আরব বিপ্লবের অম্লান নারীরা by জাহাঙ্গীর আলম
বিগত ২০১১ সালে সবচে আলোচিত বিষয় ছিল মধ্যপ্রাচ্যে সরকার বিরোধী গণজাগরণ। ‘আরব বসন্ত’ নামে অভিহিত রাষ্ট্রগুলোতে চলমান একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই গণজাগরণে তিউনিসিয়ার মোহাম্মদ বুয়াজিজি, মিশরের ওয়ায়েল ঘুনিম প্রমুখদের নাম উচ্চারিত হয়েছে বহুবার।
কিন্তু এই আন্দোলনে এমন কয়েকজন নারীও রয়েছেন যারা তথাকথিত রক্ষণশীল আরব বিশ্বের গণজাগরণে ঈর্ষণীয় ভূমিকা রেখেছেন। এদের মধ্যে একজন ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান তো শান্তিতে নোবেল পেলেন। এ সূত্রে মিশরের বিখ্যাত তাহরির স্কয়ারের প্রাণ ছিলেন মেয়েরা এটা বললে অত্যুক্তি হবে না।
এর মধ্যে ২৬ বছর বয়সী আসমা মাহফুজ যখন ফেসবুকে লিখছিলেন, তিনি কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যাচ্ছেন এবং দেশকে বাঁচাতে এই আন্দোলনে সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। এপ্রিল-৬ যুব আন্দোলনের এই প্রতিষ্ঠাতা তখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন, তিউনিসিয়ার মতো একটা গণআন্দোলন একজন স্বৈরাচারকে উচ্ছেদ করতে পারে।
সফল ওই বিপ্লবের পর তার স্মৃতিচারণে মিশরীয় টেলিভিশনে তিনি জানান, সঙ্গে আরও তিনজনকে নিয়ে তাহরির স্কয়ারে যান তিনি। সেখানে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘মিশরীয় জনগণ, চারজন মানুষ অবমাননা আর দারিদ্র্যে পিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের আগুনে নিক্ষেপ করেছে। চারজন মিশরীয় নিজেদের আগুনে নিক্ষেপ করেছে কারণ নিরাপত্তা সংস্থার ভয়ে, গুলির ভয়ে নয়। তারা গায়ে আগুন দিয়েছে, এই কথা বলতে যে, আপনারা জেগে উঠুন। জেগে উঠুন। আমরা উতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।’
আরেক বিপ্লবী নারী মোনা সেইফ (২৪)। তিনি একজন গবেষক। তিনি একজন রাজনীতিকের মেয়ে। তার জন্মের সময় বাবা জেলে ছিলেন। একজন ব্লগারের বোনও তিনি, মোবারক সরকার তার বোনকেও কারাগারে পাঠিয়েছিল।
সেদিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমি তখন ভাবিনি একটা বিপ্লব হতে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, যদি আমরা কয়েক হাজার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি তাহলে অনেক বড় একটা কাজ হবে।
দেশে ভয়াবহ দূর্নীতি আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। খালেদ সাইদের মৃত্যু (নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত) এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় কপটিক চার্চে হামলাকারী সন্দেহে আটকদের ওপর নির্যাতন এসব আমাকে খুব ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।’
আন্দোলন জমবে কিনা এ নিয়ে প্রথমে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকলেও ২৫ জানুয়ারি যখন তাহরির স্কয়ারে ২০ হাজার লোকের সমাগমে বিক্ষোভের সূচনা হলো তখন তিনি একটি সফল বিপ্লবের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠেন।
মোনা সেইফ বলেন, ‘ওই রাতে মোবারকের সমর্থক গুণ্ডারা হামলা করতে উদ্যত হলে প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, অনেক মানুষ জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়ে গেছেন, এই দৃশ্যটি আমার জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
আমার এবং আমার বন্ধুর দায়িত্ব ছিল, তাহরির স্কয়ারের ধারণ করা ছবি এবং ভিডিও তাৎক্ষণিকভাবে ইন্টারনেটে আপলোড করা। তাহরির স্কয়ারের কাছেই এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আমরা এটা করতাম।’
