মানব পাচার বন্ধে যৌথ কমিশন গঠন করুন -সাক্ষাৎকারে : ড. তাসনীম সিদ্দিকী by ফারুক ওয়াসিফ ও সুজয় মহাজন
ড. তাসনীম সিদ্দিকী |
ড. তাসনীম সিদ্দিকীর
জন্ম ১৯৫৯ সালে, ঢাকায়। ঢাকার হলিক্রস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে
উচ্চমাধ্যমিক সমাপ্ত করে প্রবেশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৪ সালে
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে সে বছরই ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দেন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। ফুলব্রাইট পান যুক্তরাষ্ট্রের
কার্বনডেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। এ ছাড়া তিনি রিফিউজি অ্যান্ড
মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন
করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ ও সুজয় মহাজন
প্রথম আলো : বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, অবৈধ অভিবাসন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ রকম সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরও কেন তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না?
তাসনীম সিদ্দিকী : এ আইনটিতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। আইনে অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির কথা বলা হলেও ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। আমরা আইনটি যেভাবে দেখতে বা পেতে চেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তেমনটি হয়নি। আইনে অবৈধ পথে ও প্রক্রিয়ায় কর্মী প্রেরণকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও আছে। কিন্তু দুর্বলতা রয়েছে এটির বিচার–প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। আইনে মোবাইল আদালতেও এ ধরনের অপরাধের বিচারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মোবাইল আদালতের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা খুবই সীমিত। সে ক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত দালাল বা অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। আইনটিতে এমন কয়েকটি বিচারিক আদালতে এ ধরনের অপরাধের বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাঁদের আসলে এক বছরের বেশি শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
প্রথম আলো : এ আইনের অধীনে এখন পর্যন্ত কতজন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?
তাসনীম সিদ্দিকী : নতুন আইনে এখন পর্যন্ত দেশে কোনো মামলা হয়নি। তাই এ–সংক্রান্ত বিষয়ে আইনি প্রতিকার চেয়ে আমরা উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছি এবং তাতে রুলও পেয়েছি। হাইকোর্ট এই আইনের অধীনে দালালদের বিরুদ্ধে কেন মামলা দায়ের করা হচ্ছে না, তার কারণ দর্শানোর আদেশ জারি করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনীর প্রতি। কিন্তু চার সপ্তাহের ভেতর উত্তর দিতে বলা হলেও এক মাস পরও কেউ কোনো কারণ দর্শায়নি বলে আমরা পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি।
প্রথম আলো : এ আইনের দুর্বলতার দিক আর কী কী?
তাসনীম সিদ্দিকী : যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধ অভিবাসনের শিকার হন, তাহলে ওই ব্যক্তিরও শাস্তির বিধান রয়েছে এ আইনে। বিশ্বের কোনো দেশের আইনে এ ধরনের বিধান নেই। যত দ্রুত সম্ভব আইনের এ ধারাটি বাদ দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহির বাইরে রাখা হয়েছে।
প্রথম আলো : অবৈধ পথে বিদেশ গিয়ে যেসব বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার আইনি বন্দোবস্ত কী?
তাসনীম সিদ্দিকী : আইনে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে বৈধ অভিবাসীদের বেলায় অন্যায়ের কারণে চাকরিচ্যুত হন তাহলে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা আইনে বলা আছে। বৈধ অভিবাসী বিদেশে মৃত্যুবরণ করলেও লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এ জন্য বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে বছরে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় বাংলাদেশিদের চাঁদাই ভরসা।
প্রথম আলো : অবৈধ পথে অভিবাসন বন্ধে আন্তর্জাতিক কোনো উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে আপনি মনে করেন কি?
