গেদার মুখে রোমহর্ষক বর্ণনা by ওয়েছ খছরু
অপরাধের
ঘটনাপ্রবাহে কনস্টেবল এবাদুরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল র্যাবের কথিত সোর্স
গেদা মিয়ার। রায়নগর এলাকার এক মিনি পতিতালয় উচ্ছেদ ঘটনাকে কেন্দ্র করে
এবাদুরের সঙ্গে গেদার সম্পর্ক হয়। সেখানে তাদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা হয়। সেই
থেকে এবাদুর, গেদা ও রাকিব এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যায়। আদালতে দেয়া
জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানিয়েছে আতাউর রহমান গেদা মিয়া। কিন্তু আদালতে তার
অপরাধের খতিয়ান তেমনটি জানায় নি সে। গেদার কারণে অতিষ্ঠ ছিল এলাকার মানুষ।
পুলিশ ও র্যাবের দাপট দেখিয়ে সে একের পর এক অপরাধ কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে
রায়নগর, ঝেরঝেরিপাড়া এলাকায়। ওই এলাকায় কয়েকটি বাসায় গোপনে মিনি পতিতালয়
খোলা হয়েছিল। এসব দেখভাল করতো গেদা নিজেই। বন্দরবাজার এলাকায় মাদক ব্যবসা
নিয়ন্ত্রণ করতো সে। এর বাইরে বহু মানুষের কাছ থেকে বিভিন্ন কায়দায় লুটে
নিয়েছে টাকা। গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে সে এসব করে গেছে। র্যাব কিংবা পুলিশি
ঝামেলা হলেই সবায় চলে যেতো গেদার কাছে। এরপর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে
গেদা সব ঝামেলা মিটিয়ে দিতো। মাঝেমধ্যে গেদা তার অপরাধ ঘটনায় নিজ স্ত্রীকেও
ব্যবহার করতো। প্রায় দুই মাস আগে শাহী ঈদগাহ এলাকায় গেদা মিয়ার স্ত্রী এক
তরুণকে ইভটিজিংয়ের ঘটনায় ফাঁসায়। এ ঘটনার অভিযোগকারী গেদার স্ত্রী। পরে ২০
হাজার টাকার বিনিময়ে ওই ঘটনার দফারফা হয়। পুলিশ কনস্টেবল এবাদুরের সঙ্গে
পরিচয়ের প্রসঙ্গ তুলে ধরে আদালতে গেদা জানায়, ‘গত মাসের ২৬ তারিখ আমি,
রাকিব, পুলিশের ছেলে রুবেলসহ এলাকার কয়েক লোক কামাল চাচার বাসায় রেইড দিয়ে
তৃতীয় তলায় আয়েশাসহ চারজন মহিলা ও একজন পুরুষকে পাই। খবর পেয়ে কনস্টেবল
এবাদ এসে এর মধ্যস্থতা করে। সে এয়ারপোর্ট থানার কনেস্টবল। পরের দিনই
মহিলাদের বের করে দেয়া হয়। এর পরে এবাদের সঙ্গে আমার পরিচয় ও সখ্য গড়ে
ওঠে।’ এ ছাড়া আদালতে গেদা মিয়া স্কুলছাত্র আবু সাঈদ খুনের ঘটনার রোমহর্ষক
বর্ণনা দেয়। বর্ণনা ছিল এ রকম- ‘গত বুধবারের আগের বুধবার ১১ তারিখ সকালবেলা
আমি বন্দর বাজারে ছিলাম। এবাদ ফোন দিয়ে এতিম স্কুলের সামনে যেতে বলে।
সেখানে গিয়ে এবাদ, মাছুম ও রাকিবকে পাই। এবাদ জানায়, একটা ছেলেকে অপহরণ করা
হবে। মুক্তিপণ হিসেবে যে টাকা পাওয়া যাবে তার একটা ভাগ আমাকে দেয়া হবে।
আমার দায়িত্ব ছিল বাইরের খবরাখবর রাখা। তখন সাঈদ আইসক্রিম কিনতে দোকানে
আসে। তাকেই অপহরণ করা হবে। এবাদ এ কথা জানালে আমি এলাকার লোক হওয়ায় সবাই
আমাকে চিনবে- এ কথা বলে আমি সেলুনের সামনে চলে যাই। এবাদরা তিনজন সাঈদের
সঙ্গে কথা বলে বলে এবাদের বাসায় নিয়ে যায়। এবাদের পুরো বিল্ডিং খালি। বাসায়
সে শুধু একা। পরিবার শ্বশুরবাড়ি। একটু পর আমি এবাদের দোতলার বাসায় যাই।
গিয়ে সাঈদের মুখ, হাত বেঁধে ফেলি। একটি পুরনো মডেলের নকিয়া মোবাইলের
