বাঙালির সামাজিক উৎসব -যুক্তি তর্ক গল্প by আবুল মোমেন
বাংলা নববর্ষ অবশেষে বাঙালির উৎসবে পরিণত হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙালির সামাজিক উৎসব হিসেবে এ বছর ব্যাপকভাবে উদ্যাপিত হলো পয়লা বৈশাখ। ধীরে ধীরে এ উৎসব শহর ছাপিয়ে গ্রামেও ছড়িয়েছে। এককালের নাগরিক মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক এ উৎসব বর্তমানে অরাজনৈতিক সামাজিক উৎসবে রূপ নিয়েছে।
আমাদের দেশে সব বাঙালির যৌথভাবে উদ্যাপনের মতো কোনো সামাজিক উৎসব ছিল না। দুই ঈদ কিংবা দুর্গাপূজা হলো ধর্মীয় উৎসব—মুসলমান ও হিন্দু সীমিতভাবে এ সময় পরস্পরের সঙ্গে লৌকিকতা বা সৌহার্দ্য বিনিময় করলেও তা কখনো ধর্মীয় গণ্ডি ভাঙতে পারেনি, পারার কথাও নয়।
ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিছু কিছু উৎসব অনুষ্ঠান চালু হয়েছিল, যেমন রাখি উৎসব বা হিন্দুমেলা। কিন্তু এর মধ্যে কখনো প্রকটভাবে কখনো প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চেতনা কাজ করেছে। উভয় ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মীয় প্রভাব থাকায় মুসলিম জনগণ এসবে প্রতীকীভাবে অংশগ্রহণ করলেও ব্যাপকভাবে কখনো অংশ নেয়নি। অত্যন্ত বড় মাপের নেতা হলেও মহাত্মা গান্ধীর জীবনচর্যার সংস্কৃতি হিন্দুধর্মীয় শিক্ষাদর্শে প্রভাবিত হওয়ায় ভারতীয় কংগ্রেস ব্যাপক হারে মুসলমানদের আকৃষ্ট করতে পারেনি, পারেনি তার প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে ধর্মান্ধ মুসলিম লীগের উত্থান ঠেকাতে।
বাংলাদেশে, সে তুলনায়, রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী নানান অনুষ্ঠান উৎসবের সূচনা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল শহীদ দিবস হিসেবে, যেখানে শোকই ছিল মুখ্য বিষয়। কিন্তু দিন দিন রাজনৈতিক সংগ্রামের তীব্রতা ও ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এ দিনের তাৎপর্যও পাল্টে গেছে। শোককে সত্যিই বাঙালি শক্তিতে পরিণত করেছে। মানুষ এদিন শপথ নিয়েছে, দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছে। এভাবে শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে বাঙালির জাতীয় জাগরণ ঘটেছে আর দেশব্যাপী ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাগরণ, তা যদি হয় একটি জাতির ঐক্যবদ্ধ জাগরণ, স্বাধীনতা ও সার্থকতার লক্ষ্যে জাগরণ, তাহলে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুষ্ঠানাদিই তো আয়োজিত হবে। ফলে একুশকে কেন্দ্র করে বাঙালির সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটতে থাকল—শুরু হলো বাংলা একাডেমীর মাসব্যাপী বইমেলা, প্রকাশনার জোয়ার, সারা দেশে ছোটবড় বইমেলা আর সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে এক দিনের অধিক, কখনো সপ্তাহব্যাপী, পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালা ও উৎসব। একুশেও আজ উৎসবের রূপ ধারণ করেছে। এর আলাদা তাৎপর্য তৈরি হয়েছে জাতিসংঘ এ দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায়।
তবুও একুশে ঠিক আনন্দ উৎসবের দিন নয়—এ দিনটি জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িক বাঙালির করণীয় নির্ধারণের দিন। জাতীয় প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব পালন ও দায়বদ্ধতার মতো সিরিয়াস বিষয় এখানে বিবেচ্য। তাই হয়তো উৎসবের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক এখানে উপেক্ষিত—নতুন পোশাক ও উন্নত খাবার-দাবার। তা ছাড়া প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা এবং সামাজিক পরিমণ্ডল ছাড়াও পারিবারিক পরিমণ্ডলে পালনের বিশেষ সুযোগ নেই একুশের এই দিনটি। এটা সব সময়ই গণ-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু বক্তব্যসহ জাতীয় প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটিয়েই পালন করা সম্ভব।
