মানব পাচার রোধে ‘ক্রসফায়ার’ থেরাপি! by সোহরাব হাসান
ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীরা |
বিষয়টি
কাকতালীয় হতে পারে। যেদিন সরকার চলতি অর্থবছরে মানুষের মাথাপিছু আয় ১
হাজার ৩১৪ ডলারে উন্নীত হওয়ার ঘোষণা দিল, সেদিনই টিভিতে দেখলাম থাইল্যান্ড
ও মালয়েশিয়ার কূলে ভিড়তে না দেওয়া সমুদ্রে ভাসমান একটি ট্রলারে
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কয়েক শ বাংলাদেশি নারী, পুরুষ ও শিশুর আহাজারি।
রোহিঙ্গারা তাদের দেশে অবাঞ্ছিত, বিতাড়িত। সে কারণে তারা দেশে দেশে
আশ্রয়ের খোঁজে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকেরা এভাবে কেন পাচারের
শিকার হবে? স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও কেন আমরা তাদের ন্যূনতম মানবিক ও নাগরিক
সুবিধাটুকু দিতে পারলাম না? ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসির সংবাদদাতা
জোনাথন হেডের ভাষ্য, ‘সে এক করুণ দৃশ্য। আরোহীরা চিৎকার করে সাহায্য
চাইছিলেন। চাইছিলেন খাবার ও পানি। সেখানে ৫০ জন নারী ও ৮৪টি শিশুও ছিল।
পুরোনো নৌযানটি কানায় কানায় ঠাসা ছিল।...আমরা দেখেছি, তাঁদের কেউ কেউ
বোতলে রাখা নিজের প্রস্রাব পান করছেন। আমরা তাঁদের দিকে পানির বোতল ছুড়ে
দিচ্ছিলাম।’ টিভিতে দেখেছি, একটি পানির বোতল ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে, আর
অনেকগুলো মানুষ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন সেই বোতল পাওয়ার জন্য। হয়তো একজন
পেয়েছেন, আর দশজন বেজার মুখে তাকিয়ে আছেন। ক্ষুধার্ত শিশুরা কাঁদছে। কেউ
তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার নেই।
অাগের বিবরণ শুনুন। ছয় দিন আগে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তের সাগরে চালক ও সহকারীরা নৌযানটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর ইঞ্জিনও বিকল। বুধবার রাতে থাই জেলেদের সহায়তায় তাঁরা নৌযানটিকে মালয়েশিয়া উপকূলে নিয়ে যান। সেখান থেকে থাইল্যান্ড উপকূলের দিকে ঠেলে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকেও ফেরত পাঠানো হয় তাঁদের। দু-এক দিনের মধ্যে কেউ উদ্ধার না করলে কিংবা খাবার ও পানি সরবরাহ না করলে হতভাগ্য মানুষগুলোকে বাঁচানো যাবে না। না খেয়েই মারা যাবেন। তখন হয়তো সিরাজগঞ্জের, টেকনাফের কিংবা নরসিংদীর আরও অনেক ঘরে স্বজনের বুকফাটা কান্না শোনা যাবে।
বাংলাদেশে মানব পাচার হয় এখন ৪১টি জেলা থেকে। সীমান্তবর্তী সব জেলায়ই পাচারকারী চক্র সক্রিয়। কিন্তু ওই নৌযানের আরোহীরা কূলে উঠতে পারলেই বেঁচে যাবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। সেখানে তারা কোনো দালাল চক্রের হাতে বিক্রি হয়ে যাবেন। এরপর সেই দালালেরা তাদের থাইল্যান্ড কিংবা মালয়েশিয়ার গহিন জঙ্গলে নিয়ে দেশে স্বজনদের কাছে টেলিফোন করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করবে। সেই মুক্তিপণের পরিমাণ এমন যে ওই গরিব মানুষগুলোর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে গণকবরই তাদের শেষ ঠিকানা। বিদেশের মাটিতে স্বজনদের গণকবর খুঁড়তেই কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম? লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে আর কত মানুষের এই অপমান ও করুণ মৃত্যু দেখতে হবে?