তাসনীম সিদ্দিকী : অবৈধ পথে অভিবাসন এখন শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না। এটির সঙ্গে বেশ কটি দেশ জড়িত। তাই এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে আন্তরাষ্ট্রীয় যৌথ কমিশন গঠন করতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে জাতিসংঘ এবং সার্ক ও আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার ফোরামের ভেতর জোরালোভাবে আলোচনা করতে হবে।
প্রথম আলো : মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের সুবিধার্থে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) চুক্তি হয়েছে। তবু কেন অবৈধ পথে মালয়েশিয়াগামী লোকের সংখ্যা বাড়ছে?
তাসনীম সিদ্দিকী : বাস্তবতা বিবেচনায় বলতে গেলে এ উদ্যোগটি একপ্রকার ব্যর্থ হয়েছে। এ চুক্তির আওতায় গত চার বছরে সাড়ে সাত হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। অথচ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের চাহিদার বিবেচনায় এ সময়ের মধ্যে অন্তত পাঁচ লাখ কর্মী ওই দেশে যাওয়ার কথা। এ চুক্তিটি ব্যর্থ হওয়ায় অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। দুভাবে এ অবৈধ অভিবাসনটি হচ্ছে। একটি হলো, যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তাঁরা ভ্রমণ বা বেড়ানোর নামে ভিসা নিয়ে বিমানে ওই দেশে গিয়ে থেকে যাচ্ছেন। আর যাঁদের ওই সামর্থ্য নেই, তাঁরা দালালদের প্রলোভনে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
প্রথম আলো : জীবনের ঝুঁকি জেনেও কেন ও কারা যাচ্ছেন?
তাসনীম সিদ্দিকী : বিভিন্নভাবে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অতি দরিদ্র মানুষগুলো দালালদের প্রলোভনে পড়ে পাচারের শিকার হচ্ছেন। যাঁরা একসময় জীবনের তাগিদে দেশের মধ্যে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরের কথা চিন্তাও করতেন না, তাঁরাই এখন সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের সামনে শ্রেণি উত্তরণের আর কোনো পথ নেই।
প্রথম আলো : আপনি বলছেন, সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছে। এ রকম একটি ভালো উদ্যোগ কেন ব্যর্থ হলো বলে মনে করছেন?
তাসনীম সিদ্দিকী : সরকারিভাবে কর্মী প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণের দাবিটি দুই দেশের বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তুলেছিল। আমরাও এ দাবি করেছিলাম। কারণ, বেসরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর ফলে বেশির ভাগ সময়ই কর্মীরা হয়রানির শিকার হতেন। তাই চুক্তিটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু এটির সুফল পেতে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের দরকার ছিল, সরকারের দিক থেকে তা করা হয়নি। যদি সরকারের উচিত ছিল ওই দেশে প্রশিক্ষিত মার্কেটিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া, যাতে করে তারা নিয়োগদাতাদের কাছে ঘুরে ঘুরে ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করে আনা। শুধু অনলাইনে দিয়ে রাখলেই হবে না। সরকারের চিন্তাচেতনা ও কার্যক্রম বেসরকারি খাতে যেভাবে দক্ষতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয় হয়, সে রকম হতো, তাহলে এ রকম একটি উদ্যোগ কখনোই ব্যর্থ হতো না বলে অন্তত আমার ধারণা।
প্রথম আলো : অবৈধ অভিবাসন বা অবৈধ পথে লোক পাচার বন্ধ করতে হলে কী করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
তাসনীম সিদ্দিকী : এটির উৎসে নজর দিতে হবে। যাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাঁদের প্রচলিত জীবনযাত্রা হারিয়েছেন, তাঁদেরই একাংশ যাচ্ছেন। দারিদ্র্যের কারণে তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক পথে অভিবাসনের সুবিধা নিতে পারছে না। জলবায়ু-দুর্গত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে সরকারকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। আমাদের মাইগ্রেশন প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যেতে হবে তাদের কাছে। জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিলের অর্থ হাঁস-মুরগি পালন, দড়ি