বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক by ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম |
আমাদের
দেশে বহুল প্রচারিত একটি বিতর্ক আছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা কে
করেছেন ? দেশে বড় দুটি দল , একটি বিএনপি অপরটি মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বাধীন
দল আওয়ামী লীগ । তাদের প্রত্যেকের দাবি তাদের নেতার পক্ষে। এমন একটি বিষয়
যা স্বাধীনতার বিশেষ একটি মান মর্যাদার সাথে জড়িত, এমন একটি বিষয় নিয়ে
বিতর্ক করা কখনই উচিত নয় । কিন্তু আমাদের দেশে অনুচিত অনেক কিছু ঘটে যা
বিশ্বে আর কোন দেশে ঘটে না । যেমন, স্বাধীনতার মহান নেতাকে গালি দেয়া , দেশ
নিয়ে বিতর্ক করা , রাজাকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিতর্ক করা .।
ইত্যাদি ।
এর সাথে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এই বিতর্ক কোন নূতন ঘটনা নয় । তবে আমাদের এই বিতর্কের ফলে জাতি দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে । এই পিছিয়ে পড়া জাতি কি করে মাথা তুলে দাঁড়াবে যদি কোন একতা না থাকে ?
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বীরত্ব দেখিয়ে জিয়াউর রহমান পাক সেনাবাহিনীতে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। এ সময়েই জিয়াউর রহমান বাঙালি সহকর্মীদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তাকে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানেও তিনি নবীন সেনা অফিসারদের সঙ্গে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ বিষয়ে কথা বলেছেন।
এদিকে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা প্রাপ্তির সুযোগ পায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
এই বিশাল বিজয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের অপেক্ষায় ছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্তান পিপলস্্্্্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত কম আসনে জয় পেয়েও ক্ষমতা ভাগাভাগির নানা কৌশল আটতে থাকেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও এ অপকৌশলে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘ বিলম্বের পর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কিন্তু, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাত্ ১ মার্চ দুপুরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন তিনি।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফুঁসে ওঠে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ। ১ মার্চ থেকেই রাজপথে নেমে আসেন তারা। ২ মার্চ উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। শাসকগোষ্ঠীর কারফিউ ভেঙে দিন-রাত চলে বিক্ষোভ। বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলিতে নিহত হয় অন্তত তিনজন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এদিন এক বিবৃতিতে ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গোটা প্রদেশে হরতালের ডাক দেন।
২ মার্চ থেকে ৫ মার্চ দেশজুড়ে সংঘর্ষ চলে। বহু মানুষ হতাহত হন। ৬ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের জাতীয় অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন আহ্বান করেন।
পরের দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান কী ভাষণ দেবেন তা শোনার জন্য সারাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ৭ মার্চ শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে সাত দফা ঘোষণা করেন। সামরিক আইন ও সেনা বাহিনী প্রত্যাহার, গণহত্যার তদন্ত এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হইলে পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনা করা যাইতে পারে, তাহার পূর্বে নয়।’ সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের লেখা ‘বাংলাদেশের তারিখ’ (প্রথম সংস্করণ) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে—“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয়-বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন।”
৯ মার্চ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পল্টনের এক জনসভায় শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা বাংলার নায়ক হওয়া অনেক গৌরবের।’ (দৈনিক আজাদ, ১০ মার্চ ১৯৭১) ১০ মার্চ একইভাবে তিনি বলেন, ‘আলোচনায় কিছু হবে না। ওদের আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দাও।’
১৩ মার্চ ভৈরবে এক জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘পূর্ববাংলা এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং আমরা এখন একটি পূর্ববাংলা সরকারের অপেক্ষায় আছি।’ ১৪ মার্চ জনতার বাঁধভাঙা আন্দোলনের একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান ওয়ালী খানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
শাসনতান্ত্রিক সংকট প্রশ্নে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ প্রথম শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বৈঠকে বসেন।
১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দ্বিতীয় দফা সংলাপও সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ১৮ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের বিরতি ছিল। ১৯ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা বৈঠক হয়। বৈঠকের পর শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মঙ্গলের প্রত্যাশী, আবার চরম পরিণতির জন্যও প্রস্তুত।’ ২০ মার্চ বৈঠকের পর আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
২১ মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পৃথকভাবে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে ২২ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পূর্ব ঘোষিত ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত করা হয়।
দীর্ঘ আলোচনার পর ২৪ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সমঝোতার আভাস দেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আমরা মতৈক্যে পৌঁছেছি। আমি আশা করি, প্রেসিডেন্ট এখন তা ঘোষণা করবেন।’
২৫ মার্চ দিনব্যাপী ঢাকা শহরে চলে প্রতিবাদ মিছিল, রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি এবং বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলে সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। এ দিন রাত ১১টার পর থেকে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা মহানগরীতে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে।
রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে এবং তাকে সহ ৪ জন চাকর এবং একজন দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান গণহত্যার প্রতিবাদ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে ২৭ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। পরের দিন শেখ মুজিবের গ্রেফতার ও হরতালের খবর প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এদিকে রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। এর আগে দিনে চট্টগ্রাম শহরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয় প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে না পৌঁছতে পারে সে জন্য রাস্তায় রাস্তায় তৈরি করা হয় ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগানো হয় বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ। রাত ১১টায় চট্টগ্রামস্থ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া আকস্মিকভাবে সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে নির্দেশ পাঠান এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য।
রাত প্রায় সাড়ে ১১টায় জানজুয়া নিজে এসে মেজর জিয়াকে নৌ-বাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোলশহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করিয়ে দেন। সঙ্গে একজন নৌ বাহিনীর অফিসারকে (পশ্চিম পাকিস্তানি) গার্ড হিসেবে দেয়া হয়। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড সরিয়ে যেতে তাঁর দেরি হয়। আগ্রাবাদে একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তাঁর ট্রাক থেমে যায়, তখনই পেছন থেকে একটি ডজ গাড়িতে ছুটে আসেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। গাড়ি থেকে নেমেই তিনি দৌড়ে যান মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে। হাত ধরে তাকে রাস্তার ধারে নিয়ে যান। জানান, ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছেন। পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরে বহু লোক হতাহত হয়েছে। এতে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন মেজর জিয়াউর রহমান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন— ‘উই রিভোল্ট।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি খালেকুজ্জামানকে ষোলশহরে ফিরে গিয়ে ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্য কর্নেল অলি আহমদকে নির্দেশ দিতে বলেন। আর সেই সঙ্গে নির্দেশ পাঠান ব্যাটেলিয়নের সমস্ত পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতারের। এই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়াসহ সব পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতার করা হলো।
এরপর অন্যান্য ব্যাটেলিয়নের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের ফোন করলেন, কিন্তু অনেককেই পেলেন না। এ পর্যায়ে তিনি বেসামরিক বিভাগে টেলিফোন অপারেটরকে ফোন করে ডিসি, এসপি, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে অনুরোধ করেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। টেলিফোন অপারেটর মেজর জিয়ার এ অনুরোধ সানন্দে গ্রহণ করেন।
এ পরিস্থিতিতে মেজর জিয়া অষ্টম ব্যাটেলিয়নের অফিসার, জেসিও জোয়ানদের জড়ো করলেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তখন রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিট। তিনি ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ঘোষণায় বললেন, “আমি মেজর জিয়াউর রহমান প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট ও লিবারেশন আর্মি চিফ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম। আপনারা যে যা পারেন, সামর্থ্য অনুযায়ী অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। আমাদেরকে লড়াই করতে হবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে দেশ ছাড়া করতে হবে।”
মেজর জিয়া ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কর্মীরা মেজর জিয়াউর রহমানকে পেয়ে উত্ফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। এদিকে বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন যে, আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ভাষণ দেবেন। প্রায় দেড় ঘণ্টায় তিনি তৈরি করেন তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন। এই ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দিল্লির ‘দি স্টেটস্ম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এনিয়ে কোনো বিতর্কের কোন সুযোগ নেই।জিয়াউর রহমান সেদিন সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের স্বাধীণতার ঘোষনা তৎক্ষালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ জন্য ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান এই ঘোষনা দিয়ে জাতিকে মুক্তি সংগ্রামের দিকে দাবিত করেছিলেন। এই ঘোষনা কারো প্রেরিত বার্তা ছিলোনা বরং জিয়াউর রহমানের নিজের লিখা বার্তা ছিলো।
জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন এবং জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান ব্যারাকে ফিরে যান এবং সেনাবাহিনীর নিয়মিত চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর ডাকে দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পরমুহুর্তে মেজর জিয়ার দুঃসাহসিক আত্মপ্রকাশ। মেজর জিয়াই মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে শেখ মুজিবকে ইতিহাসের মহানায়ক হওয়ার ক্ষেত্র টেকসই করে সম্প্রসারিত করেছেন। আজকাল স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক নিরর্থক এবং নিতান্তই কূট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার মাত্র। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা আছে বিশ্বজুড়ে।
ততকালীন মেজর জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ কানে শুনেছেন জিয়ার কন্ঠে ঘোষিত স্বাধীনতার বাণী। শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয় বর্হিবিশ্বের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কেও জিয়াউর রহমানের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা ধরা পড়ে। আর সেভাবেই সন্নিবেশিত হয় তাদের নথিতে। অবমুক্তকৃত সিআই এর গোপন দলিলে সেই সত্যটিই প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, ভারতের প্রেসিডেন্ট মোরারজী দেশাইও জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে উল্লেখ করেছেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং বিভিন্ন সময় উচ্চারিত হয়েছে এ প্রসঙ্গটি। জিয়াউর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ নিজ দায়িত্বে এবং ২৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা ১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডে উল্লেখ রয়েছে। জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা সিআইএর মত লন্ডনের সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান সহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।জিয়ার তেজোদীপ্ত কন্ঠের ঘোষণা শুনেছেন এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস ফেলছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, সৈয়দ আলী আহসান, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং, মেজর জেনারেল লছমন সিং, লে. জেনারেল মতিন, জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়াসহ অনেকেই তাদের নিজগৃহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। জিয়া একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত অবস্থায় একটি জাপানী জাহাজ থেকে অষ্ট্রেলিয়া রেডিওতে জিয়ার ঘোষণার বার্তাটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও জিয়ার ঘোষণাটি প্রথম প্রচার করে। এরপর বিবিসি’তে প্রচারিত হওয়ার পর তা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রমাণ মিলে ভারতের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যেও। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে বক্তৃতায় এক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিব এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি চাচ্ছেন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান, যার সুযোগ এখনো আছে। ‘ইন্ডিয়া সিকস’ (ওহফরধ ঝববশং) নামক বইতে ইন্দিরা গান্ধীর এ বক্তব্যটি সংকলিত হয়েছে।১৯৭৮ সালে ভারত সফরকালে দিল্লিতে জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় ভারতের ততকালীন প্রেসিডেন্ট নীলম সঞ্জীব রেড্ডি জিয়াকে বলেন, সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে আপনি বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ তার “জোসনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসের (১৮২-১৮৩) পাতায় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন।এরকম অনেক উদাহরণ ও প্রমাণ রয়েছে দেশে বিদেশে বইপুস্তকে-দলিল দস্তাবেজে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উক্তিতে। একাত্তরে ২৬ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হন পাকবাহিনীর হাতে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মতো সুযোগ ও সময় কোনটাই ছিলো না। সেদিন শেখ মুজিবের কন্ঠের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা কেউ শুনেননি। তাতে কিবা আসে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে শেখ মুজিবের ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে না পারার কারণে তার মর্যাদা বিন্দুমাত্র ম্লান হওয়ার কোন অবকাশ নেই।
অথচ এমন একটি স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মিথ্যে প্রমাণিত করার যারপরনাই চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে । দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে কোর্ট-কাচারী, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি রাষ্ট্রীয় সংবিধান পাল্টিয়ে জিয়াউর রহমানকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টায় রত বর্তমান সরকার। বিকৃত করা হচ্ছে ইতিহাস। প্রতিহিংসার করাত চালিয়ে জাতিকে চিড়ে ফেলার চেষ্টা কখনো শুভ হতে পারে না। ইতিহাসে যার যেখানে স্থান সেখানে অবশ্যই তাকে সমাসীন করতে হবে। কাউকে অবমূল্যায়ন, অবমাননা করে কিংবা একজনের জায়গায় অন্যকে প্রতিস্থাপিত করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অসুস্থ রাজনীতির বহমান এ ধারা দেশ ও জাতিকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে সে আশংকাই আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বিভেদ বিভ্রান্তি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে তাদের নিজ নিজ মর্যাদার আসনে বসাতে হবে।
জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সিপাহশালার। তিনি ছিলেন, এগার হাজার প্রতিরোধকারী সেনার কমান্ডার। সেটাই ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে একটি বক্তব্য দেন, যেটি প্রচারিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন First announced through Major Ziaur Rahman, to set up a full Fledged operational base from which it is administering the liberated areas. (Bangladesh Documents, Vol-I, Indian Government, page 284).
