ভাসমান কফিন-ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ড ঠেলাধাক্কা
সমুদ্রের
উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে ‘ভাসমান কফিন’। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সমুদ্রে এখনও আটকা
পড়ে আছে মিয়ানমারের কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অভিবাসী। তাদের
উদ্ধার না করলে তারা পরিণত হবেন ভাসমান কফিনে। এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছে
জাতিসংঘ। তাদের নিয়ে পুশব্যাক-পুশব্যাক চলছে তিন দেশ- থাইল্যান্ড,
ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে। নৌযানে করে বিপন্ন এসব মানুষকে প্রতিটি
দেশ ঠেলে দিচ্ছে তার জলসীমার বাইরে। এতে অভিবাসীদের অনেকের মৃত্যু
অনিবার্য। এ অবস্থায় বেঁচে থাকা এসব মানুষকে ‘ভাসমান কফিন’ বলে আখ্যায়িত
করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ওই অঞ্চলের সরকারগুলোকে
দ্রুতগতিতে এসব মানুষের জীবন রক্ষার আহ্বান জানালেও তাতে কোন সাড়া মিলছে
না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ফিল রিচার্ডসন বলেছেন বিপন্ন
এসব মানুষকে নিয়ে ত্রিমুখী খেলা বন্ধ করতে হবে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও
ইন্দোনেশিয়াকে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, এখনও সমুদ্রে ভয়াবহ
অবস্থায় ভাসছে কয়েক হাজার মানুষ, যাদের বেশির ভাগই মৃত্যুর মুখে পতিত,
তাদের খাবার নেই, পানি নেই এমন কি তারা জানে না যে, তারা এখন কোথায় আছে। এ
কথা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। তবে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক গতকাল
বলেছেন, এ সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের পাশাপাশি আসিয়ানভুক্ত সব সদস্য
দেশকে একযোগে অবশ্যই কাজ করতে হবে। অভিবাসীতে ঠাঁসা একটি নৌযান দু’বার
থাইল্যান্ড উপকূলে প্রবেশের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের সে সুযোগ দেয়া হয়নি। এ
নৌযানকে থাই সমুদ্রসীমা থেকে সে দেশের নৌবাহিনী পুশব্যাক করে পাঠিয়ে দেয়
গভীর সমুদ্রে। গতকাল মালয়েশিয়া ওই নৌযানকে দেখতে পায়। ওই বোটটি গতকাল
সকালের দিকে ফের থাইল্যান্ডের সমুদ্রসীমায় দেখা যায় বলে খবর দিয়েছে বার্তা
সংস্থা রয়টার্স। এর আগে বোটটি ইন্দোনেশিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। থাইল্যান্ড
দাবি করেছে, তারা ওই বোটের মানুষদের খাদ্য, পানীয় ও তাদের নৌযান মেরামত করে
দিয়েছে। থাই লেফটেন্যান্ট বিরাপং নাকপ্রাসিত এমন কথা বলেছেন। তিনি বলেন,
অভিবাসীরা মালয়েশিয়া যেতে চাওয়ায় তারা তাদের মালয়েশিয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
এতে সুস্পষ্ট যে, সমুদ্রে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আটকে থাকা ওইসব মানুষকে
তিনটি দেশের কেউই আশ্রয় দিতে রাজি নয়। ফলে তারা বারবারই তাদের ঠেলে দিচ্ছে
সমুদ্রে। রয়টার্সের রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতিসংঘ সমন্বিত উদ্ধার অভিযান
চালানোর আহ্বান জানানো সত্ত্বেও তা অবজ্ঞা করছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ
দেশগুলো। এতে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম
উপকূলে ও মালয়েশিয়ার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবতরণ করতে পেরেছে প্রায় ২৫০০
অভিবাসী। তবে শুক্রবার থাইল্যান্ডের ফাং নগা প্রদেশের একটি দ্বীপে যে ১০৬
অভিবাসীর সন্ধান পেয়েছে থাই কর্তৃপক্ষ তারা সেখানে গেলেন কিভাবে তা
অস্পষ্ট।
