ড্রাইভিং না মাস্তানি by শামীমুল হক
সড়ক
সন্ত্রাসে জেরবার মিনারার পরিবার। স্বামী-সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলেন তিনি।
কিন্তু সড়ক সন্ত্রাস তার স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। মিনারার স্বামী
রফিকুল ইসলাম ছিলেন সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা। সেদিন মতিঝিলের অফিস থেকে
লোকাল বাসে যাচ্ছিলেন বাসায়। সায়েদাবাদ জনপথ মোড়ে বাসটি মাঝ সড়কে নামিয়ে
দেন তাকে। বাস থেকে নামার পরই আরেকটি বাস রং সাইড দিয়ে ক্রস করতে যায়।
দুই বাসের মাঝে পড়েন রফিক। দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে
যাওয়া হয়। ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। দুই বাসের চাপায় রফিকের বুকের
হাড় ভেঙে যায়। এরই সঙ্গে রফিকের সংসারের পাঁজরও ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। দুই
সন্তানসহ মিনারার এখন শুধুই সম্বল কান্না। মিনারা বলেন, ড্রাইভাররা ঘাতক।
ওরা সন্ত্রাসী। স্টিয়ারিং ওদের অস্ত্র। রাজধানীতে গতকাল বেশক’টি স্পটে
দাঁড়িয়ে দেখা গেছে সড়কে চলন্ত বাসের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা করতে
গিয়েই কলেজছাত্র রাজীবের হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শরীর থেকে। পাশাপাশি লেগে
থাকা দুটি বাসের মধ্যে ঝুলে থাকে রাজীবের হাতটি। এ দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেন
সবাই। বাসযাত্রীরা মনে করেন ড্রাইভাররা সন্ত্রাসী। সন্ত্রাসের কারণেই এ
ঘটনা ঘটিয়েছে। গতকাল লাব্বাইক বাসের যাত্রী নজরুল ইসলাম বলেন, একটি বাসে
কম করে হলেও ৫০ থেকে ৬০ জন যাত্রী থাকে। এসব যাত্রী মাত্র তিনজনের কাছে
জিম্মি। হেলপার, কন্ডাক্টর ও ড্রাইভারের কর্মকাণ্ডে যাত্রীরা অতিষ্ঠ।
তানিয়া রহমান নামের এক যাত্রী তার ফেসবুকে মন্তব্য করেছেন অফিস থেকে বাসায়
ফেরার সময় অনেকটা রিস্ক নিয়ে বাসে উঠতে হয়। রাজীবের হাতের ছবি দেখে আঁতকে
ওঠার পাশাপাশি কুঁকড়েও গেছি। বাসের ড্রাইভারদের অমানবিক প্রতিযোগিতা কি করে
বন্ধ হবে জানি না। যাত্রীরা যখন চিৎকার করে তখন ড্রাইভাররা বেপরোয়া চালায়।
কিন্তু ড্রাইভার কিছুই শুনে না। বৃহস্পতিবার বেলা ১০টায় কাওরানবাজার
সিগন্যালের কাছে মিরপুর থেকে নারায়ণগঞ্জগামী হিমাচল পরিবহনের একটি বাস
হালকা ভাবে থামায়। একজন যাত্রী উঠতে না উঠতেই চালক গাড়ি টান দেয়। এতে ওই
যাত্রী নিচে পড়ে যান। তার হাতটি তখনও ধরা বাসে ওঠার দরজায়। এভাবে তাকে
কিছুক্ষণ টেনে নেয়। এক পর্যায়ে যাত্রী হাত ছেড়ে দেন। ততক্ষণে যাত্রীর
প্যান্ট ছিঁড়ে পায়ের ও হাতের চামড়া উঠে গেছে। আরিফ নামের একজন যাত্রী বলেন,
ড্রাইভারদের সন্ত্রাসের প্রতিযোগিতা চলে সড়ক-মহাসড়কে। প্রতিদিনই পাল্লা
দিয়ে, ঘষাঘষি করে বাস চলে। যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে যান। কিন্তু ড্রাইভাররা
মনে হয় এতে আনন্দ পান। উল্লাস করেন। তিনি বলেন, রাজীবের হাতের ছবিটা
ড্রাইভার সন্ত্রাসের একটি নমুনা মাত্র। প্রতিদিন এমন কত যে ঘটনা ঘটে তার
ইয়ত্তা নেই। ক’টিইবা মিডিয়ায় আসে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সড়কে পরিবহন
