সীমান্তে অচলাবস্থা বাণিজ্য ব্যাহত by পরিতোষ পাল ও ওয়েছ খছরু

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে এবং গ্রেপ্তার হওয়া সন্ন্যাসীদের মুক্তির দাবিতে গতকাল পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বাংলাদেশ সীমান্তে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। ফলে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যাহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ওদিকে সিলেটের শ্যাওলা ও জকিগঞ্জ পোর্ট দিয়ে বাণিজ্য কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার পেট্রাপোলে এদিন প্রায় হাজার খানেক সন্ন্যাসী ও বিভিন্ন হিন্দু সংগঠনের সমর্থকরা সীমান্ত অবরুদ্ধ করে রাখেন। সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ সীমান্তে সমবেত হয়েছিলেন। পুলিশ অবশ্য সতর্কতা হিসেবে তাদের সীমান্তের জিরো পয়েন্টের ৮০০ মিটার আগেই আটকে দিয়েছে। অবশ্য আন্দোলনকারীরা মানববন্ধন করে জিরো পয়েন্টে গিয়ে বাংলাদেশকে বার্তা দিতে চলেছেন। অখিল ভারতীয় সন্ত সমিতির আয়োজনে এই অবরোধ কর্মসূচি থেকে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।

সন্ত সমিতির বাংলা কমিটির সভাপতি স্বামী পরমাত্মানন্দ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, নির্যাতন বন্ধ এবং ধৃত  সন্ন্যাসীদের মুক্তি না দেয়া পর্যন্ত সীমান্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে। তিনি বলেন, আমরা সব রকমের বাণিজ্য বন্ধ করে দেবো। কোচবিহারের চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তেও এদিন কয়েক শ’ মানুষ প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। সীমান্তে এই অবরোধের ফলে দুই দেশের মধ্যে যাত্রীদের আনাগোনা এক প্রকার ছিল না বললেই চলে।
বিজেপি’র নেতা ও রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আগামী বুধবার পেট্রাপোল সীমান্ত অবরুদ্ধ করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
এদিকে আসামের সীমান্তেও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সংবাদ সূত্রে জানা গেছে, সনাতনী ঐক্যমঞ্চ’র ডাকে এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে কয়েক হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। শিবসাগর জেলার সুতারকান্দি সীমান্তে চলো বাংলাদেশ নামের এই বিক্ষোভ কর্মসূচিকে সমর্থন জানিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা।