তবে এই কাজ করতে গিয়ে প্রথম দিকে ধর্মীয় এবং লিঙ্গগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। তিনি জানান, ২৫ জানুয়ারির আগে মেয়েরা তাহরির স্কয়ারে গেলে হতাহত হওয়ার ভয়ে লোকজন তাদের ঘরে ফিরে যেতে বলত। এতে রাগ হতো। তিনি বলেন, ‘কিন্তু ২৫ জানুয়ারি থেকে লোকজন আমাকে তাদের সমান গণ্য করতে থাকে। তাহরির স্কয়ারে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের অব্যক্ত শ্রদ্ধাই বিরাজমান ছিল বলা যায়।’
এখানে আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই গেছে। কিন্তু তাহরির স্কয়ার যেন ভিন্ন এক সমাজ। বাইরের মিশরীয় সমাজের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই।
তাহরির স্কয়ারের এই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা এখন মোনা সেইফকে এই অনুভূতি দিয়েছে, তিনি আর সমাজ বিচ্ছিন্ন নন। তার আশা মিশরের মানুষ তাহরির স্কযারের এই স্পিরিট ধরে রাখবে। সমাজে পরিবর্তনের ধারা শুরু হবে এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত জনগণের নেতৃত্বে।
জিগি ইবরাহিম (২৪) একজন রাজনৈতিক কর্মী। মিশরে গণভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। দিনে দিনে এই রাজনৈতিক তৎপরতা তার নেশায় পরিণত হয়। নিয়মিত বৈঠকে যোগ দেওয়া আর বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ছিল সে সময়কার বাধা রুটিন।
তিনি বলেন, ‘আমি খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলাম, শ্রমিক আন্দোলনে বেশিরভাগ ধর্মঘটই শুরু করে মেয়েরা।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, প্রতিবাদ এবং ধর্মঘটে মেয়েরা একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে। যখনই সহিংসতা মাথা চাড়া দেয় তখনই মেয়েরা সামনে চলে আসে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরাই সবচে বেশি মারধরের শিকার হয়েছে।
২০১০ সালের জুনে খালেদ সাইদের প্রতিবাদের সময় একই দৃশ্য আমি দেখেছি।
তবে একজন মেয়ে হিসেবে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আমার পরিবারের তীব্র আপত্তি ছিল। তারা আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আমি মিথ্যা কথা বলে বিক্ষোভে যোগ দিতাম।’
২৫ জানুয়ারি তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ চড়াও হলে তার পিঠে রাবার বুলেট এসে লাগে। কিন্তু তারপরেও তারা আবার স্কয়ারে ফিরে যান।
জিগি বলেন, ‘বাবার উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছিল। ২৮ জানুয়ারি তো আমার বোন আমাকে ঘরে তালা দিয়ে রাখতে চাইলো। কিন্তু আমি ছিলাম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পরে তাহরির স্কয়ারের নিকটে চাচার বাড়িতে গিয়ে থাকি এবং নিয়মিত বিক্ষোভে অংশ নিই।
তবে শেষ পর্যন্ত আমার পরিবার বুঝতে পারে এবং আমাকে আরও উৎসাহ দিতে থাকে। কিন্তু আমার পরিবার কখনও সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না।’
২ ফেব্রুয়ারি যখন মোবারকের গুন্ডারা তাহরির স্কয়ারে আক্রমণ করে তখন মেয়েরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্কয়ার থেকে বের হওয়ার দুই পথ নিরাপদ রাখার দায়িত্ব ছিল তাদের। কোনও বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে তারাই সবাইকে সতর্ক করে দিত।
এছাড়া, স্কয়ারে অস্থায়ী ক্লিনিকে আহতদের সেবা শুশ্রূষা দেওয়াও ছিল তাদের কাজ। অনেক মেয়ে পুরুষদের সঙ্গে গুণ্ডাদের লক্ষ্য করে ইট-পাথরও ছুড়ে।
