দেশবাসী ড. ইউনূসকে আরও সক্রিয় দেখতে চায় by বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, বীরউত্তম

শেখ হাসিনাকে ফেলে দেয়ার জন্য জো বাইডেন নানা রকম নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছিলেন। এখন শুনছি নবনির্বাচিত ট্রাম্প শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাবেন। সেখানে ভারত সরকারেরও সহযোগিতা থাকবে। এসবের কোনো কিছুই ভালো না। আমাদের দেশ, আমাদের জনগণ কাকে ক্ষমতায় বসাবে আর কাকে বসাবে না সেটা ঠিক করবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি নয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও নয়। এসব খুবই বাজে কথা। পরাজিতরা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে- এটাই শাশ্বত সত্য। চাল ডাল লবণ তেল প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া...

বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মাসটি মুক্তিযুদ্ধের বড় বেশি স্মরণীয় মাস। ৩০শে নভেম্বর ’৭১ নাগরপুর থানা আক্রমণ করেছিলাম। সারা মুক্তিযুদ্ধে কাদেরিয়া বাহিনী কখনো কোথাও অত শক্তি প্রয়োগ করেনি। প্রায় পাঁচ হাজার যোদ্ধার ১৫টা কোম্পানি নিয়ে নাগরপুর থানা আক্রমণ করা হয়েছিল। আমি ছিলাম পূর্বদিকে, উত্তরে ছিল হুমায়ুন বাঙ্গাল, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি, রবিউল আলম গেরিলা, মোস্তফা, সবুর খান, মকবুল হোসেন খোকা, সাইদুর, ফজলু শামসুল হক দক্ষিণেও চেপে ধরেছিল। শুধু খোলা ছিল পশ্চিম দিক। নাগরপুর থানা মাটির নিচ দিয়ে সব জায়গায় সীমানা বাঙ্কার করা হয়েছিল। তাই আমাদের প্রথম আক্রমণে পাকিস্তান হানাদাররা থানা ছেড়ে সামান্য একটু পেছনে চলে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল হনুমান কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুনকে নিয়ে। সে তার প্রায় ৪০০ যোদ্ধা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া হানাদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা কোনো দিশা না পেয়ে আবার এসে থানার বাঙ্কারে লুকায়। সারাদিন যুদ্ধ চলে। কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি, বীরপ্রতীক, হনুমান কোম্পানি কমান্ডার হুমায়ুন বাঙ্গাল এবং একেবারে আমার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে চর পাকুল্লার শামসুল হক সারাদিন পড়ে থাকে। এ ছাড়া আরও ৬-৭ জন আহত হয়। সেই সময় কেবলই ভারত থেকে ফিরে আসা কাদেরিয়া বাহিনীর স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. শাহজাদা চৌধুরী কেদারপুরে অবস্থান করছিল। যার কারণে নাগরপুর যুদ্ধে আহত কেউ মারা যায়নি, শহীদ হয়নি। এপ্রিল থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকা দখল পর্যন্ত একত্র কোথাও কাদেরিয়া বাহিনী অত শক্তি প্রয়োগ করেনি। অত বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করেও নাগরপুর থানার পতন ঘটানো যায়নি। নাগরপুরের যুদ্ধে আমি নিজেও সামান্য আহত হয়েছিলাম। গুলি লেগেছিল আগস্ট মাসের ১৬ তারিখ আর পহেলা ডিসেম্বর ’৭১ নাগরপুর থানা দখলে। এইটটি থ্রি ব্লান্ডার সাইটের গোলা ছুড়তে গিয়ে সামান্য আঘাত লেগেছিল। সে যুদ্ধ ছিল এক মারাত্মক কঠিন ব্যাপার। সারাদিনে হানাদার ঘাঁটির পতন ঘটাতে না পেরে আমরা সবাই এক কিলোমিটারের মতো যার যার দিকে থানা থেকে সরে গিয়ে রাত কাটিয়ে ছিলাম। পরদিন বেলা ওঠার আগে থেকেই আবার যতদূর এগুনো যায়, যতদূর কেন আমরা থানা বাউন্ডারির কোন জায়গায় ১০০, কোন জায়গায় ৭০-৮০ গজের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় দিনের প্রচণ্ড গোলাগুলিতেও হানাদারদের ঘাঁটির পতন ঘটানো যায়নি। থানার একেবারে কাছে পৌঁছে যাওয়ায় থ্রি ইঞ্চ মর্টার ব্যবহার করা যাচ্ছিল না। কারণ নিজেদের গোলা নিজেদের উপর পড়তে পারে। ৭২ আর আর ছিল, ৪-৫টা রকেট লাঞ্চার, ব্যালেন্ডার সাইট মিলে প্রায় ১৫টা, হেভি মেশিনগান ৫টা, মিডিয়াম মেশিনগান ৬টা, লাইট মেশিনগান মানে খগএ প্রায় ৩০টা আর সবই স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। কিন্তু এত প্রচণ্ড শক্তির পরও হানাদারদের জন্য অনুকূল, আমাদের জন্য প্রতিকূল হওয়ায় নাগরপুর ঘাঁটির পতন ঘটাতে পারিনি। ২ তারিখ দুইটা-আড়াইটার দিকে খবর আসে নাগরপুরের হানাদারদের উদ্ধার করতে টাঙ্গাইল থেকে এক ব্যাটালিয়ান সৈন্য আসছে। তাদেরকে এলাসিন ঘাটে বাধা দেয়া হয় এবং আমরা আক্রমণ প্রত্যাহার করে সবক’টি দল নিয়ে এলাসিন ঘাটে পৌঁছে যাই। আমরা এলাসিন নদীর দক্ষিণ পাড়ে, হানাদাররা উত্তর-পূর্ব পাড়ে। তখনো তারা নদী পেরুতে পারেনি। কিন্তু হানাদাররা অনেকটা উত্তর-পশ্চিমে সরে গিয়ে নদীর বিশাল চরের মধ্যদিয়ে প্রায় দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে চলে এসেছিল। আমরা ছিলাম ভাররা বাজারের পাশে। আমাদের হাতে ১৫-২০ জন হানাদার আহত ও নিহত হয়েছিল। সেখানে আমাদের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা কামুটিয়ার সানোয়ার মারাত্মকভাবে আহত হয়। আল্লাহ’র দয়ায় সাহসী যোদ্ধাটি এখনো বেঁচে আছে। যখনই ভগ্ন স্বাস্থ্য সানোয়ারকে দেখি তখনই সেই এলাসিনের যুদ্ধের কথা মনে হয়। আল্লাহ আয়ু দিয়েছেন; তাই এখনো সানোয়ার বেঁচে আছে। এমন আরও কতো যোদ্ধা বেঁচে আছে। কিন্তু তাদের স্বস্তি নেই, শান্তি নেই, সম্মান নেই।

