মাহমুদ আব্বাস এখন কেন ক্ষমতা ছাড়তে চান?

নিজেদের দেশে এক বছরের ওপরে নৃশংসভাবে গণহত্যা চালাচ্ছে ইসরাইল। কমপক্ষে ৪৪ হাজার নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। কয়েক লাখ মানুষ অনাহারে। লাখের ওপরে আহত। রক্তে সয়লাব শুকনো মাটি। কংক্রিটের স্তূপে চাপা পড়েছে মানুষ, তাদের জীবন, জীবিকা। অথচ সেই দেশে এখন প্রেসিডেন্ট আছেন। এই ভয়াবহ যুদ্ধে তার মুখে তেমন কোনো কথা শোনা যায়নি। আন্তর্জাতিক দুনিয়া তার দেশ নিয়ে সোচ্চার হলেও তিনি দৃশ্যত নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমিয়েছেন। যেন তার কিছুই এসে যায় না। আঁচড়টা তো আর তার গায়ে লাগছে না। তিনি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। শেষ পর্যন্তু ভগ্নস্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে পারেন বলে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে অনলাইন আল-জাজিরা। এতে বলা হয়েছে, ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য যদি তিনি পদে অব্যাহতভাবে দায়িত্ব চালাতে অপারগ হন তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট কে হবেন তাও তিনি ঠিক করে রেখেছেন। এমন হলে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে তিনি মনোনীত করেছেন রাওহি ফাতু’কে। মাহমুদ আব্বাসের সময়ে তার দেশে, বিশেষ করে গাজা, পশ্চিমতীরে ইসরাইল যে নৃশংসতা চালাচ্ছে এবং তার যে গভীর অচেতন ভাব- তাতে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন আব্বাস। তার বয়স এখন ৮৯ বছর। নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও)। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে তিনি ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তারপর আর কোনো নির্বাচন দেননি। সেই থেকে তিনিই ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট। এটা নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা আছে। তিনি কেন এখন উত্তরসূরি মনোনীত করছেন এবং তা কীভাবে হবে তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। উল্লেখ্য, ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির অধীনে ফিলিস্তিনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। তখন ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তখনকার ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ও ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। গাজায়, পশ্চিমতীরে এবং পূর্ব জেরুজালেমে দখলীকৃত অংশে বসবাসকারী ফিলিস্তিনিদের জন্য শিক্ষা, নিরাপত্তা, পানির সুবিধা ও বিদ্যুতের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার দায়িত্ব পায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ। অসলো চুক্তিতে পশ্চিমতীরকে তিনটি ভাগে ভাগ করে দেয়া হয়। তা হলো- এরিয়া-এ, বি এবং সি। এর মধ্যে এরিয়া-এ’তে ফিলিস্তিনকে নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয়। এরিয়া-বি’তে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয়। কিন্তু এসব নিয়ম লঙ্ঘন করে দখলীকৃত পুরো পশ্চিমতীরে নিয়মিত সহিংস ঘেরাও দিতে থাকে ইসরাইলিরা। সমালোচকরা বলেন, এ সময়ে ইসরাইলি দখলদারদের পক্ষে নিরাপদ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ।