এ তো একটি নৌযানের কাহিনি। এ রকম অনেকগুলো নৌযানে এ যুগের মানব দাসদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্থলপথে, বিমানপথেও পাচার হচ্ছে মানুষ। বিদেশি সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রসীমায় ভাসতে থাকা বিভিন্ন নৌযানের প্রায় আট হাজার অভিবাসী এখন তীব্র খাদ্য ও পানীয় কষ্টে রয়েছে। ক্ষুধায় ও অসুস্থতায় অনেকে মারা গেছে। কিছু নৌযানে জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে। এক সপ্তাহ ধরে আন্দামান সাগরে লক্ষ্যহীনভাবে ভাসতে থাকা একটি নৌযানের ১০ জন মারা গেছে। নৌযানটিতে খাদ্য ও পানীয় ফুরিয়ে গিয়েছিল। মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হওয়া ওই নৌযানে প্রায় ৩৫০ জন অভিবাসী ছিল। নৌযানটি থাইল্যান্ড উপকূলে এলেও দেশটি অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়নি।
বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে ভয়াবহ মানবিক সংকট বলে অভিহিত করলেও আমাদের নেতা–নেত্রীরা আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। তাঁরা আছেন রাজনৈতিক কৌশলে কে জিতল কে হারল, সেই হিসাব–নিকাশ নিয়ে। তিন সিটি নির্বাচনের পর এখন নবনির্বাচিতদের সংবর্ধনা ও অভিষেকের মহড়া চলছে। কোনো দল ব্যস্ত নেত্রীর সংবর্ধনা নিয়ে; কোনো দল প্রয়াত নেতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন নিয়ে। এই সব দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের কথা ভাবার সময় কোথায় তাদের।
আমাদের নেতা–নেত্রীরা হররোজ উন্নয়নের বুলি আওড়াচ্ছেন। মধ্যম আয়ের দেশ করার খোয়াব দেখাচ্ছেন। ঢাকাকে হংকং-সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ার কথা বলছেন। যে দেশে এখনো গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, যে শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বস্তি ও ফুটপাতে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সেই শহরকে তারা কীভাবে সিঙ্গাপুর বানাবেন? ফি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত হচ্ছে। কিন্তু ওই পাচার হওয়া মানুষগুলো এবং তাদের মতো আরও লাখ লাখ মানবসন্তান এই হিসাবের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সরকার দাবি করছে, দেশে দারিদ্র্য কমেছে, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। সবই মানলাম। কিন্তু মানব পাচার থামছে না কেন?
আসলে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিতে, রাজনৈতিক দর্শনে মারাত্মক গলদ আছে। এখানে তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়। উন্নয়নের সুফল কতিপয় ব্যক্তি পেলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থাকে বঞ্চিত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সে দেশের মানুষ জাহাজে করে হংকং, তাইওয়ান কিংবা জাপানের পথে পাড়ি দিত। তাদের বলা হতো ‘নৌকা মানব’। এখন আর ভিয়েতনামিদের বহন করা জাহাজ সমুদ্রে ভাসতে দেখা যায় না। মাত্র দুই দশকে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উন্নয়নের মডেল হতে পেরেছে। আর আমরা প্রবৃদ্ধির হার ৬ না সাড়ে ৫ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করছি। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট ভূখণ্ডে ১৬ কোটি লোক বাস করে। তার পরও আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছি। সব বিশেষজ্ঞের মতকে অগ্রাহ্য করে বর্ধিত জনসংখ্যা বোঝা নয়, সম্পদ বলে প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু সেই জনসংখ্যাকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করতে হয়, সেই চেষ্টা করছি না। আমাদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নের চেষ্টা নেই। ফলে বেকার মানুষগুলো পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। জীবিকার সন্ধানে গিয়ে অনেকে সাগরে, মরুভূমিতে, জঙ্গলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। গতকাল প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। এমনকি এ ব্যাপারে গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় স্থান পায়নি সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়টি।