পয়লা বৈশাখ কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে যুক্ত না থেকেও আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করা যায়। বাড়িতেই নতুন পোশাক ও ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেই তা সম্ভব।
এবার পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠানের রীতিমতো জোয়ার বয়েছে। অথচ একসময় বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তি আর বাংলা নববর্ষ শহরাঞ্চলে কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। ছায়ানট যখন আইয়ুবের সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে নববর্ষ উদ্যাপন শুরু করেছে গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায়, তখন সারা দেশে এটিই ছিল বাংলা বর্ষবরণের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। হয়তো এর বাইরে কোনো কোনো জেলা শহরে ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ নববর্ষ উদ্যাপন ও উপভোগ করেছে, অংশ নিয়েছে এবং অনুপ্রাণিত হয়েছে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই। দেশের অনেক জায়গায় এটিকে অনুসরণ করে নববর্ষে প্রভাতি সংগীতানুষ্ঠান চালু হয়।
এখন বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের জন্য দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। কোথাও কোথাও সপ্তাহব্যাপী দেশীয় পণ্যের মেলাও চালু হচ্ছে। এবার সরকারের আগ্রহে ও নির্দেশে প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে, শিল্পকলা একাডেমী ও শিশু একাডেমীতে অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে সম্ভবত সরকারি নির্দেশনার ফলেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আমি একটি কথা বলতে চাই, যেহেতু এটি হলো সামাজিক উৎসব, তাই এ উৎসবটি শিক্ষক ও ছাত্রদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে অংশ নিয়ে উদ্যাপনের সুযোগ দেওয়া উচিত। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ বা ষোলোই ডিসেম্বরের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের চরিত্রগত পার্থক্য আছে। একুশে হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস, আর বাকি দুটি হলো আমাদের রাষ্ট্র অর্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত দিন। ফলে এগুলো সরকারি নির্দেশে রাষ্ট্রীয়-জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হতে পারে। পতাকা উত্তোলন থেকে নানা আনুষ্ঠানিকতার বাধ্যবাধকতায় এগুলো একটু ফরমাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যাপনের দিন। কিন্তু যেটি সামাজিক উৎসব সেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উদ্যাপন করতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব হবে যাতে আপামর মানুষ শান্তিতে আনন্দে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসব উদ্যাপন করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু নির্দেশনা দেওয়ার দরকার নেই, প্রেরণা ও উৎসাহ দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি আশা করি সরকার খেয়াল করবে।
উৎসবের প্রসঙ্গে এবার আরেকটি দিকে আলোচনা করতে চাই।
প্রশ্নটা হলো, আমরা তো বলছি উৎসব, বলছি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব। উৎসব কেবল ভোগে-বিলাসে হইচইয়ের মধ্যেই কাটিয়ে দিচ্ছি না তো? সারাটা দিন মাইকে মাইকে গীতকলরব, বাদ্যগীতসহ শোভাযাত্রা, পথে পথে ভিড়-জনসমুদ্র, দিন শেষে ক্লান্তিই কি থাকল অবশেষ?