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট অসলো চুক্তির অধীনে ১৯৯৯ সালের মধ্যে গাজা ও পশ্চিমতীরকে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মধ্যে আনার কথা বলা হয়েছিল। এর রাজধানী করার কথা ছিল পূর্ব জেরুজালেমকে। কিন্তু চুক্তিটি স্বাক্ষরের ঠিক এক বছরের মধ্যে পশ্চিমতীরে বেআইনি বসতি নির্মাণ শুরু করে ইসরাইল। ইসরাইলের উগ্র ডানপস্থি এক জাতীয়তাবাদী হত্যা করে আইজ্যাক রবিনকে। এতে দখল করে নেয়া ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ইসরাইল যে আর ফিরিয়ে দেবে সেই আশা ম্লান হয়ে যায়। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে অব্যাহতভাবে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নেতৃত্বে থেকে যান মাহমুদ আব্বাস, যদিও তার মেয়াদ টেকনিক্যালি শেষ হয়ে যায় ২০০৯ সালে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে ফিলিস্তিনে বিজয়ী হয় যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস। তাদেরকে স্বীকৃতি দেয়নি ইসরাইল। তারা বিজয়ী হওয়ার ফলে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করার জন্য পশ্চিমা দাতারা তাদের তহবিল ফ্রিজ করে ফেলে। তবে ফিলিস্তিনকে যতদিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি না দেবে, ততদিন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায় ফিলিস্তিন। এর ফলে হামাস ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী দল ফাতাহ’র মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির উদ্যোগ নেয়া হয়। ফাতাহর নেতৃত্বে আছেন মাহমুদ আব্বাস। ক্ষমতা ভাগাভাগির উদ্যোগ নেয়া হলেও দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ চলতে থাকে। গাজা থেকে ফাতাহকে বের করে দেয় হামাস। তখন থেকে দখল হয়ে যাওয়া পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনকে প্রতিনিধিত্ব করছে ফাতাহ। কিন্তু তারা ইসরাইলের আগ্রাসন থামাতে ব্যর্থ হচ্ছে। হারাচ্ছে জনপ্রিয়তা। বিশ্লেষকরা বলেন, সেই থেকে পার্লামেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এড়িয়ে চলছেন মাহমুদ আব্বাস। কারণ, তার আশঙ্কা নির্বাচন দিলে হামাসের কাছে হারতে হবে। হারলেই তার প্রেসিডেন্ট পদ চলে যাবে। তা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিরা আশা করেন ২০২১ সালের মে মাসে তারা ভোট দেবেন। কিন্তু সেই ভোটও স্থগিত করেন আব্বাস। এর জন্য তিনি ইসরাইলের কাঁধে দোষ চাপান। বলেন, দখলীকৃত পূর্ব জেরুজালেমে ভোটের অনুমতি দেয়নি ইসরাইল।

ওদিকে মাত্র কয়েকদিনে তিনি তার উত্তরসূরি মনোনীত করেছেন। তিনি হলেন- প্যালেস্টাইনিয়ান লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সাবেক স্পিকার, প্যালেস্টাইনিয়ান ন্যাশনাল কাউন্সিলের বর্তমান স্পিকার এবং ফাতাহ’র সেন্ট্রাল কমিটির সদস্য রাওহি ফাতু। যদি আব্বাস প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে নতুন নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত ৯০ দিনের জন্য প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা পাবেন রাওহি ফাতু। ইয়াসির আরাফাত ২০০৪ সালে মারা যাওয়ার পর তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ক্ষমতালোভী নন। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) ফিলিস্তিনের রাজনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ তাহানি মুস্তাফা বলেন, যদি নতুন একজন নেতা নির্বাচিত হন তাহলে তিনি এ পদ থেকে সরে যাবেন। তার কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। তিনি ক্ষমতার শিখা হস্তান্তর করবেন।
কিন্তু মাহমুদ আব্বাস কেন এখন ক্ষমতা ছাড়তে চাইছেন? রিপোর্টে বলা হয়েছে এর কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে চাপ।  সেপ্টেম্বরে বেশ কিছু আরব ও ইউরোপিয়ান দেশের সঙ্গে মিত্রতা করে সৌদি আরব বলে তারা ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ বন্ধে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের জন্য চাপ দিচ্ছে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে অর্থশূন্য ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ৬ কোটি ডলার অর্থ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় রিয়াদ। আইসিজি’র মুস্তাফা বলেন, এই অর্থের মধ্যে চূড়ান্ত দফার এক কোটি ডলার হস্তান্তরের জন্য সৌদি আরব শর্ত দিয়েছে। তা হলো মাহমুদ আব্বাসকে তার উত্তরসূরি বাছাই করতে হবে। ওদিকে এখনও ফাতাহর প্রধান মাহমুদ আব্বাস। তিনি এরই মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ- চেয়ারম্যান মাহমুদ আল আলুলকে তার পরে দলের জন্য বাছাই করেছেন বলে শোনা যায়। আরও বড় কথা হলো- এখনও পিএলও’র প্রধান হিসেবে এর নেতৃত্ব দেন মাহমুদ আব্বাস। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চেয়ে অধিক শক্তিধর পিএলও।

mzamin


No comments

Powered by Blogger.