অবর্ণনীয় দুর্ভোগ বোটে: আটকে পড়া বোটগুলোতে অভিবাসীরা বেঁচে আছেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে। তাদের দেহ হাড্ডিসার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির দিকে। রোগে ভুগে, ক্ষুধায় কাতর এসব মানুষ। তাদের পান করার মতো পানি নেই। এমন বর্ণনা দিলেন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মানু আবদুল সালাম (১৯)। তিনি বললেন, আমি যদি জানতাম নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেয়া এতটাই কঠিন তাহলে প্রয়োজনে দেশের মাটিতেই মারা যেতাম। শুক্রবার যেসব মানুষ ইন্দোনেশিয়ার তীরে উঠতে পেরেছেন তাদের একজন তিনি। বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ যখন সমুদ্রে মানব পাচার বন্ধে পদক্ষেপ জোরালো করে তখন তাদের বহনকারী নৌযানটি সমুদ্রের মাঝে। তারপর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ সতর্কতা উচ্চারণ করেছে আগেই। তারা বলেছে, এ অভিযান জোরালো হওয়ার ফলে পাচারকারী চক্রের ক্যাপ্টেন, যে নৌযান চালাচ্ছিল, সে নৌযান ফেলে, এতগুলো মানুষকে বিপদের মুখে ফেলে পালাতে পারে। হয়েছেও তাই। মানু আবদুল সালাম বলেন, বেশ কয়েক দিন আগে একটি ফোন আসে। সেই ফোন পেয়ে একটি স্পিডবোট নিয়ে পালিয়ে যায় মানু। তার আগে সে তাদের নৌযানের ইঞ্জিন বিকল করে দিয়ে যায়। তারপর থেকে তারা ভাসছিল গভীর সমুদ্রে।
রোহিঙ্গা-বাংলাদেশী মারামারি: একপর্যায়ে ওই নৌযানের খাবার ফুরিয়ে যায়। পানি শেষ হয়ে যায়। অধৈর্য্য হয়ে পড়েন সবাই। ফলে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে শুরু হয় মারামারি। এতে কমপক্ষে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন। মানু আবদুল বলেন, বাংলাদেশীরা মনে করেছিল ক্যাপ্টেনের বাড়ি ছিল মিয়ানমারে। তাই বাংলাদেশীরা আমাদের ওপর লাঠি ও ছুরি নিয়ে আক্রমণ চালায়। তবে এই ঘটনায় বেঁচে আছেন ১৯ বছর বয়সী বাংলাদেশী সাইদুল ইসলাম। তিনি বললেন, ওই মারামারি পর অনাহারে ও আঘাতের ক্ষত নিয়ে তাদের নৌযানের কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছে। তিন মাস ধরে তারা সমুদ্রে ভাসছেন। এক ব্যক্তি তার গ্রামে গিয়ে লোভ দেখিয়েছিল জাহাজে করে মালয়েশিয়া নিয়ে ভাল চাকরি দেয়ার। তার কথায় সায় দিয়ে তিনি যখন সমুদ্রে গেছেন তখনই ক্যাপ্টেন তার কাছে কয়েক শত ডলার দাবি করে বসে। শুধু সাইদুলের বেলায় নয়, সবার বেলায়ই এটা ঘটেছে। এসব মানুষের পরিবারের সদস্যদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে।
মিয়ানমারের না: ওদিকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার দাবি অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। গত দু’সপ্তাহ ধরে যখন রোহিঙ্গাদের এই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে, তারপর এই প্রথম এ বিষয়ে মুখ খুললো মিয়ানমার। সরকারের মুখপাত্র ইয়ে হুট বলেছেন, আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না যে, ওইসব অভিবাসী মিয়ানমারের নাগরিক। এর আগে তাদেরকে শনাক্ত করতে হবে। পাচার হওয়া মানুষের বেশির ভাগেরই দাবি যে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক। এমনটা দাবি করা খুব সহজ এবং অন্যকে তারা সহজেই এ বিষয়টি বোঝাতে পারে। মিয়ানমারের অন্য এক সরকারি কর্মকর্তা মেজর জাও হে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করার জন্য যে আঞ্চলিক বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে তাতে যোগ দেবে না মিয়ানমার।
ভাসমান কফিন: শুক্রবার জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন মহাসচিব বান কি মুন। তিনি এ সময় সব নেতার প্রতি সবার আগে জীবন রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্য কথায়, আমরা তাদের ভাসমান কফিন হতে দিতে পারি না।