বছরের এই শুরুর দিনটি নানা আনন্দ-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হোক। কিন্তু প্রভাতি অনুষ্ঠানটি হোক সুপরিকল্পিত। সারা বছরের জন্য মন ও মস্তিষ্ক কিছু কিছু রসদ পাক সে অনুষ্ঠানে। উৎসব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি, তাঁর লেখা থেকে এ বিষয়ে জানতে পারি।
‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেই দিন।’
এই প্রতিপাদ্য আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন তিনি এভাবে—‘যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না—যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখ-দুঃখের দ্বারা ক্ষুব্ধ করি, সেদিন না—যেদিন প্রাকৃতিক নিয়মপরম্পরার হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো—সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না—সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট—সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না—সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না—সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা যায় না।’
আরও স্পষ্টভাবে কথাটা এ রকম—‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী—কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ এদিন আমরা ব্যক্তিবিশেষ নই, মানুষ হিসেবেই নিজেকে জেনে ও সেভাবে প্রকাশ করে ধন্য হই।
রবীন্দ্রনাথের এই ভাবাদর্শিক পথনির্দেশের সূত্রে আমরা বলতে পারি, নববর্ষের উৎসবের ভাবাদর্শের মধ্যে থাকবে দেশ ও জাতির জন্য, বিশ্ব ও মানবতার জন্য কল্যাণ কামনা ও আত্মনিবেদনের অঙ্গীকার; মহৎ আদর্শ ও উচ্চভাবে ত্যাগের উদ্দীপনায় শ্রীময় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার কাজে ব্রতী হওয়ার অঙ্গীকার। ফলে অনুষ্ঠানের একটা পরিকল্পনা তৈরি করতে পারি আমরা। প্রভাতি সমাবেশ হবে এদিন, রমনার বটমূলে যেমন ছায়ানটের আয়োজনে হয়ে থাকে—ছোটবড় যত বেশি সম্ভব সারা দেশে, সর্বত্র। তাতে কোনো সর্বমান্য শ্রদ্ধেয় বয়স্কজন—নারী বা পুরুষ, হিন্দু বা মুসলমান বা বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান বা ধর্ম বিষয়ে মুক্ত ব্যক্তি—সমাগতদের উদ্দেশে মূল ভাবাদর্শের আলোকে আশীর্বচন উচ্চারণ করবেন। এতে সমস্যা দেখা দিলে উদ্যোক্তাদের সর্বসম্মতিতে লিখিতভাবে নববর্ষের ঘোষণা পাঠ হতে পারে। তারপর নৃত্য ও বাদ্যসহ সংগীত ও আবৃত্তির অনুষ্ঠান। এরপর রাখিবন্ধন হলে কেমন হয়? বঙ্গভঙ্গের আদলে শুধু হিন্দু-মুসলিমে নয়, নারী-পুরুষে, ধনী-দরিদ্রে, ছোট-বড়তে, হিন্দু-মুসলিমে, শহুরে-গ্রাম্যে এবং যেকোনো রকম বিন্যাসে (অর্থাৎ নারীতে-নারীতে, মুসলিমে-মুসলিমে, ধনীতে-ধনীতে ইত্যাদি) রাখিবন্ধন হবে। ইতিহাসের এখনকার দাবি ও চাহিদা এ রকমই। শোভাযাত্রায় তারপর যোগ দেওয়া যায়, কিংবা শোভাযাত্রা থেকে দিনের সব কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তার পরই শেষ? না, নববর্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় ও জ্ঞাপনের রেওয়াজটা অনুষ্ঠানস্থল থেকে বাড়ি পর্যন্ত আসুক। ছোটরা বড়দের ফুল দেবে, বড়রা ছোটদের বই দেবে, বয়স্ক সমবয়সীরা ফুল/বই বিনিময় করবে—মোট কথা, উপহার বিনিময় ও প্রীতি সম্ভাষণ চলবে। আর বাড়ি পর্যন্ত আসা-যাওয়ার প্রথা শুরু হলে মিষ্টিমুখ, বিশেষ খাবারের আয়োজন স্বভাবতই চলে আসবে।
তখন অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব সত্যিকারের রূপ পাবে, সংসারের মাটিতে শেকড়বদ্ধ হবে এবং জীবনকে শিল্প ও সংস্কৃতির রসদ জোগাবে। উৎসবের আবহে জীবন আনন্দময় হবে, মুক্তি ও বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।
