নেপাল–ভারত বিরোধে সীমান্ত অবরোধ না ‘শাস্তি’? by মহিউদ্দিন আহমদ
নেপালের ক্যাবল টেলিভিশন অপারেটররা প্রায় সবকটি ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধ করে প্রতিবাদ জানায় |
সম্প্রতি
ফেসবুকে একটা ভিডিও ক্লিপিং দেখলাম। ছোট একটা ছাগল বড় একটা গরুর সঙ্গে
গুঁতোগুঁতি করছে। প্রথমে গরুটা ছাগলটাকে ঠেলতে ঠেলতে অনেক দূর নিয়ে গেছে।
তারপর ছাগলটা কেমন করে যেন অমিত বিক্রমশালী হয়ে উঠল এবং গরুটাকে চেপে ধরল।
গরু বেচারা দৌড়ে পালাল। এই সময়ের একটা উত্তপ্ত খবর হচ্ছে নেপালের ওপর
ভারতের অবরোধ। গরু-ছাগলের যুদ্ধটা প্রতীকী। এখানে দেখানো হলো শেষমেশ
ছাগলেরই জয়। এই ছবি দেখে নেপালি জাতীয়তাবাদ কিঞ্চিৎ সঞ্জীবিত হবে। কিন্তু
বাস্তব চিত্রটা খুবই রূঢ়, নির্মম ও বেদনাদায়ক। নেপালের বিরুদ্ধে
অনানুষ্ঠানিক ভারতীয় অবরোধ চলছে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে।
গোলমালটা শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে নেপালের গণপরিষদে নতুন সংবিধান তৈরি হওয়ার সময়। নির্বাচিত গণপরিষদের প্রায় ৯০ শতাংশ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট এবং বড় চারটি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাদ সেধেছে কয়েকটি ছোট দল। কয়েকটি আঞ্চলিক-নৃগোষ্ঠীও ক্ষুব্ধ হয়েছে। এরা হলো দক্ষিণাঞ্চলের থারু ও মদেশি সম্প্রদায়। তারা তাদের মতো করে আলাদা প্রদেশ চেয়েছিল। এখন সাতটি প্রদেশ নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হলো, তাতে তারা ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভ সহিংসতার পর্যায়ে গেছে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। ভারতের সঙ্গে নেপালের প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটারব্যাপী স্থলসীমান্ত এখন বেশ উত্তপ্ত। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অধিবাসী এই সম্প্রদায়গুলো সংবিধানের কয়েকটি ধারা মানতে চাইছে না। তাদের এই বিক্ষোভে ভারতের সায় আছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শংকর কাঠমান্ডু সফর করে নতুন সংবিধান জারি করার, অর্থাৎ প্রক্রিয়াটি স্থগিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। নেপালের জন্য ভারতের পরামর্শ ‘আদেশ’-এর পর্যায়ে পড়ে। নেপালের রাজনীতিবিদেরা জয়শংকরের পরামর্শের তোয়াক্কা করেননি। ফলে, নেপালের দক্ষিণের সমতলভূমি, যা তরাই অঞ্চল নামে পরিচিত, সেখানকার কয়েকটি গোষ্ঠী সড়ক অবরোধ করে বসে আছে। এই অবস্থায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল ট্রাক-বাস-লরি মহাসড়কে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
নেপালের আমদানির ৬৩ শতাংশ আসে ভারত থেকে, ১৭ শতাংশ চীন থেকে এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসে বাকি ২০ শতাংশ। চারদিকে ভূমিবেষ্টিত এই দেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, ভারত হয়েই আমদানি-রপ্তানি হয়। গত এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে নেপাল-চীন সড়কপথ বন্ধ হয়ে আছে। খাবার, ওষুধ ও জ্বালানি তেলের মজুত তলানিতে। নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই অম্লমধুর এবং মাঝেমধ্যে তা বেশ তেতো হয়ে যায়। এই টানাপোড়েন চলে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকেই। ওই সময় নেপাল রাজ্যটি আরও বড় ছিল। তখন ছিল গোটা সাম্রাজ্য। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নেপালের যুদ্ধ চলে দুই বছর, ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ সাল অবধি। ১৮১৬ সালের ২ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সুগাওলি চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নেপালের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ব্রিটিশ-ভারতের দখলে চলে যায়। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অঞ্চলের মধ্যে ছিল সিকিম, গাড়োয়াল, কুমায়ুন ইত্যাদি রাজ্য। নেপালের রাজা তাঁর দেশে একজন ব্রিটিশ আবাসিক প্রতিনিধি রাখতে বাধ্য হন। তাঁর কাজ হলো রাজার ওপর ছড়ি ঘোরানো। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সৈন্য সরবরাহ করতে নেপালকে রাজি হতে হয়। সেই থেকে গোর্খা সম্প্রদায়ের লোকেরা ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে কাজ করছেন।
নেপালে ভারতবিরোধী মনস্তত্ত্ব যত জোরালো হচ্ছে, চীনপ্রীতিও বাড়ছে। ভবিষ্যতে দেশটি ভারত-চীন প্রক্সি-ওয়ারের কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ভারত কি এই ঝুঁকি নেবে?
