ঝরে পড়া, অকৃতকার্য হওয়া by শাফিউল হাসান

প্রথমেই স্মরণ করছি সেই মেয়েটির কথা, যে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ায় বাবা-মায়ের গালমন্দ ও ভর্ৎসনা সহ্য করতে না পেরে বেছে নিয়েছে আত্মহননের পথ। নিজের পড়ার ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে। সব গ্লানি, অপমান, লাঞ্ছনাকে শোকে, জলে, আফসোসে, ভালোবাসায় পরিণত করে না ফেরার জায়গায় চলে গেল। তার নাম তানিয়া আহমেদ। সে সাভারের বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) পাবলিক স্কুল থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে গণিতে অকৃতকার্য হয়। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল মেয়েটি। এ জন্য মেয়ের অকৃতকার্য হওয়ার বিষয়টি তাঁরা মেনে নিতে পারেননি এবং বকাঝকা করেছেন। দোষ তাঁদেরও দেওয়া যায় না। কারণ আমাদের দেশে তো আদর্শ বাবা-মা বা অভিভাবক হওয়ার জন্য কোনো প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই।
তার বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে এখন শুধু সে স্মৃতি। আমাদের কাছেও স্মৃতি। আমরা তাকে দেখিনি, এ কথা সত্য। কিন্তু তার মতো কোমলমতি অনেক শিক্ষার্থীর কথা আমরা জানি, যারা নিজেদের ব্যক্তিত্বের ওপর কোনো ধরনের আঘাত সহ্য করে না। আর আমরাও যেন কেমন, প্রতিবছরই যেন খুব আগ্রহের সঙ্গেই অপেক্ষা করি এমন একটি খবর শোনার বা পড়ার জন্য। আরও কয়টি প্রাণ ঝরে পড়ল। এ বছর প্রাণ ঝরেছে একটি কিন্তু জীবন্মৃত হতে চলেছে কয়েক লাখ শিশু।
এবার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর বিগত দুটি এবং ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষার ফলাফলের চিত্র দেখা যাক। ২০১০ সালে ঝরে পড়েছে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৭০ জন শিক্ষার্থী। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৫৯ হাজার ৮৪১। সংখ্যা বেড়েছে ছয় হাজারের বেশি। ২০১০ সালে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার প্রথম দিনেই কেন্দ্রে অনুপস্থিত ছিল দুই লাখ ৮৩ হাজার ১৩২ জন শিক্ষার্থী। এ ফলাফলে সুখের ও দুঃখের দুটি ব্যাপারই ঘটেছে।
২০১০ সালে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫৩৬ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল ৮১ হাজার ৭২০ জন। জুনিয়র স্তরে ৩৬৭টি এবং প্রাথমিক স্তরে দুই হাজার ৭৮৭টি বিদ্যালয়ে পাসের হার শূন্য। রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত আনন্দ বিদ্যালয়গুলো থেকে ২০১০ সালে ছয় হাজার ৬৬১টি আনন্দ বিদ্যালয়ের এক লাখ ৪৩ হাজার ৪৬৬ শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছিল। এদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল ৬৬ হাজার ৮১৭ জন। দুই হাজার ২১১টি বিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীই উত্তীর্ণ হয়নি। বেসরকারি সংস্থা পরিচালিত বিদ্যালয়ে ভুয়া পরীক্ষার্থী দেখা গেছে এবং বিদ্যালয়গুলোর ফলাফল মারাত্মক রকমের খারাপ। ইতিমধ্যে প্রতারণার অভিযোগে ৬০টি উপজেলায় প্রায় ৪০০টি বেসরকারি সংস্থার বিদ্যালয় পরিচালনার অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। বিদ্যালয়গুলোতে মন্ত্রণালয়ের তদারকি-ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি বেশ কিছু সংস্থার বরাদ্দও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। দেশের বঞ্চিত, দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলো কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ছাড়াই। একটি বিশেষ ব্যবস্থার শিক্ষা পরিচালনা করতে প্রকল্পের কর্মকর্তা, শিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাসহ যাঁরা এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে জড়িত ছিলেন, তাঁদের সবাইকে অনেক