চলাচলের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় যাত্রীদের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়। নগরীর
রাস্তায় কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। সবাই জিম্মি ড্রাইভারদের কাছে। সরকারি তিতুমীর
কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন যাত্রাবাড়ীর একটি মেসে
থাকেন। সেখান থেকে রাজীব মঙ্গলবার দুপুরে একটি বিআরটিসি বাসে উঠেছিলেন
কলেজে যাওয়ার জন্য। রাজধানীর ভিআইপি সড়ক হিসেবে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম
সড়কের সার্ক ফোয়ারার কাছে ব্যক্তি মালিকানাধীন স্বজন পরিবহনের একটি বাস
সেখানে দ্রুতগতিতে এসে বিআরটিসি বাসটির গা-ঘেঁষে এগোতে থাকে। রাজীব
বিআরটিসি বাসের দরজায় ঝুলে যাচ্ছিলেন। বাস দু’টির রেষারেষিতে রাজীব রাস্তায়
পড়ে মাথায় আঘাত পান। আর তার ডান হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই বাসের
মাঝখানে ঝুলতে থাকে। রাজীব এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রাজীবের স্বজনরা
জানিয়েছেন পটুয়াখালীর বাউফল এলাকার রাজীব ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছেন।
তার দু’টি ছোট ভাই আছে। তাদের তিন ভাইকেই চাচা-মামারা ভাগাভাগি করে লেখাপড়া
করাচ্ছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট রিসার্চ
ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শামসুল হক বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সঠিক
ব্যবস্থাপনার অভাবে পরিস্থিতি প্রতিদিনই খারাপ হচ্ছে। তিনি বলেন,
সিস্টেমটাই খুব বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। আমরা যা দেখি, আসলে উপসর্গটা দেখি। আমরা
এমন কোনো পরিকল্পনা করিনি যেখানে বাস ড্রাইভাররা সুষ্ঠুভাবে গাড়ি চালাবে।
আমরা যখন যে এসেছে, রুট পারমিট দিয়েছি। মালিকরাও ফিক্সড ইনকামে চলে গেছে।
ফলে দিনের শেষে এখন চালকরাই ব্যবসাটা করছে পুরো রাস্তায়। এ ব্যাপারে একাধিক
পরিবহন মালিকের সঙ্গে কথা বললে তারাও রাস্তার পরিস্থিতির জন্য
ব্যবস্থাপনার অভাবের কথা তুলে ধরেন। আট নম্বর বাসের একজন মালিক খায়রুল
ইসলাম বলেন, ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা হলে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব
হ্রাস পাবে। গতকাল সকাল ৯টায় গুলিস্তান হলের সামনে দাঁড়িয়ে দেখা যায় গাড়ি
চারদিক থেকে আসছে। হলের সামনে যাত্রীরা বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। শিকড়
পরিবহনের একটি গাড়ি যাত্রী তুলছিল। এ সময় অপর একটি শিকড় গাড়ি পেছন দিক থেকে
ওই গাড়িটিকে ধাক্কা দেয়। এ সময় একজন যাত্রী উঠতে গিয়ে রাস্তায় ছিটকে পড়েন।
কিন্তু এ দিকে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। পেছনের গাড়ির চালক মতিন জানান, ওই গাড়ি
আমার আগের সিরিয়ালের। ও কেন আমার গাড়ি আসার পরও দাঁড়িয়ে থাকবে? ধাক্কা না
দিলে সে যাবে না। তাই ধাক্কা দিয়েছি। একটু এগিয়ে পল্টন মোড়ে দেখা যায়,
মনজিল পরিবহনের দুটি বাস ঘষাঘষি করে চলছে। এভাবে মিনিট খানেক চলার পর একটি
গাড়ির গ্লাস ভেঙে সড়কে পড়ে যায়। আর দুটি বাসের ভেতর থেকেই যাত্রীরা চিৎকার