এবার নতুন অবস্থা, নতুন আঙ্গিকে, নতুন প্রেক্ষাপট। কিন্তু কেন যেন ভালো কিছু দেখতে পাচ্ছি না। অধ্যাপক ইউনূসের গ্রামীণ ব্যাংকের দুঃসময়ে প্রায় ২-৩ বছর তাকে ছায়ার মতো সাহস দিয়েছি। একজন রাজনৈতিক মানুষের যা কিছু করা সম্ভব করার চেষ্টা করেছি। এসবের মধ্যে ছিলেন ড. কামাল হোসেন। তার উৎসাহেই ওসব করেছি। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। সাধারণ মানুষ তার কাছ থেকে যতটা যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধের আশা করেছিল উপদেষ্টা পরিষদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের তেমন আশা পূরণ হয়নি। যে কারণে তিনি নিজেও ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেন। ইদানীং সমন্বয়কদের কথা শুনছি। বিশেষ করে সারজিস, তার কথাবার্তা অনেকটাই শেখ হাসিনার মতো। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা যাদের পরাজিত করে মহা বিজয় অর্জন করেছেন, পরাজিতরা নাকে সরিষার তেল দিয়ে মোটেই ঘুমিয়ে থাকবে না- এটাই সত্য কথা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলতেন তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সরকারকে অস্থিতিশীল করা, তাকে সরিয়ে অন্যেরা সরকারে আসা- এটাই শতসিদ্ধ সত্য। এর কোনো কোনো জায়গায় নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র হয়। কিন্তু সবটুকু নয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারিয়েছে। তার প্রধান কাজ ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করা। সেটা তিনি বা তারা সদা সর্বদা করবেন। এ সরকারকে অস্থিতিশীল করার যত রকমের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আছে তা করবেন। এতে ক্ষোভ প্রকাশের কোনো কারণ নেই। এ তো খুবই সত্য। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কয়েক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আহত-নিহত হয়েছে। এটা তো বুকে হাত দিয়ে অবশ্যই বলা যায়- আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তরাও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো সাহায্য সহযোগিতা পায়নি। এমনকি যথাযথ চিকিৎসা সেবাও পায়নি। তাই শুধু কথার ফুলঝুরি ঝরালেই চলবে না, বাস্তবের সঙ্গেও কিছু না কিছু মিল থাকতে হবে। পতিতদের কাজ কি? হারানো স্থান দখল করা বা ফিরে পাওয়া। সেক্ষেত্রে হাসিনা আর আওয়ামী লীগকে এক করে ফেললে নিশ্চয়ই তার শক্তি সামর্থ্য বাড়বে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর বঙ্গবন্ধু এক কথা নয়। শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষ মুক্তিযোদ্ধাও না। এ জিনিসগুলো আন্দোলনকারীদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।