জন কেরির ফোন: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বৃহস্পতিবার রাতেই ফোন করেছেন থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। এ সময় তিনি এসব মানুষকে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। তবে জবাবে থাইল্যান্ড কি বলেছে তা প্রকাশ করেন নি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেফ রাথকে।
অবৈধ অভিবাসীভর্তি বহু নৌকা এখনও ভাসছে: ওদিকে গতরাতে বিবিসি খবর দিয়েছে যে- থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি উপকূল ও সাগরে এখনও নৌকায় ভাসছে পাচার হওয়া বহু মানুষ। বলা হচ্ছে, এরা মূলত বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা। ইউএনএইচসিআরের একজন কর্মকর্তা জেফরি স্যাভেজ বার্তা সংস্থা রয়টারকে বলেছেন, সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতার কোন লক্ষণই তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে প্রায় ৮০০ অভিবাসী তীরে নেমেছে। এ নিয়ে উত্তরপূর্ব মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আড়াই হাজারেরও বেশি অভিবাসী তীরে নামতে পেরেছেন। তবে আরও বহু অভিবাসী এখনও সাগরে ভাসমান নৌকায় রয়েছেন। রয়টার্স খবর দিয়েছে, মালয়েশিয়ার নৌযানগুলো শনিবারও একটি অভিবাসী-ভর্তি নৌকা তাদের জলসীমা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মালয়েশিয়ান একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এই নৌকাটি প্রথম থাইল্যান্ড যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে থাই নৌবাহিনী দুইবার তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। তবে তারা নৌকার ইঞ্জিনটি মেরামত করে দেয় এবং আরোহীদের খাদ্য, পানি, জ্বালানি তেল ইত্যাদি দিয়ে মালয়েশিয়ার পথ দেখিয়ে সাগরে ছেড়ে দেয়। থাইল্যান্ড-এর ফ্যাং এনগা প্রদেশে একটি দ্বীপে শুক্রবার আরও ১০৬ জন অভিবাসীকে পাওয়া গেছে। সাগরে ভেসে থাকা অনেককে হেলিকপ্টার থেকে খাবার দিলেও তাদের তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না ওই অঞ্চলের দেশগুলো। মালয়েশিয়ার সরকার এ সপ্তাহে বলেছে, তারা এসব অভিবাসীকে গ্রহণ করবে না। এর আগে থাইল্যান্ডের মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী জঙ্গলে অবৈধ অভিবাসীদের গণকবর পাওয়া যায়। জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে পাচার হচ্ছে এসব মানুষ।
কোস্টগার্ডের সীমিত পাহারা: মানব পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না
টেকনাফ কোস্ট গার্ডের স্টেশন কমান্ডার মোহাম্মদ শাহীদ হোসেন চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, সমুদ্রে তীরবর্তী একেকটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাহারা দেয়ার জন্য যে পরিমাণ নৌযান দরকার, তার অভাব আছে। তাদের কিছু হাইস্পিড বোট থাকলেও গভীর সমুদ্রে পাহারা দেয়ার মতো নৌযান এখনও নেই। তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া তাদের পক্ষে সাগরে ভাসমান সব নৌযান তল্লাশি করাও সম্ভব হয় না। কমান্ডার চৌধুরী জানান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়াতে যেসব নৌকায় অভিবাসী নারী ও শিশুদের পাওয়া যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই মিয়ানমার থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা বলে তারা ধারণা করেন। অথচ বাংলাদেশের উপকূলে প্রহরায় কাজ করছে নৌ বাহিনী, বর্ডার গার্ড ও কোস্ট গার্ড। এসব বাহিনীর চোখ এড়িয়ে কিভাবে ঘটছে মানব পাচারের ঘটনা, এ প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন। কিন্তু এর সঙ্গে কোস্টাগার্ডের কোন সদস্যের যোগসাজশের সম্ভাবনার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন কমান্ডার শাহীদ হোসেন চৌধুরী।
