সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালী by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সারা দেশে এখন বইছে শীতের হাড়কাঁপানো হাওয়া কিন্তু একই সঙ্গে বইছে গা-কাঁপানো আরেক হাওয়া—নির্বাচনী হাওয়া। ঢাকা-চট্টগ্রামে বসে সেই হাওয়ার আঁচ পাওয়া কঠিন। কিন্তু ছোট ছোট শহরে যান, বন্দর-উপজেলায় যান, সেই হাওয়া বাঁচিয়ে হাঁটা সম্ভব হবে না। ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি ২০১১ হবে পৌরসভা নির্বাচন। ২৬৯ পৌরসভার ওই সংখ্যক মেয়র, দুই হাজার ৫৩৪ কাউন্সিলর এবং ৮৭৪ সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর নির্বাচনের জন্য প্রায় ৭৫ লাখ ৬০ হাজার ভোটার ভোটকেন্দ্রে যাবেন অথবা যাবেন বলে আশা প্রার্থীদের। আমাদের দেশে ভোটের হাওয়ার প্রতিশ্রুতির ফানুস ওড়ে, টাকা ওড়ে, আনুগত্য ও বিরোধিতার দলীয় ঝান্ডা ওড়ে। কিন্তু একই সঙ্গে ওড়ে রেষারেষি-শত্রুতা এবং প্রতিহিংসার বিষাক্ত ধোঁয়া। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রার্থী-সমর্থকের শেষ নিঃশ্বাস। আমাদের দেশে জাতীয় থেকে স্থানীয়—সব নির্বাচনেই সহিংসতা একটা অনিবার্য শর্ত। পৌর নির্বাচনেও অনেকে সহিংসতার ভয় করছেন, কোনো কোনো এলাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। ২১ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনাম: ‘প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মাঠে নামছে সন্ত্রাসীরা।’
শিরোনামটি ভয় পাওয়ার মতো, কিন্তু এটি এতই সাধারণ যে পাঠক সংবাদটি নিয়ে খুব উৎসাহ বোধ করবেন না। নির্বাচন যেহেতু, সন্ত্রাসীরা তো মাঠে নামবেই। এ আর নতুন কী। এবং সন্ত্রাসীরা যেখানে আছে প্রভাবশালীরাও সেখানে আছেন, তাদের মেলে দেওয়া ছাতাও আছে। সে ছাতার নিচে সন্ত্রাসীদের পরিবর্তে সাধারণ শান্তিকামী মানুষই যদি জোটে, তাহলে তাঁরা প্রভাবশালী কেন হলেন? তাঁদের বড়জোর জনদরদি বলা যায়। কিন্তু জনদরদি হওয়ার মধ্যে মানুষের ও প্রশাসনের সমীহ আদায়কারী বীরত্বের ভাবটি নেই। জনদরদিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বারান্দায় বসে থাকেন, থানার দারোগার সাক্ষাৎ না পেয়ে বিষণ্ন মনে ফিরে যান; প্রভাবশালীরা সেখানে হুঙ্কারে চেঁচামেচি ও আদেশ-নির্দেশে থানা অফিস কাঁপান। প্রভাবশালীদের ছায়ায় নামছে সন্ত্রাসীরা—এ সংবাদটি তাই সাধারণ পাঠককে যেমন ভয় দেখাবে, স্থানীয় প্রশাসনকেও। এটি প্রকৃত অর্থে সংবাদ না হলেও আমাদের জীবনের এক অনিবার্যতা তো বটে। একে উপেক্ষা করার উপায় সাধারণ মানুষের যেমন নেই, স্থানীয় প্রশাসনেরও তেমনি নেই। স্থানীয় প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে জানানো হবে, সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক, ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্র-তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং সরকারি দলের সাধারণ-যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাঁরা অবশ্যই এই ডাক দেবেন মিডিয়ার সামনে, আট-দশ টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা এবং এগুলোর ভিড়ে পেছনে পড়ে যাওয়া ছাপা-মাধ্যমের সাংবাদিকদের সামনে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে এই বার্তাটির অন্তর্নিহিত ইঙ্গিতটি বুঝে নেবে—না নিলে এলাকার প্রভাবশালীরাই তাদের তা বুঝিয়ে দেবেন। সন্ত্রাসী যে দলেরই হোক, ব্যবস্থা নিতে হবে, শুধু সরকারদলীয় ছাড়া। কোনো ভুলোমনা আমলা বা দারোগা যদি ব্যবস্থা নেনও, স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিশ্চিত করবেন, ব্যবস্থাটা অব্যবস্থা হয়ে ভুলোমনাদের বিরুদ্ধেই যেন যায়। এবং যায় যে, সে প্রমাণও ওই সংবাদমাধ্যমেই মাঝেমধ্যে সখেদে প্রচারিত হয়।