তিনি বলেন, ‘তাহরির স্কয়ারে টানা ১৮ দিন অবস্থান করেছি কিন্তু একটা মেয়েও হয়রানির শিকার হয়নি। আমার চারদিকে পাঁচজন পুরুষের মাঝে আমি ঘুমিয়েছি যাদের আমি চিনি না। আমি ছিলাম সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
জিগি ইবরাহিম মনে করেন এখনও বিপ্লব শেষ হয়নি। তাদের সব দাবি এখনও পূরণ হয়নি। তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। মিশরের পুনর্গঠনে আসল শ্রমটা এখন তাদের দিতে হবে।
সালমা এল তারজি (৩৩), তিনি একজন চিত্র নির্মাতা। জীবনে কখনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি সালমা। তার কখনও বিশ্বাস হয়নি এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ একদিন মিশরের ইতিহাস পাল্টে দেবে। কিন্তু বাসার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে যখন তিনি দেখছিলেন, হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে যাচ্ছে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এই আন্দোলনের অংশীদার তাকে হতেই হবে। এর পর আর ফিরে তাকাননি সালমা।
তিনি বলেন, ‘২৬ ও ২৭ জানুয়ারি আমি একাই ছিলাম কিন্তু ২৮ তারিখে ছোট ভাই এসে সঙ্গে যোগ দিলে আমার উৎসাহ বেড়ে যায়। স্বাধীনতা নয়ত কারাবরণের জন্য এখানেই দৃঢ়পদ থেকে লড়াই করে যেতে হবে। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিলাম।’
তবে অন্যদের মতো সালমাকে পরিবারের বাধার মুখে পড়তে হয়নি। তার বাবা ছিলেন তাদের বড় সমর্থক। ভাই-বোনকে বাবা বলতেন, ‘গোলাগুলি দেখে ভয়ে পালাবে না, সামনে এগিয়ে যাবে।’
সালমা বলেন, ‘তাহরির স্কয়ার যেন গণতন্ত্রের একটি ক্ষুদ্র মডেলে পরিণত হয়েছিল। সেখানে টিকে থাকা সহজ ছিল না। আমরা নিকটবর্তী একটি মসজিদ এবং আমি এক বন্ধুর বাড়িতে যেতাম পরিষ্কার হওয়ার জন্য। খুবই ঠাণ্ডার মধ্যে মেঝেতে ঘুমাতে হতো। বিপ্লবের সুবাস আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে এবং সব কাঠিন্য অতিক্রম করতে প্রেরণা দিয়েছে।’
তাহরির স্কয়ার নারী-পুরুষ ভেদবুদ্ধিতেও পরিবর্তন এনেছিল। যখন পুরুষরা দেখতো মেয়েরা সামনে থেকে লড়াই করছে তখন তারা বুঝল আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। এখানে সবাই মিশরীয়।
আমার সঙ্গে ছিল নানা বয়সের অনেক নারী। আমরা পুরুষদের মতোই তৎপর ছিলাম। এটা অনেকের মধ্যে নারীর ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনেছিল। কোনও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেনি। শুধু মোবারকের পতনের দিনেই কিছু হয়রানির ঘটনা ঘটে। যারা এসব করেছে তারা আসলে বিপ্লব চায়নি। এরা শুধু ছবি তুলতে এসেছিল।
সালমা বলেন, ’২৫ জানুয়ারির আগে পর্যন্ত আমি ভাবিনি আমার কথা কেউ শুনবে। আমার কখনও মনে হয়নি, আমি ভষ্যিতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মোবারক যেমনটি বলতেন, তিনিই আমাদের পিতা আমরা তার সন্তান। এই ধারণা আমাদের এমন ভাবনায় আবিষ্ট করেছিল, যেনো কোনও প্রণোদনায়ই আমাদের জাগাতে পারবে না।’
আরেক বিপ্লবী নারী ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান (৩২)। প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে রাজধানী সানার চেঞ্জ স্কয়ারে জড়ো হওয়া প্রতিবাদকারী তরূণদের মধ্যে দুর্দমনীয় এক প্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি।
প্রথমদিকে কেউ ধারণাই করেনি তিন সন্তানের জননী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী তাওয়াক্কুল সালেহর গদি টলিয়ে দেবেন। আগে থেকেই অবশ্য তিনি সালেহর পথের কাঁটা ছিলেন এবং এ কারণে বহুবার জেলেও গেছেন।
