জন্মদিনে মাকে খোলা চিঠি by আশফিয়া বিনতে আউয়াল
প্রিয় আম্মা,
আজ ৩ মে ২০১৫, তোমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। কী পরিচয় দেব তোমার? ব্যক্তিজীবনে রুমী-জামীর স্নেহময়ী আম্মা, পেশাগত জীবনে একজন অনুকরণীয় শিক্ষিকা, সাহিত্যিক, অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আপসহীন নেত্রী—প্রতিটি ভূমিকাতেই তুমি ছিলে অনন্য, অসাধারণ। একসময় ছিলে শুধু রুমী-জামীর মা, ১৯৭১ সালে এসে হলে সব মুক্তিযোদ্ধার মা আর আজ তরুণ প্রজন্মের ‘প্রিয় আম্মা’। তোমার মাতৃত্বের আবেদন সর্বজনীন, সর্বকালীন।
১৯৪৮ সালে বিয়ের সময় বাংলার মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য ভেঙে লাল বেনারসির পরিবর্তে সাদা সালোয়ার-কামিজ এবং সোনার গয়নার পরিবর্তে রজনীগন্ধার মালা পরে জীবনের প্রারম্ভেই তুমি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে। দুই পুত্রকে নামাজ শেখানো, কোরআন শরিফ খতম করানো, পড়াশোনা, খেলাধুলা, আদব-কায়দা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদার মানসিকতা, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া—সব বিষয়েই সেরা করে তুলেছিলে। দেশে কখন কী ঘটছে, দেশ ও জাতি কোন দিকে যাচ্ছে, বাঙালি হিসেবে আমাদের কোন পথ অবলম্বন করা উচিত—এসব বিষয়ে আলোচনার সময়ে দুই ছেলেকে শামিল করতে। ফলে তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমীর মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—এসব গেঁথে গিয়েছিল। তোমার সুযোগ্য পরিচালনা, শিক্ষার প্রভাবেই রুমী ১৯৭১ সালে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সর্বোপরি দেশমাতাকে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে তোমাকে দিয়ে যায় ‘শহীদজননী’ উপাধি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তুমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গিয়েছ। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভেই রুমীর ২০তম জন্মদিনের আশীর্বাণীতে তাকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলে। তুমি জানতে যুদ্ধের ভয়াবহতা রুমীকে তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারে এবং বাস্তবে হয়েছিলও তাই। রুমীকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত ছিলে না, দেশের ভেতরে বসে নিজেও মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেভাবে সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে গিয়েছ—টাকা পাঠানো থেকে শুরু করে নিজ হাতে খাওয়ানো পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধে সব হারিয়ে ফেলার পরও মাতৃত্বের আবেদন এতটুকু কমেনি তোমার আর তাই তো ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের মর্যাদাতেই আসীন ছিলে আমৃত্যু। স্বাধীনতার পর হৃদয়কে পাথর করে আমাদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে গেছ ‘একাত্তরের দিনগুলি’—মুক্তিযুদ্ধকালীন তোমার রক্তঝরা স্মৃতিগুলোকে।
মৌলবাদী, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অশুভ গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, ঠিক তখনই তুমি তোমার আশ্চর্য সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে তাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করা শুরু করলে, সোচ্চার হলে একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক এ-দেশীয় দালালদের বিচার করতে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তারিখে গণ-আদালতের রায়ে উচ্চারিত হলো গোলাম আযমের ফাঁসির দণ্ড। এর জন্য কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি তোমায়—আগেই ছিল দেহে মরণব্যধি ক্যানসার, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা নিয়ে ঘুরতে হয়েছে, রাজপথে পুলিশের লাঠিপেটার কারণে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়েছে।
২৬ জুন, ১৯৯৪—দেশ যখন একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে উত্তাল, সে সময় ঘাতকদের বিচারের দায়িত্বভার জনগণের ওপর অর্পণ করে পাড়ি জমালে না–ফেরার দেশে। মৃত্যুশয্যায় তোমার শেষ আহ্বান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আজ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। তোমার নেতৃত্বে গঠিত ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকার ২০১০ সালে গঠন করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণ-আদালতে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের প্রায় ২১ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে দুজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। আরও কয়েকজনের দণ্ড সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে চলমান যুদ্ধাপরাধীর বিচার তোমারই আন্দোলনের ফসল। তোমার আদর্শে উজ্জীবিত তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আজ সমবেত, তাদের মুখে গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় উচ্চারিত হচ্ছে তোমার নাম।
১৯৭১-এর এই দিনটিতে তোমার দুই পুত্র তোমাকে বনি প্রিন্স (গোলাপ) উপহার দিয়েছিল আর ২০১৫ সালের এই দিনে শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তোমার এ প্রজন্মের সন্তানেরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
আশফিয়া বিনতে আউয়াল: সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক, শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।