অবর্ণনীয় দুর্ভোগ বোটে: আটকে পড়া বোটগুলোতে অভিবাসীরা বেঁচে আছেন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে। তাদের দেহ হাড্ডিসার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির দিকে। রোগে ভুগে, ক্ষুধায় কাতর এসব মানুষ। তাদের পান করার মতো পানি নেই। এমন বর্ণনা দিলেন মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা মানু আবদুল সালাম (১৯)। তিনি বললেন, আমি যদি জানতাম নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেয়া এতটাই কঠিন তাহলে প্রয়োজনে দেশের মাটিতেই মারা যেতাম। শুক্রবার যেসব মানুষ ইন্দোনেশিয়ার তীরে উঠতে পেরেছেন তাদের একজন তিনি। বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ যখন সমুদ্রে মানব পাচার বন্ধে পদক্ষেপ জোরালো করে তখন তাদের বহনকারী নৌযানটি সমুদ্রের মাঝে। তারপর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ সতর্কতা উচ্চারণ করেছে আগেই। তারা বলেছে, এ অভিযান জোরালো হওয়ার ফলে পাচারকারী চক্রের ক্যাপ্টেন, যে নৌযান চালাচ্ছিল, সে নৌযান ফেলে, এতগুলো মানুষকে বিপদের মুখে ফেলে পালাতে পারে। হয়েছেও তাই। মানু আবদুল সালাম বলেন, বেশ কয়েক দিন আগে একটি ফোন আসে। সেই ফোন পেয়ে একটি স্পিডবোট নিয়ে পালিয়ে যায় মানু। তার আগে সে তাদের নৌযানের ইঞ্জিন বিকল করে দিয়ে যায়। তারপর থেকে তারা ভাসছিল গভীর সমুদ্রে।
রোহিঙ্গা-বাংলাদেশী মারামারি: একপর্যায়ে ওই নৌযানের খাবার ফুরিয়ে যায়। পানি শেষ হয়ে যায়। অধৈর্য্য হয়ে পড়েন সবাই। ফলে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশী অভিবাসীদের মধ্যে শুরু হয় মারামারি। এতে কমপক্ষে কয়েক ডজন মানুষ নিহত হন। মানু আবদুল বলেন, বাংলাদেশীরা মনে করেছিল ক্যাপ্টেনের বাড়ি ছিল মিয়ানমারে। তাই বাংলাদেশীরা আমাদের ওপর লাঠি ও ছুরি নিয়ে আক্রমণ চালায়। তবে এই ঘটনায় বেঁচে আছেন ১৯ বছর বয়সী বাংলাদেশী সাইদুল ইসলাম। তিনি বললেন, ওই মারামারি পর অনাহারে ও আঘাতের ক্ষত নিয়ে তাদের নৌযানের কয়েক ডজন মানুষ মারা গেছে। তিন মাস ধরে তারা সমুদ্রে ভাসছেন। এক ব্যক্তি তার গ্রামে গিয়ে লোভ দেখিয়েছিল জাহাজে করে মালয়েশিয়া নিয়ে ভাল চাকরি দেয়ার। তার কথায় সায় দিয়ে তিনি যখন সমুদ্রে গেছেন তখনই ক্যাপ্টেন তার কাছে কয়েক শত ডলার দাবি করে বসে। শুধু সাইদুলের বেলায় নয়, সবার বেলায়ই এটা ঘটেছে। এসব মানুষের পরিবারের সদস্যদের কাছে মুক্তিপণ দাবি করা হয়েছে।
মিয়ানমারের না: ওদিকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার দাবি অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। গত দু’সপ্তাহ ধরে যখন রোহিঙ্গাদের এই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে, তারপর এই প্রথম এ বিষয়ে মুখ খুললো মিয়ানমার। সরকারের মুখপাত্র ইয়ে হুট বলেছেন, আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছি না যে, ওইসব অভিবাসী মিয়ানমারের নাগরিক। এর আগে তাদেরকে শনাক্ত করতে হবে। পাচার হওয়া মানুষের বেশির ভাগেরই দাবি যে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক। এমনটা দাবি করা খুব সহজ এবং অন্যকে তারা সহজেই এ বিষয়টি বোঝাতে পারে। মিয়ানমারের অন্য এক সরকারি কর্মকর্তা মেজর জাও হে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করার জন্য যে আঞ্চলিক বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে তাতে যোগ দেবে না মিয়ানমার।
ভাসমান কফিন: শুক্রবার জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে আঞ্চলিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছেন মহাসচিব বান কি মুন। তিনি এ সময় সব নেতার প্রতি সবার আগে জীবন রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্য কথায়, আমরা তাদের ভাসমান কফিন হতে দিতে পারি না।
