ভুটানে আগ্রাসী চমক সৃষ্টির জন্য প্রস্তুত মোদি by গোপিলাল আচার্য
ভারতের
সাম্প্রতিক পুনর্নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৭ আগস্ট থিম্পুতে
আসছেন। হিমালয় অঞ্চলের দেশটিতে এটা তার দ্বিতীয় সফর।
ভুটানে প্রধানমন্ত্রী মোদি রাজা জিগমে সিঙ্গে খেসার নামগেল ওয়াংচুক এবং চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের সাথে সাক্ষাত করবেন। সেই সাথে এই সফরে বেশ কিছু প্রকল্প উদ্বোধন এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে এই সফর একটা মাইলফলক সফর হতে যাচ্ছে।
প্রধান এজেন্ডাগুলোর মধ্যে রয়েছে ৭২০ মেগাওয়াট মাংদেচ্ছু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং সংশোধিত শুল্ক, যেটা ভুটানের ১২তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লী সফরের সময় রফতানি শুল্ক সংশোধন করে প্রতি ইউনিট ৪.১২ গুলট্রাম (ভুটানের মুদ্রা) করা হয়। ভারত একই সাথে ভুটানের ১২তম পরিকল্পনার জন্য ৪৫ বিলিয়ন গুলট্রাম-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং বাণিজ্য সহায়তা ও ভারতে ভুটানের রফতানি বৃদ্ধির জন্য আরও অতিরিক্ত ৪ বিলিয়ন গুলট্রাম-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মোদি একইসাথে রু পে কার্ডেরও উদ্বোধন করবেন। ভারতে কেনাবেচার জন্য অনেকটা ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মতোই এটা ব্যবহার করা যায় এবং এটিএম মেশিনে এই কার্ড ব্যবহার করা যায়। সিঙ্গাপুরের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে রু পে কার্ড ব্যবহার করতে যাচ্ছে ভুটান।
সাউথ এশিয়ান স্যাটেলাইটের জন্য একটি গ্রাউন্ড স্টেশানও উদ্বোধন করা হবে। দুই দেশের মধ্যে যে নয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে, তার মধ্যে ভুটানের নতুন মহাকাশ প্রযুক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশানের সহযোগিতার বিষয়টিও রয়েছে।
যুবকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির এজেন্ডা
একটা উল্লেখযোগ্য ভারতীয় এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে ভারত-ভুটান সম্পর্কের ব্যাপারে তরুণদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
দিল্লীতে গত সপ্তাহে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ভুটানের সাথে সম্পর্ককে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সীমানা ছাড়িয়ে আরও সামনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে বলেছেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পর্যটন খাতের বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভুটানের রয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভুটানের তরুণ প্রজন্মের সাথে সরাসরি কথা বলবেন।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদি দুই দেশের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলবেন। আমাদের উদ্দেশ্য হলো ভুটানের তরুণদের আরও কাছাকাছি যাওয়া এবং তাদেরকে এটা বোঝানো যে আমরা ভুটানের সাথে আরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়তে চাই”।
যদিও স্কলারশিপ নিয়ে বা নিজ খরচে উচ্চশিক্ষার জন্য ভুটানিজ শিক্ষার্থীদের ভারত গমন অব্যাহত রয়েছে, এর পরও দুই দেশের তরুণদের মধ্যে বিনিময়ের মাত্রা যথেষ্ট কম। তাছাড়া ভারতের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভুটানিজ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভারত সরকার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
সচিব বিজয় গোখলে বলেছেন, এ কারণেই যে সব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে, সেখানে অনেকগুলো স্বাক্ষরিত হবে দুই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশলী, এবং গণিতের ব্যাপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তিনি বলেন, স্কলারশিপ এবং অন্যান্য উপায়ে ভারত সরকার ভুটানিজ শিক্ষার্থীদের ভারতে নেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
২০১৮ সালে ভারত-ভুটান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সময় চিত্রকলা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ভুটানিজদের সাথে বিনিময় বৃদ্ধির বিষয়ে জোর দেয়া হয়।
ভুটানের তরুণ জণগোষ্ঠির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপারে একটা অস্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। অনেকে ভারতকে বন্ধুপ্রতীম সহায়ক প্রতিবেশী মনে করেন। অন্যেরা মনে করেন, এই সম্পর্কের ভেতরে ভারসাম্যহীন উপায়ে বিনিময় হচ্ছে, সেটা ভুটানের জন্য ইতিবাচক নয়।