বা মোমবাতি বানানো বা সবজি চাষের প্রশিক্ষণ দান এবং দুর্যোগসহ জাতের ধানবীজ রোপণ করে আয় খুম কম। বরং ড্রাইভিং, কারিগরি শিক্ষাসহ যেসব দক্ষতা চাকরিদাতা দেশগুলোতে প্রয়োজন, সেসব বিষয়ে উঁচুমানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়তে হবে। এসব কাজের সুফল দেশেও তারা পাবে, আবার বাইরের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগে চাকরিও পাবে। সরকারের উচিত বিএমইটি (Bureau of Manpower, Employment and Training)-এর কার্যালয় ওসব এলাকায় নিয়ে যাওয়া। আমাদের আরবান গ্রোথ সেন্টার সৃষ্টি করতে হবে সারা দেশে, যাতে সবাইকে ঢাকায় আসতে না হয়। বাংলাদেশকে অভিবাসন নিয়ে বড় আকারে চিন্তা করতে হবে। আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বতন্ত্র অধ্যায় না রেখে প্রতিটি অধ্যায়ে অভিবাসনকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা থাকতে হবে।
প্রথম আলো : সম্প্রতি কয়েকজন অবৈধ পাচারকারী নিহত হওয়ার খবর আসছে, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
তাসনীম সিদ্দিকী : এখন দেখতে পাচ্ছি, যখন দেশে-বিদেশে জোর সমালোচনা করা হচ্ছে, তখন সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। এই চাপের মুখে কিছু করা সরকারের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমরা হতাশ হচ্ছি এটা দেখে যে, এদের ধরে এনে বিচার করার বদলে তাদের কেউ কেউ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাচ্ছে। এতে করে সমস্যার গোড়ায় আর হাত দেওয়া যাচ্ছে না। মানব পাচার সমস্যাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনায় সরকার সত্যিই আন্তরিক কি না, এসব দেখে সেই সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো : যাদের থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় উদ্ধার করা হচ্ছে, তাদের বিষয়ে এখন কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী : যেখানে যে অবস্থায় তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে তাদের দ্রুত সুব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা। যারা ফিরে আসছেন তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন। এদের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন মানসিক পরিচর্যা (কাউন্সেলিং)। তারপর প্রয়োজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসন। সে ক্ষেত্রে সরকারের এখন যে প্রবাসীকল্যাণ তহবিল আছে, সেখান থেকে সেবার সুযোগ এঁরা পাবেন না। আইন অনুযায়ী শুধু বৈধ অভিবাসীরাই তা পেতে পারেন। তাই সরকারের উচিত দ্রুত একটা তহবিল গঠন করা, উন্নয়ন বা রাজস্ব বাজেট থেকে টাকা এনে এদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা। লিবিয়া-ফেরত কর্মীদের যেভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এককালীন সহযোগিতা করা হয়েছিল, সে রকম করে নয়, বরং তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করতে হবে। এটুকু টাকা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করার দরকার নেই, এটুকু টাকা রাষ্ট্রেরই খরচ করা উচিত।
প্রথম আলো : বাংলাদেশিদের পাচারের সঙ্গে তো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাও জড়িত, ওই বিষয়েও তো সমাধান লাগবে।
তাসনীম সিদ্দিকী : যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে এই অবৈধ পথে অভিবাসনের যোগসূত্র রয়েছে, সেহেতু আমরা দাবি করছি, পূর্বের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার যে সরকারি নীতি, তা থেকে সরকার বেরিয়ে আসবে। বরং আন্তর্জাতিক পরিসরে এই সমস্যার সমাধানের আওয়াজ তুলতে হবে। প্রতিবেশী হিসেবে একদিকে আমরা তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখছি, অন্যদিকে আমরাও আক্রান্ত হচ্ছি।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তাসনীম সিদ্দিকী : ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসন আইন, ২০১৩ অনুযায়ী, অবৈধ অভিবাসন শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ রকম সুনির্দিষ্ট আইন থাকার পরও কেন তা রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না?
