আওয়ামী লীগের শাসনামলে চোরতন্ত্র সৃষ্টি হয়েছিল

দেশের অর্থনীতির অবস্থা পর্যালোচনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি মনে করে, দেশে গত ১৫ বছরে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিল, যাতে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার বা ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৭ লাখ কোটি টাকা।

সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে শ্বেতপত্র কমিটির সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময় কমিটির সব সদস্য সংক্ষেপে তাদের প্রতিক্রিয়া জানান।

কারা বেশি দুর্নীতিবাজ ছিল- এমন প্রশ্নের জবাবে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় বলেছেন, কমিটি বিষয়টি নিয়ে যেসব শুনানি করেছে সেখানে এমন মত এসেছে যে ‘চোরতন্ত্রের মূল স্তম্ভ ছিল আমলারা, সামরিক-বেসামরিক-রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীরা। আইনসভা, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগসহ সবাই যখন গোষ্ঠীবদ্ধভাবে চুরির অংশ হয় সেটাই চোরতন্ত্র। মূলত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনই এই বিষবৃক্ষ তৈরি করেছে।

কারা এসব দুর্নীতি করেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের কাজ চোর ধরা না, চুরির বর্ণনা দেয়া। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, বরং চুরির প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা। ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়ে কারও কিছু বলার থাকলে দুদক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে যাওয়াই শ্রেয়।
শ্বেতপত্রে গত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে সীমাহীন দুর্নীতি, পাচার বা লুটপাটের তথ্য-উপাত্ত দেয়া হলেও কমিটি বলছে, তাদের হাতে এর কোনো প্রমাণ নেই। তবে তাদের ধারণা যেসব খাতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে তার মধ্যে শীর্ষে থাকবে ব্যাংকিং, অবকাঠামো, জ্বালানি এবং তথ্য প্রযুক্তি খাত।
এর আগে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি রোববার উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তখন তারা জানিয়েছিল যে, শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও আর্থিক কারচুপির যে তথ্য পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। এই কমিটি দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করেছে। গত ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর ২৮শে আগস্ট দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক চিত্র জানতে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয়।

শ্বেতপত্র যা বলছে: শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবারিত দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার ও স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতার অপপ্রয়োগের মাধ্যমে দেড় দশক ধরে বাংলাদেশে একটি ‘চোরতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। প্রতিবছর পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার।
এতে আরও বলা হয়, বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে মেগা প্রকল্পগুলোতে। ১৫ বছরে প্রকল্পের খরচ গড়ে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকল্পগুলো শেষ করতে গড়ে ৫ বছরের বেশি সময় লেগেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ ৬১ হাজার থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা) রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাজেট বাড়ানোর মতো বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে। এতে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীর করেছে। বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেতো। ধারাবাহিক ঋণ খেলাপির ঘটনা এবং বড় ধরনের কেলেঙ্কারিগুলো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করেছে এবং উৎপাদনশীল খাত থেকে পুঁজি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে বলেও শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অভিবাসন খাতে গত এক দশকে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ কোটি টাকা সরানো হয়েছে হুন্ডিতে লেনদেনের মাধ্যমে। মূলত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে ভিসা ক্রয়ের নামে এ টাকা বিদেশে গেছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়, এ টাকা মতিঝিল-উত্তরা রুটের মেট্রোরেল নির্মাণ খরচের চারগুণ। সিন্ডিকেট ও অনৈতিক রিক্রুটমেন্ট চর্চার কারণে সত্যিকার অভিবাসী কর্মীরা ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং দেশ রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ভুয়া বরাদ্দগুলোর কারণে লাখ লাখ মানুষ ঝুঁকিতে পড়েছে। জলবায়ু তহবিলে দুর্নীতির অভিযোগও আনা হয়েছে শ্বেতপত্রে।
গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, গৃহস্থালির উৎপাদন, পরিসংখ্যান বিকৃত করা এবং চাহিদা কম দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে চাল, ভোজ্য তেল এবং গমের মতো প্রধান পণ্যের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে। যা বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। সাধারণ ভোক্তাদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে উন্নয়ন বাজেটের ৪০ শতাংশ অর্থ তছরুপ হয়েছে। সেই সঙ্গে দেশের ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদ ভোগ করেছেন।

শ্বেতপত্র কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে ৭টি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছেন প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তিনি বলেন, ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে যে টাকা পাচার হয়েছে সেটা দেশের মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাঁধে থেকে যাবে। টাকা পাচার ধরা খুবই কঠিন। তবুও আমরা চেষ্টা করেছি।
কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক একে এনামুল হক বলেন, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে।
কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ জানান, বিগত শাসনামলে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপি’র ৬ শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিনগুণ করা যেতে পারতো বলে জানান তিনি।