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ (মরহুম) অলি আহাদ তার "জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫" বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে লেখেন, "...আমি জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করিতাম তাহার বাসায় রাত্রিযাপন করিতে গিয়ে তাহারই রেডিও সেটে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশেহারা, হতভম্ব, সম্বিতহারা ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ।"
ভারতে সরকারী ওয়েব সাইটে বলা আছে “While the where abouts of Mujib remained unknown, Major Ziaur Rahman announced the formation of the provisional government of Bangladesh over radio Chittagong. আর মার্কিন ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি On march 27 the clandestine radio announced the formation of a revolutionary army and provisional government under the leadership of Major Ziaur Rahman”.
মুক্তিযুদ্ধের ৫ নাম্বার সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী (বীর-উত্তম) লিখেছেন, " অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এবং পরে স্বাধীনতাযুদ্ধের ডাক দিলে আমি সানন্দে যুদ্ধে যোগদান করি। "
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক-উল ইসলাম (বীর-উত্তম) তার A tale of Millions বইয়ের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, "২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।"
একজন পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন’ বলে সম্প্রতি দালিলিক সত্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সংস্থাটির ওয়াশিংটনস্থ সদর দফতর সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ক গোপন দলিল অবমুক্ত করলে এ বিষয়ে গত ৯ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম আলো পত্রিকায় সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে গত ৮ ডিসেম্বর প্রেরিত নিবন্ধে মিজানুর রহমান খান সিআইএর গোপন দলিলের বরাত দিয়ে লিখেন- ‘সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হলেও জিয়া ছিলেন ক্যারিশমেটিক নেতা । প্রায় ছয় বছরের নেতৃত্বে এক আশাবিহীন দরিদ্র ও বিশৃংখল অবস্থা থেকে তিনি বাংলাদেশকে সমস্যা মোকাবিলা করার উপযোগী করে তুলেছিলেন।’ ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রস্তুত সিআইএ’র বাংলাদেশ বিষয়ক হ্যান্ডবুকে দেশের প্রথম দশকের রাজনীতি মূল্যায়ন করে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। পর্যাপ্ত সামরিক নেতৃত্বের ঘাটতির সুযোগে সামরিক বাহিনী একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সিআইএর গোপন দলিলে জিয়াউর রহমানের প্রশংসার পাশাপাশি বলেছে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণকে তিনি আরো বিস্তৃত করেছিলেন।’
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি সামরিক বাহিনীর উর্দি ছেড়ে নিজেকে বেসামরিক ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। এর আগেও তিনি আরেকবার উর্দি ছেড়েছিলেন, সেটা ২৬ মার্চ উই রিভোল্ট বলার মাধ্যম।
জিয়া সৈনিক ছিলেন আজীবন, যে অর্থে একজন সৈনিক সব সময় যিনি যুদ্ধে থাকেন, থাকেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধ পাকিস্তানের দুঃশাসন থেকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ বুক ভরে শ্বাস নেয়, তারা জানালা খুলে দেয়। বাংলাদেশকে অস্পষ্ট মেরুদ- থেকে একটা শক্ত মেরুদন্ডের ওপর দাঁড় করান তিনি। জিয়া অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তান কে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টি করেন। আবার সেই বাংলাদেশে যখন একদলীয় বাকশাল আর রাহুর গ্রাসের মধ্যে পড়ে তখন তাকে মুক্ত করেন।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতীক। ১৯৩৬ সালের এই দিনে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মনসুর রহমান একজন রসায়নবিদ হিসেবে কলকাতাতে সরকারী চাকুরী করতেন। মাতা-পিতা তখন আদর করে নাম রাখেন কমল। দেশ, মাটি ও মানুষের জন্যে আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্বের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, অসাধারণ দেশপ্রেমিক, অসম সাহসী ও সহজ-সরল ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতাতে কেটেছে। দেশবিভাগের পর (১৯৪৭) তার বাবা করাচি চলে যান। তখন জিয়াউর রহমান কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঐ স্কুল থেকে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন এবং তারপর করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি কেকুলে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে শিক্ষানবিস অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি সেখানে দুই বছর চাকুরি করেণ, তারপর ১৯৫৭ সালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি খেমকারান সেক্টরে একটি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন এবং তার কোম্পানি যুদ্ধে বীরত্বের জন্য যে সব কোম্পানি সর্বাধিক পুরষ্কার পায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব পান। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জয়দেবপুরস্থ সেকেন্ড ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান। উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানীতে যান। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায় তখন এর আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সবোর্স্তরের জনগণ। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধপরিচালনা করেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলার কিয়দংশে মুক্তিপাগল মানুষকে মেজর জিয়া সংগঠিত করেন এবং পরবর্তীতে ‘জেড ফোর্সের’ অধিনায়ক হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেন সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ লড়াই করে অজির্ত হল সবুজ জমিনে ওপর রক্তলাল সূর্যখচিত পতাকাসমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। লাখো শহীদের পবিত্র রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অজির্ত হল এদেশের স্বাধীনতা। গণতন্ত্র এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, শোষন বঞ্চনার অবসান ঘটবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব- এই ছিল সেদিনের স্বপ্ন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান যুদ্ধের পরিক্লপনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এর জুন পর্যন্ত ১ নং সেক্টর কমান্ডার ও তারপর জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। অসীম সাহসিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্বে তিনি ছিলেন নির্ভীক। যখন রাজনৈতিক নেতারা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর একজন মেজর এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; জীবনবাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন; বীর উত্তম খেতাব পান। স্বাধীনতার পর তিনি ফের সৈনিক জীবনে ফিরে যান। সেনাবাহিনীতে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর প্রথমে তিনি কুমিল্লা ব্রিগেড কমান্ডার এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে কর্নেল, ১৯৭৩-এর মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার এবং শেষ দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান এ দেশের মানুষের কাছে প্রথম পরিচিত হলেও পরে তিনি বাংলাদেশের একজন বরেণ্য রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশকে রাজনৈতিক ঐকতানে নিয়ে আসা ও সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর কারণে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে আখ্যা পান। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের মধ্যদিয়ে দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির সূচনা করেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নতুন দর্শন উপস্থাপন করেন জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়ে দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যান।
শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, জিয়াউর রহমানও বালাদেশের স্বাধীনতার জন্য সেই তরুণ বয়স থেকেই নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তত রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে “একটি জাতির জন্ম“ শিরোনামে নিবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন ..“স্কুল জীবন থেকেই পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতা আমার মনকে পীড়া দিতো। আমি জানতাম, অন্তর দিয়ে ওরা আমাদের ঘৃণা করে।—বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণার বীজ উপ্ত করে দেওয়া হতো স্কুল ছাত্রদের শিশু মনেই।—সেই স্কুল জীবন থেকে মনে মনে আমার একটা আকাংখাই লালিত হতো, যদি কখনো দিন আসে, তাহলে এই পাকিস্তানবাদের অস্তিত্বেই আমি আঘাত হানবো..পাকিস্তানী পশুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার, দুর্বারতম আকাংখা দুর্বার হয়ে উঠতো মাঝে মাঝেই। উদগ্র কামনা জাগতো পাকিস্তানের ভিত্তি ভূমিটাকে তছনছ করে দিতে। কিন্তু উপযুক্ত সময় আর উপযুক্ত স্থানের অপেক্ষায় দমন করতাম সেই আকাংখাকে ”।
তার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি দেশের মানুষের প্রিয় দল হিসেবে ’৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ, ’৯১ সালের পঞ্চম সংসদ ও ষষ্ঠ এবং অষ্টম সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত ’৮৬ সালের তৃতীয় ও ’৮৮ সালের চতুর্থ এবং এছাড়া সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অধীনে অনুষ্ঠিত একতরফার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দল। এই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। বাকি ১৪৭ আসনের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল বলে বিভিন্ন সংগঠন দাবি করে। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ অন্যান্য বিরোধী দলও এই নির্বাচন বর্জন করে। একতরফার এই নির্বাচনে সমর্থন জানায়নি দেশী-বিদেশী কোনো সংস্থাই। ভোটারবিহীন সেই নির্বাচনের পর থেকেই বিরোধী জোট দ্রুত সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
সংবিধান অনুযায়ী দলটি এখনও দেশের প্রধান বিরোধী দল। আগামী ২৪ জানুয়ারি নবম সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। যদিও এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
৭১ সালে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা যেমন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল, তেমনি ’৭৫ সালে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখন হুমকির মুখে, তখন সিপাহি-জনতার অভ্যূত্থান হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হন। তিনি একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে জিয়াউর রহমান চীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের সূচনা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশকে নিয়ে ‘সার্ক’ গঠনের উদ্যোগ তারই। ওআইসিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সংহতি জোরদার করার জন্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাতবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। শহীদ জিয়ার জন্মদিন আজ এমন এক সময়ে উদযাপিত হতে যাচ্ছে, যখন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি পার করছে একটি চরম ও কঠিন সময়। শহীদ জিয়ার সহধর্মিনী, বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গুলশানে নিজ অফিসে আজ ১৬ দিন ধরে অবরুদ্ধ।
রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত দর্শন ও নেতৃত্বের অনুপস্থিতি আজ স্পষ্ট। নেতৃত্ব ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার নেশায় ডুবে আছে, যা জাতিকে বারবার সঙ্কটের মুখোমুখি করছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশ ও মানুষকে নিয়ে জিয়াউর রহমান যেভাবে ভেবেছেন, কাজ করেছেন, রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করেছেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে গুরুত্ব দিয়েছেন—এসবের মাধ্যমে তিনি এক ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসেছেন। তিনি দেশ গড়ার ভিশনকে ক্ষমতা ও সময়ের মাপকাঠির বাইরে রেখেছিলেন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভিত্তি মূলত জিয়াউর রহমানই গড়ে তুলেছেন। এজন্য একদিকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ও অন্যদিকে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ নীতিতে কাজ করেছেন।
বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ জিয়া ছিলেন বাংলার আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র।স্বাধীনতা উত্তর দুর্ভিক্ষ পিড়িত জনগন শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর যখন শুধু অনিষচয়তা আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই চোখে দেখছিলনা , ঠিক তখনই জিয়া জালিয়েছিলেন আশার আলো, বাংলাদেশের জনগন বুকে বেধেছিল অনেক বড় স্বপ্ন। কিন্তু দেশ বিরোধী ঘাতক চক্র ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র ” এর সহযোগীতায় নির্মম ভাবে শহীদ করে প্রেসিডেন্টকে। তার শাহাদাতে জাতি কলংকিত। সেদিনই আমরা সেই কলংক থেকে মুক্ত হতে পারব যেদিন আমরা গড়তে পারব জিয়ার স্বপ্নের সেই সোনার বাংলাদেশ।
আবার পঁচাত্তরের এক কালো সময়ে জিয়াউর রহমান সামনে চলে আসেন। সময় তাকে জাতীয় ভূমিকায় টেনে আনে। সেটাও ছিল এক অন্ধাকারাচ্ছন্ন সময়। সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশের বিদ্রোহে এবং আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। জাতি এক চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। এমন এক দিকনির্দেশনাহীন সময়ে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জাতীয় ভূমিকায় আবির্ভূত হন। সেখানেও তিনি নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন। কিন্তু দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তাকে সফলতার শীর্ষে নিয়ে গেছে।
সিপাহী-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’-এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সিপাহী-জনতা। ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন করে নির্মাণ করে। তত্কালীন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য রাতের আঁধারে বিদ্রোহ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ৩ নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেন। ওইদিন জাতীয় চার নেতাকেও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পদচ্যুত করে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এ চারদিন দেশ ও দেশের জনগণ দুঃসহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে। ৬ নভেম্বর রাত প্রায় ১টার সময় সশস্ত্র বাহিনীর পুনরুত্থানবাদী চক্রের বিরুদ্ধে বীর জনগণ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহীরা বিপ্লব ঘটিয়ে বন্দী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চার দিনের দুঃস্বপ্নের ইতি হয়। আওয়াজ ওঠে ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ হয়।
জিয়াউর রহমান আবার সেনাবাহিনীপ্রধানের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যেমন উদ্যোগ নেন, তেমনি সময়ের প্রয়োজেন তিনি দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সব ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। রাজনীতিতে অস্থিরতা কাটিয়ে একটি সমন্বিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক ব্যক্তি হয়েও তিনি রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। সাধারণত মিলিটারি শাসকরা রাজনীতিকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সামরিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগের চেষ্টা করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সমরনীতির প্রভেদ বুঝতেন। দেশের একটি অন্ধকার সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া দ্বিতীয় ভাষণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়া
