চট্টগ্রামে রনির বিতর্কিত ভূমিকায় প্রশ্নবিদ্ধ ছাত্রলীগ
চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে পেশিশক্তি প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। সংগঠনটি ব্যবহার করে তিনি এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। এরই মধ্যে নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে গিয়ে অস্ত্র ও গুলিসহ একবার গ্রেফতার হন তিনি। মুরাদপুর এলাকায় একটি অ্যালুমিনিয়াম কারখানা জবরদখল করে মূল মালিককে দখলচ্যুত করার অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া বিভিন্ন কলেজেও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজ সংগঠনের ছাত্রদের ওপর হামলা ও সংঘাত-সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়ছেন তিনি। এসব কারণে ছাত্রলীগের সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংগঠনের প্রতি অনীহা সৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড তার একার ভূমিকার কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে। সর্বশেষ চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামে সুইমিংপুল নির্মাণ কাজ বন্ধে মঙ্গলবার যে হামলা চালানো হয়েছে পুলিশের ওপর ওই ঘটনায়ও নেতৃত্ব দেন রনি। এ ঘটনায়ও পুলিশ ও ঠিকাদার বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছে। এ দুটি মামলার অন্যতম আসামি করা হয়েছে নুরুল আজিম রনিকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের ৭ মে হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে ভোট গ্রহণ চলাকালে কেন্দ্রের বাইরে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছিলেন রনি।
মির্জাপুর ইউনিয়নের চারিয়া বোর্ড স্কুল কেন্দ্রের বাইরে থেকে এ সময় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হারুন-উর রশীদের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে। এ সময় তার কাছ থেকে ৭.৬৫ এমএম পিস্তল, ১৫ রাউন্ড তাজা গুলি ও ২টি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ঘটনার পরদিন তাকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এ ঘটনায় অস্ত্র আইনে করা মামলার তদন্ত শেষে গত বছরের ১৬ জুন রনির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। হাটহাজারী থানার এসআই দেলোয়ার হোসেন এ মামলার তদন্ত করেন। আদালত চার্জশিট গ্রহণ করে পরবর্তী বিচারিক কার্যক্রমের জন্য তা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানোর আদেশ দেন। বর্তমানে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বিচারাধীন আছে। এর আগে ২০১৫ সালে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন মুরাদপুর এলাকায় অবস্থিত আজমীর অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি দখলেও নগর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রনি নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই কারখানার মালিকপক্ষ রনির বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করে। চাঁদাবাজির অভিযোগে পাঁচলাইশ থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৮ মে প্রথমে কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। একই বছরের ৩ আগস্ট ভোরে নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন সন্ত্রাসী কারখানায় গিয়ে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে।
নয়তো কারখানার দখল ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেন। এই চাঁদা দাবির অভিযোগে একই বছরের ৭ আগস্ট পাঁচলাইশ থানায় হাজির হয়ে রনিসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন কারখানার অংশীদার ইব্রাহিম। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর পক্ষ হয়ে রনি কারখানাটি জোরপূর্বক দখল করে অন্যজনের হাতে তুলে দেন। এখন পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন কারখানা মালিক মুজিবুর রহমানসহ অন্যরা। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন শেষ করে বাসায় ফিরেই রনির রোষানলে পড়েন কারখানা মালিক মুজিবুর রহমান। রনির অনুসারীরা তাকে আটক করে মারধর করার পর পাঁচলাইশ থানা পুলিশের হাতে তুলে দেয়। একটি নাশকতা মামলায় জড়ানো হয় তাকে। সূত্রগুলো অভিযোগ করেছে, নুরুল আজিম রনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নানা কৌশলে আন্দোলনের নামে প্রভাব বিস্তার করেন। ছাত্রলীগ করলেও তার অনুসারী না হলে কোনো পদ-পদবি পাওয়া যায় না। উল্টো নানাভাবে আক্রান্ত হতে হয় রনি ও তার অনুসারীদের হাতে। হাটহাজারী থানায় করা অস্ত্র মামলায় জামিনে মুক্তি পাওয়ার পর রনি আরও বেপরোয়া আচরণ করতে থাকেন। শিবিরের হাত থেকে দখলমুক্ত হওয়ার পর চট্টগ্রাম কলেজে রনি নিজ দলের (ছাত্রলীগের) কর্মীদের সঙ্গে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে একাধিকবার সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সর্বশেষ গত বছরের ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের জঙ্গিবিরোধী একটি কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রনির অনুসারীদের গুলিতে নগর কমিটির এক উপসম্পাদকসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন।
চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাধারণ নেতাকর্মী ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতৃত্বে থেকে এভাবে অপকর্মে জড়িয়ে পড়া, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রভাব বিস্তার করা, নগরীর অলিগলি পাড়া-মহল্লা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় নিজ সংগঠনের নেতাকর্মী এমনকি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে বিরোধে জড়িয়ে পড়ায় সংগঠনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তারা বলছেন, নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার (রনির) দায়িত্ব সবার সঙ্গে সমন্বয় করে সংগঠনকে এগিয়ে নেয়া। ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে আন্দোলন করা। কিন্তু তিনি তা না করে কখনও কারখানার দখল নিয়ে, কখনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য নিয়ে, কখনও বা সুইমিং পুলের নির্মাণ কাজ বন্ধ করার কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলছেন। আর এসব তিনি করছেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘নিজের ইচ্ছায়। ব্যক্তিগত আক্রোশে।’ এর দায়ভার এসে বর্তাচ্ছে ছাত্রলীগের ওপর। অভিযোগ আছে, রনি ব্যক্তিগত আক্রোশবশত সম্প্রতি ছাত্রলীগের নগর কমিটির সহসভাপতি এম কায়সার উদ্দিনকে মারধর ও লাঞ্ছিত করে তার কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেন। একইভাবে গত বছরের ২২ জুলাই নগর কমিটির আরেক সহসভাপতি ফারুক ইসলামকে নিয়মবহির্ভূত বহিষ্কারাদেশ দেন।
নুরুল আজিম রনি যা বলেন: অভিযোগ প্রসঙ্গে নগর ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি বুধবার দুপুরে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করছি বলে যারা বলছেন তারা জামায়াত-শিবিরের লোক। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের কেউ আমাকে বিতর্কিত বলেন না। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত আমার কথা বলে গেছেন। যারা জামায়াতের লোক নিয়ে দল ভারি করেন তারাই এসব কথা বলছেন।’ সুইমিংপুলের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা সুইমিংপুলের নির্মাণ কাজ বন্ধ করার জন্য আন্দোলনে নামিনি। সুইমিংপুলের জন্য খেলাধুলার মাঠটি সংকুচিত হয়ে যাবে- এ কারণে আন্দোলনে নেমেছি। সুইমিংপুল করার অনেক জায়গা আছে। একইভাবে আমরা লালদীঘির মাঠকে রক্ষার জন্যও আন্দোলনে নেমেছিলাম।’ মুরাদপুরে অ্যালুমিনিয়াম কারখানার জবরদখলের অভিযোগ প্রসঙ্গে রনি বলেন, যার বৈধ কাগজপত্র ছিল তার পক্ষে কথা বলেছিলেন তিনি। কারখানা জবরদখল করেননি।
No comments