এবার পয়লা বৈশাখে সেই লক্ষণ দেখতে পেয়ে মন কিছুটা আশ্বস্ত হয়, আবার খানিকটা এগিয়ে বারবার পিছিয়ে পড়ার যে ইতিহাস আছে, আমাদের তা মনে পড়লে শঙ্কিত না হয়ে পারি না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
আমাদের দেশে সব বাঙালির যৌথভাবে উদ্যাপনের মতো কোনো সামাজিক উৎসব ছিল না। দুই ঈদ কিংবা দুর্গাপূজা হলো ধর্মীয় উৎসব—মুসলমান ও হিন্দু সীমিতভাবে এ সময় পরস্পরের সঙ্গে লৌকিকতা বা সৌহার্দ্য বিনিময় করলেও তা কখনো ধর্মীয় গণ্ডি ভাঙতে পারেনি, পারার কথাও নয়।
ব্রিটিশ ভারতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কিছু কিছু উৎসব অনুষ্ঠান চালু হয়েছিল, যেমন রাখি উৎসব বা হিন্দুমেলা। কিন্তু এর মধ্যে কখনো প্রকটভাবে কখনো প্রচ্ছন্নভাবে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক চেতনা কাজ করেছে। উভয় ক্ষেত্রে হিন্দুধর্মীয় প্রভাব থাকায় মুসলিম জনগণ এসবে প্রতীকীভাবে অংশগ্রহণ করলেও ব্যাপকভাবে কখনো অংশ নেয়নি। অত্যন্ত বড় মাপের নেতা হলেও মহাত্মা গান্ধীর জীবনচর্যার সংস্কৃতি হিন্দুধর্মীয় শিক্ষাদর্শে প্রভাবিত হওয়ায় ভারতীয় কংগ্রেস ব্যাপক হারে মুসলমানদের আকৃষ্ট করতে পারেনি, পারেনি তার প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে ধর্মান্ধ মুসলিম লীগের উত্থান ঠেকাতে।
বাংলাদেশে, সে তুলনায়, রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী নানান অনুষ্ঠান উৎসবের সূচনা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল শহীদ দিবস হিসেবে, যেখানে শোকই ছিল মুখ্য বিষয়। কিন্তু দিন দিন রাজনৈতিক সংগ্রামের তীব্রতা ও ব্যাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে এ দিনের তাৎপর্যও পাল্টে গেছে। শোককে সত্যিই বাঙালি শক্তিতে পরিণত করেছে। মানুষ এদিন শপথ নিয়েছে, দেশ ও জাতির কল্যাণে নিজেকে অঙ্গীকারবদ্ধ করেছে। এভাবে শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে বাঙালির জাতীয় জাগরণ ঘটেছে আর দেশব্যাপী ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জাগরণ, তা যদি হয় একটি জাতির ঐক্যবদ্ধ জাগরণ, স্বাধীনতা ও সার্থকতার লক্ষ্যে জাগরণ, তাহলে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুষ্ঠানাদিই তো আয়োজিত হবে। ফলে একুশকে কেন্দ্র করে বাঙালির সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটতে থাকল—শুরু হলো বাংলা একাডেমীর মাসব্যাপী বইমেলা, প্রকাশনার জোয়ার, সারা দেশে ছোটবড় বইমেলা আর সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে এক দিনের অধিক, কখনো সপ্তাহব্যাপী, পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালা ও উৎসব। একুশেও আজ উৎসবের রূপ ধারণ করেছে। এর আলাদা তাৎপর্য তৈরি হয়েছে জাতিসংঘ এ দিনকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায়।
তবুও একুশে ঠিক আনন্দ উৎসবের দিন নয়—এ দিনটি জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অসাম্প্রদায়িক বাঙালির করণীয় নির্ধারণের দিন। জাতীয় প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব পালন ও দায়বদ্ধতার মতো সিরিয়াস বিষয় এখানে বিবেচ্য। তাই হয়তো উৎসবের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দুটি দিক এখানে উপেক্ষিত—নতুন পোশাক ও উন্নত খাবার-দাবার। তা ছাড়া প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা এবং সামাজিক পরিমণ্ডল ছাড়াও পারিবারিক পরিমণ্ডলে পালনের বিশেষ সুযোগ নেই একুশের এই দিনটি। এটা সব সময়ই গণ-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু বক্তব্যসহ জাতীয় প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সচেতনতার প্রকাশ ঘটিয়েই পালন করা সম্ভব।
পয়লা বৈশাখ কিন্তু কোনো অনুষ্ঠানে যুক্ত না থেকেও আনন্দের সঙ্গে উপভোগ করা যায়। বাড়িতেই নতুন পোশাক ও ভালো খাবারের ব্যবস্থা করেই তা সম্ভব।