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতের কেন্দ্র চলে আসেন। ১৯ শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তিনি প্রধান সামরিক প্রশাষকের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সায়েমকে কৌশলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার পর ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ অধীষ্ঠ হন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গনতান্ত্রায়নের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গনতন্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন, “I will make politics difficult for the politicians” (আমি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদের জন্য কঠিন করে দেব)। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক বিদ্রোহে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ২৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সরকার তাঁকে সেনাবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ নিয়োগ করেন। নভেম্বরে পুনরায় সেনা বিদ্রোহ, খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত, আবূ সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্ট হন। ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লবে জিয়াউর রহমানকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ-অফ-স্টাফ পদের দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন, ১৯৭৬-এ কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়াম্যান পদ লাভ করে। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬-এর ২৯ নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬-এ গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন, ১৯৭৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন, এপ্রিলের ২১ তারিখ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ। মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০ মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।
জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম জননির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। যে রাষ্ট্রপতি তার জীবদ্দশায় গেছেন কৃষকের পর্ণকুটিরে, শ্রমিকের বস্তিতে। গ্রামে গ্রামে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা জেনে তা সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব, দুরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা, জনসাধারণকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করার পদক্ষেপ এবং নিজের প্রশ্নাতীত সততা তাঁকে এক যুগে তার সমসাময়িক কালের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করে। আবার ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’র ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সব মতের মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংক্ষেপে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এর সভানেত্রী।‘দেশ’ ও ‘মানুষ’ই তার রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শের পরিচয় একটি বক্তৃতার মাধ্যমে আমি তুলে ধরছি। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ রামপুরা টেলিভিশন ভবনে বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা সকলে বাংলাদেশী। আমরা প্রথমে বাংলাদেশী এবং শেষেও বাংলাদেশী। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’ (দৈনিক বাংলা, ১৪ মার্চ, ১৯৭৬)
১৯৭৭ সালে তিনি প্রণয়ন করেন ১৯ দফা কর্মসূচি। জিয়াউর রহমান ঘোষিত এই ১৯ দফা ছিল তার উন্নয়নের মূলমন্ত্র। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তার পেছনে গাইডলাইন হিসেবে কাজ করেছে ১৯ দফা।
জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘জাতীয় সেনাবাহিনী’ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। প্রশিক্ষণ, কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা দ্বারা অফিসারদের নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগাতে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি। ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন তাদের। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সামরিক বাহিনীর একটা ক্ষুদ্র গ্রুপ দ্বারা সংঘটিত অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলেও এটা সত্য যে, তিনিই সামরিক বাহিনীতে ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। উন্নত প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বয়ে এবং সম্মানজনক বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সামরিক বাহিনীর মনোবলকে উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দুর্বল-শক্তিশালী সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ সবার সঙ্গে পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বৈদেশিক নীতি নির্দিষ্ট ও বাস্তবায়ন করেন। জোটনিরপেক্ষ এবং ইসলামী দেশগুলো ও বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের সম্মেলনে তার ব্যক্তিগত এবং সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ গতি সঞ্চারিত হয়। ব্যক্তিগত কূটনীতি দ্বারা তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বৈদেশিক নীতির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলকে তিন ভাগে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, তিনি জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্বব্যাপী শান্তির আবহ তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির উন্নয়ন ঘটান। এর ফলেই বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। তিনি উপমহাদেশের জন্য একটি স্থানীয় শান্তিকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো নিয়ে আসিয়ানের মতো সংস্থা গড়ার উদ্যোগ নেন, যা পরবর্তীকালে সার্ক নামে প্রতিষ্ঠা পায়।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির আরেকটা লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে বহুমুখীকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্যকে উত্সাহিত করা। তার শাসনকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সত্ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্ব্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ মালয়েশিয় দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে বলা হয়, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯)
ওই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের এক সংখ্যায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা, স্বনির্ভরতা অর্জন এবং উত্পাদন দ্বিগুণ করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়। কাজের জন্য জনগণকে সংগঠিত ও অনুপ্রাণিত করতে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রায়ই গ্রামে-গঞ্জে সফর করেন। ‘জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষায় বাংলাদেশী নেতা’ শিরোনামে মাইকেল টি ক্যাফম্যানের এ রিপোর্টে গ্রামাঞ্চলে সপ্তাহে তিন-চারবার সফরের সময় জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেয়া হয়।
এ সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা কৌশল নিয়েও বিশ্ববাসী উচ্চ ধারণা পোষণ করে। বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি বহির্বিশ্বের আস্থা সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আরেকটা অবদান হলো নাগরিক বাহিনী গঠনের চিন্তা বাস্তবায়ন করা। তিনি এক কোটি নারী ও পুরুষকে সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) গঠনের মাধ্যমে দেশগঠন ও নিরাপত্তায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন।
জিয়াউর রহমানের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিশেষ প্রচার পেয়েছিল। জিয়াউর রহমান আমলানির্ভর প্রকল্প না করে স্থানীয় নেতাদের দ্বারা কৃষককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এতে কৃষকের মধ্যেও ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক প্লাটফর্মে থেকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি এদেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগানোর প্রয়াস চালান। অনেকটা সফলও হন তিনি। এ জাতীয়তাবাদী দর্শনই একটি জাতি ও দেশের রক্ষাকবচ।
জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য:
সকল দলের অঃশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান; জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি; বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া; দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব; সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লেক্ষ্য স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারী সহায়তায়র সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন; গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান; গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন; গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা; হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ; ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ কের গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ; নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত দূরীকরণ; কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি; কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তআনীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ; যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ; ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃইষ্ট করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন; তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লেক্ষ্য গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন; জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ; তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি; দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ‘সার্ক’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ; বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ; জনশক্তি রপ্তানি, তৈরী পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন; শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ। যে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইলের ওপর আমাদের অর্থনীতি আজ দাঁড়ানো, তার গোড়াপত্তন করেন জিয়া
জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সময় সংক্ষিপ্ত—পাঁচ বছরের একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব কাজ করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমি ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই পাঠান সম্রাট শেরশাহের অনেক মিল খুঁজে পাই। শেরশাহের শাসনভার ছিল এমনই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু জনকল্যাণে, সাধারণ মানুষের মঙ্গলে তাঁর কীর্তিগুলো ছিল যেমন অভিনব, তেমনই অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাবের, যা আজও তাঁর দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু—সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয়-সংকটে আক্রান্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা জাতিকে তার সত্যিকারের পরিচয় এবং তার আপন স্বাধীন স্বকীয়তার পরিচিতি তিনি উন্মোচন করতে পেরেছিলেন। সে পরিচিতি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সংমিশ্রণে হাজার বছরের যে রসায়ন, তারই আবিষ্কার তিনি ঘটিয়ে ছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত তাঁর মন, মনন ও চেতনা—তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। তাই তাঁর প্রিয় গান, যা তিনি আপন মনে গুন গুন করে গাইতেন, ‘আমার জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’
১৯৮১ সালের ৩০শে মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হন।
চট্রগ্রামে বিএনপির উপদলীয় কোন্দল নিরসনের লক্ষ্যে ২৯ মে সকালে পতেঙ্গা বিমান বিন্দরে পৌছলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। তার সফরসঙ্গী ছিলেন বি চৌধুরি, মহিবুল হাসান, নাজমুল হুদা, ড: আমিনা , নৌ বাহিনীর প্রধান এম এ খান প্রমুখ। চট্রগ্রাম সার্কিট হাউজে হাল্কা নাস্তা সেরে বারান্দায় আলোচনায় বসলেন বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে । বেলা সাড়ে বারটার দিকে জুম্মা নামাজের বিরতি । সাদা পাঞ্জাবি -পায়জামা পরে চকবাজারের নন্দনপুরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন জিয়া। নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লীদের সাথে কুশল বিনিময় করে ফিরে আসলেন সার্কিট হাউজে । দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুপুরের খাবার সেরে ঘন্টা দেড়েক বিশ্রাম নেন । বিকালে চবির ভিসি, অধ্যাপকবৃন্দ, আইনজীবি, সাংবাদিক প্রমুখ আগত অতিথীদের সাথে আড়াই ঘন্টা আলাপ করেন । তারপর স্থানীয় বিএনপির দুই উপদলের সাথে আলাদাভাবে রাত ৯ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত আলোচনা করেন । এর মধ্যে চট্রগ্রামের ডিসি ও পুলিশ কমিশনারের সাথে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন । রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিৎসক লে কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম তার খাবার পরখ করে শেষ করলে রাত ১১টার একটু পরে জিয়াকে রাতের খাবার দেয়া হয় । ডিনার শেষে ঢাকায় তার স্ত্রী খালেদার সঙ্গে টেলিফোনে মিনিট পনেরো কথা বলেন জিয়া । জীবনের আলো নিভে যাবার ৫ঘন্টা আগে ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমুতে গেলেন জিয়া । নিশ্চিন্তে বিছানায় নিদ্রায় গেলেন তিনি । ওদিকে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করতে এগিয়ে আসছে ঘাতক দল । বাইরে তখন তুমুল ঝড় বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঝলকানি ।
রাত আড়াইটার দিকে কালুরঘাটস্থ রেডিও ট্রানসমিটারের কাছে হাজির হল ঘাতক দল । ঘাতকদলের নেতৃত্ব দেয় লে. কর্নেল মতিউর রহমান । ঘাতকদল তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমন পরিচালনার পরিকল্পনা নেয় । মতি থাকল দ্বিতীয় দলে যারা প্রথমদলকে পেছন থেকে সহায়তা দিবে । রাত সাড়ে তিনটার সামান্য কিছু পরে দল তিনটি প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে এগুতে থাকে । ঘাতকদল বিনাবাঁধায় সার্কিট হাউজে ঢুকে পড়ে । ভীতি সঞ্চার করতে রকেট ল্যান্সার থেকে ফায়ার ও গ্রেনেড চার্জ করা হয় আর মেশিনগানের গুলি চালানো হয় । পাহারারত ৪৪ জন পুলিশের ১ জন নিহত, ১২ জন আহত ও বাকিরা আত্মগোপন করেন । রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল । যে দুজনের রাষ্ট্রপতির কক্ষের সামনে পাহারা দেবার কথা তাদের আগেই খতম করে দেয়া হয় । রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা কর্মকর্তা লে. কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজ দু'তলায় রাষ্ট্রপতির শয়নকক্ষের পেছনের কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন । রকেটের আওয়াজে তারা জেগে উঠে । রাষ্ট্রপতিকে বাচাতে তারা তাদের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পাবার আগেই ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন । ঘাতকদলটি ঐ সময় দুতলায় রাষ্ট্রপতির ৯ নম্বর কক্ষ খুজতে শুরু করে । ঘাতকদলের একজন ঐ কক্ষের দরজা ভেঙ্গে ফেলতেই ঘরে ড. আমিনাকে আবস্কার করেন । ফলে রাষ্ট্রপতির খোজে ওরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে । তারা ইতিমধ্যে বুঝতে পারে রাষ্ট্রপতি আছেন ৪ নম্বর রুমে । ঘাতকদলের একজন ঐ কক্ষের বারান্দার দিকে দরজা লাথি দিতে ভাঙ্গতে চেষ্টা করে ।
গোলাগুলি আর চিৎকার চেচামেচিতে উঠে বসলেন চকিতে জিয়া ।
কি ব্যাপার ? ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে , পরনে রাতে শয্যার পোষাক । গভীর আত্মপ্রত্যয় আর অগাধ আস্থা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ।
কি চাও তোমরা?
