পাগলা মসজিদের দানবাক্সে রেকর্ড আট কোটি টাকা
শনিবার পাগলা মসজিদের টাকা গণনার সময় সকালে সমন্বয়ক ইকরাম হোসাইন গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, আমরা বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি, অতীতে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল, তারা বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে বিভিন্ন ছলচাতুরির মাধ্যমে পাগলা মসজিদের টাকা সরিয়েছে। যারা মসজিদ প্রশাসনে রয়েছেন তারা ফুলে ফেঁপে কলাগাছ হয়েছেন। তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাদের আয়ের উৎস কি? কীভাবে তাদের এতো অঢেল সম্পদ হয়েছে, এসব খতিয়ে দেখা উচিত। সমন্বয়ক ইকরাম হোসাইন বলেন, বছরের পর বছর পাগলা মসজিদের দানবাক্সে কোটি কোটি টাকা আসছে। কিশোরগঞ্জসহ সারা দেশের মানুষ জানতে চাচ্ছিলো এই টাকা কোথায় রাখা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাগলা মসজিদের কত কোটি টাকা রয়েছে, এই টাকা কোথায় ব্যয় হচ্ছে। দেশের মানুষ এবং কিশোরগঞ্জের আপামর ছাত্র-জনতা প্রশ্ন তুলেছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ এবং পরিতাপের বিষয়, এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের প্রশাসন যারা পাগলা মসজিদের দায়িত্বে রয়েছেন, তারা এটা ক্লিয়ার করেননি। কত টাকা আসছে, সোনা-রুপা কি আসছে, বৈদেশিক মুদ্রা কি আসছে, ওই টাকা কোথায় রাখা হচ্ছে। কাদের মাধ্যমে রাখা হচ্ছে, কোথায় ব্যয় করা হচ্ছে। পাগলা মসজিদ নিয়ে মানুষের আস্থা এবং বিশ্বাসের যে জায়গা রয়েছে, সেটি নিয়ে লুকোচুরি করা হচ্ছে। এ সময় সমন্বয়ক ইকরাম হোসাইন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, যারা পাগলা মসজিদের দায়িত্বে রয়েছেন, তারা যদি অনতিবিলম্বে দেশবাসীর কাছে পাগলা মসজিদের অর্থের বিষয়টি স্পষ্ট না করেন, তাহলে কিশোরগঞ্জের ছাত্র-জনতাসহ এ দেশের মানুষ এই হিসাব নিবে ইনশাআল্লাহ্। তবে টাকা গণনা চলার সময়ে ওয়াক্ফ হিসাব নিরীক্ষক মো. আলাউদ্দিন জানান, ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদটি ওয়াক্ফ এস্টেটের তালিকাভুক্ত। এখানে ১২ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তী কমিটি রয়েছে।
কমিটির কাজগুলো ওয়াক্ফ প্রশাসন তদারকি করে। মানুষের মানতের অর্থ সুষ্ঠুভাবে রেজিস্ট্রারভুক্ত হচ্ছে কি-না, কোন খাতে খরচ হচ্ছে, সেগুলো তদারকি করা হয়। প্রতিবছর আয়-ব্যয়ের হিসাব দিতে হয়। ওয়াক্ফ প্রশাসন ৫ শতাংশ ওয়াক্ফ ট্যাক্স নিয়ে থাকে। গত অর্থবছরে পাগলা মসজিদ থেকে ১ কোটি ৫৩ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ টাকা ওয়াক্ফ কন্ট্রিবিউশন নেয়া হয়েছে। পাগলা মসজিদের অ্যাকাউন্টে মোট কত টাকা রয়েছে সাংবাদিকদের এ প্রশ্নে ওয়াক্ফ হিসাব নিরীক্ষক মো. আলাউদ্দিন বলেন, বিষয়টি আমি এখন আপনাদের বলবো না। জেলা প্রশাসক মহোদয় কিছুক্ষণ আগে আপনাদের এই প্রশ্নের উত্তর দেননি, আমিও দেবো না। এটা সরকারের সিকিউরিটির ব্যাপার। এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান মানবজমিনকে বলেন, পাগলা মসজিদে দান হিসেবে যে টাকা আসে, তার সবটাই ব্যাংকে জমা রাখা হয়। ব্যাংক থেকে টাকার যে লভ্যাংশ আসে, সেটি দিয়ে পরিচালনা ব্যয়সহ অন্যান্য কার্যক্রম করা হয়। জমা রাখা মূল টাকাতে হাত দেয়া হয় না। এটি একটি সরকারি ব্যবস্থাপনা। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোন সুযোগ নেই।