তাসনীম সিদ্দিকী : এ আইনটিতে অনেক দুর্বলতা রয়েছে। আইনে অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির কথা বলা হলেও ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। আমরা আইনটি যেভাবে দেখতে বা পেতে চেয়েছিলাম শেষ পর্যন্ত তেমনটি হয়নি। আইনে অবৈধ পথে ও প্রক্রিয়ায় কর্মী প্রেরণকে আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধানও আছে। কিন্তু দুর্বলতা রয়েছে এটির বিচার–প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। আইনে মোবাইল আদালতেও এ ধরনের অপরাধের বিচারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মোবাইল আদালতের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা খুবই সীমিত। সে ক্ষেত্রে অবৈধ অভিবাসনের সঙ্গে যুক্ত দালাল বা অপরাধীরা পার পেয়ে যাবে। আইনটিতে এমন কয়েকটি বিচারিক আদালতে এ ধরনের অপরাধের বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যাঁদের আসলে এক বছরের বেশি শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা নেই।
প্রথম আলো : এ আইনের অধীনে এখন পর্যন্ত কতজন অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে?
তাসনীম সিদ্দিকী : নতুন আইনে এখন পর্যন্ত দেশে কোনো মামলা হয়নি। তাই এ–সংক্রান্ত বিষয়ে আইনি প্রতিকার চেয়ে আমরা উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেছি এবং তাতে রুলও পেয়েছি। হাইকোর্ট এই আইনের অধীনে দালালদের বিরুদ্ধে কেন মামলা দায়ের করা হচ্ছে না, তার কারণ দর্শানোর আদেশ জারি করেছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং আইনশৃঙ্খলা প্রয়োগকারী বাহিনীর প্রতি। কিন্তু চার সপ্তাহের ভেতর উত্তর দিতে বলা হলেও এক মাস পরও কেউ কোনো কারণ দর্শায়নি বলে আমরা পত্রিকা মারফত জানতে পেরেছি।
প্রথম আলো : এ আইনের দুর্বলতার দিক আর কী কী?
তাসনীম সিদ্দিকী : যদি কোনো ব্যক্তি অবৈধ অভিবাসনের শিকার হন, তাহলে ওই ব্যক্তিরও শাস্তির বিধান রয়েছে এ আইনে। বিশ্বের কোনো দেশের আইনে এ ধরনের বিধান নেই। যত দ্রুত সম্ভব আইনের এ ধারাটি বাদ দেওয়া দরকার। এ ছাড়া আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহির বাইরে রাখা হয়েছে।
প্রথম আলো : অবৈধ পথে বিদেশ গিয়ে যেসব বাংলাদেশি মৃত্যুবরণ করেন, তাঁদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার আইনি বন্দোবস্ত কী?
তাসনীম সিদ্দিকী : আইনে সুস্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে বৈধ অভিবাসীদের বেলায় অন্যায়ের কারণে চাকরিচ্যুত হন তাহলে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথা আইনে বলা আছে। বৈধ অভিবাসী বিদেশে মৃত্যুবরণ করলেও লাশ দেশে আনার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এ জন্য বিদেশে বাংলাদেশি মিশনগুলোকে বছরে যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় বাংলাদেশিদের চাঁদাই ভরসা।
প্রথম আলো : অবৈধ পথে অভিবাসন বন্ধে আন্তর্জাতিক কোনো উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে আপনি মনে করেন কি?
তাসনীম সিদ্দিকী : অবৈধ পথে অভিবাসন এখন শুধু বাংলাদেশের সমস্যা না। এটির সঙ্গে বেশ কটি দেশ জড়িত। তাই এসব সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে হলে আন্তরাষ্ট্রীয় যৌথ কমিশন গঠন করতে হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, বিশেষ করে জাতিসংঘ এবং সার্ক ও আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতার ফোরামের ভেতর জোরালোভাবে আলোচনা করতে হবে।
প্রথম আলো : মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের সুবিধার্থে দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে (জিটুজি) চুক্তি হয়েছে। তবু কেন অবৈধ পথে মালয়েশিয়াগামী লোকের সংখ্যা বাড়ছে?