আজ ৩ মে ২০১৫, তোমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী। কী পরিচয় দেব তোমার? ব্যক্তিজীবনে রুমী-জামীর স্নেহময়ী আম্মা, পেশাগত জীবনে একজন অনুকরণীয় শিক্ষিকা, সাহিত্যিক, অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আপসহীন নেত্রী—প্রতিটি ভূমিকাতেই তুমি ছিলে অনন্য, অসাধারণ। একসময় ছিলে শুধু রুমী-জামীর মা, ১৯৭১ সালে এসে হলে সব মুক্তিযোদ্ধার মা আর আজ তরুণ প্রজন্মের ‘প্রিয় আম্মা’। তোমার মাতৃত্বের আবেদন সর্বজনীন, সর্বকালীন।
১৯৪৮ সালে বিয়ের সময় বাংলার মুসলিম সমাজের ঐতিহ্য ভেঙে লাল বেনারসির পরিবর্তে সাদা সালোয়ার-কামিজ এবং সোনার গয়নার পরিবর্তে রজনীগন্ধার মালা পরে জীবনের প্রারম্ভেই তুমি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলে। দুই পুত্রকে নামাজ শেখানো, কোরআন শরিফ খতম করানো, পড়াশোনা, খেলাধুলা, আদব-কায়দা, পরমতসহিষ্ণুতা, উদার মানসিকতা, প্রতিবেশী এবং আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেওয়া—সব বিষয়েই সেরা করে তুলেছিলে। দেশে কখন কী ঘটছে, দেশ ও জাতি কোন দিকে যাচ্ছে, বাঙালি হিসেবে আমাদের কোন পথ অবলম্বন করা উচিত—এসব বিষয়ে আলোচনার সময়ে দুই ছেলেকে শামিল করতে। ফলে তোমার জ্যেষ্ঠ পুত্র রুমীর মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা—এসব গেঁথে গিয়েছিল। তোমার সুযোগ্য পরিচালনা, শিক্ষার প্রভাবেই রুমী ১৯৭১ সালে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবন বাজি রাখা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং সর্বোপরি দেশমাতাকে হায়েনাদের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে তোমাকে দিয়ে যায় ‘শহীদজননী’ উপাধি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তুমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আঙ্গিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে গিয়েছ। মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভেই রুমীর ২০তম জন্মদিনের আশীর্বাণীতে তাকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছিলে। তুমি জানতে যুদ্ধের ভয়াবহতা রুমীকে তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারে এবং বাস্তবে হয়েছিলও তাই। রুমীকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিয়েই ক্ষান্ত ছিলে না, দেশের ভেতরে বসে নিজেও মুক্তিযোদ্ধার দায়িত্ব পালন করে গিয়েছ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেভাবে সম্ভব মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করে গিয়েছ—টাকা পাঠানো থেকে শুরু করে নিজ হাতে খাওয়ানো পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধে সব হারিয়ে ফেলার পরও মাতৃত্বের আবেদন এতটুকু কমেনি তোমার আর তাই তো ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধাদের মায়ের মর্যাদাতেই আসীন ছিলে আমৃত্যু। স্বাধীনতার পর হৃদয়কে পাথর করে আমাদের ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে গেছ ‘একাত্তরের দিনগুলি’—মুক্তিযুদ্ধকালীন তোমার রক্তঝরা স্মৃতিগুলোকে।
মৌলবাদী, ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অশুভ গোষ্ঠী এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, ঠিক তখনই তুমি তোমার আশ্চর্য সাংগঠনিক ক্ষমতাবলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে তাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করা শুরু করলে, সোচ্চার হলে একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতক এ-দেশীয় দালালদের বিচার করতে। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ তারিখে গণ-আদালতের রায়ে উচ্চারিত হলো গোলাম আযমের ফাঁসির দণ্ড। এর জন্য কম কষ্ট সহ্য করতে হয়নি তোমায়—আগেই ছিল দেহে মরণব্যধি ক্যানসার, রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা নিয়ে ঘুরতে হয়েছে, রাজপথে পুলিশের লাঠিপেটার কারণে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়েছে।
২৬ জুন, ১৯৯৪—দেশ যখন একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে উত্তাল, সে সময় ঘাতকদের বিচারের দায়িত্বভার জনগণের ওপর অর্পণ করে পাড়ি জমালে না–ফেরার দেশে। মৃত্যুশয্যায় তোমার শেষ আহ্বান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আজ বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। তোমার নেতৃত্বে গঠিত ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সরকার ২০১০ সালে গঠন করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। গণ-আদালতে জামায়াতের আমির গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের প্রায় ২১ বছর পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রথম রায়ে যুদ্ধাপরাধী আবুল কালাম আযাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে দুজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। আরও কয়েকজনের দণ্ড সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে চলমান যুদ্ধাপরাধীর বিচার তোমারই আন্দোলনের ফসল। তোমার আদর্শে উজ্জীবিত তরুণ প্রজন্ম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে আজ সমবেত, তাদের মুখে গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় উচ্চারিত হচ্ছে তোমার নাম।
১৯৭১-এর এই দিনটিতে তোমার দুই পুত্র তোমাকে বনি প্রিন্স (গোলাপ) উপহার দিয়েছিল আর ২০১৫ সালের এই দিনে শ্রদ্ধার্ঘ্যস্বরূপ রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার মাধ্যমে তোমার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তোমার এ প্রজন্মের সন্তানেরা অঙ্গীকারবদ্ধ।
আশফিয়া বিনতে আউয়াল: সহযোগী তত্ত্বাবধায়ক, শহীদজননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি জাদুঘর।
No comments