বৃহস্পতিবার রাতে টেলিভিশনের খবরে শুনলাম, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা শুধু বৈধ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি। অবৈধ শ্রমিকদের নিয়ে নয়।’ পাচার রোধ বা পাচার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ব্যাপারে নাকি তাঁর দায়িত্ব নেই। এটি দেখবে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে মানব পাচার নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও কোনো বিবৃতি বা ব্যাখ্যা আমাদের চোখে পড়েনি। তাঁরা হয়তো এটিকে সমস্যাই মনে করেন না। এর সঙ্গে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানাসাকের বক্তব্যটি মিলিয়ে নিন। তিনি বলেছেন, দীর্ঘস্থায়ী অবৈধ অভিবাসী সমস্যার সমাধানে উৎস দেশ, অর্থাৎ যেসব দেশ থেকে তারা পাচার হয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা ও সহায়তা করতে তাঁর সরকার প্রস্তুত।
কেবল সমুদ্রপথেই মানুষ পাচার হচ্ছে না। কয়েক বছর আগেও ঢাকা বিমানবন্দর ছিল শিশু ও নারী পাচারের নিরাপদ রুট। আর স্থলপথে মানব পাচারের ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। কেবল পশ্চিমবঙ্গের কারাগারেই দেড় হাজারের বেশি বাংলাদেশি আটক আছেন। সারা ভারতে সংখ্যাটা কত হবে কিংবা পাকিস্তানে? একজন সাবেক কূটনীতিক জানান, পৃথিবীতে এ রকম দেশ হয়তো পাওয়া যাবে না, যেখানে বাংলাদেশি অভিবাসী আছে, কিন্তু কারাবন্দী নেই।
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন বলেছে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে সমুদ্রপথে ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা পাচার হয়ে গেছে, যা গত বছরে একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। এ সময়ে অনাহারে কিংবা অসুখে মারা গেছে ৩০০ জন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দাবি, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পাচার হয়ে যায়। ইউএনডিপি বলেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৩ লাখ ও তিন দশকে ১০ লাখ। এই পরিসংখ্যান উন্নয়নের বার্তা প্রচারকারী নেতা–নেত্রীরা কীভাবে নেবেন জানি না। লজ্জায় আমাদের মাথা অবনত করে দেয়।
দুই সপ্তাহ ধরে মানব পাচারের বিষয়টি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বরং তারা মানব পাচার রোধের অতি সহজ পথ হিসেবে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধকে বেছে নিয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ ও র্যাবের হাতে পাঁচজন কথিত মানব পাচারকারী নিহত হয়েছেন। সরকার বলতে পারে, এরা এতটাই দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছিল যে অভিযান চলাকালে কর্তব্যরত পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই তারা গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পাচারকারীরা পুলিশের ওপর হামলা করার মতো শক্তি পেল কোথায়? সেই দানবদের পাকড়াও করার জন্য তারা এত দিন কোনো পদক্ষেপ নিল না কেন? যেভাবে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন থেকে শুরু করে মানব পাচার রোধ—সব ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারকে মোক্ষম দাওয়াই মনে করছে, তাতে ভবিষ্যতে আইন–আদালতের প্রয়োজনই হবে না।