মাধ্যমে (যার মধ্যে এয়ারটেলের সিম ছিল) এবাদরা তিনজন কারও সঙ্গে যোগাযোগ
করে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। বিকালের দিকে আমরা বাড়ির দরজায় তালা
লাগিয়ে বেরিয়ে যাই। আমাকে খবরাখবর রাখতে বলে তারা চলে যায়। আমি বাসায় চলে
যাই।’ আদালতে গেদা আরও জানায়, ‘পরের দিন সকালবেলা সাঈদের মামা আমাকে ফোন
দিয়ে বলেন, সাঈদ হারিয়ে গেছে। আমি র্যাবের সোর্স, তাদের সাহায্য করতে বলে।
১০টায় তাদের বাসায় যাই। সেখানে চা খাই। তখন এয়ারটেলের ওই নম্বর থেকে দুটি
মেসেজ সাঈদের মামা জয়নালের মোবাইলে আসে। দ্রুত টাকা দেয়ার জন্য এবং টাকা
দেয়ার লোকেশন তারা জানাবে বলে ওই টেক্সে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জয়নাল ভাই
আমাকে জানায়। আমি জয়নাল ভাই ও সাঈদের এক নানাকে নিয়ে জালালাবাদ ফুলকলির
দোকানে র্যাবের সঙ্গে দেখা করি। সেখানে কথাবার্তা বলে এলাকায় চলে আসি।
জয়নালদের থেকে আলাদা হয়ে ওই মোবাইল নম্বরে ফোন করি। এবাদ নম্বরটি ব্যবহার
করছিল। ফোন রিসিভ করে সে কোন কথাই বলেনি। আমি জানাই যে টাকা দিতে পার্টি
প্রস্তুত আছে। ছেলেকে ছেড়ে দিলেই টাকা পাওয়া যাবে। তাকে অনুনয় বিনয় করে বলি
নইলে আমি ফেঁসে যাবো। এটি আমার এলাকার ঘটনা। প্রায় ১০ মিনিট কল ধরেছিল
এবাদুর। কিন্তু কোন কথাই বলেনি। পরে কয়েকবার কল করি। তাও প্রায় ৫ মিনিট কল
রিসিভ করে আমার কথা শোনে কিন্তু ওপার থেকে কোন কথা বলেনি। আমার মোবাইলে সব
রেকর্ড হয়ে গেছে। তা পুলিশকে দিয়েছি।’ গেদা জানায়, ‘এবাদরা টাকার জন্য
কোথাও যায়। আমি এলাকাতেই ছিলাম। বিকালবেলা এবাদ ফোন করে বাসায় যেতে বলে
বাসায় মূল গেটে কামাল চাচা ও খাটো লোকটাকে দেখি। এবাদের রুমে গিয়ে এবাদ,
মাসুম ও রাকিবকে দেখি। তারা খুব তর্কাতর্কি করছিল। তা থেকে জানতে পারি,
সাঈদের আত্মীয়স্বজনরা টাকা দেয়নি। পুলিশে জানিয়ে দেয়ায় তারা ফেরত এসেছে।
একপর্যায়ে সাঈদকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। এবাদ সাঈদের গলায় রশি পেঁচিয়ে
ধরে। আমি গলা চেপে ধরি। মাছুম হাত ও রাকিব পা চেপে ধরে থাকে। একটু পরেই
সাঈদ মারা যায়। বাইরের অবস্থা দেখার ও খবরাখবর নেয়ার জন্য আমি চলে যাই।
তারা তিনজন লাশের ব্যবস্থা করার কথা বলে। সমস্যা হলে আমাকে জানানোর কথা
হয়।’ গেদা খুন-পরবর্তী ঘটনার বিবরণ দিয়ে জানায়, ‘পরের দিন শুক্রবার
সকালবেলা আমি সাঈদের মামা ও নানাদের নিয়ে শাহী ঈদগাহে র্যাবের সঙ্গে দেখা
করি। সারাদিন এলাকায় থাকি। রাতে এবাদ ফোন দিয়ে বাসায় যেতে বলে। বাসায় গেলে
লাশ সরাতে হবে। গাড়ি ভাড়া করার কথা বলে এবাদ হুকুম দেয়। এত রাতে গাড়ি কোথায়
পাবো বললে সে জানায় যেখান থেকে পারা যায় বলে আমাকে পাঠিয়ে দেয়। খোঁজ করেও
সুবিধামতো কোন গাড়ি ওই রাতে পাইনি। সিদ্ধান্ত হয় দিনের বেলা লাশ সরানো যাবে
না, রাতের বেলা ব্যবস্থা নিতে হবে। তাই শনিবার এলাকায় থাকি। রাত ১০টায় ফোন
আসে। থানায় গিয়ে দেখি এবাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমাকে থানা থেকেই
গ্রেপ্তার করা হয়। স্যার আল্লাহ আছে, বিচার করবেন। আমি যা জানি তা বলেছি।’
No comments