১৮৫৭ সালের ‘সিপাহি বিদ্রোহের’ সময় ব্রিটিশদের সাহায্য করার পুরস্কার হিসেবে নেপাল তার হারানো কিছু ভূখণ্ড ফিরে পায়। অনেকটাই থেকে যায় ভারতের দখলে। এ নিয়ে নেপালিদের মনে অনেক ক্ষোভ। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার’ উত্তরাধিকার সূত্রে ‘ব্রিটিশরাজ’-এর মনস্তত্ত্ব ধরে রাখে। ১৯৫০ সালে ভারত-নেপাল শান্তি-মৈত্রী চুক্তি করে একধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখে। ব্রিটিশরা ১৮৯০ সালেই সিকিমকে একটা করদ রাজ্যের ‘মর্যাদা’ দিয়েছিল। স্বাধীন ভারত সিকিমের দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের দায়িত্ব নিজের হাতে রেখে দেয়। সিকিম পায় ‘প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন’। রাজার উপাধি ছিল ‘চোগিয়াল’। তাঁর বিরুদ্ধে সিকিমে ‘গণতন্ত্রের’ জন্য আন্দোলন হয়। চোগিয়াল ক্ষমতা হারান। সিকিমের গণতন্ত্রপন্থীরা লেন্দুপ দরজির নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের ২২তম রাজ্য হয়। সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় ভারতের পার্লামেন্টে। বিষয়টা ছিল নেপালের জন্য অস্বস্তিকর। এরপরেই নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব তাঁর দেশকে ‘শান্তি এলাকা’ ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। চীন ও পাকিস্তান এ প্রস্তাব সমর্থন করে। ভারত যুক্তি দেয়, ১৯৫০ সালের শান্তি-মৈত্রী চুক্তিতে নেপালে শান্তি বজায় রাখার পাকাপাকি ব্যবস্থা আছে, নতুন করে শান্তি এলাকা ঘোষণার দরকার নেই। ১৯৯০ সালে নেপালের এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ১২২টি দেশ সমর্থন দেয়।
ভারতের সঙ্গে নেপালের একটা বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তি হয় ১৯৫২ সালে। ১৯৮৯ সালের ২৩ মার্চ চুক্তি নবায়ন করার সময় নেপাল দাবি করে দুটো আলাদা চুক্তি হোক। নেপাল চেয়েছিল আন্তর্জাতিক বিধান মেনে ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য ট্রানজিট আইনের ভিত্তিতে আলাদা চুক্তি হোক। ভারত রাজি হয়নি। এরপর নেপালে ভারতের বাণিজ্য অবরোধ চলে প্রায় ১৩ মাস। চাপের মুখে রাজা বীরেন্দ্রকে মাথা নোয়াতে হয়।
২০০৮ সালে নেপালে গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়। নানান দলাদলি ও মতভেদ চাপা দিয়ে যে সংবিধান দুই বছরের মধ্যে করার কথা ছিল, অবশেষে সাত বছরের মাথায় তা সম্পন্ন হলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারত এই সংবিধান নিয়ে খুশি নয়। ভারত সীমান্তে তরাই অঞ্চলে প্রদেশ তৈরির ব্যাপারে দিল্লি যে রকমটি চেয়েছিল, নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সেই পথে হাঁটেনি। এদিকে ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে পরিচিত ছোট কয়েকটি দল সংবিধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। ভারত বলছে, সংবিধানের ব্যাপারে ‘ঐকমত্য’ থাকতে হবে। নেপালের প্রথম সারির রাজনীতিবিদেরা এই সব ‘ভারতপন্থী’ দলের নেতাদের ইতিমধ্যে ‘লেন্দুপ’ বলে গাল দেওয়া শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, ‘মদেশি’দের আশকারা দিয়ে ভারত নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। নেপালের পাহাড়ি এলাকার মানুষ ভারত সীমান্তের অধিবাসীদের ‘মদেশি’ বলে। এর অর্থ হলো ‘বিদেশি’। এদের চালচলন, ভাষা, পোশাক, খাবারদাবার সবই ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশের মানুষের মতো। নেপালের রাজনীতির এই ‘বিভক্তি’ ক্রমেই তাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে।