ডেইলি স্টার ধন্যবাদ পেতে পারে বাংলাদেশের এই জ্বলন্ত সমস্যাটি সামনে নিয়ে আসার জন্য। সরকার যদি এটিকে তাদের বিরুদ্ধে নতুন কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ মনে না করে, তাহলে তাদের উচিত হবে পাচারের কারণগুলো অনুসন্ধান করে এর প্রতিকারে এখনই কিছু করা। তাদের বুঝতে হবে দেশে কাজ থাকলে কেউ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে কিংবা সমুদ্রপথে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় না।
কয়েক দিন আগে দেশে দুই দফায় ভূমিকম্প হয়ে গেল। সেই ভূমিকম্পে তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু পাচার নামক মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পের ক্ষতি বিশাল ও ভয়াবহ। যেসব বাংলাদেশি নারী পুরুষ ও শিশু পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে এখন সাগরে ভাসছে কিংবা বিদেশে কারাগারে আটক আছেন, তাদের বিষয়ে কি মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখা এবং ‘প্রকৃত জাতীয়তাবাদী’ সরকারের কিছুই করার নেই?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
অাগের বিবরণ শুনুন। ছয় দিন আগে থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া সীমান্তের সাগরে চালক ও সহকারীরা নৌযানটি ছেড়ে পালিয়ে যায়। এর ইঞ্জিনও বিকল। বুধবার রাতে থাই জেলেদের সহায়তায় তাঁরা নৌযানটিকে মালয়েশিয়া উপকূলে নিয়ে যান। সেখান থেকে থাইল্যান্ড উপকূলের দিকে ঠেলে পাঠানো হয়। এরপর সেখান থেকেও ফেরত পাঠানো হয় তাঁদের। দু-এক দিনের মধ্যে কেউ উদ্ধার না করলে কিংবা খাবার ও পানি সরবরাহ না করলে হতভাগ্য মানুষগুলোকে বাঁচানো যাবে না। না খেয়েই মারা যাবেন। তখন হয়তো সিরাজগঞ্জের, টেকনাফের কিংবা নরসিংদীর আরও অনেক ঘরে স্বজনের বুকফাটা কান্না শোনা যাবে।
বাংলাদেশে মানব পাচার হয় এখন ৪১টি জেলা থেকে। সীমান্তবর্তী সব জেলায়ই পাচারকারী চক্র সক্রিয়। কিন্তু ওই নৌযানের আরোহীরা কূলে উঠতে পারলেই বেঁচে যাবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। সেখানে তারা কোনো দালাল চক্রের হাতে বিক্রি হয়ে যাবেন। এরপর সেই দালালেরা তাদের থাইল্যান্ড কিংবা মালয়েশিয়ার গহিন জঙ্গলে নিয়ে দেশে স্বজনদের কাছে টেলিফোন করে মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করবে। সেই মুক্তিপণের পরিমাণ এমন যে ওই গরিব মানুষগুলোর পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। ফলে গণকবরই তাদের শেষ ঠিকানা। বিদেশের মাটিতে স্বজনদের গণকবর খুঁড়তেই কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম? লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশে আর কত মানুষের এই অপমান ও করুণ মৃত্যু দেখতে হবে?
এ তো একটি নৌযানের কাহিনি। এ রকম অনেকগুলো নৌযানে এ যুগের মানব দাসদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্থলপথে, বিমানপথেও পাচার হচ্ছে মানুষ। বিদেশি সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সমুদ্রসীমায় ভাসতে থাকা বিভিন্ন নৌযানের প্রায় আট হাজার অভিবাসী এখন তীব্র খাদ্য ও পানীয় কষ্টে রয়েছে। ক্ষুধায় ও অসুস্থতায় অনেকে মারা গেছে। কিছু নৌযানে জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে। এক সপ্তাহ ধরে আন্দামান সাগরে লক্ষ্যহীনভাবে ভাসতে থাকা একটি নৌযানের ১০ জন মারা গেছে। নৌযানটিতে খাদ্য ও পানীয় ফুরিয়ে গিয়েছিল। মাছ ধরার কাজে ব্যবহৃত হওয়া ওই নৌযানে প্রায় ৩৫০ জন অভিবাসী ছিল। নৌযানটি থাইল্যান্ড উপকূলে এলেও দেশটি অভিবাসীদের আশ্রয় দেয়নি।
বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে ভয়াবহ মানবিক সংকট বলে অভিহিত করলেও আমাদের নেতা–নেত্রীরা আমলে নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। তাঁরা আছেন রাজনৈতিক কৌশলে কে জিতল কে হারল, সেই হিসাব–নিকাশ নিয়ে। তিন সিটি নির্বাচনের পর এখন নবনির্বাচিতদের সংবর্ধনা ও অভিষেকের মহড়া চলছে। কোনো দল ব্যস্ত নেত্রীর সংবর্ধনা নিয়ে; কোনো দল প্রয়াত নেতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন নিয়ে। এই সব দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের কথা ভাবার সময় কোথায় তাদের।
আমাদের নেতা–নেত্রীরা হররোজ উন্নয়নের বুলি আওড়াচ্ছেন। মধ্যম আয়ের দেশ করার খোয়াব দেখাচ্ছেন। ঢাকাকে হংকং-সিঙ্গাপুরের আদলে গড়ার কথা বলছেন। যে দেশে এখনো গরিষ্ঠসংখ্যক মানুষ ন্যূনতম মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত, যে শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ বস্তি ও ফুটপাতে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে, সেই শহরকে তারা কীভাবে সিঙ্গাপুর বানাবেন? ফি বছর বাজেটের আকার বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার স্ফীত হচ্ছে। কিন্তু ওই পাচার হওয়া মানুষগুলো এবং তাদের মতো আরও লাখ লাখ মানবসন্তান এই হিসাবের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সরকার দাবি করছে, দেশে দারিদ্র্য কমেছে, সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত আছে। সবই মানলাম। কিন্তু মানব পাচার থামছে না কেন?
আসলে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিতে, রাজনৈতিক দর্শনে মারাত্মক গলদ আছে। এখানে তেলা মাথায় তেল দেওয়া হয়। উন্নয়নের সুফল কতিপয় ব্যক্তি পেলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থাকে বঞ্চিত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সে দেশের মানুষ জাহাজে করে হংকং, তাইওয়ান কিংবা জাপানের পথে পাড়ি দিত। তাদের বলা হতো ‘নৌকা মানব’। এখন আর ভিয়েতনামিদের বহন করা জাহাজ সমুদ্রে ভাসতে দেখা যায় না। মাত্র দুই দশকে তারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় উন্নয়নের মডেল হতে পেরেছে। আর আমরা প্রবৃদ্ধির হার ৬ না সাড়ে ৫ নিয়ে অহেতুক বিতর্ক করছি। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ছোট্ট ভূখণ্ডে ১৬ কোটি লোক বাস করে। তার পরও আমরা জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করছি। সব বিশেষজ্ঞের মতকে অগ্রাহ্য করে বর্ধিত জনসংখ্যা বোঝা নয়, সম্পদ বলে প্রচারণা চালাচ্ছি। কিন্তু সেই জনসংখ্যাকে কীভাবে সম্পদে পরিণত করতে হয়, সেই চেষ্টা করছি না। আমাদের কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা থাকলেও বাস্তবায়নের চেষ্টা নেই। ফলে বেকার মানুষগুলো পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। জীবিকার সন্ধানে গিয়ে অনেকে সাগরে, মরুভূমিতে, জঙ্গলে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। গতকাল প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়ে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সতর্ক করা হলেও যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। এমনকি এ ব্যাপারে গৃহীত জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় স্থান পায়নি সমুদ্রপথে মানব পাচারের বিষয়টি।
বৃহস্পতিবার রাতে টেলিভিশনের খবরে শুনলাম, প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, ‘আমরা শুধু বৈধ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করি। অবৈধ শ্রমিকদের নিয়ে নয়।’ পাচার রোধ বা পাচার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর ব্যাপারে নাকি তাঁর দায়িত্ব নেই। এটি দেখবে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে মানব পাচার নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও কোনো বিবৃতি বা ব্যাখ্যা আমাদের চোখে পড়েনি। তাঁরা হয়তো এটিকে সমস্যাই মনে করেন না। এর সঙ্গে থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তানাসাকের বক্তব্যটি মিলিয়ে নিন। তিনি বলেছেন, দীর্ঘস্থায়ী অবৈধ অভিবাসী সমস্যার সমাধানে উৎস দেশ, অর্থাৎ যেসব দেশ থেকে তারা পাচার হয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে আলোচনা ও সহায়তা করতে তাঁর সরকার প্রস্তুত।
