সম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে কাজটি শুরু হলো। এরপর অনেক ধাপ পার করতে হয়। বাংলাদেশ এখনো সেই সব ধাপ পার করা তো দূরে থাক, ঠিকমতো সেই ধাপে পা-ই রাখেনি। আর এখন দেশে ট্রানজিট নিয়ে সরকার যেসব কাজ করছে, তাতে মনে হচ্ছে, ধাপে ধাপে পা রাখার বদলে দ্রুত লাফ দিয়ে ধাপগুলো পার হওয়াটাই বেশি কাঙ্ক্ষিত।
সামান্য পেছনে যাওয়া যাক। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। এই সফরে নয়াদিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে যে যৌথ ঘোষণা গৃহীত হয়, তাতে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিতে এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে সম্মতি প্রকাশ করে। ভারতও নেপাল ও ভুটানকে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশে আসতে দিতে বা বাংলাদেশের জন্য ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়। অর্থাৎ, প্রথমে দ্বিপক্ষীয় এবং পরে একটি উপ-আঞ্চলিক কাঠামোয় ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সম্মত হয়েছে।
কিন্তু এরপর প্রায় ১০ মাস সময় নষ্ট করা হয়েছে ট্রানজিট নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কোনো কাজ না করে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা কেন এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বহীনভাবে চলতে দিয়েছেন, সেটাই বিস্ময়কর। বরং এই সময়কালের মধ্যে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে ট্রানজিট নিয়ে কাজ করতে গিয়েছে। তাতে প্রতীয়মান হয়েছে, সরকার ট্রানজিট নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আওতায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকার একটি কোর কমিটি গঠন করে। কোর কমিটি স্বল্পতম সময়ে বেশ পরিশ্রম করেই ট্রানজিটের বিষয়ে একটি অবস্থানপত্রের খসড়া দাঁড় করায়। এই খসড়ায় অবকাঠামোগত অপ্রতুলতায় আগামী তিন বছরের মধ্যে রেল ও সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়া সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিকল্প হিসেবে এই সময়কালে ট্রানশিপমেন্ট চালু করা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। অবশ্য নৌপথে ট্রানজিট-সুবিধা চালু রয়েছে।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, ভারতকে মূল ভূখণ্ড থেকে পণ্যসামগ্রী উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াটা হলো মূলত করিডর-সুবিধা দেওয়া। একটু বৃহত্তরভাবে এটাকে ‘ভারত থেকে ভারতে ট্রানজিট’ বলা যেতে পারে। তবে ভারত যখন চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করবে, তখন এই বন্দরগুলো হবে ভারতের ট্রানজিট বন্দর। আর ব্যবহূত রেল বা সড়কপথটি হবে ট্রানজিট রুট। একইভাবে বাংলাদেশি পণ্য ভারত হয়ে নেপালে গেলে বা নেপালি পণ্য ভারত হয়ে বাংলাদেশে এলে তা হবে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ বা নেপালকে দেওয়া ট্রানজিট। ট্রানজিট ও করিডরের ক্ষেত্রে এই সুবিধা গ্রহণকারী দেশের যানবাহন সুবিধা প্রদানকারী দেশের ওপর দিয়ে চলাচলের অনুমতি পায়। অন্যদিকে ট্রানশিপমেন্ট হলো ভারতীয় পণ্যবাহী যান এক সীমান্তে সেই পণ্য নামিয়ে আবার বাংলাদেশি বাহনে তুলে দেবে। এরপর বাংলাদেশি বাহন আরেক সীমান্তে গিয়ে সেই পণ্য নামিয়ে আবার ভারতীয় বাহনে তুলে দেবে।
এখানে যৌক্তিক প্রশ্ন হলো, ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে সুবিধা প্রদানকারী দেশ কী পাবে? বা কেন এই সুবিধা দেবে? সুবিধা দেবে এ জন্যই যে, এর বিনিময়ে প্রাথমিকভাবে কিছু আর্থিক প্রাপ্তিযোগ ঘটবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিময়তা বাড়বে পরিবহনসহ নানামুখী ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটে। তবে পুরো বিষয়টিই অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এই সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সবার আগে ঠিক করা প্রয়োজন, ট্রানজিটের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতি কী হবে। এ ছাড়া বিষয়টি অনেক বিস্তৃত এবং এর প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। তাই পর্যাপ্ত আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষি ছাড়া এ-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করা বা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। দুই দেশের মধ্যে কোনো বাণিজ্য চুক্তিই দরকষাকষি ছাড়া সম্পন্ন হয় না। এই দরকষাকষির আগে স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের যথেষ্ট প্রস্তুত করতে হয়। আর এই প্রস্তুতি দু-চার দিনে ও বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া যায় না।
ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার যে প্রক্রিয়াটি এখন অনুসৃত হচ্ছে, তাতে দরকষাকষির প্রস্তুতিতে ঘাটতি প্রতীয়মান হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন পর্যন্ত ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত মৌলিক নীতি চূড়ান্ত হয়নি। অন্তত জনসম্মুখে তা প্রকাশ করা হয়নি। এত বড় একটা কাজ কীভাবে কোনো নীতি-পরিকল্পনা ছাড়া সম্পন্ন করা সম্ভব? ট্যারিফ কমিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, সেটি মূলত এক ধরনের অবস্থানপত্র, যা থেকে কিছু দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তবে সেটা অনুসরণ করা না-করা সরকারের এখতিয়ার। সুতরাং, ট্রানজিট-বিষয়ক নীতি আগে চূড়ান্ত ও স্পষ্ট হওয়া দরকার।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আলোচনার তথা দরকষাকষির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ও যৌথ ঘোষণার পর দুই দেশের মধ্যে একটি রূপরেখা বা কর্মকাঠামো চুক্তি করার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করা সহজ হতো। সাধারণত ব্যাপক কোনো বিষয়ে দুই দেশ যখন বড় ধরনের চুক্তি করার কথা ভাবে, তখন শুরু হিসেবে এই রূপরেখা চুক্তি করা হয়। ট্রানজিট-বিষয়ক রূপরেখা চুক্তিতে মূলত আলোচনার বৃহত্তর পরিসীমা নির্ণয় করা যেত। যেমন: ট্রানজিটের জন্য মাশুল দিতে হবে। তবে কী হারে এবং কীভাবে মাশুল আরোপ ও আদায় হবে, তার বিস্তারিত ঠিক হতো পরের ধাপে। আর এই রূপরেখা চুক্তির আলোকে কয়েক দফা আলোচনায় বসার মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের আগ্রহ, স্বার্থ ও প্রয়োজনের দিকগুলো স্পষ্ট হতো, সমস্যা চিহ্নিত করা সহজ হতো। যেমন: কোর কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের ফলে বছরে এক কোটি ৭৪ লাখ মেট্রিক টন পণ্যের যান চলাচল করবে। এটি সম্ভাব্য কিছু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করতে হয়েছে। সংগত কারণেই এসব অনুমান পুরোপুরি বাস্তবায়িত না-ও হতে পারে। সে জন্য দরকার যতটা সম্ভব বাস্তবানুগ অনুমান করে প্রাক্কলন করা। যদি রূপরেখার চুক্তির আলোকে আলোচনা অগ্রসর হতো, তাহলে সেই আলোচনা থেকে বেশ কিছু রসদ পাওয়া যেত, যা অনুমিতি নির্ধারণে অধিক সহায়ক হতো। সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয় করাও খানিকটা সহজ হতো। সর্বোপরি ট্রানজিট নিয়ে সরকার কীভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে বড় ধরনের স্বচ্ছতা আসত। এমনকি জাতীয় সংসদেও রূপরেখা চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হতে পারত।
দেখা যাচ্ছে, ট্রানজিট দেওয়ার নীতিগত সম্মতির পর প্রয়োজনীয় ধাপগুলো পূরণ না করে আমরা লাফ দিতে যাচ্ছি। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হলো ভারতের আগ্রহের দিকটি। সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়, ভারত তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবে ১৫টি সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে সাত বছর মেয়াদি একটি প্রটোকল স্বাক্ষরের অনুরোধ করেছে ভারত। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকার এই প্রস্তাব বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে যৌথ ঘোষণার ১০ মাস পর কেন ভারত তাদের প্রস্তাবটি দিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে এটা স্পষ্ট, ভারত নিজেদের প্রয়োজন ও স্বার্থ নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে তাদের প্রস্তাবটি পাঠিয়েছে। এবং এটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের ভারতের কাছ থেকে বিষয়টি শেখা দরকার।