কাছে দন্ডায়মান লে. মোসলেহউদ্দিন রীতিমত ঘাবরে যান । সে জিয়াকে আশ্বস্ত করে-‘‘স্যার আপনি ঘাবরাবেন না । এখানে ভয়ের কিছু নেই ।’’
মোসলেহউদ্দিনের ঠোট থেকে জিয়ার প্রতি আশ্বাসবানী মিলিয়ে যাবার আগেই লে. কর্নেল মতিউর রহমান তার এসএমজি থেকে অতি কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার করেন জিয়ার শরীরের ডানদিক একেবারে ঝাঝরা করে ফেলে । দরজার কাছেই মুখ থুবরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন জিয়া । এরপর মতি তার বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার প্রাণহীন দেহ উলটিয়ে নেয় । তারপর ক্ষিপ্তপ্রায় মতি জিয়ার মুখমন্ডল আর বুকের উপর তার এসএমজির ট্রিগার টিপে রেখে ম্যাগাজিন খালি করে তার খুনের নেশা মেটায় । আনুমানিক চার থেকে সাড়ে চারটায় জিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে । জিয়াকে খুন করে ঘাতকদল ঝটপট সার্কিট হাউজ ছেড়ে চলে যায় ।
জিয়াউর রহমানকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দাফন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ঘটে যেখানে প্রায় ২০ লক্ষ্যাধিক মানুষ সমবেত হয়।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের জনগণের মাঝে অভূতপূর্ব শোকের ছায়া নেমে আসে। গণমানুষের এ শোক জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও নীতির প্রতি দেশবাসীর ব্যাপক সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষনজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম,পরিশ্রমপ্রিয়তা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলি এ দেশের গণমানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্যে তা জোটেনি। মাত্র ছয় বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার ওপর ছিল প্রচণ্ড আস্থাশীল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার ওপর মানুষের এই আস্থায় কোনো চিড় ধরেনি।
জাতির বর্তমান দুর্বিসহ ক্রান্তিকালে মেজর জিয়ার মতো একজন কালজয়ী বহুদলীয় গণতন্ত্রের কান্ডারীর নিরন্তর প্রয়োজন।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম , জিয়া পরিষদের সহ আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম আহবায়ক
এর সাথে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এই বিতর্ক কোন নূতন ঘটনা নয় । তবে আমাদের এই বিতর্কের ফলে জাতি দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে । এই পিছিয়ে পড়া জাতি কি করে মাথা তুলে দাঁড়াবে যদি কোন একতা না থাকে ?
১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে একজন কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে বীরত্ব দেখিয়ে জিয়াউর রহমান পাক সেনাবাহিনীতে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন। এ সময়েই জিয়াউর রহমান বাঙালি সহকর্মীদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। এরপর তাকে পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানেও তিনি নবীন সেনা অফিসারদের সঙ্গে ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ বিষয়ে কথা বলেছেন।
এদিকে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পূর্ব-পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতা প্রাপ্তির সুযোগ পায় পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগ। জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে।
এই বিশাল বিজয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণের অপেক্ষায় ছিলেন। অন্যদিকে, পাকিস্তান পিপলস্্্্্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ নির্বাচনে অপেক্ষাকৃত কম আসনে জয় পেয়েও ক্ষমতা ভাগাভাগির নানা কৌশল আটতে থাকেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানও এ অপকৌশলে সহায়ক ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘ বিলম্বের পর ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কিন্তু, কোনো কারণ ছাড়াই হঠাত্ ১ মার্চ দুপুরে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন তিনি।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ফুঁসে ওঠে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ। ১ মার্চ থেকেই রাজপথে নেমে আসেন তারা। ২ মার্চ উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। শাসকগোষ্ঠীর কারফিউ ভেঙে দিন-রাত চলে বিক্ষোভ। বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলিতে নিহত হয় অন্তত তিনজন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এদিন এক বিবৃতিতে ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত গোটা প্রদেশে হরতালের ডাক দেন।
২ মার্চ থেকে ৫ মার্চ দেশজুড়ে সংঘর্ষ চলে। বহু মানুষ হতাহত হন। ৬ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের জাতীয় অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন আহ্বান করেন।
পরের দিন ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান কী ভাষণ দেবেন তা শোনার জন্য সারাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ৭ মার্চ শেখ মুজিব বজ্রকণ্ঠে সাত দফা ঘোষণা করেন। সামরিক আইন ও সেনা বাহিনী প্রত্যাহার, গণহত্যার তদন্ত এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের প্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করা হইলে পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রশ্ন বিবেচনা করা যাইতে পারে, তাহার পূর্বে নয়।’ সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের লেখা ‘বাংলাদেশের তারিখ’ (প্রথম সংস্করণ) নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে—“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয়-বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলে ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেন।”
৯ মার্চ মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পল্টনের এক জনসভায় শেখ মুজিবকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অপেক্ষা বাংলার নায়ক হওয়া অনেক গৌরবের।’ (দৈনিক আজাদ, ১০ মার্চ ১৯৭১) ১০ মার্চ একইভাবে তিনি বলেন, ‘আলোচনায় কিছু হবে না। ওদের আসসালামু আলাইকুম জানিয়ে দাও।’
১৩ মার্চ ভৈরবে এক জনসভায় ভাসানী বলেন, ‘পূর্ববাংলা এখন সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং আমরা এখন একটি পূর্ববাংলা সরকারের অপেক্ষায় আছি।’ ১৪ মার্চ জনতার বাঁধভাঙা আন্দোলনের একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রধান ওয়ালী খানের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করেন।
শাসনতান্ত্রিক সংকট প্রশ্নে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবু মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। ১৬ মার্চ প্রথম শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বৈঠকে বসেন।
১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের দ্বিতীয় দফা সংলাপও সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। ১৮ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের বিরতি ছিল। ১৯ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের মধ্যে তৃতীয় দফা বৈঠক হয়। বৈঠকের পর শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি মঙ্গলের প্রত্যাশী, আবার চরম পরিণতির জন্যও প্রস্তুত।’ ২০ মার্চ বৈঠকের পর আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে জানান তিনি।
২১ মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় আসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পৃথকভাবে শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করেন। রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে ২২ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পূর্ব ঘোষিত ২৫ মার্চের জাতীয় পরিষদের সভা স্থগিত করা হয়।
দীর্ঘ আলোচনার পর ২৪ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সমঝোতার আভাস দেন। সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, ‘ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আমরা মতৈক্যে পৌঁছেছি। আমি আশা করি, প্রেসিডেন্ট এখন তা ঘোষণা করবেন।’
২৫ মার্চ দিনব্যাপী ঢাকা শহরে চলে প্রতিবাদ মিছিল, রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি এবং বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ চলে সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের। সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। এ দিন রাত ১১টার পর থেকে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর সদর দফতর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পুরো ঢাকা মহানগরীতে হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে।
রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং কয়েকটি ট্রাক বোঝাই সৈন্য শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ওপর দিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাস্তা ধরে এগিয়ে আসে এবং তাকে সহ ৪ জন চাকর এবং একজন দেহরক্ষীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান গণহত্যার প্রতিবাদ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে ২৭ মার্চ সারাদেশে হরতাল আহ্বান করেন। পরের দিন শেখ মুজিবের গ্রেফতার ও হরতালের খবর প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
এদিকে রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিটের দিকে চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন মেজর জিয়াউর রহমান। এর আগে দিনে চট্টগ্রাম শহরে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে। অস্ত্র বোঝাই জাহাজ সোয়াতের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হয় প্রবল প্রতিরোধ। অস্ত্র খালাস করে যাতে পশ্চিমা সৈন্যদের হাতে না পৌঁছতে পারে সে জন্য রাস্তায় রাস্তায় তৈরি করা হয় ব্যারিকেড। এই ব্যারিকেড সরিয়ে রাস্তা পরিষ্কারের কাজে লাগানো হয় বাঙালি সৈন্যদের। রাত ১০টা পর্যন্ত চলে এই ব্যারিকেড সরানোর কাজ। রাত ১১টায় চট্টগ্রামস্থ অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’র কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুর রশীদ জানজুয়া আকস্মিকভাবে সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে নির্দেশ পাঠান এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে বন্দরে যাওয়ার জন্য।
রাত প্রায় সাড়ে ১১টায় জানজুয়া নিজে এসে মেজর জিয়াকে নৌ-বাহিনীর একটি ট্রাকে তুলে ষোলশহর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বন্দরের দিকে রওনা করিয়ে দেন। সঙ্গে একজন নৌ বাহিনীর অফিসারকে (পশ্চিম পাকিস্তানি) গার্ড হিসেবে দেয়া হয়। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড সরিয়ে যেতে তাঁর দেরি হয়। আগ্রাবাদে একটা বড় ব্যারিকেডের সামনে বাধা পেয়ে তাঁর ট্রাক থেমে যায়, তখনই পেছন থেকে একটি ডজ গাড়িতে ছুটে আসেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। গাড়ি থেকে নেমেই তিনি দৌড়ে যান মেজর জিয়াউর রহমানের কাছে। হাত ধরে তাকে রাস্তার ধারে নিয়ে যান। জানান, ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে বার্তা নিয়ে এসেছেন। পশ্চিমারা গোলাগুলি শুরু করেছে। শহরে বহু লোক হতাহত হয়েছে। এতে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন মেজর জিয়াউর রহমান। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৃঢ়কণ্ঠে তিনি বলে ওঠেন— ‘উই রিভোল্ট।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি খালেকুজ্জামানকে ষোলশহরে ফিরে গিয়ে ব্যাটালিয়নকে তৈরি করার জন্য কর্নেল অলি আহমদকে নির্দেশ দিতে বলেন। আর সেই সঙ্গে নির্দেশ পাঠান ব্যাটেলিয়নের সমস্ত পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতারের। এই রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়াসহ সব পশ্চিমা অফিসারকে গ্রেফতার করা হলো।