অবরোধের ফলে নেপালে জ্বালানি-সংকটে মানুষ দিশেহারা। গাড়ি চলাচল বন্ধ, অ্যাম্বুলেন্সও চলছে না। নেপাল কত দিন এই ‘চাপ’ সহ্য করতে পারবে, তা এখন শুধু দেখার বিষয়। নেপালের ওপর অবরোধ চাপিয়ে দিয়ে ভারত তার নিজের সংবিধানের ৫১ ধারা লঙ্ঘন করেছে, যেখানে ভূমিবেষ্টিত দেশের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকারকে সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দুনিয়ার ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের’ দেশ প্রতিবেশী ‘শিশু গণতন্ত্রের’ দেশের টুঁটি চেপে ধরেছে। এটা হলো ভারতীয় গণতন্ত্রের অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স।
ভারতের উত্তর সীমান্তের বড় দেশ চীন। চীন ভারতকে খেপিয়ে নেপালের সঙ্গে মিতালি করতে কত দূর এগিয়ে যাবে, তা বলা মুশকিল। নেপালে ভারতবিরোধী মনস্তত্ত্ব যত জোরালো হচ্ছে, চীনপ্রীতিও বাড়ছে। ভবিষ্যতে দেশটি ভারত-চীন প্রক্সি-ওয়ারের কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ভারত কি এই ঝুঁকি নেবে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক।
mohi2005@gmail.com
গোলমালটা শুরু হয়েছিল গত সেপ্টেম্বরে নেপালের গণপরিষদে নতুন সংবিধান তৈরি হওয়ার সময়। নির্বাচিত গণপরিষদের প্রায় ৯০ শতাংশ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট এবং বড় চারটি রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। কিন্তু বাদ সেধেছে কয়েকটি ছোট দল। কয়েকটি আঞ্চলিক-নৃগোষ্ঠীও ক্ষুব্ধ হয়েছে। এরা হলো দক্ষিণাঞ্চলের থারু ও মদেশি সম্প্রদায়। তারা তাদের মতো করে আলাদা প্রদেশ চেয়েছিল। এখন সাতটি প্রদেশ নিয়ে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি হলো, তাতে তারা ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভ সহিংসতার পর্যায়ে গেছে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে এ পর্যন্ত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। ভারতের সঙ্গে নেপালের প্রায় ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটারব্যাপী স্থলসীমান্ত এখন বেশ উত্তপ্ত। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের অধিবাসী এই সম্প্রদায়গুলো সংবিধানের কয়েকটি ধারা মানতে চাইছে না। তাদের এই বিক্ষোভে ভারতের সায় আছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জয়শংকর কাঠমান্ডু সফর করে নতুন সংবিধান জারি করার, অর্থাৎ প্রক্রিয়াটি স্থগিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। নেপালের জন্য ভারতের পরামর্শ ‘আদেশ’-এর পর্যায়ে পড়ে। নেপালের রাজনীতিবিদেরা জয়শংকরের পরামর্শের তোয়াক্কা করেননি। ফলে, নেপালের দক্ষিণের সমতলভূমি, যা তরাই অঞ্চল নামে পরিচিত, সেখানকার কয়েকটি গোষ্ঠী সড়ক অবরোধ করে বসে আছে। এই অবস্থায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল ট্রাক-বাস-লরি মহাসড়কে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