তাসনীম সিদ্দিকী : বাস্তবতা বিবেচনায় বলতে গেলে এ উদ্যোগটি একপ্রকার ব্যর্থ হয়েছে। এ চুক্তির আওতায় গত চার বছরে সাড়ে সাত হাজার কর্মী মালয়েশিয়া গেছেন। অথচ মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের চাহিদার বিবেচনায় এ সময়ের মধ্যে অন্তত পাঁচ লাখ কর্মী ওই দেশে যাওয়ার কথা। এ চুক্তিটি ব্যর্থ হওয়ায় অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। দুভাবে এ অবৈধ অভিবাসনটি হচ্ছে। একটি হলো, যাঁদের আর্থিক সামর্থ্য আছে তাঁরা ভ্রমণ বা বেড়ানোর নামে ভিসা নিয়ে বিমানে ওই দেশে গিয়ে থেকে যাচ্ছেন। আর যাঁদের ওই সামর্থ্য নেই, তাঁরা দালালদের প্রলোভনে পড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে মালয়েশিয়ার যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
প্রথম আলো : জীবনের ঝুঁকি জেনেও কেন ও কারা যাচ্ছেন?
তাসনীম সিদ্দিকী : বিভিন্নভাবে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অতি দরিদ্র মানুষগুলো দালালদের প্রলোভনে পড়ে পাচারের শিকার হচ্ছেন। যাঁরা একসময় জীবনের তাগিদে দেশের মধ্যে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরের কথা চিন্তাও করতেন না, তাঁরাই এখন সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন। কারণ, তাঁদের সামনে শ্রেণি উত্তরণের আর কোনো পথ নেই।
প্রথম আলো : আপনি বলছেন, সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণের উদ্যোগটি ব্যর্থ হয়েছে। এ রকম একটি ভালো উদ্যোগ কেন ব্যর্থ হলো বলে মনে করছেন?
তাসনীম সিদ্দিকী : সরকারিভাবে কর্মী প্রেরণের উদ্যোগ গ্রহণের দাবিটি দুই দেশের বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তুলেছিল। আমরাও এ দাবি করেছিলাম। কারণ, বেসরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর ফলে বেশির ভাগ সময়ই কর্মীরা হয়রানির শিকার হতেন। তাই চুক্তিটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। কিন্তু এটির সুফল পেতে যেসব ব্যবস্থা গ্রহণের দরকার ছিল, সরকারের দিক থেকে তা করা হয়নি। যদি সরকারের উচিত ছিল ওই দেশে প্রশিক্ষিত মার্কেটিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া, যাতে করে তারা নিয়োগদাতাদের কাছে ঘুরে ঘুরে ওয়ার্ক পারমিট জোগাড় করে আনা। শুধু অনলাইনে দিয়ে রাখলেই হবে না। সরকারের চিন্তাচেতনা ও কার্যক্রম বেসরকারি খাতে যেভাবে দক্ষতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয় হয়, সে রকম হতো, তাহলে এ রকম একটি উদ্যোগ কখনোই ব্যর্থ হতো না বলে অন্তত আমার ধারণা।
প্রথম আলো : অবৈধ অভিবাসন বা অবৈধ পথে লোক পাচার বন্ধ করতে হলে কী করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
তাসনীম সিদ্দিকী : এটির উৎসে নজর দিতে হবে। যাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাঁদের প্রচলিত জীবনযাত্রা হারিয়েছেন, তাঁদেরই একাংশ যাচ্ছেন। দারিদ্র্যের কারণে তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক পথে অভিবাসনের সুবিধা নিতে পারছে না। জলবায়ু-দুর্গত ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে সরকারকে সর্বোচ্চ নজর দিতে হবে। আমাদের মাইগ্রেশন প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে যেতে হবে তাদের কাছে। জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিলের অর্থ হাঁস-মুরগি পালন, দড়ি বা মোমবাতি বানানো বা সবজি চাষের প্রশিক্ষণ দান এবং দুর্যোগসহ জাতের ধানবীজ রোপণ করে আয় খুম কম। বরং ড্রাইভিং, কারিগরি শিক্ষাসহ যেসব দক্ষতা চাকরিদাতা দেশগুলোতে প্রয়োজন, সেসব বিষয়ে উঁচুমানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়তে হবে। এসব কাজের সুফল দেশেও তারা পাবে, আবার বাইরের সঙ্গেও সরাসরি যোগাযোগে চাকরিও পাবে। সরকারের উচিত বিএমইটি (Bureau of Manpower, Employment and Training)-এর কার্যালয় ওসব এলাকায় নিয়ে যাওয়া। আমাদের আরবান গ্রোথ সেন্টার সৃষ্টি করতে হবে সারা দেশে, যাতে সবাইকে ঢাকায় আসতে না হয়। বাংলাদেশকে অভিবাসন নিয়ে বড় আকারে চিন্তা করতে হবে। আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বতন্ত্র অধ্যায় না রেখে প্রতিটি অধ্যায়ে অভিবাসনকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার পরিকল্পনা থাকতে হবে।
প্রথম আলো : সম্প্রতি কয়েকজন অবৈধ পাচারকারী নিহত হওয়ার খবর আসছে, আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
তাসনীম সিদ্দিকী : এখন দেখতে পাচ্ছি, যখন দেশে-বিদেশে জোর সমালোচনা করা হচ্ছে, তখন সরকারের ওপর একধরনের চাপ তৈরি হয়েছে। এই চাপের মুখে কিছু করা সরকারের জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমরা হতাশ হচ্ছি এটা দেখে যে, এদের ধরে এনে বিচার করার বদলে তাদের কেউ কেউ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যাচ্ছে। এতে করে সমস্যার গোড়ায় আর হাত দেওয়া যাচ্ছে না। মানব পাচার সমস্যাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনায় সরকার সত্যিই আন্তরিক কি না, এসব দেখে সেই সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলো : যাদের থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়ায় উদ্ধার করা হচ্ছে, তাদের বিষয়ে এখন কী করণীয়?
তাসনীম সিদ্দিকী : যেখানে যে অবস্থায় তাঁদের পাওয়া যাচ্ছে সেখান থেকে তাদের দ্রুত সুব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনা। যারা ফিরে আসছেন তাঁরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন। এদের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন মানসিক পরিচর্যা (কাউন্সেলিং)। তারপর প্রয়োজন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্বাসন। সে ক্ষেত্রে সরকারের এখন যে প্রবাসীকল্যাণ তহবিল আছে, সেখান থেকে সেবার সুযোগ এঁরা পাবেন না। আইন অনুযায়ী শুধু বৈধ অভিবাসীরাই তা পেতে পারেন। তাই সরকারের উচিত দ্রুত একটা তহবিল গঠন করা, উন্নয়ন বা রাজস্ব বাজেট থেকে টাকা এনে এদের পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা। লিবিয়া-ফেরত কর্মীদের যেভাবে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এককালীন সহযোগিতা করা হয়েছিল, সে রকম করে নয়, বরং তাদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করতে হবে। এটুকু টাকা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ করার দরকার নেই, এটুকু টাকা রাষ্ট্রেরই খরচ করা উচিত।
প্রথম আলো : বাংলাদেশিদের পাচারের সঙ্গে তো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাও জড়িত, ওই বিষয়েও তো সমাধান লাগবে।
তাসনীম সিদ্দিকী : যেহেতু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে এই অবৈধ পথে অভিবাসনের যোগসূত্র রয়েছে, সেহেতু আমরা দাবি করছি, পূর্বের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার যে সরকারি নীতি, তা থেকে সরকার বেরিয়ে আসবে। বরং আন্তর্জাতিক পরিসরে এই সমস্যার সমাধানের আওয়াজ তুলতে হবে। প্রতিবেশী হিসেবে একদিকে আমরা তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট দেখছি, অন্যদিকে আমরাও আক্রান্ত হচ্ছি।
প্রথম আলো : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
তাসনীম সিদ্দিকী : ধন্যবাদ।
No comments