তরুণ কলেজ গ্র্যাজুয়েট দর্জি ফুন্তশো বলেন, “আমাদের রাজারা সবসময় ভারতের সাথে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, এবং আমাদেরকেও অবশ্যই সেই একই কাজ করতে হবে”।
অন্যেরা শিল্প ও সংস্কৃতিতে বিনিময় বৃদ্ধির কথা বলেছেন। ভুটানিজ এবং ভারতীয়রা একত্র হয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করছে, এবং বার্ষিক ‘মাউন্টেন ইকোজ’ অনুষ্ঠানে দুই দেশের লেখক, একাডেমিক, চিত্রশিল্পী, এবং অন্যান্য পেশাদারদের সমাগম ক্রমেই বাড়ছে। ভারতের টিভি সোপ অনুষ্ঠানগুলো ভুটানিজ নারীদের মধ্যে জনপ্রিয়, এবং সব বয়সের ভুটানিজরা ব্যবসায় ও তীর্থভ্রমণে ভারত সফর করে থাকেন।
অন্যদিকে, ভারত-বিদ্বেষী একটা মনোভাবও মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে, বিশেষ করে যখন ভুটান-চীন সম্পর্কের বিষয় এসেছে এবং ভুটান যেখানে চীনের সাথে ইস্যুগুলোকে সরাসরি সমাধান করতে চেয়েছে। ভুটানিজরা ভারতের ভুটান নীতিকে বল-প্রয়োগমূলক এবং বড় ভাইসুলভ হিসেবে দেখে থাকে।
২০১৭ সালের দোকলাম অচলাবস্থার মতো ঘটনা – যেখানে ভুটান দুই বড় প্রতিবেশীর মধ্যে আটকা পড়েছিল। এই ঘটনা ভারতের ভূ-রাজনৈতিক কবল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ভুটানিজদের আকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এক তরুণ ভুটানিজ ব্লগার লিখেছেন, “ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও বৃহৎ সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের ভৌগলিক অবস্থানটি সবচেয়ে বড় অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ভারতের বন্ধুত্ব ও উন্নয়ন সহায়তা প্রয়োজন, আর সেটার জন্য আমাদের মূল্য দিতে হচ্ছে”।
এরপরও, নরেন্দ্র মোদি ভুটানের জনগণকে চমৎকৃত করতে চান এবং হিমালয় অঞ্চলের ক্ষুদে এ দেশটির সাথে ঐতিহ্যগত সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে চান, কারণ এই রাষ্ট্রটি তার বৃহৎ প্রতিবেশীকে স্বাচ্ছন্দ্যে রেখেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব গোখলে ভারতীয় মিডিয়াকে বলেছেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভুটান সফরের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। সেখানকার মহামান্য রাজা ও মহামান্য চতুর্থ রাজাসহ প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শেরিংয়ের সাথে তার শক্তিশালী ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে”।
তিনি আরও বলেন, “আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, এই সফরের মধ্য দিয়ে ভুটানের সাথে আমাদের অনন্য সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে”।
প্রতিবেশী প্রথম
মোদি সরকারের প্রতিবেশী প্রথম নীতির অংশ হিসেবে নতুন নির্বাচিত ও উদ্দীপ্ত নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে তার প্রথম বিদেশ সফরে ভুটানে এসেছিলেন। তিনি সে সময় নেপালও সফর করেছিলেন এবং ভারতের সীমান্তকে মুক্ত বাণিজ্য ও ব্যবসায়ের দুয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তবে, তার উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ শিগগিরই উধাও হয়ে যায় যখন মাধেসি জনগোষ্ঠির আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাস্তবায়নের জন্য নেপালের সংবিধানে পরিবর্তন আনতে নেপালি এমপিদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে ভারত। এই সূত্রে দুই দেশের মধ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং নেপালের জ্বালানি সরবরাহ আটকে দেয় ভারত। নেপালের জনগণ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে এবং সোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ জানায়। ভারত সরকারের পদক্ষেপকে তারা দেশকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছে এবং সামাজিক যাতনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছে, বিশেষ করে ২০১৫ সালের এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর যে অনানুষ্ঠানিক অবরোধ আরোপ করা হয়, সে সময় থেকে ভারতকে এইভাবে বিবেচনা করেছে নেপাল। জ্বালানির ব্যাপক সঙ্কটের কারণে সে সময় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক মেরামত চেষ্টার অংশ হিসেবে মোদি জুনে মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা সফর করেছেন। এই দুই দ্বীপরাষ্ট্র তার সফরকে সফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের মাধ্যমে চীনা প্রভাবের মোকাবেলার তার সফরকে সফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। মোদি দুই দেশেই উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সাময়িক বাধা বাদ দিলে, প্রতিবেশী প্রথম নীতিতে ফল মিলছে, যদিও সেটা ধীরগতিতে। ভারত ভুটানের সাথে দৃঢ় বন্ধুত্ব ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। একইভাবে, বিগত পাঁচ বছরে ভারত ও বাংলাদেশও আরও কাছাকাছি হয়েছে। শেখ হাসিনার অধীনে, ঢাকা দিল্লির সাথে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর করেছে এবং দ্বিপাক্ষিক বিনিময় বাড়িয়েছে।
আসলে ভারত যদি তার প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গভীর করার আশা করে থাকে, তাহলে এর জন্য এই মুহূর্তের চেয়ে উত্তম সময় আর হতে পারে না। বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) উপ-আঞ্চলিক ব্লক আঞ্চলিক শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করতে পারে। বৃহৎ পরিসরে, ভারত যদি বিমসটেকের মধ্যেও একই ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে সেটাও সংযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
তবে, ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে তাদের ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ভারতকে সচেতন থাকতে হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের সমতাকে গ্রহণ করে নিতে হবে, তা তাদের আকার যত ছোটই হোক না কেন। তা না হলে এ অঞ্চলের উন্নয়নে এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ভারত যে ভূমিকা রাখতে চায়, সেটা ভেস্তে যাবে এবং এ জন্য তাদেরকে উচ্চমূল্য দিতে হবে।
এমনকি ভারত তাদের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর কাশ্মীর যেভাবে উত্তপ্ত হওয়া অব্যাহত রেছে, সেখানে ভারতের ক্ষুদে প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটির প্রতিটি পদক্ষেপের উপর নজর রাখবে। এই মুহূর্তে এটা একটা সচেতন অপেক্ষার খেলা যদিও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে বলেছেন যে, ভুটান কাশ্মীর ইস্যুকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই জানে।
ভুটানে প্রধানমন্ত্রী মোদি রাজা জিগমে সিঙ্গে খেসার নামগেল ওয়াংচুক এবং চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের সাথে সাক্ষাত করবেন। সেই সাথে এই সফরে বেশ কিছু প্রকল্প উদ্বোধন এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে এই সফর একটা মাইলফলক সফর হতে যাচ্ছে।
প্রধান এজেন্ডাগুলোর মধ্যে রয়েছে ৭২০ মেগাওয়াট মাংদেচ্ছু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং সংশোধিত শুল্ক, যেটা ভুটানের ১২তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লী সফরের সময় রফতানি শুল্ক সংশোধন করে প্রতি ইউনিট ৪.১২ গুলট্রাম (ভুটানের মুদ্রা) করা হয়। ভারত একই সাথে ভুটানের ১২তম পরিকল্পনার জন্য ৪৫ বিলিয়ন গুলট্রাম-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং বাণিজ্য সহায়তা ও ভারতে ভুটানের রফতানি বৃদ্ধির জন্য আরও অতিরিক্ত ৪ বিলিয়ন গুলট্রাম-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মোদি একইসাথে রু পে কার্ডেরও উদ্বোধন করবেন। ভারতে কেনাবেচার জন্য অনেকটা ভিসা বা মাস্টারকার্ডের মতোই এটা ব্যবহার করা যায় এবং এটিএম মেশিনে এই কার্ড ব্যবহার করা যায়। সিঙ্গাপুরের পর দ্বিতীয় দেশ হিসেবে রু পে কার্ড ব্যবহার করতে যাচ্ছে ভুটান।
সাউথ এশিয়ান স্যাটেলাইটের জন্য একটি গ্রাউন্ড স্টেশানও উদ্বোধন করা হবে। দুই দেশের মধ্যে যে নয়টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে, তার মধ্যে ভুটানের নতুন মহাকাশ প্রযুক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশানের সহযোগিতার বিষয়টিও রয়েছে।
যুবকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির এজেন্ডা
একটা উল্লেখযোগ্য ভারতীয় এজেন্ডার মধ্যে রয়েছে ভারত-ভুটান সম্পর্কের ব্যাপারে তরুণদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।
দিল্লীতে গত সপ্তাহে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ভুটানের সাথে সম্পর্ককে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সীমানা ছাড়িয়ে আরও সামনে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।
পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে বলেছেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পর্যটন খাতের বিষয়গুলোও খতিয়ে দেখা হবে। তিনি বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভুটানের রয়েল ইউনিভার্সিটিতে ভুটানের তরুণ প্রজন্মের সাথে সরাসরি কথা বলবেন।
তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী মোদি দুই দেশের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলবেন। আমাদের উদ্দেশ্য হলো ভুটানের তরুণদের আরও কাছাকাছি যাওয়া এবং তাদেরকে এটা বোঝানো যে আমরা ভুটানের সাথে আরও ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়তে চাই”।
যদিও স্কলারশিপ নিয়ে বা নিজ খরচে উচ্চশিক্ষার জন্য ভুটানিজ শিক্ষার্থীদের ভারত গমন অব্যাহত রয়েছে, এর পরও দুই দেশের তরুণদের মধ্যে বিনিময়ের মাত্রা যথেষ্ট কম। তাছাড়া ভারতের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভুটানিজ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ভারত সরকার অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
সচিব বিজয় গোখলে বলেছেন, এ কারণেই যে সব সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে, সেখানে অনেকগুলো স্বাক্ষরিত হবে দুই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশলী, এবং গণিতের ব্যাপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। তিনি বলেন, স্কলারশিপ এবং অন্যান্য উপায়ে ভারত সরকার ভুটানিজ শিক্ষার্থীদের ভারতে নেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
২০১৮ সালে ভারত-ভুটান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সময় চিত্রকলা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের ভুটানিজদের সাথে বিনিময় বৃদ্ধির বিষয়ে জোর দেয়া হয়।
ভুটানের তরুণ জণগোষ্ঠির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ব্যাপারে একটা অস্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। অনেকে ভারতকে বন্ধুপ্রতীম সহায়ক প্রতিবেশী মনে করেন। অন্যেরা মনে করেন, এই সম্পর্কের ভেতরে ভারসাম্যহীন উপায়ে বিনিময় হচ্ছে, সেটা ভুটানের জন্য ইতিবাচক নয়।
তরুণ কলেজ গ্র্যাজুয়েট দর্জি ফুন্তশো বলেন, “আমাদের রাজারা সবসময় ভারতের সাথে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন, এবং আমাদেরকেও অবশ্যই সেই একই কাজ করতে হবে”।
অন্যেরা শিল্প ও সংস্কৃতিতে বিনিময় বৃদ্ধির কথা বলেছেন। ভুটানিজ এবং ভারতীয়রা একত্র হয়ে চলচ্চিত্র প্রযোজনা করছে, এবং বার্ষিক ‘মাউন্টেন ইকোজ’ অনুষ্ঠানে দুই দেশের লেখক, একাডেমিক, চিত্রশিল্পী, এবং অন্যান্য পেশাদারদের সমাগম ক্রমেই বাড়ছে। ভারতের টিভি সোপ অনুষ্ঠানগুলো ভুটানিজ নারীদের মধ্যে জনপ্রিয়, এবং সব বয়সের ভুটানিজরা ব্যবসায় ও তীর্থভ্রমণে ভারত সফর করে থাকেন।
অন্যদিকে, ভারত-বিদ্বেষী একটা মনোভাবও মাথাচাড়া দিতে শুরু করেছে, বিশেষ করে যখন ভুটান-চীন সম্পর্কের বিষয় এসেছে এবং ভুটান যেখানে চীনের সাথে ইস্যুগুলোকে সরাসরি সমাধান করতে চেয়েছে। ভুটানিজরা ভারতের ভুটান নীতিকে বল-প্রয়োগমূলক এবং বড় ভাইসুলভ হিসেবে দেখে থাকে।
২০১৭ সালের দোকলাম অচলাবস্থার মতো ঘটনা – যেখানে ভুটান দুই বড় প্রতিবেশীর মধ্যে আটকা পড়েছিল। এই ঘটনা ভারতের ভূ-রাজনৈতিক কবল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য ভুটানিজদের আকাঙ্ক্ষাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এক তরুণ ভুটানিজ ব্লগার লিখেছেন, “ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরও বৃহৎ সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের ভৌগলিক অবস্থানটি সবচেয়ে বড় অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ভারতের বন্ধুত্ব ও উন্নয়ন সহায়তা প্রয়োজন, আর সেটার জন্য আমাদের মূল্য দিতে হচ্ছে”।
এরপরও, নরেন্দ্র মোদি ভুটানের জনগণকে চমৎকৃত করতে চান এবং হিমালয় অঞ্চলের ক্ষুদে এ দেশটির সাথে ঐতিহ্যগত সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করতে চান, কারণ এই রাষ্ট্রটি তার বৃহৎ প্রতিবেশীকে স্বাচ্ছন্দ্যে রেখেছে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব গোখলে ভারতীয় মিডিয়াকে বলেছেন, “আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভুটান সফরের জন্য প্রতীক্ষা করছেন। সেখানকার মহামান্য রাজা ও মহামান্য চতুর্থ রাজাসহ প্রধানমন্ত্রী ড. লোটে শেরিংয়ের সাথে তার শক্তিশালী ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে”।