এরপর অন্যান্য ব্যাটেলিয়নের বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের ফোন করলেন, কিন্তু অনেককেই পেলেন না। এ পর্যায়ে তিনি বেসামরিক বিভাগে টেলিফোন অপারেটরকে ফোন করে ডিসি, এসপি, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে অনুরোধ করেন যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। টেলিফোন অপারেটর মেজর জিয়ার এ অনুরোধ সানন্দে গ্রহণ করেন।
এ পরিস্থিতিতে মেজর জিয়া অষ্টম ব্যাটেলিয়নের অফিসার, জেসিও জোয়ানদের জড়ো করলেন। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে তখন রাত আনুমানিক ২টা ১৫ মিনিট। তিনি ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। ঘোষণায় বললেন, “আমি মেজর জিয়াউর রহমান প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট ও লিবারেশন আর্মি চিফ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য দেশবাসীকে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হলাম। আপনারা যে যা পারেন, সামর্থ্য অনুযায়ী অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। আমাদেরকে লড়াই করতে হবে এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে দেশ ছাড়া করতে হবে।”
মেজর জিয়া ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে যান। বেতার কর্মীরা মেজর জিয়াউর রহমানকে পেয়ে উত্ফুল্ল হয়ে ওঠেন। কিন্তু কি বলবেন তিনি? একটি করে বিবৃতি লেখেন আবার তা ছিঁড়ে ফেলেন। এদিকে বেতার কর্মীরা বারবার ঘোষণা করছিলেন যে, আর পনের মিনিটের মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমান ভাষণ দেবেন। প্রায় দেড় ঘণ্টায় তিনি তৈরি করেন তাঁর ঐতিহাসিক ঘোষণাটি। সেটা তিনি বাংলা এবং ইংরেজিতে পাঠ করেন। এই ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ দিল্লির ‘দি স্টেটস্ম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন এনিয়ে কোনো বিতর্কের কোন সুযোগ নেই।জিয়াউর রহমান সেদিন সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বাংলাদেশের স্বাধীণতার ঘোষনা তৎক্ষালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দেওয়ার কথা থাকলেও তা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছিলেন। এ জন্য ২৬ মার্চ জিয়াউর রহমান এই ঘোষনা দিয়ে জাতিকে মুক্তি সংগ্রামের দিকে দাবিত করেছিলেন। এই ঘোষনা কারো প্রেরিত বার্তা ছিলোনা বরং জিয়াউর রহমানের নিজের লিখা বার্তা ছিলো।
জিয়াউর রহমান রণাঙ্গনে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন এবং জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই করে নেয় বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান ব্যারাকে ফিরে যান এবং সেনাবাহিনীর নিয়মিত চাকরিতে যোগ দেন। তাঁর ডাকে দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশ স্বাধীন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতারের পরমুহুর্তে মেজর জিয়ার দুঃসাহসিক আত্মপ্রকাশ। মেজর জিয়াই মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করে শেখ মুজিবকে ইতিহাসের মহানায়ক হওয়ার ক্ষেত্র টেকসই করে সম্প্রসারিত করেছেন। আজকাল স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক নিরর্থক এবং নিতান্তই কূট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার মাত্র। মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা আছে বিশ্বজুড়ে।
ততকালীন মেজর জিয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে একাত্তরের ২৬ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ কানে শুনেছেন জিয়ার কন্ঠে ঘোষিত স্বাধীনতার বাণী। শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নয় বর্হিবিশ্বের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কেও জিয়াউর রহমানের দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা ধরা পড়ে। আর সেভাবেই সন্নিবেশিত হয় তাদের নথিতে। অবমুক্তকৃত সিআই এর গোপন দলিলে সেই সত্যটিই প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, ভারতের প্রেসিডেন্ট মোরারজী দেশাইও জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বলে উল্লেখ করেছেন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং বিভিন্ন সময় উচ্চারিত হয়েছে এ প্রসঙ্গটি। জিয়াউর রহমান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ নিজ দায়িত্বে এবং ২৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার কথা ১৯৮২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম প্রকাশিত স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের ১৫ খন্ডে উল্লেখ রয়েছে। জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার অমোঘ ঘোষণা সিআইএর মত লন্ডনের সাপ্তাহিক গার্ডিয়ান সহ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও সংবাদ মাধ্যম লিপিবদ্ধ করে রেখেছে।জিয়ার তেজোদীপ্ত কন্ঠের ঘোষণা শুনেছেন এমন লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে নি:শ্বাস ফেলছেন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেনানায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, সৈয়দ আলী আহসান, ব্যারিষ্টার আমিরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, রাও ফরমান আলী, মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং, মেজর জেনারেল লছমন সিং, লে. জেনারেল মতিন, জেনারেল সুবিদ আলী ভূঁইয়াসহ অনেকেই তাদের নিজগৃহে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জিয়ার কন্ঠে স্বাধীনতা ঘোষণা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন। জিয়া একাত্তরের ২৬ মার্চ সন্ধ্যা ৭:৪৫ মিনিটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গররত অবস্থায় একটি জাপানী জাহাজ থেকে অষ্ট্রেলিয়া রেডিওতে জিয়ার ঘোষণার বার্তাটি পাঠানো হয়। অস্ট্রেলিয়া রেডিও জিয়ার ঘোষণাটি প্রথম প্রচার করে। এরপর বিবিসি’তে প্রচারিত হওয়ার পর তা পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে।
জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রমাণ মিলে ভারতের ততকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্যেও। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে বক্তৃতায় এক জায়গায় ইন্দিরা গান্ধী বলেন, শেখ মুজিব এখনো বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি চাচ্ছেন সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান, যার সুযোগ এখনো আছে। ‘ইন্ডিয়া সিকস’ (ওহফরধ ঝববশং) নামক বইতে ইন্দিরা গান্ধীর এ বক্তব্যটি সংকলিত হয়েছে।১৯৭৮ সালে ভারত সফরকালে দিল্লিতে জিয়াউর রহমানের সম্মানে আয়োজিত ভোজ সভায় ভারতের ততকালীন প্রেসিডেন্ট নীলম সঞ্জীব রেড্ডি জিয়াকে বলেন, সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করে আপনি বাংলাদেশের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদ তার “জোসনা ও জননীর গল্প” উপন্যাসের (১৮২-১৮৩) পাতায় জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে লিখেছেন।এরকম অনেক উদাহরণ ও প্রমাণ রয়েছে দেশে বিদেশে বইপুস্তকে-দলিল দস্তাবেজে, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের উক্তিতে। একাত্তরে ২৬ মার্চ শেখ মুজিব গ্রেফতার হন পাকবাহিনীর হাতে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মতো সুযোগ ও সময় কোনটাই ছিলো না। সেদিন শেখ মুজিবের কন্ঠের স্বাধীনতা ঘোষণার কথা কেউ শুনেননি। তাতে কিবা আসে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে শেখ মুজিবের ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে না পারার কারণে তার মর্যাদা বিন্দুমাত্র ম্লান হওয়ার কোন অবকাশ নেই।
অথচ এমন একটি স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত সত্যকে মিথ্যে প্রমাণিত করার যারপরনাই চেষ্টা চলছে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে । দেশের আপামর জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করে কোর্ট-কাচারী, মামলা-মোকদ্দমা এমনকি রাষ্ট্রীয় সংবিধান পাল্টিয়ে জিয়াউর রহমানকে তার প্রাপ্য মূল্যায়ন ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টায় রত বর্তমান সরকার। বিকৃত করা হচ্ছে ইতিহাস। প্রতিহিংসার করাত চালিয়ে জাতিকে চিড়ে ফেলার চেষ্টা কখনো শুভ হতে পারে না। ইতিহাসে যার যেখানে স্থান সেখানে অবশ্যই তাকে সমাসীন করতে হবে। কাউকে অবমূল্যায়ন, অবমাননা করে কিংবা একজনের জায়গায় অন্যকে প্রতিস্থাপিত করে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। অসুস্থ রাজনীতির বহমান এ ধারা দেশ ও জাতিকে কোথায় নিয়ে ঠেকাবে সে আশংকাই আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এ বিভেদ বিভ্রান্তি ও প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেড়িয়ে আসতে হলে জাতীয় নেতৃবৃন্দকে তাদের নিজ নিজ মর্যাদার আসনে বসাতে হবে।
জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সিপাহশালার। তিনি ছিলেন, এগার হাজার প্রতিরোধকারী সেনার কমান্ডার। সেটাই ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে একটি বক্তব্য দেন, যেটি প্রচারিত হয় ১১ এপ্রিল ১৯৭১ স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন First announced through Major Ziaur Rahman, to set up a full Fledged operational base from which it is administering the liberated areas. (Bangladesh Documents, Vol-I, Indian Government, page 284).
বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ (মরহুম) অলি আহাদ তার "জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৭-৭৫" বইয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে লেখেন, "...আমি জনাব আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সহিত নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করিতাম তাহার বাসায় রাত্রিযাপন করিতে গিয়ে তাহারই রেডিও সেটে ২৭ মার্চ চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র হইতে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বরে স্বাধীন বাংলার ডাক ধ্বনিত হইয়াছিল। এই ডাকের মধ্যে সেই দিশেহারা, হতভম্ব, সম্বিতহারা ও মুক্তিপ্রাণ বাঙালি জনতা শুনিতে পায় এক অভয়বাণী, আত্মমর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়িবার আহ্বান, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লড়াইয়ের সংবাদ।"
ভারতে সরকারী ওয়েব সাইটে বলা আছে “While the where abouts of Mujib remained unknown, Major Ziaur Rahman announced the formation of the provisional government of Bangladesh over radio Chittagong. আর মার্কিন ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি On march 27 the clandestine radio announced the formation of a revolutionary army and provisional government under the leadership of Major Ziaur Rahman”.