প্রশ্ন হলো, ভারতীয় প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ কত দূর অগ্রসর হবে? যেহেতু রূপরেখা চুক্তি হয়নি, যেহেতু ট্রানজিট-নীতি চূড়ান্ত হয়নি, সেহেতু ভারতীয় প্রস্তাবের ভিত্তিতে অগ্রসর হলে অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ উপেক্ষিত হবে। আর তাই এখন প্রয়োজন অসম্পূর্ণ ধাপগুলো সম্পন্ন করা। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন ও ভারতীয় প্রস্তাব যেহেতু হাতে আছে, সেহেতু কিছু কাজ সহজ হয়ে যাবে। বিশেষ করে মৌলিক নীতি চূড়ান্তকরণ ও রূপরেখা চুক্তি সম্পন্ন করার দিকেই এখন মনোযোগ দেওয়া অধিক যুক্তিসংগত হবে; বিস্তারিত কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি নয়। ট্রানজিটের সুফল পেতে হলে ‘৪০ বছর সময়ক্ষেপণ’, ‘সংকীর্ণ মানসিকতা’ আর ‘অসভ্যতা’র দোহাই দিয়ে তাড়াহুড়ো করার কোনো যুক্তিই ধোপে টিকে না, টিকবে না।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
তবে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবতার আলোকে কতটা গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিসংগত তা বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই একটা বিষয় স্পষ্ট করে নেওয়া দরকার, ভারতকে কিংবা নেপাল ও ভুটানকে ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট-সুবিধা দেওয়ায় নীতিগতভাবে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। কেননা, এর মাধ্যমে আঞ্চলিক সম্পৃক্ততা জোরদার হবে। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতির মধ্যে যোগাযোগ বিস্তৃত হওয়ার পথ তৈরি হবে। শুধু সংকীর্ণ রাজনৈতিক বিবেচনায় বা ভারতবিরোধিতার নামে ট্রানজিটের তথা আঞ্চলিক সম্পৃক্ততার বিরোধিতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এ ধরনের বিরোধিতা দীর্ঘ মেয়াদে লোকসান ছাড়া লাভ বয়ে আনবে না।
প্রশ্ন হলো, নীতিগতভাবে সম্মত হলেই কি সব কাজ শেষ হয়ে যায়? নিশ্চয়ই নয়। বরং নীতিগতভাবে সম্মত হওয়ার মধ্য দিয়ে কাজটি শুরু হলো। এরপর অনেক ধাপ পার করতে হয়। বাংলাদেশ এখনো সেই সব ধাপ পার করা তো দূরে থাক, ঠিকমতো সেই ধাপে পা-ই রাখেনি। আর এখন দেশে ট্রানজিট নিয়ে সরকার যেসব কাজ করছে, তাতে মনে হচ্ছে, ধাপে ধাপে পা রাখার বদলে দ্রুত লাফ দিয়ে ধাপগুলো পার হওয়াটাই বেশি কাঙ্ক্ষিত।
সামান্য পেছনে যাওয়া যাক। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেন। এই সফরে নয়াদিল্লিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বৈঠকে যে যৌথ ঘোষণা গৃহীত হয়, তাতে বাংলাদেশ ভারতকে ট্রানজিট দিতে এবং চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে সম্মতি প্রকাশ করে। ভারতও নেপাল ও ভুটানকে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশে আসতে দিতে বা বাংলাদেশের জন্য ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়। অর্থাৎ, প্রথমে দ্বিপক্ষীয় এবং পরে একটি উপ-আঞ্চলিক কাঠামোয় ট্রানজিট দেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও ভারত সম্মত হয়েছে।