বেশি দায়িত্ববোধের পরিচয় দেওয়া দরকার ছিল। বলা প্রয়োজন, শিক্ষা বিষয়টি কোনো বন্য গাছ নয় যে এটা যেমন ইচ্ছা সেভাবে বেড়ে উঠবে। একজন মানবশিশুকে দিয়ে শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে প্রয়োজন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটা সুন্দর পরিবেশ, সময়োপযোগী পাঠ্যপুস্তক, শিখন পদ্ধতি, প্রশিক্ষিত শিক্ষক এবং শিশুটিকে বুঝতে পারার ক্ষমতা। তবেই না মূল্যায়নের সময় শিশুটির শিখনের ওপর মূল্য আরোপ করা যাবে। তখনই তার কাছ থেকে ভালো ফল আশা করা যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, কোনো ধরনের অভাব না থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নে অনেক শিক্ষক বা প্রশাসক এই কাজগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে করেন না। দুটি স্তরে শিক্ষার্থীদের ফলাফলের চিত্র তা-ই বলে।
বিদ্যালয়ের পরিবেশ হতে হবে অবশ্যই শিখনবান্ধব। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলার মাঠ নেই, মুক্ত স্বাধীন পরিবেশ নেই। দিন দিন জায়গা আরও কমে আসবে। নির্ধারিত স্থান ও সময় ছাড়া শিশুরা খেলার সুযোগ পাবে না। মুক্ত পরিবেশে শেখার সুযোগ পাবে না। এই সত্যটি সবাইকে মানতে হবে। কাজেই সংকীর্ণ পরিবেশটাকেই কতটা শিখনবান্ধব, আনন্দময় ও মানুষ তৈরির উপযোগী করা যায়, সেদিকে নজর দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। ক্লাসরুমের আয়তনের অতিরিক্ত শিক্ষার্থীকে এই পরিবেশেই কোন পদ্ধতিতে পাঠদান করলে তাদের দিয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে, তা নির্ধারণ করা উচিত।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সম্পর্ক আরও ভালো করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতায় থাকা কর্মকাণ্ডগুলোকে আরও পরিকল্পিতভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিষ্ঠানে অভিভাবক সমাবেশ করার পাশাপাশি সন্তান-অভিভাবককে নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে, যেখানে তারা যৌথভাবে কোনো সমস্যার সমাধান করবে। তা ছাড়া দেশের গণমাধ্যমগুলোকেও পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, শিক্ষায় শিশুর বিভিন্ন প্রবণতা নিয়ে পরামর্শ ও সচেতনতা সৃষ্টিমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের আয়োজন করতে হবে। অভিভাবকদের সঙ্গে বিদ্যালয়ের শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের কর্মকাণ্ড আরও বাড়াতে হবে। তবে কর্মকাণ্ডগুলো অবশ্যই শিক্ষাকেন্দ্রিক হতে হবে।
শিক্ষার্থীদের সক্রিয় শিখনে শিক্ষা উপকরণের বিকল্প নেই। শিক্ষার্থীর অজানা বিষয়টি শেখানোর আগে বা শেখানোর সময়ই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিভিন্ন ধরনের উপকরণ ব্যবহার করলে শিক্ষার্থীর শিখন অনেকটা স্থায়ী হয়। অনেক আগে থেকেই শ্রেণীতে হাতে তৈরি বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের কয়জন শিক্ষক সেই কাজটা করেন?
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করা ছাড়া কোনোক্রমেই ঝরে পড়া রোধ করা সম্ভব নয়। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, এটা তারা বুঝতে পারবে শুধু বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হলেই। যে শিক্ষার্থী ক্লাস করে না, তার মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে গুরুত্বহীন মনে করার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হয়। পাশাপাশি পরীক্ষার সময় তার মনে এক ধরনের পরীক্ষাভীতি কাজ করে। কারণ সারা বছর পরীক্ষার জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করেনি। তাই অনতিবিলম্বে শিশুর শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে।
শাফিউল হাসান: সাংবাদিক
shsohag71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.