নেপালের আমদানির ৬৩ শতাংশ আসে ভারত থেকে, ১৭ শতাংশ চীন থেকে এবং অন্যান্য দেশ থেকে আসে বাকি ২০ শতাংশ। চারদিকে ভূমিবেষ্টিত এই দেশ ভারতের ওপর নির্ভরশীল। কারণ, ভারত হয়েই আমদানি-রপ্তানি হয়। গত এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে নেপাল-চীন সড়কপথ বন্ধ হয়ে আছে। খাবার, ওষুধ ও জ্বালানি তেলের মজুত তলানিতে। নেপালের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বরাবরই অম্লমধুর এবং মাঝেমধ্যে তা বেশ তেতো হয়ে যায়। এই টানাপোড়েন চলে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকেই। ওই সময় নেপাল রাজ্যটি আরও বড় ছিল। তখন ছিল গোটা সাম্রাজ্য। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে নেপালের যুদ্ধ চলে দুই বছর, ১৮১৪ থেকে ১৮১৬ সাল অবধি। ১৮১৬ সালের ২ ডিসেম্বর দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সুগাওলি চুক্তি হয়। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী নেপালের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ড ব্রিটিশ-ভারতের দখলে চলে যায়। হাতছাড়া হয়ে যাওয়া অঞ্চলের মধ্যে ছিল সিকিম, গাড়োয়াল, কুমায়ুন ইত্যাদি রাজ্য। নেপালের রাজা তাঁর দেশে একজন ব্রিটিশ আবাসিক প্রতিনিধি রাখতে বাধ্য হন। তাঁর কাজ হলো রাজার ওপর ছড়ি ঘোরানো। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সৈন্য সরবরাহ করতে নেপালকে রাজি হতে হয়। সেই থেকে গোর্খা সম্প্রদায়ের লোকেরা ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে কাজ করছেন।
নেপালে ভারতবিরোধী মনস্তত্ত্ব যত জোরালো হচ্ছে, চীনপ্রীতিও বাড়ছে। ভবিষ্যতে দেশটি ভারত-চীন প্রক্সি-ওয়ারের কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ভারত কি এই ঝুঁকি নেবে?
১৮৫৭ সালের ‘সিপাহি বিদ্রোহের’ সময় ব্রিটিশদের সাহায্য করার পুরস্কার হিসেবে নেপাল তার হারানো কিছু ভূখণ্ড ফিরে পায়। অনেকটাই থেকে যায় ভারতের দখলে। এ নিয়ে নেপালিদের মনে অনেক ক্ষোভ। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতের ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার’ উত্তরাধিকার সূত্রে ‘ব্রিটিশরাজ’-এর মনস্তত্ত্ব ধরে রাখে। ১৯৫০ সালে ভারত-নেপাল শান্তি-মৈত্রী চুক্তি করে একধরনের স্থিতাবস্থা বজায় রাখে। ব্রিটিশরা ১৮৯০ সালেই সিকিমকে একটা করদ রাজ্যের ‘মর্যাদা’ দিয়েছিল। স্বাধীন ভারত সিকিমের দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগের দায়িত্ব নিজের হাতে রেখে দেয়। সিকিম পায় ‘প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন’। রাজার উপাধি ছিল ‘চোগিয়াল’। তাঁর বিরুদ্ধে সিকিমে ‘গণতন্ত্রের’ জন্য আন্দোলন হয়। চোগিয়াল ক্ষমতা হারান। সিকিমের গণতন্ত্রপন্থীরা লেন্দুপ দরজির নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৫ সালে সিকিম ভারতের ২২তম রাজ্য হয়। সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় ভারতের পার্লামেন্টে। বিষয়টা ছিল নেপালের জন্য অস্বস্তিকর। এরপরেই নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ দেব তাঁর দেশকে ‘শান্তি এলাকা’ ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। চীন ও পাকিস্তান এ প্রস্তাব সমর্থন করে। ভারত যুক্তি দেয়, ১৯৫০ সালের শান্তি-মৈত্রী চুক্তিতে নেপালে শান্তি বজায় রাখার পাকাপাকি ব্যবস্থা আছে, নতুন করে শান্তি এলাকা ঘোষণার দরকার নেই। ১৯৯০ সালে নেপালের এই প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ১২২টি দেশ সমর্থন দেয়।