কেবল সমুদ্রপথেই মানুষ পাচার হচ্ছে না। কয়েক বছর আগেও ঢাকা বিমানবন্দর ছিল শিশু ও নারী পাচারের নিরাপদ রুট। আর স্থলপথে মানব পাচারের ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটছে। কেবল পশ্চিমবঙ্গের কারাগারেই দেড় হাজারের বেশি বাংলাদেশি আটক আছেন। সারা ভারতে সংখ্যাটা কত হবে কিংবা পাকিস্তানে? একজন সাবেক কূটনীতিক জানান, পৃথিবীতে এ রকম দেশ হয়তো পাওয়া যাবে না, যেখানে বাংলাদেশি অভিবাসী আছে, কিন্তু কারাবন্দী নেই।
জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন বলেছে, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে সমুদ্রপথে ২৫ হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা পাচার হয়ে গেছে, যা গত বছরে একই সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ। এ সময়ে অনাহারে কিংবা অসুখে মারা গেছে ৩০০ জন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের দাবি, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ পাচার হয়ে যায়। ইউএনডিপি বলেছে, গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৩ লাখ ও তিন দশকে ১০ লাখ। এই পরিসংখ্যান উন্নয়নের বার্তা প্রচারকারী নেতা–নেত্রীরা কীভাবে নেবেন জানি না। লজ্জায় আমাদের মাথা অবনত করে দেয়।
দুই সপ্তাহ ধরে মানব পাচারের বিষয়টি দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। বরং তারা মানব পাচার রোধের অতি সহজ পথ হিসেবে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধকে বেছে নিয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ ও র্যাবের হাতে পাঁচজন কথিত মানব পাচারকারী নিহত হয়েছেন। সরকার বলতে পারে, এরা এতটাই দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছিল যে অভিযান চলাকালে কর্তব্যরত পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাই তারা গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পাচারকারীরা পুলিশের ওপর হামলা করার মতো শক্তি পেল কোথায়? সেই দানবদের পাকড়াও করার জন্য তারা এত দিন কোনো পদক্ষেপ নিল না কেন? যেভাবে সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন থেকে শুরু করে মানব পাচার রোধ—সব ক্ষেত্রে ক্রসফায়ারকে মোক্ষম দাওয়াই মনে করছে, তাতে ভবিষ্যতে আইন–আদালতের প্রয়োজনই হবে না।
ডেইলি স্টার ধন্যবাদ পেতে পারে বাংলাদেশের এই জ্বলন্ত সমস্যাটি সামনে নিয়ে আসার জন্য। সরকার যদি এটিকে তাদের বিরুদ্ধে নতুন কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ মনে না করে, তাহলে তাদের উচিত হবে পাচারের কারণগুলো অনুসন্ধান করে এর প্রতিকারে এখনই কিছু করা। তাদের বুঝতে হবে দেশে কাজ থাকলে কেউ কাঁটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে কিংবা সমুদ্রপথে মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয় না।
কয়েক দিন আগে দেশে দুই দফায় ভূমিকম্প হয়ে গেল। সেই ভূমিকম্পে তেমন ক্ষতি হয়নি। কিন্তু পাচার নামক মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পের ক্ষতি বিশাল ও ভয়াবহ। যেসব বাংলাদেশি নারী পুরুষ ও শিশু পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে এখন সাগরে ভাসছে কিংবা বিদেশে কারাগারে আটক আছেন, তাদের বিষয়ে কি মধ্যম আয়ের দেশের স্বপ্ন দেখা এবং ‘প্রকৃত জাতীয়তাবাদী’ সরকারের কিছুই করার নেই?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab০3@dhaka.net
No comments