গত জানুয়ারিতে নিজের গাড়ি থেকে ধরে জেলে দেওয়ার পর তিনি আন্তর্জাতিক মহলের গোচরে আসেন। এসময় হাজার হাজার মানুষ তার মুক্তির দাবিতে সানার রাজপথে বিক্ষোভ করে। প্রেসিডেন্ট সালেহর বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা মূহূর্ত ছিল এটি। এ জন্যই তাকে বলা হয় ‘বিপ্লবের জননী’। এবছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে ২৬ বছর বয়সী আসমা মাহফুজ যখন ফেসবুকে লিখছিলেন, তিনি কায়রোর তাহরির স্কয়ারে যাচ্ছেন এবং দেশকে বাঁচাতে এই আন্দোলনে সবাইকে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। এপ্রিল-৬ যুব আন্দোলনের এই প্রতিষ্ঠাতা তখন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন, তিউনিসিয়ার মতো একটা গণআন্দোলন একজন স্বৈরাচারকে উচ্ছেদ করতে পারে।
সফল ওই বিপ্লবের পর তার স্মৃতিচারণে মিশরীয় টেলিভিশনে তিনি জানান, সঙ্গে আরও তিনজনকে নিয়ে তাহরির স্কয়ারে যান তিনি। সেখানে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘মিশরীয় জনগণ, চারজন মানুষ অবমাননা আর দারিদ্র্যে পিষ্ট হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেদের আগুনে নিক্ষেপ করেছে। চারজন মিশরীয় নিজেদের আগুনে নিক্ষেপ করেছে কারণ নিরাপত্তা সংস্থার ভয়ে, গুলির ভয়ে নয়। তারা গায়ে আগুন দিয়েছে, এই কথা বলতে যে, আপনারা জেগে উঠুন। জেগে উঠুন। আমরা উতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি।’
আরেক বিপ্লবী নারী মোনা সেইফ (২৪)। তিনি একজন গবেষক। তিনি একজন রাজনীতিকের মেয়ে। তার জন্মের সময় বাবা জেলে ছিলেন। একজন ব্লগারের বোনও তিনি, মোবারক সরকার তার বোনকেও কারাগারে পাঠিয়েছিল।
সেদিনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘আমি তখন ভাবিনি একটা বিপ্লব হতে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম, যদি আমরা কয়েক হাজার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারি তাহলে অনেক বড় একটা কাজ হবে।
দেশে ভয়াবহ দূর্নীতি আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। খালেদ সাইদের মৃত্যু (নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত) এবং আলেকজান্দ্রিয়ায় কপটিক চার্চে হামলাকারী সন্দেহে আটকদের ওপর নির্যাতন এসব আমাকে খুব ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।’
আন্দোলন জমবে কিনা এ নিয়ে প্রথমে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে থাকলেও ২৫ জানুয়ারি যখন তাহরির স্কয়ারে ২০ হাজার লোকের সমাগমে বিক্ষোভের সূচনা হলো তখন তিনি একটি সফল বিপ্লবের ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে ওঠেন।
মোনা সেইফ বলেন, ‘ওই রাতে মোবারকের সমর্থক গুণ্ডারা হামলা করতে উদ্যত হলে প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, অনেক মানুষ জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়ে গেছেন, এই দৃশ্যটি আমার জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল।
আমার এবং আমার বন্ধুর দায়িত্ব ছিল, তাহরির স্কয়ারের ধারণ করা ছবি এবং ভিডিও তাৎক্ষণিকভাবে ইন্টারনেটে আপলোড করা। তাহরির স্কয়ারের কাছেই এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আমরা এটা করতাম।’
তবে এই কাজ করতে গিয়ে প্রথম দিকে ধর্মীয় এবং লিঙ্গগত সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। তিনি জানান, ২৫ জানুয়ারির আগে মেয়েরা তাহরির স্কয়ারে গেলে হতাহত হওয়ার ভয়ে লোকজন তাদের ঘরে ফিরে যেতে বলত। এতে রাগ হতো। তিনি বলেন, ‘কিন্তু ২৫ জানুয়ারি থেকে লোকজন আমাকে তাদের সমান গণ্য করতে থাকে। তাহরির স্কয়ারে পরস্পরের প্রতি এক ধরনের অব্যক্ত শ্রদ্ধাই বিরাজমান ছিল বলা যায়।’