তিনি আরও বলেন, “আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, এই সফরের মধ্য দিয়ে ভুটানের সাথে আমাদের অনন্য সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে”।
প্রতিবেশী প্রথম
মোদি সরকারের প্রতিবেশী প্রথম নীতির অংশ হিসেবে নতুন নির্বাচিত ও উদ্দীপ্ত নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে তার প্রথম বিদেশ সফরে ভুটানে এসেছিলেন। তিনি সে সময় নেপালও সফর করেছিলেন এবং ভারতের সীমান্তকে মুক্ত বাণিজ্য ও ব্যবসায়ের দুয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তবে, তার উচ্ছ্বাস ও আশাবাদ শিগগিরই উধাও হয়ে যায় যখন মাধেসি জনগোষ্ঠির আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের দাবি বাস্তবায়নের জন্য নেপালের সংবিধানে পরিবর্তন আনতে নেপালি এমপিদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে ভারত। এই সূত্রে দুই দেশের মধ্যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় এবং নেপালের জ্বালানি সরবরাহ আটকে দেয় ভারত। নেপালের জনগণ তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে এবং সোশাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ জানায়। ভারত সরকারের পদক্ষেপকে তারা দেশকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছে এবং সামাজিক যাতনা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিবেচনা করেছে, বিশেষ করে ২০১৫ সালের এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর যে অনানুষ্ঠানিক অবরোধ আরোপ করা হয়, সে সময় থেকে ভারতকে এইভাবে বিবেচনা করেছে নেপাল। জ্বালানির ব্যাপক সঙ্কটের কারণে সে সময় ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছিল।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক মেরামত চেষ্টার অংশ হিসেবে মোদি জুনে মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা সফর করেছেন। এই দুই দ্বীপরাষ্ট্র তার সফরকে সফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের মাধ্যমে চীনা প্রভাবের মোকাবেলার তার সফরকে সফল হিসেবে দেখা হচ্ছে। মোদি দুই দেশেই উল্লেখযোগ্য আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সাময়িক বাধা বাদ দিলে, প্রতিবেশী প্রথম নীতিতে ফল মিলছে, যদিও সেটা ধীরগতিতে। ভারত ভুটানের সাথে দৃঢ় বন্ধুত্ব ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। একইভাবে, বিগত পাঁচ বছরে ভারত ও বাংলাদেশও আরও কাছাকাছি হয়েছে। শেখ হাসিনার অধীনে, ঢাকা দিল্লির সাথে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর করেছে এবং দ্বিপাক্ষিক বিনিময় বাড়িয়েছে।
আসলে ভারত যদি তার প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক গভীর করার আশা করে থাকে, তাহলে এর জন্য এই মুহূর্তের চেয়ে উত্তম সময় আর হতে পারে না। বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) উপ-আঞ্চলিক ব্লক আঞ্চলিক শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করতে পারে। বৃহৎ পরিসরে, ভারত যদি বিমসটেকের মধ্যেও একই ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে সেটাও সংযোগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
তবে, ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে তাদের ত্রুটি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। ভারতকে সচেতন থাকতে হবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সার্বভৌমত্বের সমতাকে গ্রহণ করে নিতে হবে, তা তাদের আকার যত ছোটই হোক না কেন। তা না হলে এ অঞ্চলের উন্নয়নে এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ভারত যে ভূমিকা রাখতে চায়, সেটা ভেস্তে যাবে এবং এ জন্য তাদেরকে উচ্চমূল্য দিতে হবে।
এমনকি ভারত তাদের সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের পর কাশ্মীর যেভাবে উত্তপ্ত হওয়া অব্যাহত রেছে, সেখানে ভারতের ক্ষুদে প্রতিবেশী দেশগুলো তাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটির প্রতিটি পদক্ষেপের উপর নজর রাখবে। এই মুহূর্তে এটা একটা সচেতন অপেক্ষার খেলা যদিও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে বলেছেন যে, ভুটান কাশ্মীর ইস্যুকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই জানে।
No comments