কমিটির আরেক সদস্য ম. তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং ১০ শতাংশ যদি অবৈধ লেনদেন ধরা হয়, তাহলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তির বিধান করে দুর্নীতির রাজকপাট খুলে দেয়া হয়েছিল গত ১৫ বছরে এবং নীতি করেই দুর্নীতির পথ সুগম করে দেয়া হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, এতদিন ভেবেছিলাম, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার শঙ্কায় আছি। এখন আমরা বলছি, আমরা সেই ফাঁদে পড়ে গেছি। পরিসংখ্যান দিয়ে এতদিন উন্নয়ন দেখানো হয়েছে। বাস্তবে তা হয়নি। হিসাব গরমিলের কারণে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছি। তার মতে, সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতি সংস্কার ও জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ছাড়া এ থেকে উত্তরণের উপায় নেই।

এলডিসি থেকে উত্তরণ সম্পর্কে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সক্ষমতা ও আয়তন অনুসারে বাংলাদেশ এলডিসিতে থাকার মতো দেশ নয়। যদি কোনো কারণে ২০২৬ সালে উত্তরণ হতে না পারি, তাহলে আবার বলা হবে, “সোনার সংসার রেখে গিয়েছিলাম, এটা নষ্ট করে গেছে।” যারা (বাজার-সুবিধাপ্রাপ্ত রপ্তানিকারক) এলডিসি উত্তরণ পিছিয়ে দিতে তদবির করেন, তাদের গোড়া কোথায়, তা দেখেন। তারা সংসদে প্রভাবশালী ছিলেন, রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন। আমরা দেখেছি, একটি রপ্তানি খাতকে কীভাবে একচেটিয়া সুবিধা দেয়া হয়েছে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, চরম ত্রুটিপূর্ণ তিনটি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা না হলে পুরনো খেলোয়াড়েরা (যারা এসব খাত ধ্বংস করেছে) ফিরে আসতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ৫টি পরামর্শ দেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান। প্রথমত, গত পাঁচ মাসে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা। দ্বিতীয়ত, আগামী ছয় মাস যেহেতু দেশ ও জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তাই এ সময়ে কী অর্থনৈতিক সংস্কার করা হবে, তা জনগণের সামনে তুলে ধরা। যেমন- মূল্যস্ফীতি, সুদের হার, টাকার মান কত হবে, তা জনগণকে জানানো। অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা উচিত। তৃতীয়ত, আগামী দিনের সীমারেখা কী, তা না বুঝে কেউ বিনিয়োগ করবে না। নিকট ভবিষ্যৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হবেন। দুই বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা করার পরামর্শ দেন তিনি। চতুর্থত, তিনি মনে করেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়া স্থবির হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনটি মাপকাঠিতে বাংলাদেশ উত্তীর্ণ হয়েছে। তাই ২০২৬ সালের আগে বড় ধরনের অর্থনৈতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হলে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এখনো সেই সময় হয়নি। পঞ্চমত, উন্নয়ন সহযোগী; বাজার-সুবিধা দেয়ার দেশ; বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং শ্রমশক্তি নেয়, এমন দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে আগামী বছরের প্রথম দিকে একটি উন্নয়ন ফোরাম বৈঠক করা, যেখানে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে হবে।

যেসব পদ্ধতিতে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ শাসনামলে দুর্নীতি হয়েছে, তার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে। এ পদ্ধতিগুলো হলো-

ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারি: প্রতারণাপূর্ণ ব্যাংকঋণের ব্যাপক প্রসারের কথা উল্লেখ করেছে শ্বেতপত্র কমিটি। এর পাশাপাশি ছিল ঋণের অর্থ আত্মসাৎ করা।

ব্যাংক অধিগ্রহণ: আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে জোর করে ব্যাংকের মালিকানা অধিগ্রহণ বা দখল করা হয়েছে। শ্বেতপত্র কমিটি বলছে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সহায়তা নেয়া হয়েছে।

অবৈধভাবে অর্থ পাচার: বেআইনিভাবে যে অর্থ নেয়া হয়েছে, তা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। পাচার করা অর্থের পরিমাণ ছিল বিপুল।

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেয়া অলাভজনক প্রকল্প: লাভজনক হবে না, এমন প্রকল্পে সম্পদের অপচয় করা হয়েছে। সময়মতো এসব প্রকল্প শেষ করা হয়নি। বিপুল অর্থ খরচের কারণে তা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।

প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি: প্রকল্পের খরচ ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে, যাতে টাকা চুরি করা যায়।

