সেই স্বপ্ন, সেই মূল্যবোধ—সেই মুজিবনগর সরকার by সৈয়দ বদরুল আহ্সান
আজ যখন আমরা মুজিবনগর সরকারকে পুনরায় স্মরণ করি, তখন আমাদের মনের গভীরে একটিই প্রশ্ন জাগে—১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে যে সাহস ও যে মূল্যবোধ আমাদের নিজেদের জন্য, দেশের জন্য তুলে ধরেছিলাম এবং এসবের মাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েছিলাম, সেই সাহস, সেই মূল্যবোধ আজ আমাদের মধ্যে, আমাদের সন্তানদের মধ্যে কতটুকু রয়ে গেছে? যখন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান বাঙালির ইতিহাসে সর্বপ্রথম সেই সরকারটি গঠন করলেন, যে সরকার দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হলো এবং অবশেষে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে তার স্থান করে নিল, তখন আমরা যথার্থই জাতি হিসেবে গর্ববোধ করেছিলাম। আমরা পলাশীর যুদ্ধের কথা বলি এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। কিন্তু বাঙালি জনগণের সরকার এবং বাঙালির নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার বলতে যা বোঝায়, তা ওই এপ্রিল ১৯৭১ সালেই আমরা দেখেছি। কী হতো আমাদের জীবনে, যদি তাজউদ্দীন আহমদ সেই দিন সরকার গঠনের উদ্যোগ না নিতেন এবং তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করতেন না? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি টিকে যেত আর আমরা বাঙালিরা যারা ওই দেশটির দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বরাবরই ছিলাম, পরিণত হতাম পাকিস্তানের দাসে। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে নিজে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সহকর্মীদের তাঁদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু যে একজন বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন, তা তিনি আবার প্রমাণ করলেন সেই ২৫-২৬ মার্চ রাতে। দেশের নির্বাচিত নেতা হয়ে তিনি পালিয়ে যেতে পারেন না। কিন্তু তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর গ্রেপ্তার হতে পারেন এবং এসবের আগে তিনি দলের অন্য নেতাদের নির্দেশ দিয়ে যেতে পারেন তাঁরা যেন প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এবং হয়েছিলও তা-ই।
মুজিবনগর সরকার তাই বাঙালি জাতির জীবনে একটি বড় ধরনের প্রেরণা জুগিয়েছিল। সর্বমোট যে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা অনায়াসে শরণার্থী হয়েই থেকে যেত, যদি ১৭ এপ্রিলের ঘটনাটি না ঘটত। যাঁরা সেই সরকার পরিচালনা করেছেন, তাঁরা সেই দায়িত্বটি পালন না করে বিদেশের মাটিতে থেকে যেতে পারতেন, যেমনটি পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই বিভিন্ন সময়ে করেছেন। যদি মুজিবনগর সরকার গঠিত না হতো, তাহলে একটা বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকত না এবং সেটা এই যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে জীবিত রাখত না। আর আগেই যেটা বলেছি, এই দেশটি দাসের রাজ্যে পরিণত হতো। কিন্তু তা হয়নি। আজ যখন আমরা ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এর কথা ভাবি, তখন মনে পড়ে ওই সব বাঙালি সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাকে, যাঁরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। ওই সরকার ছিল বলেই হাজার হাজার যুবক বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ছুটে গেছে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তা যে পেশা এবং ক্ষেত্র থেকেই হোক, সবাই সেই দিন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে মুজিবনগর সরকার গঠনের অর্থই হচ্ছে একটা আদর্শকে তুলে ধরা। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, আমাদের স্মৃতিতে চিরদিন প্রতিদিনের নতুন নতুন যুবকের যুদ্ধে যাওয়ার দৃশ্যগুলো অম্লান থেকে যাবে। সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং অন্যান্য সবাই যুদ্ধের ময়দানে চলে গেছেন ওই মুজিবনগর সরকারের জন্যই।