এখানে আমাদের অনেক চড়াই-উতরাই গেছে। কিন্তু তাহরির স্কয়ার যেন ভিন্ন এক সমাজ। বাইরের মিশরীয় সমাজের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই।
তাহরির স্কয়ারের এই অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা এখন মোনা সেইফকে এই অনুভূতি দিয়েছে, তিনি আর সমাজ বিচ্ছিন্ন নন। তার আশা মিশরের মানুষ তাহরির স্কযারের এই স্পিরিট ধরে রাখবে। সমাজে পরিবর্তনের ধারা শুরু হবে এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত জনগণের নেতৃত্বে।
জিগি ইবরাহিম (২৪) একজন রাজনৈতিক কর্মী। মিশরে গণভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন শ্রমিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। দিনে দিনে এই রাজনৈতিক তৎপরতা তার নেশায় পরিণত হয়। নিয়মিত বৈঠকে যোগ দেওয়া আর বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ছিল সে সময়কার বাধা রুটিন।
তিনি বলেন, ‘আমি খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারলাম, শ্রমিক আন্দোলনে বেশিরভাগ ধর্মঘটই শুরু করে মেয়েরা।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি, প্রতিবাদ এবং ধর্মঘটে মেয়েরা একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে। যখনই সহিংসতা মাথা চাড়া দেয় তখনই মেয়েরা সামনে চলে আসে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এরাই সবচে বেশি মারধরের শিকার হয়েছে।
২০১০ সালের জুনে খালেদ সাইদের প্রতিবাদের সময় একই দৃশ্য আমি দেখেছি।
তবে একজন মেয়ে হিসেবে বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে আমার পরিবারের তীব্র আপত্তি ছিল। তারা আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আমি মিথ্যা কথা বলে বিক্ষোভে যোগ দিতাম।’
২৫ জানুয়ারি তাহরির স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ চড়াও হলে তার পিঠে রাবার বুলেট এসে লাগে। কিন্তু তারপরেও তারা আবার স্কয়ারে ফিরে যান।
জিগি বলেন, ‘বাবার উদ্বেগ দিন দিন বাড়ছিল। ২৮ জানুয়ারি তো আমার বোন আমাকে ঘরে তালা দিয়ে রাখতে চাইলো। কিন্তু আমি ছিলাম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পরে তাহরির স্কয়ারের নিকটে চাচার বাড়িতে গিয়ে থাকি এবং নিয়মিত বিক্ষোভে অংশ নিই।
তবে শেষ পর্যন্ত আমার পরিবার বুঝতে পারে এবং আমাকে আরও উৎসাহ দিতে থাকে। কিন্তু আমার পরিবার কখনও সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না।’
২ ফেব্রুয়ারি যখন মোবারকের গুন্ডারা তাহরির স্কয়ারে আক্রমণ করে তখন মেয়েরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। স্কয়ার থেকে বের হওয়ার দুই পথ নিরাপদ রাখার দায়িত্ব ছিল তাদের। কোনও বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলে তারাই সবাইকে সতর্ক করে দিত।
এছাড়া, স্কয়ারে অস্থায়ী ক্লিনিকে আহতদের সেবা শুশ্রূষা দেওয়াও ছিল তাদের কাজ। অনেক মেয়ে পুরুষদের সঙ্গে গুণ্ডাদের লক্ষ্য করে ইট-পাথরও ছুড়ে।
তিনি বলেন, ‘তাহরির স্কয়ারে টানা ১৮ দিন অবস্থান করেছি কিন্তু একটা মেয়েও হয়রানির শিকার হয়নি। আমার চারদিকে পাঁচজন পুরুষের মাঝে আমি ঘুমিয়েছি যাদের আমি চিনি না। আমি ছিলাম সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
জিগি ইবরাহিম মনে করেন এখনও বিপ্লব শেষ হয়নি। তাদের সব দাবি এখনও পূরণ হয়নি। তাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। মিশরের পুনর্গঠনে আসল শ্রমটা এখন তাদের দিতে হবে।