মুক্তিযুদ্ধের ৫ নাম্বার সেক্টরের কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী (বীর-উত্তম) লিখেছেন, " অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ ঘোষণা করলে এবং পরে স্বাধীনতাযুদ্ধের ডাক দিলে আমি সানন্দে যুদ্ধে যোগদান করি। "
আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিক-উল ইসলাম (বীর-উত্তম) তার A tale of Millions বইয়ের ১০৫-১০৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, "২৭ মার্চের বিকেলে তিনি (মেজর জিয়া) আসেন মদনাঘাটে এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।"
একজন পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন’ বলে সম্প্রতি দালিলিক সত্য প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। সংস্থাটির ওয়াশিংটনস্থ সদর দফতর সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ক গোপন দলিল অবমুক্ত করলে এ বিষয়ে গত ৯ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম আলো পত্রিকায় সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান এর লেখা একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে গত ৮ ডিসেম্বর প্রেরিত নিবন্ধে মিজানুর রহমান খান সিআইএর গোপন দলিলের বরাত দিয়ে লিখেন- ‘সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হলেও জিয়া ছিলেন ক্যারিশমেটিক নেতা । প্রায় ছয় বছরের নেতৃত্বে এক আশাবিহীন দরিদ্র ও বিশৃংখল অবস্থা থেকে তিনি বাংলাদেশকে সমস্যা মোকাবিলা করার উপযোগী করে তুলেছিলেন।’ ১৯৮২ সালের নভেম্বরে প্রস্তুত সিআইএ’র বাংলাদেশ বিষয়ক হ্যান্ডবুকে দেশের প্রথম দশকের রাজনীতি মূল্যায়ন করে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করে। পর্যাপ্ত সামরিক নেতৃত্বের ঘাটতির সুযোগে সামরিক বাহিনী একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। সিআইএর গোপন দলিলে জিয়াউর রহমানের প্রশংসার পাশাপাশি বলেছে ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণকে তিনি আরো বিস্তৃত করেছিলেন।’
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, যিনি সামরিক বাহিনীর উর্দি ছেড়ে নিজেকে বেসামরিক ব্যক্তিতে পরিণত করেছেন। এর আগেও তিনি আরেকবার উর্দি ছেড়েছিলেন, সেটা ২৬ মার্চ উই রিভোল্ট বলার মাধ্যম।
জিয়া সৈনিক ছিলেন আজীবন, যে অর্থে একজন সৈনিক সব সময় যিনি যুদ্ধে থাকেন, থাকেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধ পাকিস্তানের দুঃশাসন থেকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশকে মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়ার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ বুক ভরে শ্বাস নেয়, তারা জানালা খুলে দেয়। বাংলাদেশকে অস্পষ্ট মেরুদ- থেকে একটা শক্ত মেরুদন্ডের ওপর দাঁড় করান তিনি। জিয়া অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তান কে যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক রাষ্ট্র বাংলাদেশের সৃষ্টি করেন। আবার সেই বাংলাদেশে যখন একদলীয় বাকশাল আর রাহুর গ্রাসের মধ্যে পড়ে তখন তাকে মুক্ত করেন।
তিনি ছিলেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতীক। ১৯৩৬ সালের এই দিনে বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলার বাগমারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মনসুর রহমান একজন রসায়নবিদ হিসেবে কলকাতাতে সরকারী চাকুরী করতেন। মাতা-পিতা তখন আদর করে নাম রাখেন কমল। দেশ, মাটি ও মানুষের জন্যে আমৃত্যু নিবেদিতপ্রাণ এই ব্যক্তিত্বের পরিচিতি সর্বজনবিদিত। দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক, অসাধারণ দেশপ্রেমিক, অসম সাহসী ও সহজ-সরল ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে জিয়াউর রহমান ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতাতে কেটেছে। দেশবিভাগের পর (১৯৪৭) তার বাবা করাচি চলে যান। তখন জিয়াউর রহমান কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঐ স্কুল থেকে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন এবং তারপর করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি কেকুলে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে শিক্ষানবিস অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি সেখানে দুই বছর চাকুরি করেণ, তারপর ১৯৫৭ সালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি খেমকারান সেক্টরে একটি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন এবং তার কোম্পানি যুদ্ধে বীরত্বের জন্য যে সব কোম্পানি সর্বাধিক পুরষ্কার পায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব পান। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জয়দেবপুরস্থ সেকেন্ড ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান। উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানীতে যান। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান।
২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায় তখন এর আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সবোর্স্তরের জনগণ। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধপরিচালনা করেন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলার কিয়দংশে মুক্তিপাগল মানুষকে মেজর জিয়া সংগঠিত করেন এবং পরবর্তীতে ‘জেড ফোর্সের’ অধিনায়ক হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেন সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ লড়াই করে অজির্ত হল সবুজ জমিনে ওপর রক্তলাল সূর্যখচিত পতাকাসমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। লাখো শহীদের পবিত্র রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অজির্ত হল এদেশের স্বাধীনতা। গণতন্ত্র এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, শোষন বঞ্চনার অবসান ঘটবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব- এই ছিল সেদিনের স্বপ্ন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান যুদ্ধের পরিক্লপনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এর জুন পর্যন্ত ১ নং সেক্টর কমান্ডার ও তারপর জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। অসীম সাহসিকতা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্বে তিনি ছিলেন নির্ভীক। যখন রাজনৈতিক নেতারা সিদ্ধান্তহীনতায় ছিলেন, তখন সেনাবাহিনীর একজন মেজর এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন; জীবনবাজি রেখে সশস্ত্র যুদ্ধ করেন। সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন; বীর উত্তম খেতাব পান। স্বাধীনতার পর তিনি ফের সৈনিক জীবনে ফিরে যান। সেনাবাহিনীতে সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর প্রথমে তিনি কুমিল্লা ব্রিগেড কমান্ডার এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে কর্নেল, ১৯৭৩-এর মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার এবং শেষ দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।
স্বাধীনতার ঘোষক, মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে জিয়াউর রহমান এ দেশের মানুষের কাছে প্রথম পরিচিত হলেও পরে তিনি বাংলাদেশের একজন বরেণ্য রাষ্ট্রনায়কে পরিণত হন। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশকে রাজনৈতিক ঐকতানে নিয়ে আসা ও সুদৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর কারণে তিনি আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে আখ্যা পান। তিনি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠনের মধ্যদিয়ে দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতির সূচনা করেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নতুন দর্শন উপস্থাপন করেন জিয়াউর রহমান। তিনি ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়ে দেশে উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে যান।
শুধু রাজনীতিবিদরাই নন, জিয়াউর রহমানও বালাদেশের স্বাধীনতার জন্য সেই তরুণ বয়স থেকেই নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তত রেখেছিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবসে “একটি জাতির জন্ম“ শিরোনামে নিবন্ধে জিয়াউর রহমান লিখেছেন ..“স্কুল জীবন থেকেই পাকিস্তানীদের দৃষ্টিভঙ্গির অস্বচ্ছতা আমার মনকে পীড়া দিতো। আমি জানতাম, অন্তর দিয়ে ওরা আমাদের ঘৃণা করে।—বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটা ঘৃণার বীজ উপ্ত করে দেওয়া হতো স্কুল ছাত্রদের শিশু মনেই।—সেই স্কুল জীবন থেকে মনে মনে আমার একটা আকাংখাই লালিত হতো, যদি কখনো দিন আসে, তাহলে এই পাকিস্তানবাদের অস্তিত্বেই আমি আঘাত হানবো..পাকিস্তানী পশুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার, দুর্বারতম আকাংখা দুর্বার হয়ে উঠতো মাঝে মাঝেই। উদগ্র কামনা জাগতো পাকিস্তানের ভিত্তি ভূমিটাকে তছনছ করে দিতে। কিন্তু উপযুক্ত সময় আর উপযুক্ত স্থানের অপেক্ষায় দমন করতাম সেই আকাংখাকে ”।
তার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি দেশের মানুষের প্রিয় দল হিসেবে ’৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ, ’৯১ সালের পঞ্চম সংসদ ও ষষ্ঠ এবং অষ্টম সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে।
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের অধীনে অনুষ্ঠিত ’৮৬ সালের তৃতীয় ও ’৮৮ সালের চতুর্থ এবং এছাড়া সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন মহাজোটের অধীনে অনুষ্ঠিত একতরফার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দল। এই নির্বাচনে ১৫৩টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। বাকি ১৪৭ আসনের নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি ছিল বলে বিভিন্ন সংগঠন দাবি করে। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটসহ অন্যান্য বিরোধী দলও এই নির্বাচন বর্জন করে। একতরফার এই নির্বাচনে সমর্থন জানায়নি দেশী-বিদেশী কোনো সংস্থাই। ভোটারবিহীন সেই নির্বাচনের পর থেকেই বিরোধী জোট দ্রুত সবার অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে।
সংবিধান অনুযায়ী দলটি এখনও দেশের প্রধান বিরোধী দল। আগামী ২৪ জানুয়ারি নবম সংসদের মেয়াদ শেষ হবে। যদিও এরই মধ্যে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে।
৭১ সালে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা যেমন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল, তেমনি ’৭৫ সালে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখন হুমকির মুখে, তখন সিপাহি-জনতার অভ্যূত্থান হয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আসীন হন। তিনি একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনে জিয়াউর রহমান চীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সম্পর্কের সূচনা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাতটি দেশকে নিয়ে ‘সার্ক’ গঠনের উদ্যোগ তারই। ওআইসিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর সংহতি জোরদার করার জন্য তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত বিএনপি সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮১ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাতবরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর তৎকালীন সরকার তাকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। শহীদ জিয়ার জন্মদিন আজ এমন এক সময়ে উদযাপিত হতে যাচ্ছে, যখন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেশের বৃহত্তম ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপি পার করছে একটি চরম ও কঠিন সময়। শহীদ জিয়ার সহধর্মিনী, বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া গুলশানে নিজ অফিসে আজ ১৬ দিন ধরে অবরুদ্ধ।
রাষ্ট্রের যথোপযুক্ত দর্শন ও নেতৃত্বের অনুপস্থিতি আজ স্পষ্ট। নেতৃত্ব ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার নেশায় ডুবে আছে, যা জাতিকে বারবার সঙ্কটের মুখোমুখি করছে। নির্দ্বিধায় বলা যায়, দেশ ও মানুষকে নিয়ে জিয়াউর রহমান যেভাবে ভেবেছেন, কাজ করেছেন, রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি তৈরি করেছেন, সবকিছুর ঊর্ধ্বে দেশকে গুরুত্ব দিয়েছেন—এসবের মাধ্যমে তিনি এক ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়কের আসনে বসেছেন। তিনি দেশ গড়ার ভিশনকে ক্ষমতা ও সময়ের মাপকাঠির বাইরে রেখেছিলেন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ভিত্তি মূলত জিয়াউর রহমানই গড়ে তুলেছেন। এজন্য একদিকে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ও অন্যদিকে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ নীতিতে কাজ করেছেন।
বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবর্তক শহীদ জিয়া ছিলেন বাংলার আকাশের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র।স্বাধীনতা উত্তর দুর্ভিক্ষ পিড়িত জনগন শেখ মুজিবের মৃত্যুর পর যখন শুধু অনিষচয়তা আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই চোখে দেখছিলনা , ঠিক তখনই জিয়া জালিয়েছিলেন আশার আলো, বাংলাদেশের জনগন বুকে বেধেছিল অনেক বড় স্বপ্ন। কিন্তু দেশ বিরোধী ঘাতক চক্র ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র ” এর সহযোগীতায় নির্মম ভাবে শহীদ করে প্রেসিডেন্টকে। তার শাহাদাতে জাতি কলংকিত। সেদিনই আমরা সেই কলংক থেকে মুক্ত হতে পারব যেদিন আমরা গড়তে পারব জিয়ার স্বপ্নের সেই সোনার বাংলাদেশ।
আবার পঁচাত্তরের এক কালো সময়ে জিয়াউর রহমান সামনে চলে আসেন। সময় তাকে জাতীয় ভূমিকায় টেনে আনে। সেটাও ছিল এক অন্ধাকারাচ্ছন্ন সময়। সশস্ত্র বাহিনীর একটি অংশের বিদ্রোহে এবং আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। জাতি এক চরম সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। এমন এক দিকনির্দেশনাহীন সময়ে সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান জাতীয় ভূমিকায় আবির্ভূত হন। সেখানেও তিনি নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়েছেন। কিন্তু দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞা তাকে সফলতার শীর্ষে নিয়ে গেছে।
সিপাহী-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ‘জাতীয় ঐক্যের প্রতীক’-এর মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে সিপাহী-জনতা। ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের মাধ্যমে এ দেশের রাজনীতির গতিপথ নতুন করে নির্মাণ করে। তত্কালীন সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য রাতের আঁধারে বিদ্রোহ করে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ নিজেকে সেনাপ্রধান হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ৩ নভেম্বর সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেন। ওইদিন জাতীয় চার নেতাকেও জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাককে পদচ্যুত করে বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেয়া হয়। ৩ নভেম্বর জিয়াউর রহমান বন্দী হওয়ার পর ৭ নভেম্বর পর্যন্ত এ চারদিন দেশ ও দেশের জনগণ দুঃসহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে অতিক্রম করে। ৬ নভেম্বর রাত প্রায় ১টার সময় সশস্ত্র বাহিনীর পুনরুত্থানবাদী চক্রের বিরুদ্ধে বীর জনগণ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনীর সিপাহীরা বিপ্লব ঘটিয়ে বন্দী মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেন। সিপাহী ও জনতার মিলিত বিপ্লবে চার দিনের দুঃস্বপ্নের ইতি হয়। আওয়াজ ওঠে ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই’, ‘জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ’। ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিরাপদ হয়।
জিয়াউর রহমান আবার সেনাবাহিনীপ্রধানের দায়িত্ব নেন। এরপর তিনি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার যেমন উদ্যোগ নেন, তেমনি সময়ের প্রয়োজেন তিনি দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সমাজনীতি, নৈতিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সব ক্ষেত্রেই তিনি সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। রাজনীতিতে অস্থিরতা কাটিয়ে একটি সমন্বিত সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সামরিক ব্যক্তি হয়েও তিনি রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। সাধারণত মিলিটারি শাসকরা রাজনীতিকদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেন এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সামরিক সিদ্ধান্ত প্রয়োগের চেষ্টা করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান রাজনীতি ও সমরনীতির প্রভেদ বুঝতেন। দেশের একটি অন্ধকার সময়ে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পেয়ে ১৯৭৫ সালের ২৩ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া দ্বিতীয় ভাষণেই জেনারেল জিয়াউর রহমান অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন।
রাষ্ট্রপতি জিয়া
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর সিপাহি জনতা বিপ্লবের পর তিনি রাজনীতের কেন্দ্র চলে আসেন। ১৯ শে নভেম্বর ১৯৭৬ সালে তিনি প্রধান সামরিক প্রশাষকের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবু সায়েমকে কৌশলে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার পর ২১ এপ্রিল ১৯৭৭ সালে জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ অধীষ্ঠ হন। রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন জিয়া দেশে আবার গনতান্ত্রায়নের উদ্যোগ নেন। তিনি বহুদলীয় গনতন্র চালুর সিদ্ধান্ত নেন। দেশের রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা সৃষ্টির আভাস দিয়ে তিনি বলেন, “I will make politics difficult for the politicians” (আমি রাজনীতিকে রাজনীতিবিদের জন্য কঠিন করে দেব)। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক বিদ্রোহে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হলে দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। ২৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক সরকার তাঁকে সেনাবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ নিয়োগ করেন। নভেম্বরে পুনরায় সেনা বিদ্রোহ, খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত, আবূ সাদাত মোহাম্মদ সায়েম প্রেসিডেন্ট হন। ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লবে জিয়াউর রহমানকে পুনরায় সেনাবাহিনীর চীফ-অফ-স্টাফ পদের দায়িত্বে প্রত্যাবর্তন এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭৬ সালের ৮ মার্চ মহিলা পুলিশ গঠন, ১৯৭৬-এ কলম্বোতে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বাংলাদেশ ৭ জাতি গ্রুপের চেয়াম্যান পদ লাভ করে। ১৯৭৬ সালেই তিনি উলশি যদুনাথপুর থেকে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খনন উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬-এর ২৯ নভেম্বর তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৬-এ গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন, ১৯৭৭-এর ২০ ফেব্রুয়ারি একুশের পদক প্রবর্তন, এপ্রিলের ২১ তারিখ বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ। মে মাসে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আস্থা যাচাইয়ের জন্য ৩০ মে গণভোট অনুষ্ঠান ও হাঁ-সূচক ভোটে বিপুল জনসমর্থন লাভ করেন।
জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম জননির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। যে রাষ্ট্রপতি তার জীবদ্দশায় গেছেন কৃষকের পর্ণকুটিরে, শ্রমিকের বস্তিতে। গ্রামে গ্রামে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা জেনে তা সমাধান করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর সৃষ্টিশীল নেতৃত্ব, দুরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা, জনসাধারণকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করার পদক্ষেপ এবং নিজের প্রশ্নাতীত সততা তাঁকে এক যুগে তার সমসাময়িক কালের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করে। আবার ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে’র ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠনের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সব মতের মানুষের সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সংক্ষেপে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে বেগম খালেদা জিয়া এর সভানেত্রী।‘দেশ’ ও ‘মানুষ’ই তার রাজনীতির প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আদর্শের পরিচয় একটি বক্তৃতার মাধ্যমে আমি তুলে ধরছি। ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ রামপুরা টেলিভিশন ভবনে বেতার ও তথ্য বিভাগের পদস্থ অফিসারদের এক সমাবেশে জেনারেল জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা সকলে বাংলাদেশী। আমরা প্রথমে বাংলাদেশী এবং শেষেও বাংলাদেশী। এই মাটি আমাদের, এই মাটি থেকে আমাদের অনুপ্রেরণা আহরণ করতে হবে। জাতিকে শক্তিশালী করাই আমাদের লক্ষ্য। ঐক্য, শৃঙ্খলা, দেশপ্রেম, নিষ্ঠা ও কঠোর মেহনতের মাধ্যমেই তা সম্ভব।’ (দৈনিক বাংলা, ১৪ মার্চ, ১৯৭৬)
১৯৭৭ সালে তিনি প্রণয়ন করেন ১৯ দফা কর্মসূচি। জিয়াউর রহমান ঘোষিত এই ১৯ দফা ছিল তার উন্নয়নের মূলমন্ত্র। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, তার পেছনে গাইডলাইন হিসেবে কাজ করেছে ১৯ দফা।
জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ‘জাতীয় সেনাবাহিনী’ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। প্রশিক্ষণ, কঠোর পরিশ্রম ও কর্তব্যনিষ্ঠা দ্বারা অফিসারদের নিজ নিজ পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও তাদের মাঝে দেশপ্রেম জাগাতে অসামান্য অবদান রাখেন তিনি। ধর্মীয় মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আত্মবিশ্বাসী করে তোলেন তাদের। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে সামরিক বাহিনীর একটা ক্ষুদ্র গ্রুপ দ্বারা সংঘটিত অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হলেও এটা সত্য যে, তিনিই সামরিক বাহিনীতে ঐক্য ও সংহতি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। উন্নত প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্রের সমন্বয়ে এবং সম্মানজনক বেতন-ভাতা প্রদানের মাধ্যমে তিনি সামরিক বাহিনীর মনোবলকে উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দুর্বল-শক্তিশালী সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। ভারত, চীন, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ সবার সঙ্গে পারস্পরিক সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন করতে যথেষ্ট সফলতা দেখিয়েছেন। দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি বৈদেশিক নীতি নির্দিষ্ট ও বাস্তবায়ন করেন। জোটনিরপেক্ষ এবং ইসলামী দেশগুলো ও বিভিন্ন উন্নয়নকামী দেশের সম্মেলনে তার ব্যক্তিগত এবং সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বিশেষ গতি সঞ্চারিত হয়। ব্যক্তিগত কূটনীতি দ্বারা তিনি বাংলাদেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হন।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের বৈদেশিক নীতির দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলকে তিন ভাগে আলোচনা করা যায়। প্রথমত, তিনি জাতিসংঘকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্বব্যাপী শান্তির আবহ তৈরি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেন। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির উন্নয়ন ঘটান। এর ফলেই বাংলাদেশ ১৯৮০ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়। তিনি উপমহাদেশের জন্য একটি স্থানীয় শান্তিকাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো নিয়ে আসিয়ানের মতো সংস্থা গড়ার উদ্যোগ নেন, যা পরবর্তীকালে সার্ক নামে প্রতিষ্ঠা পায়।
রাষ্ট্রপতি জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির আরেকটা লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যকে বহুমুখীকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ ও সাহায্যকে উত্সাহিত করা। তার শাসনকালে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার নিরলস প্রচেষ্টার প্রশংসা করে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনালের সুজান গ্রিন ঢাকা থেকে পাঠানো এক ডেসপাচে লিখেছিলেন, ‘সাম্যের প্রতীক ও সত্ লোকরূপে ব্যাপকভাবে গণ্য জিয়াউর রহমান স্ব্বনির্ভর সংস্কার কর্মসূচি শুরু করে বাংলাদেশের ভিক্ষার ঝুড়ি ভাঙার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছেন।’ মালয়েশিয় দৈনিক ‘বিজনেস টাইমস’-এ প্রকাশিত ওই ডেসপাচে বলা হয়, ‘অতীতে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে পরিচিত করেছিল যে মহাপ্লাবী সমস্যাগুলো, প্রেসিডেন্ট জিয়া কার্যত সেগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।’ (দৈনিক ইত্তেফাক, ৪ নভেম্বর ১৯৭৯)