কিন্তু এরপর প্রায় ১০ মাস সময় নষ্ট করা হয়েছে ট্রানজিট নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে কোনো কাজ না করে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা কেন এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে গুরুত্বহীনভাবে চলতে দিয়েছেন, সেটাই বিস্ময়কর। বরং এই সময়কালের মধ্যে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থা বিচ্ছিন্নভাবে ট্রানজিট নিয়ে কাজ করতে গিয়েছে। তাতে প্রতীয়মান হয়েছে, সরকার ট্রানজিট নিয়ে একধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের আওতায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকার একটি কোর কমিটি গঠন করে। কোর কমিটি স্বল্পতম সময়ে বেশ পরিশ্রম করেই ট্রানজিটের বিষয়ে একটি অবস্থানপত্রের খসড়া দাঁড় করায়। এই খসড়ায় অবকাঠামোগত অপ্রতুলতায় আগামী তিন বছরের মধ্যে রেল ও সড়কপথে ট্রানজিট দেওয়া সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বিকল্প হিসেবে এই সময়কালে ট্রানশিপমেন্ট চালু করা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের পদক্ষেপ নিতে ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। অবশ্য নৌপথে ট্রানজিট-সুবিধা চালু রয়েছে।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, ভারতকে মূল ভূখণ্ড থেকে পণ্যসামগ্রী উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় যাওয়ার জন্য বাংলাদেশি ভূখণ্ড ব্যবহারের অনুমতি দেওয়াটা হলো মূলত করিডর-সুবিধা দেওয়া। একটু বৃহত্তরভাবে এটাকে ‘ভারত থেকে ভারতে ট্রানজিট’ বলা যেতে পারে। তবে ভারত যখন চট্টগ্রাম বা মংলা বন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করবে, তখন এই বন্দরগুলো হবে ভারতের ট্রানজিট বন্দর। আর ব্যবহূত রেল বা সড়কপথটি হবে ট্রানজিট রুট। একইভাবে বাংলাদেশি পণ্য ভারত হয়ে নেপালে গেলে বা নেপালি পণ্য ভারত হয়ে বাংলাদেশে এলে তা হবে ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ বা নেপালকে দেওয়া ট্রানজিট। ট্রানজিট ও করিডরের ক্ষেত্রে এই সুবিধা গ্রহণকারী দেশের যানবাহন সুবিধা প্রদানকারী দেশের ওপর দিয়ে চলাচলের অনুমতি পায়। অন্যদিকে ট্রানশিপমেন্ট হলো ভারতীয় পণ্যবাহী যান এক সীমান্তে সেই পণ্য নামিয়ে আবার বাংলাদেশি বাহনে তুলে দেবে। এরপর বাংলাদেশি বাহন আরেক সীমান্তে গিয়ে সেই পণ্য নামিয়ে আবার ভারতীয় বাহনে তুলে দেবে।
এখানে যৌক্তিক প্রশ্ন হলো, ট্রানজিট বা ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে সুবিধা প্রদানকারী দেশ কী পাবে? বা কেন এই সুবিধা দেবে? সুবিধা দেবে এ জন্যই যে, এর বিনিময়ে প্রাথমিকভাবে কিছু আর্থিক প্রাপ্তিযোগ ঘটবে। আর দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিময়তা বাড়বে পরিবহনসহ নানামুখী ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটে। তবে পুরো বিষয়টিই অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখতে হবে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর এই সিদ্ধান্ত নিতে গেলে সবার আগে ঠিক করা প্রয়োজন, ট্রানজিটের বিষয়ে বাংলাদেশের নীতি কী হবে। এ ছাড়া বিষয়টি অনেক বিস্তৃত এবং এর প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। তাই পর্যাপ্ত আলাপ-আলোচনা ও দরকষাকষি ছাড়া এ-সংক্রান্ত কোনো চুক্তি স্বাক্ষর করা বা কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। দুই দেশের মধ্যে কোনো বাণিজ্য চুক্তিই দরকষাকষি ছাড়া সম্পন্ন হয় না। এই দরকষাকষির আগে স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের যথেষ্ট প্রস্তুত করতে হয়। আর এই প্রস্তুতি দু-চার দিনে ও বিচ্ছিন্নভাবে নেওয়া যায় না।
ভারতকে ট্রানজিট দেওয়ার যে প্রক্রিয়াটি এখন অনুসৃত হচ্ছে, তাতে দরকষাকষির প্রস্তুতিতে ঘাটতি প্রতীয়মান হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, এখন পর্যন্ত ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট নিয়ে একটি সুনির্দিষ্ট ও সুচিন্তিত মৌলিক নীতি চূড়ান্ত হয়নি। অন্তত জনসম্মুখে তা প্রকাশ করা হয়নি। এত বড় একটা কাজ কীভাবে কোনো নীতি-পরিকল্পনা ছাড়া সম্পন্ন করা সম্ভব? ট্যারিফ কমিশন যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে, সেটি মূলত এক ধরনের অবস্থানপত্র, যা থেকে কিছু দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তবে সেটা অনুসরণ করা না-করা সরকারের এখতিয়ার। সুতরাং, ট্রানজিট-বিষয়ক নীতি আগে চূড়ান্ত ও স্পষ্ট হওয়া দরকার।