এমন বিশ্ববিদ্যালয় চাই, যা হবে উন্নয়নের সহযোগী by মোহাম্মদ কায়কোবাদ
পৃথিবীর স্থলভাগের মাত্র এক সহস্রাংশ বাংলাদেশে হলেও তার জনসংখ্যার ২৪ সহস্রাংশ ধারণ করে আছে আমাদের দেশটি। প্রাকৃতিক সম্পদেরও দারুণ কোনো ছড়াছড়ি নেই। যাও বা আছে, দক্ষতার অভাবে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় তা বিদেশিদের কারিগরি অদক্ষতায় কিংবা গাফিলতিতে অনিষ্ট হচ্ছে, যার যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবির ক্ষমতাও আমাদের নেই। এই ক্ষুদ্র দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর বেঁচে থাকার জন্য চাই প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি। আর প্রতিটি ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য তথ্যপ্রযুক্তির থেকে অধিকতর কার্যকর ও সর্বজনীন প্রযুক্তি আর নেই। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ধারণা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সেহেতু কার্যকর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে মানবসম্পদ উন্নয়নের বিকল্প নেই।
জাতীয় উন্নয়নে চাই আত্মবিশ্বাস, আর আত্মবিশ্বাসের প্রতিষ্ঠায় চাই সফল উদাহরণ। ভারতবাসী আইআইটি, আইআইএসসি কিংবা টিআইএফআরের মতো বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ববোধ করে আত্মবিশ্বাসী হয়, জাতীয় অগ্রগতিতে কার্যকর অবদান রাখে। আমাদের এই ভূখণ্ডে আমরা একসময় আদমজী জুটমিল নিয়ে গর্ববোধ করতাম। কিন্তু এই গর্বের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন কেবল প্রকৃতিপ্রদত্ত কক্সবাজারের দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত আর সুন্দরবন ছাড়া নিজেদের তৈরি গর্বের কিছু দেখানোর নেই। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম জনবহুল দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই মানসম্পন্ন কোনো বৈশ্বিক তালিকায় স্থান পাচ্ছে না, যদিও আমাদের দেশে পড়তে আসা ছাত্রদের দেশ মালয়েশিয়া কিংবা কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থান করে নিচ্ছে। থাইল্যান্ডও এই উন্নতিক্রমে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে, এমনকি পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও।
পাকিস্তানে হায়ার অ্যাডুকেশন কমিশন পাঁচ বছর ধরে প্রতিবছর তিন শ জন বিদেশি অধ্যাপক এনে তাদের গবেষণা ভিত্তিকে সমৃদ্ধ করছে, ভারতের আইআইটিগুলোতে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনি যে আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে তারা দেশে চলে আসে। আর আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে এমন কোনো পদক্ষেপ নেই।
কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একটি লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী তৈরি করা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে কোরিয় ভাষা না জানা, কোরিয় সংস্কৃতি না জানা মার্কিন এক নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে এসেছিল, যাতে করে কোরীয় বিজ্ঞানীরা এই নোবেল বিজয়ীর সান্নিধ্য পায়, উদ্বুদ্ধ হতে পারে। ১৯৭১ সালে স্থাপিত কাইস্ট এ পর্যন্ত নয় হাজার ১৬৮টি বিএসসি, ১৮ হাজার ৮৪৪টি এমএসসি এবং সাত হাজার ২২৩টি পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কাইস্টের থেকে বয়সে বড় হলেও পিএইচডি দেওয়ার সংখ্যায় শতভাগ পিছিয়ে। স্বভাবতই ২০০৮ সালের এশিয়া উইকের তালিকায় কোরিয় কাইস্টের অবস্থান এক নম্বরে। একসময় আমাদের থেকে পিছিয়ে থাকা কোরিয়া দুর্দান্ত গতিতে যে উন্নয়নের সোপান বেয়ে উঠছে, তা কিন্তু শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই। জনসংখ্যাসর্বস্ব আমাদের দেশের উন্নয়নও নির্ভর করছে শিক্ষাকে আমরা কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি তার ওপর।