পৌর নির্বাচনে প্রভাবশালীদের ছাতার নিচে যে তাণ্ডব করবে সন্ত্রাসীরা, এটি তাই শিরোনাম হওয়ার মতো কোনো সংবাদ নয়, যা অনিবার্য, যা স্বতঃসিদ্ধ তাতে সংবাদের চমক থাকে না। যেমন শুল্ক বা পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি বা সিন্ডিকেটের কারসাজিতে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার ঘটনা। সন্ত্রাসীদের মাঠে নামার খরবটা তাই ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের সতর্ক বার্তার মতো। আসছে, ধেয়ে আসছে, এখন নিজেকে বাঁচান। সংবাদটি তাই পড়ে দেখতেও আগ্রহ বোধ করিনি। কিন্তু আগ্রহটা জেগেছে অন্য জায়গায়—ওই সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীর বন্ধনীভুক্ত হওয়ার বিষয়টায়। এই আগ্রহ যতটা অপরাধবিজ্ঞানীয়, তার থেকে বেশি সমাজতাত্ত্বিক। অথবা আরও সহজভাবে, লৌকিক। আমাদের সমাজে সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীর যে সখ্য, তার একটা জটিল প্রকাশই তো দেখি রাজনীতিতে। এবং তা যে শুধু বাংলাদেশে, তা তো নয়, ইউরোপ-আমেরিকার মতো সভ্য বলে বিবেচিত সমাজেও তো তার প্রকাশ দেখি। ভারতে এই সখ্যের প্রকাশ এমনই ব্যাপক, কোনো কোনো রাজ্যে যে সিনেমাওলারাও একে লুফে নিয়েছেন ব্যবসার উপাদান হিসেবে। বলিউডের এক সিনেমায় একবার দেখেছিলাম, এক রাজ্যের খোদ মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন সন্ত্রাসীদের গডফাদার। এমন খারাপ কাজ নেই যা মুখ্যমন্ত্রী করেন না, কিন্তু এক সৎ, সাহসী এবং দেশপ্রেমী পুলিশ ইন্সপেক্টরের কাছে তিনি শেষ পর্যন্ত ধরাশায়ী হলেন। সত্যের জয় হলো, তবে এমনই অবিশ্বাস্য এবং উদ্ভট উপায়ে যে ওই জয়ের আনন্দ দর্শক বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিতে পারবে না।
আমাদের দেশেও সন্ত্রাসী-প্রভাবশালীর সখ্য নিয়ে ছবি হয়েছে। ছবিগুলোর কাঠামো একই, তবে পাত্রপাত্রী একটু পরিবর্তিত। সেটিই স্বাভাবিক। আমাদের দেশের উচ্চপর্যায়ে যে দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হয়, তার সরাসরি উল্লেখ দূরে থাকুক, প্রতীকী পরিবেশনাও বিপজ্জনক। শরীফ বদমাশ বাজনতার শত্রু ধরনের ছবিতে তাই আকারে-ইঙ্গিতে বোঝানো হয়, প্রভাবশালীরা কারা। কিন্তু সেন্সর বোর্ডে যখন যায় কোনো ছবি, তার ছাড়পত্র পেতে হলে কারা সন্ত্রাসী, কারা গডফাদার সে ব্যাপারটাকে একটু দূরবর্তী ইঙ্গিতে না ফেললে প্রযোজককে মাথায় হাত দিতে হয়।
সিনেমার কথা থাক, বাস্তবেই বরং ফিরে আসি। বাস্তবে প্রভাবশালী কারা, তা বলা খুবই সহজ। আবার খুব কঠিনও বটে। যারা সন্ত্রাসের শিকার, তারা সন্ত্রাসীদের চেনে, তাদের মাথায় ছাতা মেলে দেওয়া প্রভাবশালীদেরও একসময় চিনতে পারে। এদের পুলিশ ও প্রশাসন চেনে, সংবাদকর্মীরা চেনেন, কিন্তু তাদের নাম সবাই বলতে পারে না। তাদেরকে লোকজন চেনে, কিন্তু তাদের চিহ্নিত করা সহজ হয় না। পুলিশ যেমন মাঝেমধ্যে ‘কে বা কাহারা’ বর্ণনায় অপরাধীর পরিচিতি নির্ণয় করে, প্রভাবশালীরাও এই সাধারণ পরিচয়ে উপস্থিত হন। জাতীয় দৈনিকটিও শিরোনামে নিচে যে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে, তাতে প্রভাবশালীরা অচিহ্নিত, সন্ত্রাসীদের মতোই।
একটা দেশে যদি শুধু সন্ত্রাসের শিকাররাই চিহ্নিত হন, সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীরা রয়ে যান অনির্ণীত, অশনাক্ত, ওই সাধারণ পরিচিতির আড়ালে, তাহলে আইনি শাসন কীভাবে প্রতিষ্ঠা পাবে? আইনি শাসন, আর যা হোক, ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অথচ বর্তমানে তাই চলছে। তা ছাড়া যুদ্ধ যে চলছে, তাও বলা যাবে না। বরং বলা যায়, ছায়ার সঙ্গে সন্ধি চলছে সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রম।

২.
সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে সমস্যা তেমন নেই। সন্ত্রাসীরা কারা, কেন এবং কী কী সন্ত্রাস তারা করে, এ নিয়ে রহস্য নেই। পুলিশের খাতায় তাদের নাম থাকে, নাম না থাকলেও পুলিশ জানে এবং বুঝতে পারে কারা সন্ত্রাসী। মানুষও জানে—মানুষই বরং অনেক ভালোভাবে জানে—কারা সন্ত্রাসী। এবং তাদের সংখ্যা যে দিনে দিনে বাড়ছে, তাও সাধারণ জ্ঞানের বিষয়। কিন্তু সমস্যা হয় প্রভাবশালীদের নিয়ে। প্রভাবশালী তকমাটা আগেই বলেছি, সমীহ আদায়কারী। প্রভাবশালীদের প্রতিপত্তি ও বিত্ত থাকে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ ও পেশাজীবীর পরিচিতিও থাকে। অনেকে ধার্মিক একটা লেবাসও গায়ে চাপান। এদের সন্তানেরা পড়াশোনা, চাকরি-বাকরি করে। এদের ভাই-বেরাদররাও চাকরি-বাকরি ব্যবসাপাতি করে। এরা যদি সৎ হতো, রুচিশীল হতো, সংস্কৃতিমনা হতো; এরা যদি সন্ত্রাসীদের ছাতার নিচে আশ্রয় না দিয়ে ওই ছাতা ভাঁজ করে পেটাত এবং এরা যদি তাদের প্রভাব ইতিবাচক কাজে লাগাত, তাহলে সমাজটা কত সুন্দর হতো। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। শিক্ষিত হয়েও তাঁদের মানসিকতায় কোনো পরিবর্তন আসে না, সন্তানের পিতা হয়েও তাঁরা আরেক পিতার সন্তানকে খুন করার দায়িত্ব নিতে দুবার ভাবেন না। বিষয়টা আমাকে ভাবায়। কিন্তু কেন প্রভাবশালীরা প্রায় সব ক্ষেত্রে তাঁদের প্রভাব খারাপ কাজে খাটান, তার কোনো উত্তর পাই না।
বিশাল উদাহরণসমুদ্র থেকে এ রকম খারাপ কাজের মাত্র তিনটি উল্লেখ করছি। এক গ্রামে এক মেয়েকে ধর্ষণ করেছে তিন সন্ত্রাসী (পত্রিকার ভাষায় ‘বখাটে’)। জনগণ সন্ত্রাসীদের ধরে থানায় দিয়েছে। কিন্তু খবর পেয়েই এক প্রভাবশালী তাঁদের থানা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী শহরতলিতে তিন কাঠা জমিতে একটি আধপাকা ঘর তুলেছেন। ঘরটি দখল করে নিল স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। তিনি গেলেন স্থানীয় প্রভাবশালীর কাছে। প্রভাবশালী তাঁকে পিটিয়ে বের করে দিলেন। অথচ প্রভাবশালী নিজে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে পাঠানো ইয়াবার একটা চালান ধরেছে পুলিশ, দুই অপরাধী, যাকে বলে বামাল ধরা পড়েছে। তাদের আধা মাইল দূরে থানায় নিয়ে যাওয়ার সময় পায়নি পুলিশ, প্রভাবশালী গিয়ে হাজির। তারপর যা হওয়ার তা-ই হলো। শুধু ইয়াবাটুকু ফেলে যেতে হলো। অথচ ওই প্রভাবশালীর ছেলেমেয়ে কলেজে পড়ে; কাপড়ে-লেবাসে তাঁকে দেখে খুবই ধার্মিক মনে হতে পারে।
এসব দুর্নীতি-অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কম, প্রতিরোধ কম। এ ক্ষেত্রে পুলিশের থেকে বেশি দায়ী প্রভাবশালী। এবং প্রভাবশালীদের এক শ জনের মধ্যে প্রায় নিরানব্বই জনই হলো সরকারদলীয়।

৩.
এই সরকার ক্ষমতায় গিয়েছিল দিনবদলের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। দিনবদল হয় না, যদি অনেক কিছুর সঙ্গে পুরোনো অপরাধ কাঠামোগুলো না বদলায়। এই অপরাধ কাঠামোতে শক্ত অবস্থানে আছেন প্রভাবশালীরা। যদি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে এই প্রভাবশালীদেরও কঠোর শাস্তি দেওয়া না হয়, এ দেশের অপরাধচিত্রের সামান্য পরিবর্তনও হবে না।
সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার অনেক অবদান রয়েছে এ দেশের নানা ইতিবাচক পরিবর্তনে। এখন উচিত, এই ভয়ংকর ভাসুরগুলোর নাম মুখে আনা। তাদের নাম-পরিচয় ছাপিয়ে দেওয়া। সত্যিকার গণরোষ জাগলে নিষ্ক্রিয় সরকারও সক্রিয় হবে প্রভাবশালীদের হাত থেকে তাদের ছাতা ছিনিয়ে নিতে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.