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আলোচনার তথা দরকষাকষির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক ও যৌথ ঘোষণার পর দুই দেশের মধ্যে একটি রূপরেখা বা কর্মকাঠামো চুক্তি করার মধ্য দিয়ে সেই ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করা সহজ হতো। সাধারণত ব্যাপক কোনো বিষয়ে দুই দেশ যখন বড় ধরনের চুক্তি করার কথা ভাবে, তখন শুরু হিসেবে এই রূপরেখা চুক্তি করা হয়। ট্রানজিট-বিষয়ক রূপরেখা চুক্তিতে মূলত আলোচনার বৃহত্তর পরিসীমা নির্ণয় করা যেত। যেমন: ট্রানজিটের জন্য মাশুল দিতে হবে। তবে কী হারে এবং কীভাবে মাশুল আরোপ ও আদায় হবে, তার বিস্তারিত ঠিক হতো পরের ধাপে। আর এই রূপরেখা চুক্তির আলোকে কয়েক দফা আলোচনায় বসার মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের আগ্রহ, স্বার্থ ও প্রয়োজনের দিকগুলো স্পষ্ট হতো, সমস্যা চিহ্নিত করা সহজ হতো। যেমন: কোর কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রানজিটের ফলে বছরে এক কোটি ৭৪ লাখ মেট্রিক টন পণ্যের যান চলাচল করবে। এটি সম্ভাব্য কিছু অনুমানের ওপর ভিত্তি করে হিসাব করতে হয়েছে। সংগত কারণেই এসব অনুমান পুরোপুরি বাস্তবায়িত না-ও হতে পারে। সে জন্য দরকার যতটা সম্ভব বাস্তবানুগ অনুমান করে প্রাক্কলন করা। যদি রূপরেখার চুক্তির আলোকে আলোচনা অগ্রসর হতো, তাহলে সেই আলোচনা থেকে বেশ কিছু রসদ পাওয়া যেত, যা অনুমিতি নির্ধারণে অধিক সহায়ক হতো। সে ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ণয় করাও খানিকটা সহজ হতো। সর্বোপরি ট্রানজিট নিয়ে সরকার কীভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে বড় ধরনের স্বচ্ছতা আসত। এমনকি জাতীয় সংসদেও রূপরেখা চুক্তিটি নিয়ে আলোচনা হতে পারত।
দেখা যাচ্ছে, ট্রানজিট দেওয়ার নীতিগত সম্মতির পর প্রয়োজনীয় ধাপগুলো পূরণ না করে আমরা লাফ দিতে যাচ্ছি। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, সেটা হলো ভারতের আগ্রহের দিকটি। সংবাদপত্রের খবর থেকে জানা যায়, ভারত তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের অনুরোধ জানিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিয়েছে। এই প্রস্তাবে ১৫টি সড়ক ও রেলপথ ব্যবহারের কথাও বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে সাত বছর মেয়াদি একটি প্রটোকল স্বাক্ষরের অনুরোধ করেছে ভারত। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ভারত সরকার এই প্রস্তাব বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করেছে। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে যৌথ ঘোষণার ১০ মাস পর কেন ভারত তাদের প্রস্তাবটি দিল, তা স্পষ্ট নয়। তবে এটা স্পষ্ট, ভারত নিজেদের প্রয়োজন ও স্বার্থ নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করে যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে তাদের প্রস্তাবটি পাঠিয়েছে। এবং এটা খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের ভারতের কাছ থেকে বিষয়টি শেখা দরকার।
প্রশ্ন হলো, ভারতীয় প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ কত দূর অগ্রসর হবে? যেহেতু রূপরেখা চুক্তি হয়নি, যেহেতু ট্রানজিট-নীতি চূড়ান্ত হয়নি, সেহেতু ভারতীয় প্রস্তাবের ভিত্তিতে অগ্রসর হলে অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ উপেক্ষিত হবে। আর তাই এখন প্রয়োজন অসম্পূর্ণ ধাপগুলো সম্পন্ন করা। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন ও ভারতীয় প্রস্তাব যেহেতু হাতে আছে, সেহেতু কিছু কাজ সহজ হয়ে যাবে। বিশেষ করে মৌলিক নীতি চূড়ান্তকরণ ও রূপরেখা চুক্তি সম্পন্ন করার দিকেই এখন মনোযোগ দেওয়া অধিক যুক্তিসংগত হবে; বিস্তারিত কোনো চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি নয়। ট্রানজিটের সুফল পেতে হলে ‘৪০ বছর সময়ক্ষেপণ’, ‘সংকীর্ণ মানসিকতা’ আর ‘অসভ্যতা’র দোহাই দিয়ে তাড়াহুড়ো করার কোনো যুক্তিই ধোপে টিকে না, টিকবে না।
আসজাদুল কিবরিয়া: লেখক ও সাংবাদিক।
asjadulk@gmail.com
No comments