এদিকে শনিবার সকাল ৭টায় মসজিদটির ১০টি দানসিন্দুক এবং একটি ট্রাঙ্ক খোলার মধ্য দিয়ে টাকা গণনার কাজ শুরু করা হয়। প্রথমে টাকাগুলো লোহার সিন্দুক থেকে বস্তায় ভরা হয়। পরে মসজিদের দোতলায় নিয়ে মেঝেতে ঢালা হয়। এরপর শুরু হয় টাকা গণনার কাজ। সর্বশেষ গত ১৭ই আগস্ট টাকা গণনা করতে ৩২০ জনের প্রায় ১২ ঘণ্টা লেগেছিল। এবার টাকা গণনা আরও দ্রুত করতে আরও ৩৫ জন শিক্ষার্থী এবং রূপালী ব্যাংকের আরো ৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গণনার কাজে যুক্ত করা হয়। পাগলা মসজিদ মাদ্রাসা ও আল জামিয়াতুল ইমদাদিয়ার মোট ২৮৫ জন ছাত্র এবং রূপালী ব্যাংকের ৭৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে মোট ৩৬০ জন টাকা গণনার কাজ করেন। সেনাবাহিনীর ১০ জন, পুলিশের ২০ জন, র্যাব’র ৫ জন ও আনসারের ১৫ জন সদস্য ছাড়াও মসজিদ-মাদ্রাসার ৪৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের সহায়তা করেন। এবার তিন মাস ১৩ দিন পর মসজিদের দানসিন্দুক খোলা হয়। এর আগে সর্বশেষ গত ১৭ই আগস্ট এ মসজিদের দানসিন্দুকগুলো খোলা হয়েছিল। তখন ২৮ বস্তা টাকা পাওয়া গিয়েছিল। পরে টাকা গণনা করে ৭ কোটি ২২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। এছাড়া পাওয়া যায় বৈদেশিক মুদ্রা, সোনা, রুপা ও হীরার গয়না। তবে এ মসজিদের দানসিন্দুক থেকে গত ২০শে এপ্রিল বৈদেশিক মুদ্রা, সোনা, রুপা ও হীরার গহনা ছাড়া এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ ৭ কোটি ৭৮ লাখ ৬৭ হাজার ৫৩৭ টাকা পাওয়া গিয়েছিল। এবার মসজিদের নির্দিষ্ট ৯টি দানসিন্দুক অন্তত দুই সপ্তাহ আগেই দানের টাকায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। পরে দান অব্যাহত রাখার সুবিধার্থে আরও একটি দানসিন্দুক এবং একটি ট্রাঙ্ক যুক্ত করা হয়। ফলে বস্তার হিসাবেও এবার সর্বোচ্চ ২৯ বস্তা টাকা পাওয়া যায়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে এসব টাকা গণনার কাজ শেষ হয়।
সকাল ৭টায় কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান ও মোহাম্মদ হাছান চৌধুরীর নেতৃত্বে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দানবাক্স খোলা কমিটির আহ্বায়ক মিজাবে রহমত এর উপস্থিতিতে দান সিন্দুক খোলা হয়। এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রুবেল মাহমুদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান, কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. এরশাদ মিয়া, রূপালী ব্যাংকের এজিএম রফিকুল ইসলাম, মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা শওকত উদ্দিন ভূঁইয়া এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণসহ মসজিদ কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা শহরের নরসুন্দা নদী তীরের ঐতিহাসিক এ মসজিদটিতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ এসে দান করছেন। যারা দান করতে আসেন তারা বলে থাকেন, এখানে দান করার পরে নাকি তাদের মনের আশা পূরণ হয়েছে। আর এ কারণেই দিন দিন দানের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে পাগলা মসজিদ অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠান। শহরের পশ্চিমে হারুয়া এলাকায় নরসুন্দা নদীর তীরে মাত্র ১০ শতাংশ ভূমির ওপর এই মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। সময়ের বিবর্তনে আজ এ মসজিদের পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে এর খ্যাতি ও ঐতিহাসিক মূল্যও। বর্তমানে ৩.৮৮ একর ভূমির উপর সমপ্রসারিত পাগলা মসজিদ এলাকায় মসজিদকে কেন্দ্র করে একটি অত্যাধুনিক ধর্মীয় কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। স্বভাবতই ঐতিহাসিক এই মসজিদকে নিয়ে জেলার ধর্ম-বর্ণ-সমপ্রদায় নির্বিশেষে সকলেই গর্ববোধ করেন।
No comments