এবার পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠানের রীতিমতো জোয়ার বয়েছে। অথচ একসময় বছরের শেষ দিন চৈত্রসংক্রান্তি আর বাংলা নববর্ষ শহরাঞ্চলে কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই ছিল সীমাবদ্ধ। ছায়ানট যখন আইয়ুবের সামরিক শাসনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রমনার বটমূলে নববর্ষ উদ্যাপন শুরু করেছে গত শতকের ছয়ের দশকের গোড়ায়, তখন সারা দেশে এটিই ছিল বাংলা বর্ষবরণের উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। হয়তো এর বাইরে কোনো কোনো জেলা শহরে ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু মানুষ নববর্ষ উদ্যাপন ও উপভোগ করেছে, অংশ নিয়েছে এবং অনুপ্রাণিত হয়েছে ছায়ানটের অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই। দেশের অনেক জায়গায় এটিকে অনুসরণ করে নববর্ষে প্রভাতি সংগীতানুষ্ঠান চালু হয়।
এখন বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের জন্য দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। কোথাও কোথাও সপ্তাহব্যাপী দেশীয় পণ্যের মেলাও চালু হচ্ছে। এবার সরকারের আগ্রহে ও নির্দেশে প্রতিটি জেলায় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে, শিল্পকলা একাডেমী ও শিশু একাডেমীতে অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয়েছে সম্ভবত সরকারি নির্দেশনার ফলেই। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আমি একটি কথা বলতে চাই, যেহেতু এটি হলো সামাজিক উৎসব, তাই এ উৎসবটি শিক্ষক ও ছাত্রদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে অংশ নিয়ে উদ্যাপনের সুযোগ দেওয়া উচিত। একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ বা ষোলোই ডিসেম্বরের সঙ্গে পয়লা বৈশাখের চরিত্রগত পার্থক্য আছে। একুশে হলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র বিনির্মাণের এক অফুরন্ত প্রেরণার উৎস, আর বাকি দুটি হলো আমাদের রাষ্ট্র অর্জনের সঙ্গে সম্পৃক্ত দিন। ফলে এগুলো সরকারি নির্দেশে রাষ্ট্রীয়-জাতীয় দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হতে পারে। পতাকা উত্তোলন থেকে নানা আনুষ্ঠানিকতার বাধ্যবাধকতায় এগুলো একটু ফরমাল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যাপনের দিন। কিন্তু যেটি সামাজিক উৎসব সেটি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উদ্যাপন করতে হবে। রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব হবে যাতে আপামর মানুষ শান্তিতে আনন্দে স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎসব উদ্যাপন করতে পারে তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু নির্দেশনা দেওয়ার দরকার নেই, প্রেরণা ও উৎসাহ দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। বিষয়টি আশা করি সরকার খেয়াল করবে।
উৎসবের প্রসঙ্গে এবার আরেকটি দিকে আলোচনা করতে চাই।
প্রশ্নটা হলো, আমরা তো বলছি উৎসব, বলছি বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব। উৎসব কেবল ভোগে-বিলাসে হইচইয়ের মধ্যেই কাটিয়ে দিচ্ছি না তো? সারাটা দিন মাইকে মাইকে গীতকলরব, বাদ্যগীতসহ শোভাযাত্রা, পথে পথে ভিড়-জনসমুদ্র, দিন শেষে ক্লান্তিই কি থাকল অবশেষ?
বছরের এই শুরুর দিনটি নানা আনন্দ-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হোক। কিন্তু প্রভাতি অনুষ্ঠানটি হোক সুপরিকল্পিত। সারা বছরের জন্য মন ও মস্তিষ্ক কিছু কিছু রসদ পাক সে অনুষ্ঠানে। উৎসব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা একটা দিকনির্দেশনা পেতে পারি, তাঁর লেখা থেকে এ বিষয়ে জানতে পারি।