করছিল। কিন্তু কে শুনে কার কথা। প্রায়ই দেখা যায়, এক গাড়ি অন্য গাড়িকে সাইড
না দেয়ার দৃশ্য। এক পর্যায়ে পেছনের গাড়ি একটু সুযোগ পেলেই গাড়ি এগিয়ে দেয়।
এ অবস্থায় লুকিং গ্লাস ভেঙে যায়। কখনো কখনো যাত্রীরা আঘাতপ্রাপ্ত হন। সড়কে
ড্রাইভারদের সন্ত্রাসের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এ সন্ত্রাসে হাজারো পরিবারকে
জীবনভর কান্নার সাগরে ভাসতে হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে চালকদের কোনো ভ্রুক্ষেপ
নেই। ট্রাফিক পুলিশও দায়সারা দায়িত্ব পালন করে। মাজিদুল আলম নামের এক
যাত্রী বলেন, গাড়িতে মূল স্ট্যান্ড থেকে ওঠার সময় ধীরস্থির ভাবে উঠলেও পথে
পথে গাড়ি চলন্ত অবস্থায় যাত্রীদের উঠতে হচ্ছে। আবার নামতে গেলে কখনো সড়কের
মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে নামতে বলে চালক আর হেলপার। এভাবে রিস্ক নিয়ে রাজধানীর
যাত্রীদের চলাচল করতে হচ্ছে। বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয়
কমিটি (এনসিপিএসআরআর) এ জন্য সাত কারণকে চিহ্নিত করেছে। সংগঠনের মহাসচিব
আশীষ কুমার দে জানিয়েছেন, যাত্রীদের অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে চালকদের
কাছে। তিনি সাতটি কারণের মধ্যে প্রথম কারণ উল্লেখ করেন বেপরোয়া গতিতে গাড়ি
চালানোকে। এছাড়া অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, নিয়ম ভঙ্গ করে
ওভারলোডিং ও ওভারটেকিং করার প্রবণতা, চালকদের দীর্ঘক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি
চালানো, ট্রাফিক আইন যথাযথভাবে অনুসরণ না করা, ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চলাচল
বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও বেহাল সড়ককে দায়ী
করেন। সড়ক দুর্ঘটনার ওপর ওই সংগঠনের জরিপে ওঠে এসেছে ভয়াবহ তথ্য। গত ১২
বছরে সারা দেশে ৫১৬৬৯টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৫৭২২৬
জন। আহত হয়েছেন ৯৩৫০৬ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৪ সালে
৫৯৯৭টি, যাতে ৮৭৯৮ জন নিহত ও ১৮১১৩ জন আহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম দুর্ঘটনা
ঘটেছে ২০১৬ সালে ২৯৯৮টি। এতে নিহত হয়েছেন ৩৪১২ ও আহত হয়েছেন ৮৫৭২। এ
ব্যাপারে এনসিপিএসআরআর-এর মহাসচিব আশীষ কুমার দে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে
হলে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বছরজুড়ে গঠনমূলক সংবাদ
প্রচার অব্যাহত রাখতে হবে। দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সামাজিক সংগঠনগুলোর
ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও জাল ড্রাইভিং
লাইসেন্সের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা ও
পুলিশের দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ অনেক বাঁক চিহ্নিত করে
সতর্কীকরণ সংকেত স্থাপন ও সড়ক সংস্কার অব্যাহত রাখতে হবে। তিনি বলেন, সবার
আগে চালকদের প্রতিযোগিতা করে গাড়ি চালানো বন্ধ করতে হবে। এজন্য কঠোর
নজরদারি করতে হবে। সড়কগুলোকে লেনে ভাগ করে নির্দিষ্ট গাড়িকে লেনের বাইরে
চলাচল নিষিদ্ধ করতে হবে।
No comments