স্বপ্ন দেখি একজন মানুষও হামদর্দের সেবা থেকে বাদ পড়বে না -মানবজমিনকে ড. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া
মানবজমিন: বড় হয়ে কী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
আমি জন্মেছিলাম লক্ষ্মীপুরের ছায়াঢাকা মায়াঢাকা দক্ষিণ মাগুরী নামের এক
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা গ্রামে। আমার পিতা মরহুম ছায়েদ উল্লাহ ভূঁইয়ার
জীবনযাপন, আদর্শ আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। পরম শ্রদ্ধেয় মা
মরহুমা রওশন জাহান বেগম আমাদের সব ভাই-বোনের প্রতি ছিলেন যত্নবান ও
আন্তরিক। শৈশবে আমার একটাই স্বপ্ন ছিল যে, আমি মানুষের মতো মানুষ হবো,
মানুষের কল্যাণ করবো। মানুষের উপকার করার মধ্যদিয়ে আমি সৃষ্টিকর্তার একজন
কৃতজ্ঞ বান্দা হতে চেয়েছি সবসময়।
মানবজমিন: পুলিশ সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা জগতে কেন প্রবেশ করলেন?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
আসলে আমার পুলিশ অফিসার হওয়ার কোনো স্বপ্ন ছিল না। ১৯৭১ সালে যখন
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, তখন সুযোগ এলো পুলিশে চাকরি করার। তখন মনে হলো,
পুলিশে থাকলে তো মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করা যাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার
পক্ষে কৌশলগত অবস্থান নিয়ে কাজ করা যাবে। সেই চিন্তা থেকেই আমি থেকে
গেলাম। আমি ছিলাম তেজগাঁও থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার। ঢাকার এই অঞ্চলটিতে
মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষা করা, সহযোগিতা করা, তথ্য দেয়ার মতো স্পর্শকাতর কাজ ও
উপকার আমার মাধ্যমে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে আমার মনে হয়েছে, এই পেশায়
থাকা আমার জন্য ঠিক হবে না। আমাকে আরও বড় মানবসেবার কাজ করতে হবে। সেই
ভাবনা থেকেই হামদর্দে সম্পৃক্ত হওয়া। শুরু থেকেই আমার মধ্যে বিশ্বাস ছিল
যে, হামদর্দকে আমি সফলভাবে এগিয়ে নিতে পারবো।
মানবজমিন: আপনার এই দীর্ঘ যাত্রায় কোনো প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল, হামদর্দবিরোধী ষড়যন্ত্র। প্রকাশ্য ও গোপন
ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অসংখ্যবার হামদর্দকে দখল করার চেষ্টা করা হয়েছে। পদে
পদে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা পুঁজি এবং ছয় গুণ দায়দেনা
নিয়ে আমরা শুরু করেছিলাম। ষড়যন্ত্রকারীরা চেয়েছিল যে, হামদর্দ যেন আদমজী,
বাওয়ানী শিল্প প্রতিষ্ঠানের মতো ধ্বংস হয়ে যায়, যাতে অবশিষ্ট যা কিছু থাকবে
তাই তারা লুটেপুটে খেতে পারে, দখল করতে পারে।
মানবজমিন: বাংলাদেশে ইউনানী, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার ভবিষ্যৎ কতোটা উজ্জ্বল?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
দিন যত যাচ্ছে ইউনানী আয়ুর্বেদিক ও হারবাল চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
আমাদের এ খাতের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এই চিকিৎসাব্যবস্থা এখন সবার কাছে
পরম আকাঙ্ক্ষিত। ঘরে ঘরে এ ধরনের চিকিৎসার জন্য মুখিয়ে থাকেন মানুষ। শিল্প
হিসেবেও এটি জাতীয় অর্থনীতিতে আশার আলো দেখাচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে এখন
হারবাল চিকিৎসাব্যবস্থার কাছে ফিরছে কোটি কোটি মানুষ। বিশেষ করে কোভিড
পরবর্তী সময়ে এর প্রয়োজনীয়তা আরও বেড়েছে। এই খাত স্বীকৃতি লাভ করেছে
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত ওষুধ হিসেবে এখন ভেষজ
চিকিৎসার প্রতি ঝুঁকছে বিশ্বের অগণিত মানুষ। সেই বিপুল আলোড়নের ছোঁয়া
লেগেছে বাংলাদেশেও। এখন শুধু সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার
পালা।