ওই সময় নিউইয়র্ক টাইমসের এক সংখ্যায় বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা, স্বনির্ভরতা অর্জন এবং উত্পাদন দ্বিগুণ করার ব্যাপারে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের অক্লান্ত প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়। কাজের জন্য জনগণকে সংগঠিত ও অনুপ্রাণিত করতে প্রেসিডেন্ট জিয়া প্রায়ই গ্রামে-গঞ্জে সফর করেন। ‘জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষায় বাংলাদেশী নেতা’ শিরোনামে মাইকেল টি ক্যাফম্যানের এ রিপোর্টে গ্রামাঞ্চলে সপ্তাহে তিন-চারবার সফরের সময় জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিবরণ দেয়া হয়।
এ সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা কৌশল নিয়েও বিশ্ববাসী উচ্চ ধারণা পোষণ করে। বাংলাদেশের নেতৃত্বের প্রতি বহির্বিশ্বের আস্থা সৃষ্টি হয়। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়ার আরেকটা অবদান হলো নাগরিক বাহিনী গঠনের চিন্তা বাস্তবায়ন করা। তিনি এক কোটি নারী ও পুরুষকে সাধারণ সামরিক প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর (বিএনসিসি) গঠনের মাধ্যমে দেশগঠন ও নিরাপত্তায় ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেন।
জিয়াউর রহমানের গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী করার পদক্ষেপ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো। কৃষকদের স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও বিশেষ প্রচার পেয়েছিল। জিয়াউর রহমান আমলানির্ভর প্রকল্প না করে স্থানীয় নেতাদের দ্বারা কৃষককে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এতে কৃষকের মধ্যেও ব্যাপক উত্সাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করেন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক প্লাটফর্মে থেকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি এদেশের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধ জাগানোর প্রয়াস চালান। অনেকটা সফলও হন তিনি। এ জাতীয়তাবাদী দর্শনই একটি জাতি ও দেশের রক্ষাকবচ।
জিয়া প্রবর্তিত উন্নয়নের রাজনীতির কতিপয় সাফল্য:
সকল দলের অঃশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান; জাতীয় সংসদের ক্ষমতা বৃদ্ধি; বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া; দেশে কৃষি বিপ্লব, গণশিক্ষা বিপ্লব ও শিল্প উৎপাদনে বিপ্লব; সেচ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লেক্ষ্য স্বেচ্ছাশ্রম ও সরকারী সহায়তায়র সমন্বয় ঘটিয়ে ১৪০০ খাল খনন ও পুনর্খনন; গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করে অতি অল্প সময়ে ৪০ লক্ষ মানুষকে অক্ষরজ্ঞান দান; গ্রামাঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা প্রদান ও গ্রামোন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী (ভিডিপি) গঠন; গ্রামাঞ্চলে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি বন্ধ করা; হাজার হাজার মাইল রাস্তা-ঘাট নির্মাণ; ২৭৫০০ পল্লী চিকিৎসক নিয়োগ কের গ্রামীণ জনগণের চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ; নতুন নতুন শিল্প কলকারখানা স্থাপনের ভেতর দিয়ে অর্থনৈতিক বন্ধ্যাত দূরীকরণ; কলকারখানায় তিন শিফট চালু করে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি; কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশকে খাদ্য রপ্তআনীর পর্যায়ে উন্নীতকরণ; যুব উন্নয়ন মন্ত্রাণালয় ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুব ও নারী সমাজকে সম্পৃক্তকরণ; ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রতিষ্টা করে সকল মানুষের স্ব স্ব ধর্ম পালনের সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সৃইষ্ট করে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন; তৃণমূল পর্যায়ে গ্রামের জনগণকে স্থানীয় প্রশাসন ব্যবস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করণ এবং সর্বনিম্ন পর্যায় থেকে দেশ গড়ার কাজে নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লেক্ষ্য গ্রাম সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন; জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের আসনলাভ; তিন সদস্যবিশিষ্ট আল-কুদস কমিটিতে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি; দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলে ‘সার্ক’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ; বেসরকারিখাত ও উদ্যোগকে উৎসাহিতকরণ; জনশক্তি রপ্তানি, তৈরী পোশাক, হিমায়িত খাদ্য, হস্তশিল্পসহ সকল অপ্রচলিত পণ্যোর রপ্তানীর দ্বার উন্মোচন; শিল্পখাতে বেসরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রের সম্প্রসারণ। যে গার্মেন্ট ও টেক্সটাইলের ওপর আমাদের অর্থনীতি আজ দাঁড়ানো, তার গোড়াপত্তন করেন জিয়া
জিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতার সময় সংক্ষিপ্ত—পাঁচ বছরের একটু বেশি। এই স্বল্প সময়ে তিনি যুগান্তকারী সব কাজ করে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আমি ভারতবর্ষের ইতিহাসের সেই পাঠান সম্রাট শেরশাহের অনেক মিল খুঁজে পাই। শেরশাহের শাসনভার ছিল এমনই সংক্ষিপ্ত। কিন্তু জনকল্যাণে, সাধারণ মানুষের মঙ্গলে তাঁর কীর্তিগুলো ছিল যেমন অভিনব, তেমনই অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাবের, যা আজও তাঁর দূরদর্শিতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। জিয়া জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে একটি বড় রকমের ঝাঁকুনি দিয়ে গেছেন। রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, নারী, শিশু—সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। গোটা জাতিকে তিনি একাত্তরের মতো একতাবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। একটি দৃঢ় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। পরিচয়-সংকটে আক্রান্ত হীনম্মন্যতায় ভোগা জাতিকে তার সত্যিকারের পরিচয় এবং তার আপন স্বাধীন স্বকীয়তার পরিচিতি তিনি উন্মোচন করতে পেরেছিলেন। সে পরিচিতি বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সংমিশ্রণে হাজার বছরের যে রসায়ন, তারই আবিষ্কার তিনি ঘটিয়ে ছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের ওপরই প্রতিষ্ঠিত তাঁর মন, মনন ও চেতনা—তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। তাই তাঁর প্রিয় গান, যা তিনি আপন মনে গুন গুন করে গাইতেন, ‘আমার জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।’
১৯৮১ সালের ৩০শে মে গভীর রাতে সার্কিট হাউসে ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হন।
চট্রগ্রামে বিএনপির উপদলীয় কোন্দল নিরসনের লক্ষ্যে ২৯ মে সকালে পতেঙ্গা বিমান বিন্দরে পৌছলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। তার সফরসঙ্গী ছিলেন বি চৌধুরি, মহিবুল হাসান, নাজমুল হুদা, ড: আমিনা , নৌ বাহিনীর প্রধান এম এ খান প্রমুখ। চট্রগ্রাম সার্কিট হাউজে হাল্কা নাস্তা সেরে বারান্দায় আলোচনায় বসলেন বিএনপি নেতৃবৃন্দের সঙ্গে । বেলা সাড়ে বারটার দিকে জুম্মা নামাজের বিরতি । সাদা পাঞ্জাবি -পায়জামা পরে চকবাজারের নন্দনপুরা মসজিদে নামাজ আদায় করেন জিয়া। নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লীদের সাথে কুশল বিনিময় করে ফিরে আসলেন সার্কিট হাউজে । দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুপুরের খাবার সেরে ঘন্টা দেড়েক বিশ্রাম নেন । বিকালে চবির ভিসি, অধ্যাপকবৃন্দ, আইনজীবি, সাংবাদিক প্রমুখ আগত অতিথীদের সাথে আড়াই ঘন্টা আলাপ করেন । তারপর স্থানীয় বিএনপির দুই উপদলের সাথে আলাদাভাবে রাত ৯ টা থেকে ১১ টা পর্যন্ত আলোচনা করেন । এর মধ্যে চট্রগ্রামের ডিসি ও পুলিশ কমিশনারের সাথে আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন । রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত চিকিৎসক লে কর্নেল মাহতাবুল ইসলাম তার খাবার পরখ করে শেষ করলে রাত ১১টার একটু পরে জিয়াকে রাতের খাবার দেয়া হয় । ডিনার শেষে ঢাকায় তার স্ত্রী খালেদার সঙ্গে টেলিফোনে মিনিট পনেরো কথা বলেন জিয়া । জীবনের আলো নিভে যাবার ৫ঘন্টা আগে ঘরের আলো নিভিয়ে ঘুমুতে গেলেন জিয়া । নিশ্চিন্তে বিছানায় নিদ্রায় গেলেন তিনি । ওদিকে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করতে এগিয়ে আসছে ঘাতক দল । বাইরে তখন তুমুল ঝড় বৃষ্টি আর বিদ্যুতের ঝলকানি ।
রাত আড়াইটার দিকে কালুরঘাটস্থ রেডিও ট্রানসমিটারের কাছে হাজির হল ঘাতক দল । ঘাতকদলের নেতৃত্ব দেয় লে. কর্নেল মতিউর রহমান । ঘাতকদল তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে আক্রমন পরিচালনার পরিকল্পনা নেয় । মতি থাকল দ্বিতীয় দলে যারা প্রথমদলকে পেছন থেকে সহায়তা দিবে । রাত সাড়ে তিনটার সামান্য কিছু পরে দল তিনটি প্রচন্ড বৃষ্টির মাঝে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে এগুতে থাকে । ঘাতকদল বিনাবাঁধায় সার্কিট হাউজে ঢুকে পড়ে । ভীতি সঞ্চার করতে রকেট ল্যান্সার থেকে ফায়ার ও গ্রেনেড চার্জ করা হয় আর মেশিনগানের গুলি চালানো হয় । পাহারারত ৪৪ জন পুলিশের ১ জন নিহত, ১২ জন আহত ও বাকিরা আত্মগোপন করেন । রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা তন্দ্রাচ্ছন্ন ছিল । যে দুজনের রাষ্ট্রপতির কক্ষের সামনে পাহারা দেবার কথা তাদের আগেই খতম করে দেয়া হয় । রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা কর্মকর্তা লে. কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজ দু'তলায় রাষ্ট্রপতির শয়নকক্ষের পেছনের কক্ষে ঘুমাচ্ছিলেন । রকেটের আওয়াজে তারা জেগে উঠে । রাষ্ট্রপতিকে বাচাতে তারা তাদের অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ পাবার আগেই ঘাতকদের গুলিতে নিহত হন । ঘাতকদলটি ঐ সময় দুতলায় রাষ্ট্রপতির ৯ নম্বর কক্ষ খুজতে শুরু করে । ঘাতকদলের একজন ঐ কক্ষের দরজা ভেঙ্গে ফেলতেই ঘরে ড. আমিনাকে আবস্কার করেন । ফলে রাষ্ট্রপতির খোজে ওরা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে থাকে । তারা ইতিমধ্যে বুঝতে পারে রাষ্ট্রপতি আছেন ৪ নম্বর রুমে । ঘাতকদলের একজন ঐ কক্ষের বারান্দার দিকে দরজা লাথি দিতে ভাঙ্গতে চেষ্টা করে ।
গোলাগুলি আর চিৎকার চেচামেচিতে উঠে বসলেন চকিতে জিয়া ।
কি ব্যাপার ? ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে , পরনে রাতে শয্যার পোষাক । গভীর আত্মপ্রত্যয় আর অগাধ আস্থা নিয়ে বেরিয়ে এলেন ।
কি চাও তোমরা?
কাছে দন্ডায়মান লে. মোসলেহউদ্দিন রীতিমত ঘাবরে যান । সে জিয়াকে আশ্বস্ত করে-‘‘স্যার আপনি ঘাবরাবেন না । এখানে ভয়ের কিছু নেই ।’’
মোসলেহউদ্দিনের ঠোট থেকে জিয়ার প্রতি আশ্বাসবানী মিলিয়ে যাবার আগেই লে. কর্নেল মতিউর রহমান তার এসএমজি থেকে অতি কাছ থেকে ব্রাশ ফায়ার করেন জিয়ার শরীরের ডানদিক একেবারে ঝাঝরা করে ফেলে । দরজার কাছেই মুখ থুবরে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন জিয়া । এরপর মতি তার বন্দুকের নল দিয়ে জিয়ার প্রাণহীন দেহ উলটিয়ে নেয় । তারপর ক্ষিপ্তপ্রায় মতি জিয়ার মুখমন্ডল আর বুকের উপর তার এসএমজির ট্রিগার টিপে রেখে ম্যাগাজিন খালি করে তার খুনের নেশা মেটায় । আনুমানিক চার থেকে সাড়ে চারটায় জিয়ার মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে । জিয়াকে খুন করে ঘাতকদল ঝটপট সার্কিট হাউজ ছেড়ে চলে যায় ।
জিয়াউর রহমানকে ঢাকার শেরে বাংলা নগরে দাফন করা হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়ার জানাজায় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ জনসমাগম ঘটে যেখানে প্রায় ২০ লক্ষ্যাধিক মানুষ সমবেত হয়।
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের জনগণের মাঝে অভূতপূর্ব শোকের ছায়া নেমে আসে। গণমানুষের এ শোক জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও নীতির প্রতি দেশবাসীর ব্যাপক সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে এক ক্ষনজন্মা রাষ্ট্রনায়ক। নানা কারণে তিনি বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে স্থান করে নিয়েছেন। তার সততা, নিষ্ঠা, গভীর দেশপ্রেম,পরিশ্রমপ্রিয়তা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা প্রভৃতি গুণাবলি এ দেশের গণমানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের কাছে তার যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল অন্য কোনো রাষ্ট্রনায়কের ভাগ্যে তা জোটেনি। মাত্র ছয় বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু সাধারণ মানুষ তার ওপর ছিল প্রচণ্ড আস্থাশীল। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার ওপর মানুষের এই আস্থায় কোনো চিড় ধরেনি।
জাতির বর্তমান দুর্বিসহ ক্রান্তিকালে মেজর জিয়ার মতো একজন কালজয়ী বহুদলীয় গণতন্ত্রের কান্ডারীর নিরন্তর প্রয়োজন।
লেখক : ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম , জিয়া পরিষদের সহ আর্ন্তজাতিক বিষয়ক সম্পাদক, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম আহবায়ক
No comments