এবার ফিরে আসি ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি স্থাপনের বিষয়ে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে সবচেয়ে কাছাকাছি নামে যা পেলাম, তা হলো হল্যান্ডের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় জোট করে একটি ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি তৈরি করেছে, যার খরচ তারা নিজেদের আকারের অনুপাতে বহন করে এবং প্রতিবছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয় মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, নিজের জনবল সামান্যই। অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও গবেষক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করলে এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে অর্থনীতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিসংখ্যানের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কোর্স তৈরি সম্পন্ন হয়েছে, ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য সিডি/ডিভিডি তৈরি করা হয়েছে।
মালয়েশিয়াতে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি সাইবারজায়া এবং মেলাকা নামের দুটি ক্যাম্পাসের মাধ্যমে শিক্ষাদান করে। ছাত্রদের সম্ভাবনাময় প্রকল্পসমূহ বাণিজ্যিকীকরণের জন্য এখানে একটি ইনকিউবেটরও রয়েছে। এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্যপ্রযুক্তি, ক্রিয়েটিভ মাল্টিমিডিয়া, ম্যানেজমেন্ট, ‘বিজনেস অ্যান্ড ল’ নামক অনুষদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া হয়। কোরিয়াতে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ইউনিভার্সিটি, যা ২০০৯ সাল থেকে কাইস্টের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে।
আমাদের দেশ যে অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত, তার কার্যকর সমাধান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দিতে পারছে না। যানজট সমস্যা, কয়লা-তেল উত্তোলনের সমস্যা, বন্যা ও খরার সমস্যা, উপকূল অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় সমস্যা, নদীর নাব্যতার সমস্যা কোনোটিরই কার্যকর সমাধান এখনো দিতে পারিনি। এমতাবস্থায় অবশ্যই আমাদের এমন একটি বিশ্বমানের শিক্ষা/গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত, যা আমাদের জাতীয় সমস্যাসমূহের কার্যকর সমাধান বের করার প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। ভারতের আইআইটিগুলো প্রতিষ্ঠায় যে প্রয়োজনীয় অ্যাক্ট, স্ট্যাটিউট ও অর্ডিন্যান্স পাস হয়েছিল, আমরা সেগুলোকে বিবেচনায় এনে আইন প্রণয়ন করতে পারি। এই ইনস্টিটিউটগুলোকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং তাতে শিক্ষক-গবেষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাও আলাদাভাবে দেওয়ার বিধান ছিল।
আমরা যদি এ রকম জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যা আমাদের দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, তা নিশ্চয়ই বর্তমান ৮৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হবে না। আমাদের দেশের সমস্যা কার্যকরভাবে সমাধান করতে পারে, এমন অভিজ্ঞ ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক-গবেষকদের নিয়েই তৈরি করতে হবে এমন বিশ্ববিদ্যালয়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যেহেতু নানা ক্ষেত্রে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশেষায়িত হলেও নানা বিভাগ থাকতে হবে। আমরা জেনেছি, অতি সম্প্রতি প্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র ও গবেষকেরা পাটের জেনোমে সিকুয়েন্সিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং অ্যাডভান্সড গবেষণা করছে। এই গবেষণায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অপরিসীম। বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আরও বেশ কয়েকটি বিষয় তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং সে বিষয়গুলোর যৌক্তিক মাত্রায় উপস্থিতি প্রয়োজন।
এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে, তার কিছু নিচে উপস্থাপন করা হলো। ১. এই প্রতিষ্ঠানের বাজেট ভারতের আইআইটিসমূহের তুলনীয় হতে হবে। ২. এর কর্ণধার হবেন একজন প্রোথিতযশা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী। আমরা এ রকম মানের প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষক-গবেষকদেরও বিবেচনা করতে পারি। ৩. উপদেষ্টা বোর্ডে থাকবেন বিভিন্ন দেশের নামকরা বিজ্ঞানী এবং প্রবাসী বাংলাদেশি। সরকারের গবেষক পর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরাও এ বোর্ডে থাকবেন। ৪. এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক হওয়ার শর্তাবলি হবে আইআইটি, আইআইএসসি কিংবা কাইস্টের অনুরূপ। কোনোক্রমেই এই শর্তাবলি শিথিল করা যাবে না। বিদেশি শিক্ষক ও গবেষকদের চাকরি করার সুবিধা থাকতে হবে। ৫. বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা যেন এমন উচ্চমানের হয়, যাতে করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য তা অত্যন্ত লোভনীয় হয়। যেমন—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যা বেতন, এখানে তার পাঁচগুণ করা যেতে পারে। গবেষণা করার সুযোগও পর্যাপ্ত থাকতে হবে। ৬. বিদেশি কিংবা প্রবাসী বিশেষজ্ঞরা যাতে করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালীন সময় থেকে গবেষণা ও শিক্ষাদান করতে পারে, তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। ৭. শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষণীয় আবাসন থাকতে হবে। ৮. সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সামনে রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি যাতে মডেল হয়। যাতে করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মডেল ধরে নিজেদের ডিজিটালে রূপান্তর করতে পারে। ৯. ছাত্র-গবেষকদের সম্ভাবনাময় প্রকল্পসমূহ বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য ইনকিউবেশনের ব্যবস্থা রাখা দরকার। ১০. শিক্ষক ও গবেষকদের নিয়োগের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে তাঁদের উৎপাদনশীলতার ওপর, যাতে করে স্থায়ী চাকরি উদ্ভূত জড়তা ও কাজের প্রতি অনীহা তাঁদের পেয়ে না বসে। ১১. প্রবাসী বিদেশি শিক্ষক, গবেষকদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন গড়ে তোলা। ১২. বিশ্বখ্যাত প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষক, গবেষকদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এই পথে বাংলাদেশেও হতে পারে ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশ অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, যা হবে আমাদের মর্যাদার প্রতীক, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বুয়েট ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
জাতীয় উন্নয়নে চাই আত্মবিশ্বাস, আর আত্মবিশ্বাসের প্রতিষ্ঠায় চাই সফল উদাহরণ। ভারতবাসী আইআইটি, আইআইএসসি কিংবা টিআইএফআরের মতো বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠান নিয়ে গর্ববোধ করে আত্মবিশ্বাসী হয়, জাতীয় অগ্রগতিতে কার্যকর অবদান রাখে। আমাদের এই ভূখণ্ডে আমরা একসময় আদমজী জুটমিল নিয়ে গর্ববোধ করতাম। কিন্তু এই গর্বের প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়েছি। এখন কেবল প্রকৃতিপ্রদত্ত কক্সবাজারের দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত আর সুন্দরবন ছাড়া নিজেদের তৈরি গর্বের কিছু দেখানোর নেই। পৃথিবীর সপ্তম বৃহত্তম জনবহুল দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই মানসম্পন্ন কোনো বৈশ্বিক তালিকায় স্থান পাচ্ছে না, যদিও আমাদের দেশে পড়তে আসা ছাত্রদের দেশ মালয়েশিয়া কিংবা কোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থান করে নিচ্ছে। থাইল্যান্ডও এই উন্নতিক্রমে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে, এমনকি পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও।
পাকিস্তানে হায়ার অ্যাডুকেশন কমিশন পাঁচ বছর ধরে প্রতিবছর তিন শ জন বিদেশি অধ্যাপক এনে তাদের গবেষণা ভিত্তিকে সমৃদ্ধ করছে, ভারতের আইআইটিগুলোতে শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমনি যে আমেরিকার নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে তারা দেশে চলে আসে। আর আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানোন্নয়নে এমন কোনো পদক্ষেপ নেই।
কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একটি লক্ষ্য নোবেল বিজয়ী তৈরি করা। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে কোরিয় ভাষা না জানা, কোরিয় সংস্কৃতি না জানা মার্কিন এক নোবেল বিজয়ীকে নিয়ে এসেছিল, যাতে করে কোরীয় বিজ্ঞানীরা এই নোবেল বিজয়ীর সান্নিধ্য পায়, উদ্বুদ্ধ হতে পারে। ১৯৭১ সালে স্থাপিত কাইস্ট এ পর্যন্ত নয় হাজার ১৬৮টি বিএসসি, ১৮ হাজার ৮৪৪টি এমএসসি এবং সাত হাজার ২২৩টি পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় কাইস্টের থেকে বয়সে বড় হলেও পিএইচডি দেওয়ার সংখ্যায় শতভাগ পিছিয়ে। স্বভাবতই ২০০৮ সালের এশিয়া উইকের তালিকায় কোরিয় কাইস্টের অবস্থান এক নম্বরে। একসময় আমাদের থেকে পিছিয়ে থাকা কোরিয়া দুর্দান্ত গতিতে যে উন্নয়নের সোপান বেয়ে উঠছে, তা কিন্তু শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েই। জনসংখ্যাসর্বস্ব আমাদের দেশের উন্নয়নও নির্ভর করছে শিক্ষাকে আমরা কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছি তার ওপর।
এবার ফিরে আসি ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি স্থাপনের বিষয়ে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে সবচেয়ে কাছাকাছি নামে যা পেলাম, তা হলো হল্যান্ডের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় জোট করে একটি ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি তৈরি করেছে, যার খরচ তারা নিজেদের আকারের অনুপাতে বহন করে এবং প্রতিবছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় নয় মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, নিজের জনবল সামান্যই। অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও গবেষক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো প্রকল্প গ্রহণ করলে এই বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে অর্থনীতি, চিকিৎসাশাস্ত্র, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিসংখ্যানের তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর কোর্স তৈরি সম্পন্ন হয়েছে, ব্যবহারিক ক্লাসের জন্য সিডি/ডিভিডি তৈরি করা হয়েছে।
মালয়েশিয়াতে প্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মাল্টিমিডিয়া ইউনিভার্সিটি সাইবারজায়া এবং মেলাকা নামের দুটি ক্যাম্পাসের মাধ্যমে শিক্ষাদান করে। ছাত্রদের সম্ভাবনাময় প্রকল্পসমূহ বাণিজ্যিকীকরণের জন্য এখানে একটি ইনকিউবেটরও রয়েছে। এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং, তথ্যপ্রযুক্তি, ক্রিয়েটিভ মাল্টিমিডিয়া, ম্যানেজমেন্ট, ‘বিজনেস অ্যান্ড ল’ নামক অনুষদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে লেখাপড়া হয়। কোরিয়াতে ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স ইউনিভার্সিটি, যা ২০০৯ সাল থেকে কাইস্টের সঙ্গে একীভূত হচ্ছে।
আমাদের দেশ যে অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত, তার কার্যকর সমাধান আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দিতে পারছে না। যানজট সমস্যা, কয়লা-তেল উত্তোলনের সমস্যা, বন্যা ও খরার সমস্যা, উপকূল অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় সমস্যা, নদীর নাব্যতার সমস্যা কোনোটিরই কার্যকর সমাধান এখনো দিতে পারিনি। এমতাবস্থায় অবশ্যই আমাদের এমন একটি বিশ্বমানের শিক্ষা/গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকা উচিত, যা আমাদের জাতীয় সমস্যাসমূহের কার্যকর সমাধান বের করার প্রয়োজনীয় বিশেষজ্ঞ জ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। ভারতের আইআইটিগুলো প্রতিষ্ঠায় যে প্রয়োজনীয় অ্যাক্ট, স্ট্যাটিউট ও অর্ডিন্যান্স পাস হয়েছিল, আমরা সেগুলোকে বিবেচনায় এনে আইন প্রণয়ন করতে পারি। এই ইনস্টিটিউটগুলোকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং তাতে শিক্ষক-গবেষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাও আলাদাভাবে দেওয়ার বিধান ছিল।
