কীভাবে বাল্যবিবাহ ঠেকানো সম্ভব
মানুষকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে কে? এই প্রশ্নের সবচেয়ে স্বাভাবিক উত্তর হলো মা-বাবা। তাঁরা সন্তানের মঙ্গল কামনা করেন। কখনো কখনো তাঁরা সন্তানের মঙ্গলের স্বার্থে নিজের ক্ষতিও মেনে নেন। আসলে সন্তান জন্মদানের পর থেকে মানুষ বেঁচে থাকে ও কাজকর্ম করে যতটা নিজের জন্য, তার চেয়ে বেশি সন্তানের জন্য। সন্তানকে মানুষ করার মধ্য দিয়েই প্রত্যেক মা-বাবা নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে বাল্যবিবাহ নামে একটা ব্যাপার আছে, যার মাধ্যমে মা-বাবা সন্তানের মঙ্গল করতে চেয়ে অমঙ্গল করেন। অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিলে তার ক্ষতি করা হয়—এই সত্য অনেক মা-বাবা উপলব্ধি করতে পারেন না। গ্রামাঞ্চলের যেসব পরিবার অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেয়, তাদের অশিক্ষা ও অজ্ঞতার সীমা নেই। তারা জানে না, নারী পূর্ণ নারীত্বের বয়সে পৌঁছার আগে তার বিয়ে দিলে সন্তান ধারণ ও প্রসবের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে প্রসূতিমৃত্যুর হার বেশি হওয়ার অন্যতম বড় কারণ প্রসূতির বয়স কম। সন্তান জন্ম দেওয়ার সময়েই অনেক কিশোরী মারা যায়। যারা মারা যায় না, তাদের স্বাস্থ্য খুব খারাপ হয়। মায়ের স্বাস্থ্য খারাপ হলে নবজাতকের স্বাস্থ্যও ভালো হওয়ার কোনো উপায় থাকে না। আরও একটা বৈজ্ঞানিক সত্য হলো, কোনো কিশোরী গর্ভবতী হলে সন্তান জন্মদানের আগ পর্যন্ত সে নানা রকমের স্বাস্থ্যগত সমস্যা ও জটিলতায় ভোগে। সন্তান প্রসবের সময় মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি কিশোরী মায়েদের মধ্যে। অল্প বয়সী ও অপুষ্ট মায়ের গর্ভের সন্তান পর্যাপ্ত পুষ্টি পায় না। জন্মের সময় তার ওজন ও উচ্চতা হয় স্বাভাবিকের চেয়ে কম। সে কারণে আমাদের দেশে খর্বাকৃতি ও কৃশকায় নবজাতকের সংখ্যা অনেক বেশি।
কম ওজন আর কম উচ্চতা নিয়ে যে শিশুর জন্ম হয়, তার মা নিজেই ভগ্নস্বাস্থ্য হওয়ার কারণে শিশুটি জন্মের পরে বুকের দুধ পায় না; যারা পায়, তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পায় না। এসব শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। আমাদের দেশে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির মাত্রা সবচেয়ে বেশি। তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও স্বাভাবিকের চেয়ে কম। তাই তারা ঘন ঘন অসুখে ভোগে। শিশুমৃত্যুর হারও সবচেয়ে বেশি এই বয়সী শিশুদের মধ্যেই। এভাবে এটা তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, বাল্যবিবাহের ফলে কিশোরী মা ও তার সন্তান উভয়েরই মৃত্যুর ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। মৃত্যু না হলে তাদের স্বাস্থ্য হয় অত্যন্ত খারাপ। আর যে মানুষের স্বাস্থ্য খারাপ, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে না। এসব বিষয়ে সচেতনতার অভাবের কারণে বাল্যবিবাহের প্রকোপ আমাদের দেশে এত বেশি। তবে এসব ছাড়াও কিছু কারণ আছে। সেগুলোর একটা হলো দারিদ্র্য, অন্যটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ। অনেক দরিদ্র মা-বাবা কিশোরী মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে চান এই জন্য যে এর ফলে মেয়ের ভরণপোষণ, লেখাপড়া ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়ভার থেকে তাঁরা মুক্ত হতে পারবেন। গরিব পরিবারের মেয়েশিশু যখন একটু বড় হয়, অর্থাৎ কৈশোরে পা রাখে, তখন তার নিরাপত্তার জন্য মা-বাবার চিন্তা শুরু হয়। বখাটেদের উপদ্রব, প্রেমের প্রস্তাব ইত্যাদির কথা ভেবে মা-বাবা দ্রুতই মেয়েকে বিয়ে দিতে চান। তাঁরা মনে করেন, মেয়ের বিয়ে হলে তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে কিশোরী মেয়েকে ঘরের ভেতরে আটকে ফেলার পথও সৃষ্টি হয়।
এ রকম পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ একটা বিরাট অভিশাপ হিসেবে থেকেই যাচ্ছে। বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন করেছে। সেই আইনের একটা ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে কোনো মেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই মা-বাবার সম্মতিতে বিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু যে দেশে মা-বাবারা কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য একপায়ে খাড়া হয়ে থাকেন, তাঁদের সম্মতির কথা বলাই বাহুল্য। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনের এই ধারাটির ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে; অনেকে এই ধারা বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন। এই দাবি যুক্তিসংগত। কারণ, বিশেষ ধারাটি থাকলে এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হবে না। যেসব মা-বাবা কিশোরী মেয়েকে বিয়ে দিতে চান, বিশেষ বিধান তাঁদের জন্য একটা সুবিধাজনক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তাই বিধানটি বাতিল করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাল্যবিবাহ বন্ধ করার পক্ষে অনুকূল নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহ কমতে শুরু করেছে। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক আন্দোলন শুরু হয়েছে। ঝালকাঠির রাজাপুরের কিশোরী শারমিন আক্তার নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকাতে গিয়ে বুদ্ধিমত্তা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এ জন্য সে স্বদেশে ও বিদেশে পুরস্কৃত হয়েছে। বিশ্বের ১৩ জন সাহসী নারীর একজন হিসেবে তাকে পুরস্কৃত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিভাগ। সম্প্রতি ময়মনসিংহের ত্রিশালের এক মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সোনিয়া আক্তারও অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে। তার বাবা দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি, সংসারে অভাব-অনটন। তিনি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন।
কিন্তু ১৩ বছর বয়সী সোনিয়া মাদ্রাসার অ্যাসেমব্লিতে শপথবাক্য পাঠ করায়, বাল্যবিবাহকে ‘না’ বলে। নিজের বাল্যবিবাহ সে মেনে নিতে পারে না। সে বাবা-মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তখন সোনিয়া তার এক শিক্ষককে ফোন করে সব ঘটনা জানায়। পরদিন সেই শিক্ষক সোনিয়াদের বাড়ি গিয়ে সোনিয়াকে মাদ্রাসায় নিয়ে আসেন এবং অধ্যক্ষকে সব খুলে বলেন। অধ্যক্ষ তখন ত্রিশাল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) ঘটনাটি জানান। ইউএনও সাহেব সোনিয়াকে নিজের কার্যালয়ে নিয়ে যান এবং সোনিয়ার বাবাকে সেখানে ডেকে আনেন। তিনি তাঁকে বলেন, এত অল্প বয়সে মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না, দিলে আইন ভঙ্গ করা হবে এবং আইন ভঙ্গ করার দায়ে তাঁর শাস্তি হবে। এভাবে সোনিয়ার বাল্যবিবাহ রোধ হয়। ইউএনও সাহেব সোনিয়াকে দুটি নতুন জামা কিনে দেন এবং বইখাতা কিনে দেওয়ারও আশ্বাস দেন। আর মাদ্রাসার শিক্ষকেরা আশ্বাস দেন, সোনিয়াকে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দেওয়া হবে। সোনিয়ার কাঠমিস্ত্রি বাবা সাংবাদিকদের বলেন, তিনি দরিদ্র মানুষ, সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকে। তাঁর বিবেচনায় মেয়ে বড় হয়েছে, তিনি সারা দিন বাড়িতে থাকেন না। কখন কী হয়, এই ভয়ে তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এখন যখন দেখতে পাচ্ছেন যে স্বয়ং ইউএনও, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও অন্য শিক্ষকেরা যখন তাঁর মেয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তখন তিনি আর মেয়ের বাল্যবিবাহ দিতে চান না। এটা একটা অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এ ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল মানুষেরা একটি কিশোরীর বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে এগিয়ে এসেছেন। কিশোরীর বাবার ওপর তাঁদের কোনো জবরদস্তিও করতে হয়নি। আরও একটা উৎসাহব্যঞ্জক দৃষ্টান্ত হলো ময়মনসিংহের নান্দাইল পাইলট বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম ও নবম শ্রেণির সাত ছাত্রীর গড়ে তোলা সংগঠন ‘ঘাসফুল’। তারা ইতিমধ্যে তিনটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছে। এ জন্য তারা আইন-আদালতের আশ্রয় নিতে যায়নি। প্রথমে তারা চেষ্টা করেছে মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিতে ইচ্ছুক অভিভাবকদের বোঝাতে যে বাল্যবিবাহ শুধু বেআইনি কাজই নয়, এর ফলে মেয়েদের জীবন নষ্ট হয়। কিন্তু অভিভাবকেরা যখন তাদের কথায় গুরুত্ব দেননি, তখন এই মেয়েরা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পুরো ঘটনা জানিয়েছেন, প্রধান শিক্ষক মেয়েদের পরামর্শ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে আবেদনপত্র লিখতে। মেয়েরা আবেদনপত্র জমা দিলে প্রশাসন বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। এ সময় এই মেয়েরাও প্রশাসনের সঙ্গে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল। ঘাসফুলের মতো সংগঠন দেশের প্রতিটি উপজেলায় গড়ে উঠলে এবং দেশের সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বিদ্যালয়-মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকেরা ওপরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে বাল্যবিবাহ বন্ধ করার কাজে তৎপর হলে বাংলাদেশের আর বেশি দিন এই অভিশাপ থাকবে না।
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
mashiul. alam@gmail. com
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
mashiul. alam@gmail. com
No comments