প্রকল্প অনুমোদনের পর ব্যয় বৃদ্ধি: বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদনের পর কৃত্রিমভাবে ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল তহবিলের অর্থ পকেটস্থ করা।

প্রতিযোগিতাবিহীন দরপত্র প্রক্রিয়া: সরকারি কেনাকাটা করা হয়েছে, এমনভাবে যাতে স্বজনতোষী ও সুবিধাপ্রাপ্তরা লাভবান হয়। যোগ্য সরবরাহকারীদের এ প্রক্রিয়া থেকে বাইরে রাখা হয়েছে।

অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল প্রকল্প: একটি প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে দুর্বলভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সম্পদের অপচয় হয়েছে। প্রকল্প যথাসময়ে শেষ করা হয়নি, বেড়েছে খরচ।

নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি: প্রকল্পের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, বিশেষ করে যাদের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ করা হতো, তাদের নিয়োগের মাপকাঠি ছিল রাজনীতির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ। এক্ষেত্রে মেধা বিচার করা হতো না।

ভূমি ও সম্পদের অবৈধ অধিগ্রহণ: ভূমি ও সম্পদ জব্দ কিংবা অধিগ্রহণ করা হয়েছে বেআইনি পন্থায়।
ভূমি অধিগ্রহণের অর্থের অপব্যবহার: যেসব ভূমিমালিকের শক্ত রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল না, তাদেরকে অসম চুক্তিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য যে অর্থ দেয়া হয়েছে, তার অপব্যবহার করা হয়েছে।

চুক্তিমূল্য বাড়িয়ে কাজ দেয়া: রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারদের অনেক ক্ষেত্রে যেসব সরকারি কাজ দেয়া হয়েছে, তার মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এসব কাজে দেয়া হয়েছে কোনোরকম প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়াই।

প্রকল্পের সম্পদের অপব্যবহার: ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সুবিধার জন্য যানবাহন, ভ্রমণ বাজেট এবং প্রকল্পের অন্যান্য সম্পদের অপব্যবহার করা হয়েছে।

ঘুষকে ব্যবস্থাপনার মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার: কাজের প্রক্রিয়া জোরদার করা কিংবা বিশেষ সুবিধা নেয়ার জন্য নিয়মিতভাবে ঘুষের লেনদেন করা হতো।

রাষ্ট্রীয় তহবিলের ভুল বরাদ্দ: উন্নয়নকাজের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ অন্য কাজে ব্যবহার করা। এর উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য পূরণ।
অভিজাতদের কর অব্যাহতি: কর নীতি অসঙ্গতভাবে প্রভাবশালীদের সুবিধা দিয়েছে।

সরবরাহ চেইনের বিকৃতি: সরবরাহ ব্যবস্থাকে এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, যা পণ্যমূল্য অন্যায্যভাবে বাড়িয়েছে এবং বাজারে অদক্ষতা সৃষ্টি করেছে।
ইনসাইডার ইনফরমেশন বা ভেতরের তথ্য আদান-প্রদান: নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর কাছে নীতিসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ফাঁস করে দেয়া হতো, যাতে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে।

সংঘবদ্ধ দুর্নীতি: সরকারি কর্মকর্তা ও বেসরকারি ব্যক্তিরা আঁতাত করতেন, যাতে উভয়েই লাভবান হতে পারেন।

চাঁদাবাজিভিত্তিক দুর্নীতি: ঘুষ আদায় কিংবা অন্যায্য লেনদেনে যেতে চাপ প্রয়োগ করা হতো।
একচেটিয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে দুর্নীতি: বাজার পরিস্থিতি এমনভাবে পরিচালনা করা হতো, যাতে বিশেষ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়।
আগেই তথ্য লেনদেনের মাধ্যমে দুর্নীতি: গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আগেই জানিয়ে দেয়া হতো, ফলে বিশেষ গোষ্ঠী সুবিধা পেতো।
তথ্য গোপন করার মাধ্যমে দুর্নীতি: অংশীজনের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন রাখা হতো, যাতে তারা বিভ্রান্ত হয়।

নিষ্ক্রিয়তার মাধ্যমে দুর্নীতি: ঘুষ পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করা হতো।

কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য দুর্নীতি: ঘুষ ও যোগাযোগের ব্যবহার করা হতো, যাতে পদোন্নতি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া যায়।

কমিশনের ভাগ-বাটোয়ারা: কোনো বিষয়ে অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কমিশনের ভাগ চাইতেন।

রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়া: রাজনৈতিক আনুগত্য কিংবা সুবিধা পাওয়ার জন্য সম্পদের ব্যবহার ও সিদ্ধান্ত নেয়া হতো।

আইনের প্রণয়ন: আইন ও নীতি এমনভাবে প্রণয়ন করা হতো, যা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতো।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.