আমরা যদি এ রকম জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান গড়তে চাই, যা আমাদের দেশের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, তা নিশ্চয়ই বর্তমান ৮৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হবে না। আমাদের দেশের সমস্যা কার্যকরভাবে সমাধান করতে পারে, এমন অভিজ্ঞ ও গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক-গবেষকদের নিয়েই তৈরি করতে হবে এমন বিশ্ববিদ্যালয়। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যেহেতু নানা ক্ষেত্রে, তাই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশেষায়িত হলেও নানা বিভাগ থাকতে হবে। আমরা জেনেছি, অতি সম্প্রতি প্রবাসী বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্র ও গবেষকেরা পাটের জেনোমে সিকুয়েন্সিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং অ্যাডভান্সড গবেষণা করছে। এই গবেষণায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অপরিসীম। বায়োটেকনোলজি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আরও বেশ কয়েকটি বিষয় তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুতরাং সে বিষয়গুলোর যৌক্তিক মাত্রায় উপস্থিতি প্রয়োজন।
এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যে বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে, তার কিছু নিচে উপস্থাপন করা হলো। ১. এই প্রতিষ্ঠানের বাজেট ভারতের আইআইটিসমূহের তুলনীয় হতে হবে। ২. এর কর্ণধার হবেন একজন প্রোথিতযশা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী। আমরা এ রকম মানের প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষক-গবেষকদেরও বিবেচনা করতে পারি। ৩. উপদেষ্টা বোর্ডে থাকবেন বিভিন্ন দেশের নামকরা বিজ্ঞানী এবং প্রবাসী বাংলাদেশি। সরকারের গবেষক পর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরাও এ বোর্ডে থাকবেন। ৪. এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক হওয়ার শর্তাবলি হবে আইআইটি, আইআইএসসি কিংবা কাইস্টের অনুরূপ। কোনোক্রমেই এই শর্তাবলি শিথিল করা যাবে না। বিদেশি শিক্ষক ও গবেষকদের চাকরি করার সুবিধা থাকতে হবে। ৫. বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা যেন এমন উচ্চমানের হয়, যাতে করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য তা অত্যন্ত লোভনীয় হয়। যেমন—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যা বেতন, এখানে তার পাঁচগুণ করা যেতে পারে। গবেষণা করার সুযোগও পর্যাপ্ত থাকতে হবে। ৬. বিদেশি কিংবা প্রবাসী বিশেষজ্ঞরা যাতে করে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্পকালীন সময় থেকে গবেষণা ও শিক্ষাদান করতে পারে, তার ব্যবস্থা থাকা উচিত। ৭. শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষণীয় আবাসন থাকতে হবে। ৮. সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়কে সামনে রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি যাতে মডেল হয়। যাতে করে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও এই বিশ্ববিদ্যালয়কে মডেল ধরে নিজেদের ডিজিটালে রূপান্তর করতে পারে। ৯. ছাত্র-গবেষকদের সম্ভাবনাময় প্রকল্পসমূহ বাণিজ্যিকীকরণ করার জন্য ইনকিউবেশনের ব্যবস্থা রাখা দরকার। ১০. শিক্ষক ও গবেষকদের নিয়োগের স্থায়িত্ব নির্ভর করবে তাঁদের উৎপাদনশীলতার ওপর, যাতে করে স্থায়ী চাকরি উদ্ভূত জড়তা ও কাজের প্রতি অনীহা তাঁদের পেয়ে না বসে। ১১. প্রবাসী বিদেশি শিক্ষক, গবেষকদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানের জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন গড়ে তোলা। ১২. বিশ্বখ্যাত প্রবাসী বাংলাদেশি শিক্ষক, গবেষকদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার সব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এই পথে বাংলাদেশেও হতে পারে ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ অথবা বাংলাদেশ অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, যা হবে আমাদের মর্যাদার প্রতীক, আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: অধ্যাপক, বুয়েট ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস।
No comments