এদিকে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবলে এক বিবৃতিতে ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশে হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং তাদের সমর্থনে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আবেদন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে হিন্দু, নারী ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর ইসলামী মৌলবাদীদের হামলা, হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও অমানবিক নৃশংসতার ঘটনা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। হিন্দু মহাসভার পশ্চিমবঙ্গ কমিটির  সভাপতি ডক্টর চন্দ্রচূড় গোস্বামী  বলেছেন, আমরা প্রতিবাদ করছি। তবে প্রতিশোধ নেয়া প্রয়োজন।
ওদিকে সিলেট সীমান্তে ভারতের ‘হিন্দু ঐক্যমঞ্চ’র বাংলাদেশ অভিমুখে মার্চের পর দুই পোর্টে বাণিজ্য কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এ কারণে গতকাল বিয়ানীবাজারের শ্যাওলা ও জকিগঞ্জ পোর্ট দিয়ে মালামাল আসা-যাওয়া করেনি। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন; ভারত অংশে উত্তেজনার কারণে আপাতত বন্ধ রয়েছে দুই পোর্ট। বাংলাদেশে কথিত সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগে ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ এলাকায় বিক্ষোভ চলছে। ভারতের হিন্দু ঐক্যমঞ্চ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে রোববার কয়েকশ’ সনাতনী মানুষ ‘বাংলাদেশ চলো’ কর্মসূচি নিয়ে বিয়ানীবাজারের শ্যাওলা স্থলবন্দর অভিমুখে আসতে থাকে। বাংলাদেশ সীমান্তের অদূরে একটি স্থানে প্রথমে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। কিন্তু পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে তারা এগুতে থাকলে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কাঁটা তার দিয়ে ব্যারিকেড দেয়। এই ব্যারিকেড ভাঙতে চাইলে ভারতের উগ্রপন্থি সনাতনীদের সঙ্গে বিএসএফ ও ওখানকার পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে- সংঘর্ষে  বেশ কয়েকজন আহত হন। তবে ব্যারিকেড ভেঙে শেষ পর্যন্ত আরএসএ’র নেতৃত্বে থাকা ‘হিন্দু ঐক্যমঞ্চ’র নেতারা সীমান্ত এলাকায় আসতে পারেননি। তবে; তাদের এই মুভমেন্টের পর বাংলাদেশের শ্যাওলা সীমান্ত বন্দর দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। পোর্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- নিরাপত্তা বিবেচনায় কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় গতকালও  পোর্টের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ‘বাংলাদেশ চলো’ মুভমেন্টে স্থানীয় ‘হিন্দু ঐক্যমঞ্চ’র নেতারা বলছিলেন; ‘জীবন গেলে যাবে, তবুও তারা বাংলাদেশে যাবেন।’ বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা এই মার্চ কর্মসূচি পালন করছেন বলে জানান। এদিকে- আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জের সুতারকান্দি সীমান্তে যখন মুভমেন্ট নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছিল তখন রোববার পার্শ্ববর্তী করিমগঞ্জ স্টিমারঘাটের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি- রপ্তানি বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন। করিমগঞ্জের মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া খবরে জানা গেছে; ভারত অংশের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় বাংলাদেশে কঠিন পরিস্থিতি চলছে বলে ব্যবসায়ী নেতারা উল্লেখ করেন। তবে; ব্যবসায়ীদের এই সিদ্ধান্ত না মেনে গতকাল সকালে করিমগঞ্জ পোর্ট দিয়ে কার্যক্রম শুরু হলে করিমগঞ্জ এলাকার স্থানীয় বিধায়ক কমলাক্ষ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে করিমগঞ্জের কিছু সংখ্যক নেতাকর্মী পোর্টে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও গতকাল দুপুরের পর জকিগঞ্জে ভাইরাল হয়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা গেছে; বিধায়ক কমলাক্ষ চক্রবর্তী কিছু সংখ্যক কর্মী নিয়ে এসে নদী তীরবর্তী স্টিমারঘাটের পোর্টে আসেন। এ সময় ওই পোর্ট দিয়ে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া কিছু মালামাল ঢুকছিল। তিনি মালামালের একটি চালান আটক করে প্রকাশ্যে আগুন ধরিয়ে দেন। এক পর্যায়ে তিনি নিজেই বাঁশ এনে পোর্ট এলাকায় ব্যারিকেড দেন। একই সঙ্গে ঘোষণা দেন; বাংলাদেশ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পোর্ট দিয়ে আমদানি- রপ্তানি বন্ধ থাকবে। তবে এই মুভমেন্টের আগে দু’দেশের মধ্যে কয়েক গাড়ি মালামাল আসা-যাওয়া করেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশের জকিগঞ্জ পোর্টের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন- সকালে করিমগঞ্জ থেকে নদীপথে দুই ট্রাক পণ্য এসেছিল। ওই অংশে কিছু বিশৃঙ্খলার কারণে বিকাল পর্যন্ত মালামাল আসেনি ও বাংলাদেশ থেকে যায়নি। সিলেটের ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন; ভারত অংশের সমস্যার কারণে বিয়ানীবাজারের শ্যাওলা ও জকিগঞ্জ পোর্ট দিয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। ভারতের ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে যখনই সম্মতি আসবে তখনই ফের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা হবে। সিলেট আমদানিকারক গ্রুপের যুগ্ম সম্পাদক ও শ্যাওলা বন্দরের ব্যবসায়ী জয়ন্ত চক্রবর্তী মানবজমিনকে জানিয়েছেন- করিমগঞ্জের সুতারকান্দি স্থল বন্দরের ঝামেলার কারণে  রোববার থেকে সিলেটের শ্যাওলা ও জকিগঞ্জ পোর্ট দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। করিমগঞ্জের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমদানি-রপ্তানি শুরু হতে পারে বলে জানান তিনি। শ্যাওলা পোর্টের সিবিএ’র সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ উদ্দিন জানিয়েছেন- ‘হিন্দু ঐক্যমঞ্চ’র মুভমেন্টের আগে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক ছিল। এজন্য  পোর্টে মালামাল লোড করা ট্রাক অপেক্ষমাণ ছিল। বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার কারণে ওই ট্রাকগুলো আটকা পড়ে। আপাতত লোড করা ট্রাকগুলো খালাস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে; বাংলাদেশ অংশে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যেও এ নিয়ে কোনো উত্তেজনা নেই। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড বিজিবি’র ১৯ ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মেহেদী হাসান জানিয়েছেন- বাংলাদেশ অংশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সীমান্তে পূর্বের মতো বিজিবি’র পক্ষ থেকে টহল জোরদার রয়েছে। জকিগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আফসানা তাসনিম জানিয়েছেন- সীমান্তে নজরদারি চলছে। একই সঙ্গে বিজিবি’র পক্ষ থেকে অতিরিক্ত লোকবল নিয়ে টহল বাড়ানো হয়েছে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.