মানবজমিন: বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ হামদর্দের অবস্থান কেমন বলে আপনার ধারণা?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
উপমহাদেশে হামদর্দ একটি প্রতিষ্ঠিত নাম, যার বিকল্প আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি।
তাছাড়া সারাবিশ্বেই হামদর্দ একনামে পরিচিত, অনেক দেশে হামদর্দের আদলে
ইউনানী আয়ুর্বেদিক ওষুধ শিল্প গড়ে উঠেছে।
মানবজমিন: ইউনানী-আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষালাভের বিষয়ে বর্তমান প্রজন্মের উৎসাহ কেমন বলে আপনার ধারণা?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
এই খাত নিয়ে বিপুল আগ্রহ রয়েছে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। শুধু প্রয়োজন
খাতসংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করা। ইউনানী-আয়ুর্বেদিক
ওষুধের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা এখন সারাবিশ্বে। বাংলাদেশেও এই খাতে সূচনা হয়েছে
নতুন দিগন্তের। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ; ভারত, শ্রীলঙ্কা ও
তুরস্কের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর করেছে।
ইতিমধ্যে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ক্যাম্পাসে শ্রীলঙ্কা থেকে আসা
বিশেষজ্ঞ শিক্ষক পাঠদান করেছেন। ভারত সরকারও একজন ইউনানী বিশেষজ্ঞ
শিক্ষাবিদকে পাঠিয়েছে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশে হামদর্দ
বিশ্ববিদ্যালয়ই অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক শিক্ষাকে
আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করাচ্ছে।
মানবজমিন: আপনি বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানের আলাদা বৈশিষ্ট্য কী?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
২০১২ সালে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করি। ২০১৪ সালে
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন
(ইউজিসি) এবং বাংলাদেশ বোর্ড অব ইউনানী অ্যান্ড আয়ুর্বেদিক সিস্টেমস অব
মেডিসিন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের ব্যাচেলর অব ইউনানী মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (বিইউএমএস) এবং
ব্যাচেলর অব আয়ুর্বেদিক মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি (বিএএমএস) প্রোগ্রাম
দু’টিকে আইনসম্মতভাবে অনুমোদন প্রদান করে। শুধু তাই নয়, প্রোগ্রাম দু’টির
সিলেবাস ও কোর্স কারিকুলামও ইউজিসি কর্তৃক অনুমোদিত। পাশাপাশি উক্ত অনুষদে
শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করে
তারা। ব্যতিক্রমী বিষয় হলো, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একমাত্র
হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয়ই সরাসরি বিইউএমএস ও বিএএমএস প্রোগ্রাম পরিচালনা করে
আসছে। বাংলাদেশে ৩টি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মধ্যে
একটি সরকারি। রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত সরকারি ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল
কলেজটি একটি প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ফার্মেসি অনুষদের অধিভুক্ত। অপর দু’টি প্রতিষ্ঠান হামদর্দ পরিচালিত।
লক্ষ্মীপুরে অবস্থিত রওশন জাহান ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল,
চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এবং বগুড়ায় অবস্থিত হামদর্দ
ইউনানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত
হিসেবে বিইউএমএস প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। দক্ষ এবং সৎ মানুষ তৈরির জন্যই
আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো করেছি। আমাদের প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান
আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
মানবজমিন: দেশের জাতীয় ওষুধনীতিতে ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ওষুধের স্বীকৃতি কীভাবে পেলো?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
১৯৮২ সালের ঘটনা। তখন হারবাল ওষুধ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে স্বীকৃত ছিল না। আমার
স্বপ্নের কথা জানালাম জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম স্যারকে। এরপর বিষয়টি
অবগত করলাম ওষুধ প্রশাসনের তৎকালীন পরিচালক ড. হুমায়ুন কে এম এ হাই সাহেব
এবং সংশ্লিষ্টদের। এ বিষয়ে তখন আন্তরিকতা দেখালেন ইউনানী আয়ুর্বেদিক
বোর্ডের চেয়ারম্যান হাকীম আজিজুল ইসলাম। সবার আন্তরিকতার কারণে জাতীয়
ওষুধনীতিতে অন্তর্ভুক্ত হয় হারবাল ওষুধ। ১৯৯২ সালের দিকে এই ওষুধনীতি থেকে
হারবাল খাতকে বাদ দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। আমরা ওই মামলায় জিতে যাই,
সরকার হেরে যায়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এই খাতকে।
মানবজমিন: কোন ধরনের চিন্তা থেকে আপনি এই ব্যতিক্রমী প্রয়াস গ্রহণ করলেন?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
১৯৮৬ সাল পর্যন্ত একজন মোতাওয়াল্লীই নিয়ন্ত্রণ করতেন সবকিছু। কিন্তু আমরা
দায়িত্ব বিভাজন করতে এবং সবার পরামর্শ নিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে হামদর্দকে
পরিচালনা করতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের সমন্বয়ে
ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। সেই ধারাবাহিকতায় অব্যাহত আছে ট্রাস্টি বোর্ডের
মতামত নিয়ে হামদর্দ পরিচালনার প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণের রীতি।
মানবজমিন: জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়েও আপনি কর্মঠ, নিরলস, সচল ও সক্রিয়। এর রহস্য কী?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
আমি সবসময় কাজকেই প্রাধান্য দিয়েছি। হামদর্দ ছাড়া জীবনে আর অন্যকিছু
ভাবিনি। আমি দৃঢ়ভাবে মনে করি, কাজ কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরায় না।
মানবজমিন: নিকট ভবিষ্যতে কোনো বড় ধরনের কর্মকাণ্ডে হাত দিচ্ছেন কী?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
ইউনানী আয়ুর্বেদিক শিল্পকে এগিয়ে নিতে সর্বপ্রকারের আধুনিকায়নের উদ্যোগ
আমরা গ্রহণ করেছি। এ জন্য ভারত ও চীনের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে সেটি নিতেও
আমরা প্রস্তুত আছি।
মানবজমিন: আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটি বলে মনে করেন?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া: ধ্বংসপ্রাপ্ত হামদর্দকে গড়ে তোলার মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের পাশে দাঁড়ানোই আমার জীবনের বড় অর্জন বলে মনে করি।
মানবজমিন: নতুন প্রজন্মের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কী?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া: সততার সঙ্গে কাজ করো, বসে থেকো না, চেষ্টা করে যাও, কাজ তোমাকে কখনোই হতাশ করবে না, সাফল্যের মুখ দেখাবেই।
মানবজমিন: অবসরে কী করেন?
ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
আমার কোনো অবসর নেই। সবসময় হামদর্দের নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়, পরিকল্পনা
করতে হয় এবং কর্মকর্তা-কর্মীদের নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তবে হঠাৎ যদি
অবসর পাই তাহলে ধর্মীয় টিভি সিরিয়াল দেখি, যার মাধ্যমে আমি নিজেকে আরও
ইতিহাস সমৃদ্ধ করতে পারি।
মানবজমিন: হামদর্দকে কোন পর্যায়ে দেখতে চান?
ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া:
হামদর্দ এখন বিপুলসংখ্যক মানুষকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাসেবা দিচ্ছে। আমার
স্বপ্ন হামদর্দের সেবা থেকে বাংলাদেশের একজন মানুষও বাদ পড়বে না। মৃত্যুর
আগে আমি এটা দেখে যেতে চাই।
No comments