সালমা এল তারজি (৩৩), তিনি একজন চিত্র নির্মাতা। জীবনে কখনও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেননি সালমা। তার কখনও বিশ্বাস হয়নি এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ একদিন মিশরের ইতিহাস পাল্টে দেবে। কিন্তু বাসার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে যখন তিনি দেখছিলেন, হাজার হাজার মানুষ মিছিল নিয়ে যাচ্ছে তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, এই আন্দোলনের অংশীদার তাকে হতেই হবে। এর পর আর ফিরে তাকাননি সালমা।
তিনি বলেন, ‘২৬ ও ২৭ জানুয়ারি আমি একাই ছিলাম কিন্তু ২৮ তারিখে ছোট ভাই এসে সঙ্গে যোগ দিলে আমার উৎসাহ বেড়ে যায়। স্বাধীনতা নয়ত কারাবরণের জন্য এখানেই দৃঢ়পদ থেকে লড়াই করে যেতে হবে। এছাড়া কোনো বিকল্প নেই এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছিলাম।’
তবে অন্যদের মতো সালমাকে পরিবারের বাধার মুখে পড়তে হয়নি। তার বাবা ছিলেন তাদের বড় সমর্থক। ভাই-বোনকে বাবা বলতেন, ‘গোলাগুলি দেখে ভয়ে পালাবে না, সামনে এগিয়ে যাবে।’
সালমা বলেন, ‘তাহরির স্কয়ার যেন গণতন্ত্রের একটি ক্ষুদ্র মডেলে পরিণত হয়েছিল। সেখানে টিকে থাকা সহজ ছিল না। আমরা নিকটবর্তী একটি মসজিদ এবং আমি এক বন্ধুর বাড়িতে যেতাম পরিষ্কার হওয়ার জন্য। খুবই ঠাণ্ডার মধ্যে মেঝেতে ঘুমাতে হতো। বিপ্লবের সুবাস আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে এবং সব কাঠিন্য অতিক্রম করতে প্রেরণা দিয়েছে।’
তাহরির স্কয়ার নারী-পুরুষ ভেদবুদ্ধিতেও পরিবর্তন এনেছিল। যখন পুরুষরা দেখতো মেয়েরা সামনে থেকে লড়াই করছে তখন তারা বুঝল আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ। এখানে সবাই মিশরীয়।
আমার সঙ্গে ছিল নানা বয়সের অনেক নারী। আমরা পুরুষদের মতোই তৎপর ছিলাম। এটা অনেকের মধ্যে নারীর ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এনেছিল। কোনও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেনি। শুধু মোবারকের পতনের দিনেই কিছু হয়রানির ঘটনা ঘটে। যারা এসব করেছে তারা আসলে বিপ্লব চায়নি। এরা শুধু ছবি তুলতে এসেছিল।
সালমা বলেন, ’২৫ জানুয়ারির আগে পর্যন্ত আমি ভাবিনি আমার কথা কেউ শুনবে। আমার কখনও মনে হয়নি, আমি ভষ্যিতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মোবারক যেমনটি বলতেন, তিনিই আমাদের পিতা আমরা তার সন্তান। এই ধারণা আমাদের এমন ভাবনায় আবিষ্ট করেছিল, যেনো কোনও প্রণোদনায়ই আমাদের জাগাতে পারবে না।’
আরেক বিপ্লবী নারী ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান (৩২)। প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে রাজধানী সানার চেঞ্জ স্কয়ারে জড়ো হওয়া প্রতিবাদকারী তরূণদের মধ্যে দুর্দমনীয় এক প্রেরণার উৎস ছিলেন তিনি।
প্রথমদিকে কেউ ধারণাই করেনি তিন সন্তানের জননী সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী তাওয়াক্কুল সালেহর গদি টলিয়ে দেবেন। আগে থেকেই অবশ্য তিনি সালেহর পথের কাঁটা ছিলেন এবং এ কারণে বহুবার জেলেও গেছেন।
গত জানুয়ারিতে নিজের গাড়ি থেকে ধরে জেলে দেওয়ার পর তিনি আন্তর্জাতিক মহলের গোচরে আসেন। এসময় হাজার হাজার মানুষ তার মুক্তির দাবিতে সানার রাজপথে বিক্ষোভ করে। প্রেসিডেন্ট সালেহর বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা মূহূর্ত ছিল এটি। এ জন্যই তাকে বলা হয় ‘বিপ্লবের জননী’। এবছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন তিনি।
No comments