শেখ হাসিনাকে ফেলে দেয়ার জন্য জো বাইডেন নানা রকম নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছিলেন। এখন শুনছি নবনির্বাচিত ট্রাম্প শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসাবেন। সেখানে ভারত সরকারেরও সহযোগিতা থাকবে। এসবের কোনো কিছুই ভালো না। আমাদের দেশ, আমাদের জনগণ কাকে ক্ষমতায় বসাবে আর কাকে বসাবে না সেটা ঠিক করবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি নয়, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও নয়। এসব খুবই বাজে কথা। পরাজিতরা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবে- এটাই শাশ্বত সত্য। চাল ডাল লবণ তেল প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। তাতে সত্যিই দেশবাসী বিরক্ত হতাশ। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বিবেচনার মধ্যেই নেই। অতি সম্প্রতি ইসকন থেকে বিতাড়িত চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের চট্টগ্রামের হুজ্জতি সারা দেশকে এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থায় পৌঁছে দিয়েছে। ৩-৪ ঘণ্টা আদালতে দাঙ্গা- হাঙ্গামা ইতিহাসের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সেখানে ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময়ের অনুসারীদের হাতে এড. সাইফুল ইসলাম আলিফের প্রাণনাশ এক মারাত্মক অশনিসংকেত। এটা সত্যিই আমাদের জন্য চরম উৎকণ্ঠার বিষয়। আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে হিন্দু-মুসলমানের তেমন রেষারেষি নেই। আমরা পাশাপাশি জন্মেছি, পাশাপাশি মরি। আমাদের কবরস্থান আর শ্মশানঘাট অনেক সময় পাশাপাশি দেখা যায়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে কতো শত হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান আলেম-ওলামা হিন্দুদের বাড়িঘর, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরম যত্নে পাহারা দিয়েছে। তাই এসব দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কেন যেন অধ্যাপক ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদের সে দক্ষতা খুঁজে পাচ্ছি না। যখন সবাইকে একযোগে কাজ করা উচিত সেখানে নিজেদের মধ্যেই অনেক বিভাজন, অনৈক্য দেখতে পাচ্ছি।

গ্রামীণ ব্যাংকের উপর শেখ হাসিনার সর্বগ্রাসী আক্রমণে সময় ড. কামাল হোসেনের অনুরোধে প্রায় ২-৩ বছর একনাগাড়ে অধ্যাপক ইউনূসকে যখন যেভাবে যতটা সহযোগিতা করা দরকার করার চেষ্টা করেছি। দলীয় এবং পারিবারিকভাবে অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তাকে যে উচ্চ মার্গের মানুষ হিসেবে মনে হয়েছে কেন যেন উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের পর তাকে তেমন দেখছি না। কোথায় যেন তার দক্ষতা-যোগ্যতার অল্প বিস্তর খাদ দেখতে পাচ্ছি। এক’শ কয়েকদিন তিনি ক্ষমতায়, কতো দলের সঙ্গে একাধিকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, অনেক কথা হয়েছে। আমাদের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ একটি নিবন্ধিত দল। আমাদের সঙ্গে কেন যে একবারও কথা বা আলাপ আলোচনার প্রয়োজন মনে করছেন না কেন বুঝতে পারছি না। এরমধ্যে কিছু লোকজনের সঙ্গে তো দেখা- সাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয়েছে। কিন্তু তাদের খুব একটা সক্রিয় এবং যোগ্যও মনে হচ্ছে না। কেন যেন সবাই গা এলিয়ে আছেন। এখান থেকে খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে দেশ ও জাতির মারাত্মক ক্ষতি হবে। একবার সে ক্ষতি হয়ে গেলে শত চেষ্টা করেও আমরা তা পূরণ করতে পারবো না।

No comments

Powered by Blogger.