কী ছিল সেই দিন আমাদের মূল্যবোধ? অতি সহজ ভাষায় বলতে গেলে সেই মূল্যবোধ ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের মুক্ত করা। এবং সেই মূল্যবোধগুলো আমরা তুলে ধরেছিলাম বিভিন্ন কায়দায়। সরকারের পত্রিকা জয় বাংলার মাধ্যমে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে একত্র হয়েছেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা। মুক্তিযুদ্ধটি যে ছিল সমগ্র জাতির যুদ্ধ এবং কোনো দলীয় যুদ্ধ ছিল না, সেটিই ছিল বাস্তবতা। বাঙালি ঐতিহ্য যে রক্ষা করা প্রয়োজন—এই সত্যটিই সেদিন মুজিবনগর সরকার তুলে ধরেছিল। তাজউদ্দীন নিজের কাপড় নিজেই ধুয়েছেন। সৈয়দ নজরুল যুদ্ধের বিভিন্ন রণাঙ্গন ঘুরেছেন। সরকারি কর্মচারী যে যেমন করে পেরেছেন, যুদ্ধে অবদান রেখেছেন। মুক্তিবাহিনী গঠন করার পেছনে এ সরকারই মূল শক্তি ছিল। বিদেশে পাকিস্তান সরকারের বাঙালি কূটনীতিকেরা দ্বিধা করেননি মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে এই কারণে যে, তাঁরা সেই সাহস পেয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারের উপস্থিতি থেকেই। এখানে অবশ্য স্মরণ রাখা প্রয়োজন, এমনও বড় মাপের মানুষ ছিলেন, যাঁরা আবার মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ত্যাগ করেছিলেন। কে এম শাহাবউদ্দিনের স্থান এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুজিবনগর সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। যে জাতি ১৯৭০-এর নির্বাচন থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ইস্পাত-কঠিন ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে, সেই জাতি প্রাথমিক পর্যায়ে এবং সেটা পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার সূচনার পরপরই কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই মুজিবনগর সরকার ইতিহাসের মোড়টা একেবারে ঘুরিয়ে ফেলে। যে বাঙালি জাতি এত দিন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থা রেখে আসছিল, সেই জাতিই রাতারাতি পরিণত হয় বলতে গেলে একটি যুদ্ধের জাতিতে। মুজিবনগর সরকারের কথা স্মরণ করলে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব আমাদের মনে জেগে ওঠে এবং সেটা এই যে, যাঁরা সেদিন সরকার গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছিলেন, তাঁদের কেউই কোনো দিন যুদ্ধের বিষয়ে কোনোভাবেই পারদর্শী ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস যেমন বড় মাপের নেতার উদ্ভব ঘটায়, তেমনি এমন নেতা থাকেন, যাঁরা অনেকটা অলৌকিকভাবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ইতিহাস রচনা করেন। মুজিবনগর সরকারের নেতাদের ক্ষেত্রে এই দুটি কথাই প্রযোজ্য।
মুজিবনগর সরকার যাঁরা পরিচালনা করেছেন এবং যাঁরা ওই সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁরা সবাই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু এই বাস্তব সত্যটি কি আমাদের বর্তমানের যুবসমাজ অথবা যুদ্ধের পর যাদের জন্ম, তাদের সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছি? আজ যেসব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করার কাজে ব্যস্ত, তারা দেশের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেছে। যখন বিএনপির মহাসচিব বলে ফেলেন যে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান, তখন আমরা সবাই দল-মতনির্বিশেষে লজ্জায় মাথা নত করি। তিনি তো যুদ্ধ দেখেছেন। তাহলে তিনি এই অসত্য জুড়িয়ে দিচ্ছেন কেন আমাদের জীবনের সঙ্গে? এই তো গেল ইতিহাস বিকৃতকারীদের কথা। ওই সব ছাত্রলীগ কর্মীর কথা ভাবেন, যারা বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে টেন্ডার ও ভর্তি-ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। এরা কি ইতিহাসের কথা জানে না? ১৯৭১ সালেও তো ছাত্রলীগ ছিল এবং সেই ছাত্রলীগ তো অনেক ক্ষেত্রে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কই, তারা তো ছাত্রের সম্মান কখনোই হারায়নি এবং সন্ত্রাসী হয়নি। সেই ১৯৭১-এর ছাত্র তো মুজিবনগর সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা বন্দুক হাতে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। কেউ তাঁদের হাতে কখনো কোনো চাপাতি-রামদা বা ছুরি দেখেনি।
মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাঁরা; নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ছিলেন এবং তাঁদের দেশপ্রেমের সামনে আমরা আজও মাথা নত করি। মুজিবনগর সরকার যে দেশপ্রেমে গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, পরবর্তী সরকারগুলো সেই ধারাটা কেন ধরে রাখতে পারল না এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না? ১৯৭১-এ আমরা চেয়েছিলাম একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। আজ যখন আমাদের ভয় পেতে হয় পুলিশকে, যখন কোনো বৃদ্ধ বছরের পর বছর তাঁর পেনশনের টাকার জন্য সরকারের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান, যখন শ্রমিককে তাঁর প্রাপ্য না দিয়ে মালিকপক্ষ বিদেশ ভ্রমণে চলে যায়, যখন আতঙ্কে থাকতে হয়—এই বুঝি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল এবং অসাংবিধানিক কিছু ঘটতে চলল, যখন অনেক আইনজীবী একযোগে চিৎকার করে আদালতে বিচারপতিকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন—তখন সেই ভালো মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে, যাঁরা একদিন আমাদের জীবনে আমাদেরই জন্য সর্বপ্রথম একটি সরকার গঠন করেছিলেন। তাঁরা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নগুলোর মধ্যে আমরা কতগুলোই বা ধরে রাখতে পেরেছি?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
মুজিবনগর সরকার তাই বাঙালি জাতির জীবনে একটি বড় ধরনের প্রেরণা জুগিয়েছিল। সর্বমোট যে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা অনায়াসে শরণার্থী হয়েই থেকে যেত, যদি ১৭ এপ্রিলের ঘটনাটি না ঘটত। যাঁরা সেই সরকার পরিচালনা করেছেন, তাঁরা সেই দায়িত্বটি পালন না করে বিদেশের মাটিতে থেকে যেতে পারতেন, যেমনটি পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিই বিভিন্ন সময়ে করেছেন। যদি মুজিবনগর সরকার গঠিত না হতো, তাহলে একটা বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকত না এবং সেটা এই যে, পাকিস্তান রাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে জীবিত রাখত না। আর আগেই যেটা বলেছি, এই দেশটি দাসের রাজ্যে পরিণত হতো। কিন্তু তা হয়নি। আজ যখন আমরা ১৭ এপ্রিল ১৯৭১-এর কথা ভাবি, তখন মনে পড়ে ওই সব বাঙালি সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তাকে, যাঁরা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। ওই সরকার ছিল বলেই হাজার হাজার যুবক বাংলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ছুটে গেছে মুক্তিবাহিনীতে নাম লেখানোর জন্য। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান তা যে পেশা এবং ক্ষেত্র থেকেই হোক, সবাই সেই দিন অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে মুজিবনগর সরকার গঠনের অর্থই হচ্ছে একটা আদর্শকে তুলে ধরা। আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, আমাদের স্মৃতিতে চিরদিন প্রতিদিনের নতুন নতুন যুবকের যুদ্ধে যাওয়ার দৃশ্যগুলো অম্লান থেকে যাবে। সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং অন্যান্য সবাই যুদ্ধের ময়দানে চলে গেছেন ওই মুজিবনগর সরকারের জন্যই।
কী ছিল সেই দিন আমাদের মূল্যবোধ? অতি সহজ ভাষায় বলতে গেলে সেই মূল্যবোধ ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের মুক্ত করা। এবং সেই মূল্যবোধগুলো আমরা তুলে ধরেছিলাম বিভিন্ন কায়দায়। সরকারের পত্রিকা জয় বাংলার মাধ্যমে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গিয়ে একত্র হয়েছেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা। মুক্তিযুদ্ধটি যে ছিল সমগ্র জাতির যুদ্ধ এবং কোনো দলীয় যুদ্ধ ছিল না, সেটিই ছিল বাস্তবতা। বাঙালি ঐতিহ্য যে রক্ষা করা প্রয়োজন—এই সত্যটিই সেদিন মুজিবনগর সরকার তুলে ধরেছিল। তাজউদ্দীন নিজের কাপড় নিজেই ধুয়েছেন। সৈয়দ নজরুল যুদ্ধের বিভিন্ন রণাঙ্গন ঘুরেছেন। সরকারি কর্মচারী যে যেমন করে পেরেছেন, যুদ্ধে অবদান রেখেছেন। মুক্তিবাহিনী গঠন করার পেছনে এ সরকারই মূল শক্তি ছিল। বিদেশে পাকিস্তান সরকারের বাঙালি কূটনীতিকেরা দ্বিধা করেননি মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে এই কারণে যে, তাঁরা সেই সাহস পেয়েছিলেন মুজিবনগর সরকারের উপস্থিতি থেকেই। এখানে অবশ্য স্মরণ রাখা প্রয়োজন, এমনও বড় মাপের মানুষ ছিলেন, যাঁরা আবার মুজিবনগর সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই পাকিস্তান রাষ্ট্র ত্যাগ করেছিলেন। কে এম শাহাবউদ্দিনের স্থান এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মুজিবনগর সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। যে জাতি ১৯৭০-এর নির্বাচন থেকে শুরু করে ২৫ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ইস্পাত-কঠিন ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে, সেই জাতি প্রাথমিক পর্যায়ে এবং সেটা পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার সূচনার পরপরই কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই মুজিবনগর সরকার ইতিহাসের মোড়টা একেবারে ঘুরিয়ে ফেলে। যে বাঙালি জাতি এত দিন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থা রেখে আসছিল, সেই জাতিই রাতারাতি পরিণত হয় বলতে গেলে একটি যুদ্ধের জাতিতে। মুজিবনগর সরকারের কথা স্মরণ করলে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তব আমাদের মনে জেগে ওঠে এবং সেটা এই যে, যাঁরা সেদিন সরকার গঠন ও যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়েছিলেন, তাঁদের কেউই কোনো দিন যুদ্ধের বিষয়ে কোনোভাবেই পারদর্শী ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস যেমন বড় মাপের নেতার উদ্ভব ঘটায়, তেমনি এমন নেতা থাকেন, যাঁরা অনেকটা অলৌকিকভাবে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ইতিহাস রচনা করেন। মুজিবনগর সরকারের নেতাদের ক্ষেত্রে এই দুটি কথাই প্রযোজ্য।
মুজিবনগর সরকার যাঁরা পরিচালনা করেছেন এবং যাঁরা ওই সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁরা সবাই ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। কিন্তু এই বাস্তব সত্যটি কি আমাদের বর্তমানের যুবসমাজ অথবা যুদ্ধের পর যাদের জন্ম, তাদের সামনে আমরা তুলে ধরতে পেরেছি? আজ যেসব রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তি বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করার কাজে ব্যস্ত, তারা দেশের প্রচুর ক্ষতিসাধন করেছে। যখন বিএনপির মহাসচিব বলে ফেলেন যে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান, তখন আমরা সবাই দল-মতনির্বিশেষে লজ্জায় মাথা নত করি। তিনি তো যুদ্ধ দেখেছেন। তাহলে তিনি এই অসত্য জুড়িয়ে দিচ্ছেন কেন আমাদের জীবনের সঙ্গে? এই তো গেল ইতিহাস বিকৃতকারীদের কথা। ওই সব ছাত্রলীগ কর্মীর কথা ভাবেন, যারা বিগত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে টেন্ডার ও ভর্তি-ব্যবসাকে কেন্দ্র করে দেশে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। এরা কি ইতিহাসের কথা জানে না? ১৯৭১ সালেও তো ছাত্রলীগ ছিল এবং সেই ছাত্রলীগ তো অনেক ক্ষেত্রে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। কই, তারা তো ছাত্রের সম্মান কখনোই হারায়নি এবং সন্ত্রাসী হয়নি। সেই ১৯৭১-এর ছাত্র তো মুজিবনগর সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাঁরা বন্দুক হাতে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। কেউ তাঁদের হাতে কখনো কোনো চাপাতি-রামদা বা ছুরি দেখেনি।
মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাঁরা; নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিচক্ষণ ছিলেন এবং তাঁদের দেশপ্রেমের সামনে আমরা আজও মাথা নত করি। মুজিবনগর সরকার যে দেশপ্রেমে গোটা জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, পরবর্তী সরকারগুলো সেই ধারাটা কেন ধরে রাখতে পারল না এবং এগিয়ে নিয়ে যেতে পারল না? ১৯৭১-এ আমরা চেয়েছিলাম একটি কল্যাণ রাষ্ট্র। আজ যখন আমাদের ভয় পেতে হয় পুলিশকে, যখন কোনো বৃদ্ধ বছরের পর বছর তাঁর পেনশনের টাকার জন্য সরকারের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান, যখন শ্রমিককে তাঁর প্রাপ্য না দিয়ে মালিকপক্ষ বিদেশ ভ্রমণে চলে যায়, যখন আতঙ্কে থাকতে হয়—এই বুঝি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ল এবং অসাংবিধানিক কিছু ঘটতে চলল, যখন অনেক আইনজীবী একযোগে চিৎকার করে আদালতে বিচারপতিকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন—তখন সেই ভালো মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে, যাঁরা একদিন আমাদের জীবনে আমাদেরই জন্য সর্বপ্রথম একটি সরকার গঠন করেছিলেন। তাঁরা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। সেই স্বপ্নগুলোর মধ্যে আমরা কতগুলোই বা ধরে রাখতে পেরেছি?
সৈয়দ বদরুল আহ্সান: সাংবাদিক।
No comments