জন কেরির ফোন: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বৃহস্পতিবার রাতেই ফোন করেছেন থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। এ সময় তিনি এসব মানুষকে অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। তবে জবাবে থাইল্যান্ড কি বলেছে তা প্রকাশ করেন নি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জেফ রাথকে।
অবৈধ অভিবাসীভর্তি বহু নৌকা এখনও ভাসছে: ওদিকে গতরাতে বিবিসি খবর দিয়েছে যে- থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি উপকূল ও সাগরে এখনও নৌকায় ভাসছে পাচার হওয়া বহু মানুষ। বলা হচ্ছে, এরা মূলত বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা। ইউএনএইচসিআরের একজন কর্মকর্তা জেফরি স্যাভেজ বার্তা সংস্থা রয়টারকে বলেছেন, সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতার কোন লক্ষণই তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। শুক্রবার ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে প্রায় ৮০০ অভিবাসী তীরে নেমেছে। এ নিয়ে উত্তরপূর্ব মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আড়াই হাজারেরও বেশি অভিবাসী তীরে নামতে পেরেছেন। তবে আরও বহু অভিবাসী এখনও সাগরে ভাসমান নৌকায় রয়েছেন। রয়টার্স খবর দিয়েছে, মালয়েশিয়ার নৌযানগুলো শনিবারও একটি অভিবাসী-ভর্তি নৌকা তাদের জলসীমা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। মালয়েশিয়ান একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এই নৌকাটি প্রথম থাইল্যান্ড যাওয়ার চেষ্টা করে। তবে থাই নৌবাহিনী দুইবার তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়। তবে তারা নৌকার ইঞ্জিনটি মেরামত করে দেয় এবং আরোহীদের খাদ্য, পানি, জ্বালানি তেল ইত্যাদি দিয়ে মালয়েশিয়ার পথ দেখিয়ে সাগরে ছেড়ে দেয়। থাইল্যান্ড-এর ফ্যাং এনগা প্রদেশে একটি দ্বীপে শুক্রবার আরও ১০৬ জন অভিবাসীকে পাওয়া গেছে। সাগরে ভেসে থাকা অনেককে হেলিকপ্টার থেকে খাবার দিলেও তাদের তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না ওই অঞ্চলের দেশগুলো। মালয়েশিয়ার সরকার এ সপ্তাহে বলেছে, তারা এসব অভিবাসীকে গ্রহণ করবে না। এর আগে থাইল্যান্ডের মালয়েশিয়া সীমান্তবর্তী জঙ্গলে অবৈধ অভিবাসীদের গণকবর পাওয়া যায়। জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের টেকনাফ উপকূল দিয়ে পাচার হচ্ছে এসব মানুষ।
কোস্টগার্ডের সীমিত পাহারা: মানব পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না
টেকনাফ কোস্ট গার্ডের স্টেশন কমান্ডার মোহাম্মদ শাহীদ হোসেন চৌধুরী বিবিসিকে বলেন, সমুদ্রে তীরবর্তী একেকটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল পাহারা দেয়ার জন্য যে পরিমাণ নৌযান দরকার, তার অভাব আছে। তাদের কিছু হাইস্পিড বোট থাকলেও গভীর সমুদ্রে পাহারা দেয়ার মতো নৌযান এখনও নেই। তিনি বলেন, গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া তাদের পক্ষে সাগরে ভাসমান সব নৌযান তল্লাশি করাও সম্ভব হয় না। কমান্ডার চৌধুরী জানান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়াতে যেসব নৌকায় অভিবাসী নারী ও শিশুদের পাওয়া যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই মিয়ানমার থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা বলে তারা ধারণা করেন। অথচ বাংলাদেশের উপকূলে প্রহরায় কাজ করছে নৌ বাহিনী, বর্ডার গার্ড ও কোস্ট গার্ড। এসব বাহিনীর চোখ এড়িয়ে কিভাবে ঘটছে মানব পাচারের ঘটনা, এ প্রশ্নও অনেকে তুলেছেন। কিন্তু এর সঙ্গে কোস্টাগার্ডের কোন সদস্যের যোগসাজশের সম্ভাবনার কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন কমান্ডার শাহীদ হোসেন চৌধুরী।
No comments