‘মানুষের উৎসব কবে? মানুষ যেদিন আপনার মনুষ্যত্বের শক্তি বিশেষভাবে স্মরণ করে, বিশেষভাবে উপলব্ধি করে, সেই দিন।’
এই প্রতিপাদ্য আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন তিনি এভাবে—‘যেদিন আমরা আপনাদিগকে প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্বারা চালিত করি, সেদিন না—যেদিন আমরা আপনাদিগকে সাংসারিক সুখ-দুঃখের দ্বারা ক্ষুব্ধ করি, সেদিন না—যেদিন প্রাকৃতিক নিয়মপরম্পরার হস্তে আপনাদিগকে ক্রীড়াপুত্তলির মতো ক্ষুদ্র ও জড়ভাবে অনুভব করি, সেদিন আমাদের উৎসবের দিন নহে; সেদিন তো আমরা জড়ের মতো উদ্ভিদের মতো সাধারণ জন্তুর মতো—সেদিন তো আমরা আমাদের নিজের মধ্যে সর্বজয়ী মানবশক্তি উপলব্ধি করি না—সেদিন আমাদের আনন্দ কিসের? সেদিন আমরা গৃহে অবরুদ্ধ, সেদিন আমরা কর্মে ক্লিষ্ট—সেদিন আমরা উজ্জ্বলভাবে আপনাকে ভূষিত করি না—সেদিন আমরা উদারভাবে কাহাকেও আহ্বান করি না—সেদিন আমাদের ঘরে সংসারচক্রের ঘর্ঘরধ্বনি শোনা যায়, কিন্তু সংগীত শোনা যায় না।’
আরও স্পষ্টভাবে কথাটা এ রকম—‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী—কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহত্, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ।’ এদিন আমরা ব্যক্তিবিশেষ নই, মানুষ হিসেবেই নিজেকে জেনে ও সেভাবে প্রকাশ করে ধন্য হই।
রবীন্দ্রনাথের এই ভাবাদর্শিক পথনির্দেশের সূত্রে আমরা বলতে পারি, নববর্ষের উৎসবের ভাবাদর্শের মধ্যে থাকবে দেশ ও জাতির জন্য, বিশ্ব ও মানবতার জন্য কল্যাণ কামনা ও আত্মনিবেদনের অঙ্গীকার; মহৎ আদর্শ ও উচ্চভাবে ত্যাগের উদ্দীপনায় শ্রীময় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার কাজে ব্রতী হওয়ার অঙ্গীকার। ফলে অনুষ্ঠানের একটা পরিকল্পনা তৈরি করতে পারি আমরা। প্রভাতি সমাবেশ হবে এদিন, রমনার বটমূলে যেমন ছায়ানটের আয়োজনে হয়ে থাকে—ছোটবড় যত বেশি সম্ভব সারা দেশে, সর্বত্র। তাতে কোনো সর্বমান্য শ্রদ্ধেয় বয়স্কজন—নারী বা পুরুষ, হিন্দু বা মুসলমান বা বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান বা ধর্ম বিষয়ে মুক্ত ব্যক্তি—সমাগতদের উদ্দেশে মূল ভাবাদর্শের আলোকে আশীর্বচন উচ্চারণ করবেন। এতে সমস্যা দেখা দিলে উদ্যোক্তাদের সর্বসম্মতিতে লিখিতভাবে নববর্ষের ঘোষণা পাঠ হতে পারে। তারপর নৃত্য ও বাদ্যসহ সংগীত ও আবৃত্তির অনুষ্ঠান। এরপর রাখিবন্ধন হলে কেমন হয়? বঙ্গভঙ্গের আদলে শুধু হিন্দু-মুসলিমে নয়, নারী-পুরুষে, ধনী-দরিদ্রে, ছোট-বড়তে, হিন্দু-মুসলিমে, শহুরে-গ্রাম্যে এবং যেকোনো রকম বিন্যাসে (অর্থাৎ নারীতে-নারীতে, মুসলিমে-মুসলিমে, ধনীতে-ধনীতে ইত্যাদি) রাখিবন্ধন হবে। ইতিহাসের এখনকার দাবি ও চাহিদা এ রকমই। শোভাযাত্রায় তারপর যোগ দেওয়া যায়, কিংবা শোভাযাত্রা থেকে দিনের সব কার্যক্রম শুরু হতে পারে। তার পরই শেষ? না, নববর্ষে শুভেচ্ছা বিনিময় ও জ্ঞাপনের রেওয়াজটা অনুষ্ঠানস্থল থেকে বাড়ি পর্যন্ত আসুক। ছোটরা বড়দের ফুল দেবে, বড়রা ছোটদের বই দেবে, বয়স্ক সমবয়সীরা ফুল/বই বিনিময় করবে—মোট কথা, উপহার বিনিময় ও প্রীতি সম্ভাষণ চলবে। আর বাড়ি পর্যন্ত আসা-যাওয়ার প্রথা শুরু হলে মিষ্টিমুখ, বিশেষ খাবারের আয়োজন স্বভাবতই চলে আসবে।
তখন অসাম্প্রদায়িক সামাজিক উৎসব সত্যিকারের রূপ পাবে, সংসারের মাটিতে শেকড়বদ্ধ হবে এবং জীবনকে শিল্প ও সংস্কৃতির রসদ জোগাবে। উৎসবের আবহে জীবন আনন্দময় হবে, মুক্তি ও বিকাশের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হবে।
এবার পয়লা বৈশাখে সেই লক্ষণ দেখতে পেয়ে মন কিছুটা আশ্বস্ত হয়, আবার খানিকটা এগিয়ে বারবার পিছিয়ে পড়ার যে ইতিহাস আছে, আমাদের তা মনে পড়লে শঙ্কিত না হয়ে পারি না।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments