আস্থার সংকটে পুলিশ by আলী ইমাম মজুমদার
জাতি
একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। গত প্রায় তিন মাস লাগাতার হরতাল-অবরোধ ও
সন্ত্রাস জনজীবনকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এর মোকাবিলা করছে
প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো। প্রধানত পুলিশ। তারা সংকট
থেকে উত্তরণের বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে। দীর্ঘ বিরতিহীন
প্রচেষ্টায় বেশ কিছু সাফল্য দেখা যাচ্ছে। এ সাফল্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা রাখছে তাদের পরিশ্রম। তবে মূল ভূমিকায় জনগণ। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে
তাদের মতামত যা-ই থাক, এটা বাস্তবায়নে জনগণ দীর্ঘমেয়াদি হরতাল আর অবরোধকে
মেনে নেয়নি। তাদের সমর্থন নেই কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমের প্রতি। তবে
রাজনৈতিক ইস্যুতে ঐকমত্যের অনুপস্থিতিতে পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকবে কি না,
এটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
চলমান পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা আলোচনার দাবি রাখে। ২০১৩ সালে সন্ত্রাসের সামনে তাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে এরূপ অসহায় ও অপ্রস্তুত মনে হয়েছিল। ফলে এই বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য হতাহত হন। পুড়িয়ে দেওয়া বা ভেঙে ফেলা হয় তাদের যানবাহনও। এ ধরনের দৃশ্য দেখে আমরা আহত ও শঙ্কিত হয়েছিলাম।
এবার মনে হয় তারা বেশ কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে দৃশ্যমান ব্যর্থতার দায়ভারও তাদের নিতে হবে। এমনকি কিছু প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সমালোচনাও সংগত। আর তা হচ্ছেও। এরূপ অতীতেও হয়েছে। প্রবল সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে পুলিশ, কোনো কাজে ব্যর্থতা কিংবা বাড়াবাড়ির জন্য। এবার একুশের বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসার পথে লেখক–ব্লগার অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার ঘটনাটি নতুনভাবে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
এ ধরনের ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থায় এরূপ ঘটনা ঘটা অনেকটা অস্বাভাবিক, তাই সমালোচনা হচ্ছে। তবে সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পারলে তারা প্রশংসিতও হবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কারও কারও মন্তব্যে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে দাবি করা হয়, এরূপ মন্তব্য বাহিনীর সদস্যদের মনোবলে আঘাত হেনেছে। ফলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে তাদের উদ্যমকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ দাবির সঙ্গে একমত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং আশা করা সংগত, এ ধরনের সমালোচনায় তারা আরও আগ্রাসী হয়ে নিেজদের সাফল্যের ছাপ রাখবে। মুছে ফেলবে ব্যর্থতার দায়ভার।
পুলিশ রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। এর গঠনকাঠামো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কোথাও প্রাদেশিক বা রাজ্য সরকারের আর কোথাওবা স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকে পুলিশ। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে সরকারের আওতায়ই তা আছে। তবে কাজের ধরন মোটামুটি এক। তদন্তের জন্য কোনো কোনো দেশে পৃথক সংস্থা আছে বটে। দুর্জনের হাত থেকে দুর্বলের সুরক্ষা রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি। এর দায়িত্বে থাকে পুলিশ। আর সেই কাজের পরিসর ব্যাপকতর। তেমনি আইন তাদের দায়িত্ব সম্পাদনে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছে।
আমাদের ফৌজদারি আইনে উল্লিখিত ধর্তব্য অপরাধ করার অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে থাকলে বিনা পরোয়ানায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এমনকি কতিপয় অপরাধ সংঘটনের সন্দেহভাজনদেরও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এ ধরনের ক্ষমতা থাকাও যৌক্তিক। পাশাপাশি এর অপব্যবহার হলে তারও সমালোচনা হবে। আইনি প্রতিকারও চাইতে পারেন কেউ। আর তা করলেই পুলিশের মনোবলে ভাটা পড়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, নাগরিকের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার যার যত ক্ষমতা, তাকে ততটা নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক। শাসনব্যবস্থার ভারসাম্যের জন্যও এর প্রয়োজন রয়েছে।
ইদানীং পুলিশের প্রসঙ্গ বেশি বেশি আলোচনায় আসছে। এর মধ্যে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ সংশোধন নিয়ে পুলিশের প্রস্তাব উল্লেখ করার মতো। প্রস্তাব করতে গিয়ে আইনটি প্রণয়নের পটভূমিকা সম্পর্কে তারা যে তথ্য উল্লেখ করেছে, তা যথার্থ নয়। তবে দায়িত্ব সম্পাদনে প্রতিকূল বিবেচিত হলে পুলিশ কিছু প্রস্তাব করতেই পারে। পুলিশের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ আর নাগরিকের সুরক্ষা উভয় দিক বিবেচনা করে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া সংগত। হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা কমছে না। অতিসম্প্রতি একজন সংবাদকর্মীকে ব্যাপক নির্যাতনের কাহিনিটিও বেদনাদায়ক। তা ছাড়া রাতের বেলায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনাগুলো আতঙ্কের নতুন কারণ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি ঢাকা শহরে দুজন রাজনৈতিক নেতাকে এভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একজনকে র্যাব ২১ ঘণ্টা পর থানায় হস্তান্তর করে। অবশ্য তারা গ্রেপ্তারের স্থান ও সময় ভিন্নরূপ উল্লেখ করেছে। অন্যজনের প্রায় দুই সপ্তাহ কোনো খোঁজই নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে নেয়নি বলে হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে। কারও কারও মতে, পেশাদার সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠীও এরূপ কাণ্ড ঘটাতে পারে।
যেটাই হোক, এগুলো তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব পুলিশের। এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ও প্রচেষ্টা বেদনাদায়কভাবে কম। এভাবে গুম হওয়া কিছু ব্যক্তি চিরতরেই বিলীন হয়েছেন। তাই পুলিশের সমালোচনা হতে পারে। ক্ষুব্ধ হতে পারে মানুষ।
অনেক অপরাধ ঘটে ১৬ কোটি মানুষের দেশটিতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যায় কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায়। আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে অক্ষমতা আর তদন্তে ত্রুটি এর মধ্যে প্রধান। তদন্তে ত্রুটির দায় পুলিশের। তবে সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসতে আমাদের সমাজে অনীহা বিরাজমান।
এর জন্য শুধু পুলিশকে দায়ী করা চলে না। আর তদন্তে ত্রুটি ও বিলম্বিত তদন্ত মামলার স্বাভাবিক গতিকে বিঘ্নিত করে। বিলম্ব ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস, সাক্ষীদের অনাগ্রহ ও ক্ষেত্রবিশেষে স্মৃতিবিভ্রাটের কারণ ঘটায়। উৎসাহে ভাটা পড়ে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের। উল্লেখ্য, পুলিশের কাজের চাপের তুলনায় জনবলসহ অন্যান্য সুবিধা অপ্রতুল। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ বিষয়ে সরকার সমস্যা দূরীকরণে সচেষ্ট।
উল্লেখ করা যায়, কোনো সংস্থারই চাহিদা অনুসারে সুবিধাদি নেই। যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক, সাগর-রুনি হত্যা মামলার আজ পর্যন্ত রহস্য উন্মোচন না হওয়া আর নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দুই বছরেও দাখিল না করার অক্ষমতাকে মেনে নেওয়া যায় না। তেমনি র্যাবের কতিপয় সদস্যের দ্বারা নারায়ণগঞ্জে সাতজন লোককে অপহরণ করে হত্যার ঘটনাটিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। সেই খুনের ঘটনায় ইন্ধনদাতা নূর হোসেনের টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করা হলো। অথচ তাঁকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে ধরা সম্ভব হলো না। এতে ঘটনাটির যথাযথ দ্রুত বিচার সম্পর্কে কেউ সংশয় প্রকাশ করতেই পারেন। তবে এটা সহজবোধ্য যে পুলিশ শুধু কাজের চাপ নয়, নানাবিধ চাপে আছে। এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এগুলোর দ্রুত সফল সুরাহা পুলিশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
পুলিশসহ দেশের গোটা প্রশাসনযন্ত্র জনগণকে সেবা দেওয়ার কথা। তবে শুধু পুলিশ নয়, মাত্রার হেরফের থাকলেও কোনো সংস্থাই সেবা যথার্থভাবে দিতে পারছে এমন দাবি করা যাবে না। তাই সেবাদানকারী সব সংস্থাই কমবেশি জনগণের আস্থার সংকটে ভুগছে। তবে কোনোটিকে ফেলে দেওয়া যাবে না। পুলিশের প্রতি আস্থার সংকটও নিরঙ্কুশ, এমনটি বললে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। তাই যদি হতো, ক্রমাগতভাবে নতুন নতুন থানা আর ফাঁড়ি প্রতিষ্ঠার দাবি আসত না।
বিপন্ন মানুষ সহায়তার জন্য পুলিশের কাছেই ছোটেন। কিছু ক্ষেত্রে পানও সে সহযোগিতা। আবার হতাশও হন কেউ কেউ। এসব ক্ষেত্রে সমালোচনা থেকে প্রতিকারের সুযোগ নিতে পারে পুলিশ। একজন ফরিয়াদির অভিযোগ ন্যায়সংগতভাবে অনুসন্ধান, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের প্রতি আইনের বিধান অনুসারে মানবিক আচরণ ও যথার্থ তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে সুবিচারের রাস্তা পুলিশ উন্মুক্ত করতে পারে। ক্রমান্বয়ে এরূপ করতে থাকলে তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থার মানও বাড়তে থাকবে। সে আস্থাই হবে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির মূল প্রেরণা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
চলমান পরিস্থিতিতে পুলিশের ভূমিকা আলোচনার দাবি রাখে। ২০১৩ সালে সন্ত্রাসের সামনে তাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে এরূপ অসহায় ও অপ্রস্তুত মনে হয়েছিল। ফলে এই বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য হতাহত হন। পুড়িয়ে দেওয়া বা ভেঙে ফেলা হয় তাদের যানবাহনও। এ ধরনের দৃশ্য দেখে আমরা আহত ও শঙ্কিত হয়েছিলাম।
এবার মনে হয় তারা বেশ কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে ক্ষেত্রবিশেষে দৃশ্যমান ব্যর্থতার দায়ভারও তাদের নিতে হবে। এমনকি কিছু প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত পদ্ধতিতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সমালোচনাও সংগত। আর তা হচ্ছেও। এরূপ অতীতেও হয়েছে। প্রবল সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছে পুলিশ, কোনো কাজে ব্যর্থতা কিংবা বাড়াবাড়ির জন্য। এবার একুশের বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসার পথে লেখক–ব্লগার অভিজিৎ রায় নিহত হওয়ার ঘটনাটি নতুনভাবে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে।
এ ধরনের ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থায় এরূপ ঘটনা ঘটা অনেকটা অস্বাভাবিক, তাই সমালোচনা হচ্ছে। তবে সুষ্ঠু ও দ্রুত তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পারলে তারা প্রশংসিতও হবে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কারও কারও মন্তব্যে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন একটি বিবৃতি দিয়েছে। এতে দাবি করা হয়, এরূপ মন্তব্য বাহিনীর সদস্যদের মনোবলে আঘাত হেনেছে। ফলে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে তাদের উদ্যমকে বাধাগ্রস্ত করবে। এ দাবির সঙ্গে একমত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বরং আশা করা সংগত, এ ধরনের সমালোচনায় তারা আরও আগ্রাসী হয়ে নিেজদের সাফল্যের ছাপ রাখবে। মুছে ফেলবে ব্যর্থতার দায়ভার।
পুলিশ রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। এর গঠনকাঠামো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। কোথাও প্রাদেশিক বা রাজ্য সরকারের আর কোথাওবা স্থানীয় সরকারের আওতায় থাকে পুলিশ। আমাদের মতো এককেন্দ্রিক দেশে সরকারের আওতায়ই তা আছে। তবে কাজের ধরন মোটামুটি এক। তদন্তের জন্য কোনো কোনো দেশে পৃথক সংস্থা আছে বটে। দুর্জনের হাত থেকে দুর্বলের সুরক্ষা রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি। এর দায়িত্বে থাকে পুলিশ। আর সেই কাজের পরিসর ব্যাপকতর। তেমনি আইন তাদের দায়িত্ব সম্পাদনে প্রভূত ক্ষমতা দিয়েছে।
আমাদের ফৌজদারি আইনে উল্লিখিত ধর্তব্য অপরাধ করার অভিযোগ কারও বিরুদ্ধে থাকলে বিনা পরোয়ানায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারে। এমনকি কতিপয় অপরাধ সংঘটনের সন্দেহভাজনদেরও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা রয়েছে তাদের। এ ধরনের ক্ষমতা থাকাও যৌক্তিক। পাশাপাশি এর অপব্যবহার হলে তারও সমালোচনা হবে। আইনি প্রতিকারও চাইতে পারেন কেউ। আর তা করলেই পুলিশের মনোবলে ভাটা পড়ার কোনো কারণ নেই। কেননা, নাগরিকের সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার যার যত ক্ষমতা, তাকে ততটা নিয়ন্ত্রণে রাখা আবশ্যক। শাসনব্যবস্থার ভারসাম্যের জন্যও এর প্রয়োজন রয়েছে।
ইদানীং পুলিশের প্রসঙ্গ বেশি বেশি আলোচনায় আসছে। এর মধ্যে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ সংশোধন নিয়ে পুলিশের প্রস্তাব উল্লেখ করার মতো। প্রস্তাব করতে গিয়ে আইনটি প্রণয়নের পটভূমিকা সম্পর্কে তারা যে তথ্য উল্লেখ করেছে, তা যথার্থ নয়। তবে দায়িত্ব সম্পাদনে প্রতিকূল বিবেচিত হলে পুলিশ কিছু প্রস্তাব করতেই পারে। পুলিশের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ আর নাগরিকের সুরক্ষা উভয় দিক বিবেচনা করে বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া সংগত। হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা কমছে না। অতিসম্প্রতি একজন সংবাদকর্মীকে ব্যাপক নির্যাতনের কাহিনিটিও বেদনাদায়ক। তা ছাড়া রাতের বেলায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার ঘটনাগুলো আতঙ্কের নতুন কারণ সৃষ্টি করেছে।
সম্প্রতি ঢাকা শহরে দুজন রাজনৈতিক নেতাকে এভাবে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একজনকে র্যাব ২১ ঘণ্টা পর থানায় হস্তান্তর করে। অবশ্য তারা গ্রেপ্তারের স্থান ও সময় ভিন্নরূপ উল্লেখ করেছে। অন্যজনের প্রায় দুই সপ্তাহ কোনো খোঁজই নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে নেয়নি বলে হাইকোর্টকে জানানো হয়েছে। কারও কারও মতে, পেশাদার সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠীও এরূপ কাণ্ড ঘটাতে পারে।
যেটাই হোক, এগুলো তদন্ত করে প্রকৃত রহস্য উন্মোচনের দায়িত্ব পুলিশের। এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ও প্রচেষ্টা বেদনাদায়কভাবে কম। এভাবে গুম হওয়া কিছু ব্যক্তি চিরতরেই বিলীন হয়েছেন। তাই পুলিশের সমালোচনা হতে পারে। ক্ষুব্ধ হতে পারে মানুষ।
অনেক অপরাধ ঘটে ১৬ কোটি মানুষের দেশটিতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যায় কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায়। আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে অক্ষমতা আর তদন্তে ত্রুটি এর মধ্যে প্রধান। তদন্তে ত্রুটির দায় পুলিশের। তবে সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসতে আমাদের সমাজে অনীহা বিরাজমান।
এর জন্য শুধু পুলিশকে দায়ী করা চলে না। আর তদন্তে ত্রুটি ও বিলম্বিত তদন্ত মামলার স্বাভাবিক গতিকে বিঘ্নিত করে। বিলম্ব ঘটনার গুরুত্ব হ্রাস, সাক্ষীদের অনাগ্রহ ও ক্ষেত্রবিশেষে স্মৃতিবিভ্রাটের কারণ ঘটায়। উৎসাহে ভাটা পড়ে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের। উল্লেখ্য, পুলিশের কাজের চাপের তুলনায় জনবলসহ অন্যান্য সুবিধা অপ্রতুল। তবে আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ বিষয়ে সরকার সমস্যা দূরীকরণে সচেষ্ট।
উল্লেখ করা যায়, কোনো সংস্থারই চাহিদা অনুসারে সুবিধাদি নেই। যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক, সাগর-রুনি হত্যা মামলার আজ পর্যন্ত রহস্য উন্মোচন না হওয়া আর নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দুই বছরেও দাখিল না করার অক্ষমতাকে মেনে নেওয়া যায় না। তেমনি র্যাবের কতিপয় সদস্যের দ্বারা নারায়ণগঞ্জে সাতজন লোককে অপহরণ করে হত্যার ঘটনাটিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। সেই খুনের ঘটনায় ইন্ধনদাতা নূর হোসেনের টেলিফোন আলাপ রেকর্ড করা হলো। অথচ তাঁকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পথে ধরা সম্ভব হলো না। এতে ঘটনাটির যথাযথ দ্রুত বিচার সম্পর্কে কেউ সংশয় প্রকাশ করতেই পারেন। তবে এটা সহজবোধ্য যে পুলিশ শুধু কাজের চাপ নয়, নানাবিধ চাপে আছে। এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে এগুলোর দ্রুত সফল সুরাহা পুলিশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
পুলিশসহ দেশের গোটা প্রশাসনযন্ত্র জনগণকে সেবা দেওয়ার কথা। তবে শুধু পুলিশ নয়, মাত্রার হেরফের থাকলেও কোনো সংস্থাই সেবা যথার্থভাবে দিতে পারছে এমন দাবি করা যাবে না। তাই সেবাদানকারী সব সংস্থাই কমবেশি জনগণের আস্থার সংকটে ভুগছে। তবে কোনোটিকে ফেলে দেওয়া যাবে না। পুলিশের প্রতি আস্থার সংকটও নিরঙ্কুশ, এমনটি বললে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে। তাই যদি হতো, ক্রমাগতভাবে নতুন নতুন থানা আর ফাঁড়ি প্রতিষ্ঠার দাবি আসত না।
বিপন্ন মানুষ সহায়তার জন্য পুলিশের কাছেই ছোটেন। কিছু ক্ষেত্রে পানও সে সহযোগিতা। আবার হতাশও হন কেউ কেউ। এসব ক্ষেত্রে সমালোচনা থেকে প্রতিকারের সুযোগ নিতে পারে পুলিশ। একজন ফরিয়াদির অভিযোগ ন্যায়সংগতভাবে অনুসন্ধান, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের প্রতি আইনের বিধান অনুসারে মানবিক আচরণ ও যথার্থ তদন্ত প্রতিবেদন দিয়ে সুবিচারের রাস্তা পুলিশ উন্মুক্ত করতে পারে। ক্রমান্বয়ে এরূপ করতে থাকলে তাদের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থার মানও বাড়তে থাকবে। সে আস্থাই হবে পুলিশের মনোবল বৃদ্ধির মূল প্রেরণা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
No comments