ভারতের সঙ্গে নেপালের একটা বাণিজ্য ও ট্রানজিট চুক্তি হয় ১৯৫২ সালে। ১৯৮৯ সালের ২৩ মার্চ চুক্তি নবায়ন করার সময় নেপাল দাবি করে দুটো আলাদা চুক্তি হোক। নেপাল চেয়েছিল আন্তর্জাতিক বিধান মেনে ভূমিবেষ্টিত রাষ্ট্রের জন্য প্রযোজ্য ট্রানজিট আইনের ভিত্তিতে আলাদা চুক্তি হোক। ভারত রাজি হয়নি। এরপর নেপালে ভারতের বাণিজ্য অবরোধ চলে প্রায় ১৩ মাস। চাপের মুখে রাজা বীরেন্দ্রকে মাথা নোয়াতে হয়।
২০০৮ সালে নেপালে গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের নবযাত্রা শুরু হয়। নানান দলাদলি ও মতভেদ চাপা দিয়ে যে সংবিধান দুই বছরের মধ্যে করার কথা ছিল, অবশেষে সাত বছরের মাথায় তা সম্পন্ন হলো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভারত এই সংবিধান নিয়ে খুশি নয়। ভারত সীমান্তে তরাই অঞ্চলে প্রদেশ তৈরির ব্যাপারে দিল্লি যে রকমটি চেয়েছিল, নেপালের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো সেই পথে হাঁটেনি। এদিকে ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে পরিচিত ছোট কয়েকটি দল সংবিধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে। ভারত বলছে, সংবিধানের ব্যাপারে ‘ঐকমত্য’ থাকতে হবে। নেপালের প্রথম সারির রাজনীতিবিদেরা এই সব ‘ভারতপন্থী’ দলের নেতাদের ইতিমধ্যে ‘লেন্দুপ’ বলে গাল দেওয়া শুরু করেছেন। তাঁরা বলছেন, ‘মদেশি’দের আশকারা দিয়ে ভারত নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। নেপালের পাহাড়ি এলাকার মানুষ ভারত সীমান্তের অধিবাসীদের ‘মদেশি’ বলে। এর অর্থ হলো ‘বিদেশি’। এদের চালচলন, ভাষা, পোশাক, খাবারদাবার সবই ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশের মানুষের মতো। নেপালের রাজনীতির এই ‘বিভক্তি’ ক্রমেই তাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে।
অবরোধের ফলে নেপালে জ্বালানি-সংকটে মানুষ দিশেহারা। গাড়ি চলাচল বন্ধ, অ্যাম্বুলেন্সও চলছে না। নেপাল কত দিন এই ‘চাপ’ সহ্য করতে পারবে, তা এখন শুধু দেখার বিষয়। নেপালের ওপর অবরোধ চাপিয়ে দিয়ে ভারত তার নিজের সংবিধানের ৫১ ধারা লঙ্ঘন করেছে, যেখানে ভূমিবেষ্টিত দেশের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকারকে সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দুনিয়ার ‘বৃহত্তম গণতন্ত্রের’ দেশ প্রতিবেশী ‘শিশু গণতন্ত্রের’ দেশের টুঁটি চেপে ধরেছে। এটা হলো ভারতীয় গণতন্ত্রের অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স।
ভারতের উত্তর সীমান্তের বড় দেশ চীন। চীন ভারতকে খেপিয়ে নেপালের সঙ্গে মিতালি করতে কত দূর এগিয়ে যাবে, তা বলা মুশকিল। নেপালে ভারতবিরোধী মনস্তত্ত্ব যত জোরালো হচ্ছে, চীনপ্রীতিও বাড়ছে। ভবিষ্যতে দেশটি ভারত-চীন প্রক্সি-ওয়ারের কুরুক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। ভারত কি এই ঝুঁকি নেবে?
মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক-গবেষক।
mohi2005@gmail.com
No comments