জ্বালানি ও জাতীয় স্বার্থের তর্ক-বিতর্ক কার পক্ষে by কল্লোল মোস্তফা
১৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখের প্রথম আলোতে জুবায়ের জামান লিখিত ‘জ্বালানি ও জাতীয় স্বার্থের তর্ক-বিতর্ক’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে লেখক দুটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে পিএসসি চুক্তি স্বাক্ষর প্রসঙ্গে যা বলেছেন তাঁর প্রতিক্রিয়ায় কিছু কথা পরিষ্কার করা অত্যন্ত জরুরি। কেননা বিষয়টি নিজেই জরুরি ও জাতীয় গুরুত্বসম্পন্ন।
এক. জনাব জুবায়ের জামান লিখেছেন: ‘... এক দশক ধরে বিপুল ব্যয়ে পরিচালিত অনুসন্ধান আমাদের গ্যাস সম্পদে নতুন কোনো কিছু যোগ করতে পারেনি। বর্তমান পিএসসির আওতায় পরিচালিত অনুসন্ধানেও দ্রুত গ্যাসপ্রাপ্তির আশা করা যায় না, অন্তত আগামী সাত-নয় বছরের মধ্যে তো নয়ই।’
তাহলে আমাদের প্রশ্ন হলো, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ‘মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে’ এ অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আগ্রহী হলো কি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে উদ্ধার করার অনুরূপ গ্যাস দায়গ্রস্ত (!) বাংলাদেশকে দয়া করতে, নাকি নিশ্চিত মুনাফার গন্ধ পেয়েই? উত্তরে আমরা প্রথম আলোতেই প্রকাশিত এ কে এম জাকারিয়ার ‘বঙ্গোপসাগর এখন এক লোভনীয় ক্ষেত্র’ (২০ নভেম্বর ২০০৮) লেখার কয়েকটি লাইন পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেব: ‘বঙ্গোপসাগর এখন তেল-গ্যাসের জন্য লোভনীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত সমুদ্রে ১০০ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মিয়ানমার সাত টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।... মিয়ানমার তাদের যে তিনটি ব্লকে গ্যাস পাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে, সেই ব্লকগুলো বাংলাদেশের ঘোষণা করা ব্লকগুলোর কাছাকাছি এবং অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্লকগুলোর মধ্যে পড়েছে।’ তাহলে জুবায়ের জামান কিসের ভিত্তিতে এবং কার স্বার্থে বলছেন এ অঞ্চল থেকে গ্যাসপ্রাপ্তি অনিশ্চিত এবং বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক?
দুই. মডেল পিএসসিতে এলএনজি করে রপ্তানি করার বিধান রাখা প্রসঙ্গে তিনি ‘ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ’ এই অনুসন্ধানের কাজে বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারজাত করার নিশ্চয়তা প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন:
‘... তাই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস বাজারজাতকরণ/রপ্তানি একটি যৌক্তিক প্রস্তাব। তবে তাও আবিষ্কৃত গ্যাসের আকারের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত গভীর সমুদ্র এলাকায় চার থেকে পাঁচ টিসিএফের নিচের কোনো গ্যাসক্ষেত্রের জন্য এলএনজি প্লান্ট স্থাপন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বলে বিবেচিত হয় না। এখানে উল্লেখ্য, পিএসসি মোতাবেক গ্যাসের যেকোনো রপ্তানির ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা বা দেশে তৃতীয় কোনো ব্যবহারকারী/পক্ষ গ্যাস কিনতে অপারগতা প্রকাশ করলেই কেবল পেট্রোবাংলার সম্মত শর্তে এলএনজি হিসেবে রপ্তানির সুযোগ আসবে।’
প্রথম কথা হলো, মিয়ানমার যেখানে আমাদের ব্লকগুলোর পাশেই তিনটি ব্লক থেকে সাত টিসিএফ গ্যাসপ্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে, তাহলে জুবায়ের জামান সাহেব কেন মনে করছেন এলএনজি প্লান্ট লাভজনক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্র চার থেকে পাঁচ টিসিএফ গ্যাস আমরা আমাদের তিনটি ব্লক থেকে পাব না? আবারও বলি, কার স্বার্থে?
দ্বিতীয় কথা হলো, পেট্রোবাংলা প্রথম দাবিদার ঠিকই, কিন্তু তার জন্য মডেল পিএসসির আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪ অনুসারে তাকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এক. তাকে গভীর সমুদ্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস পরিবহন করে আনতে পারতে হবে এবং দুই. উত্তোলিত গ্যাস ব্যবহার করতে পারতে হবে।
এখন আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ দেখে বহুজাতিক কোম্পানি যদি এলএনজি প্লান্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং যদি বাংলাদেশ দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করতে পারবে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন শুরু করে, তাহলে পরিবহনের পাইপলাইনহীন অবস্থায় এবং আমাদের অবদমিত শিল্প খাত সেই পরিমাণ গ্যাস সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে অক্ষম হবে। এই দুটি কারণে চুক্তি অনুসারে আমরা বাধ্য হব বহুজাতিক কোম্পানিকে এলএনজি বানিয়ে গ্যাস বিদেশে রপ্তানি করার অনুমতি দিতে।
এই রপ্তানি কিন্তু আমরা করছি না, করছে কোম্পানি। এবং করছে আমাদের প্রাপ্য গ্যাস থেকেই। রপ্তানির বিষয়টি ছাড়াও, আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪ অনুসারে বাজারজাতযোগ্য গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি আমরা পাব না অর্থাত্ অন্তত ৮০ ভাগ গ্যাসের মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির। অথচ আমাদের মতো দেশ বলিভিয়ার হাইড্রোকার্বন আইন ২০০৫-এ বলা আছে, বলিভিয়ার মালিকানা কোনোভাবেই উত্তোলিত হাইড্রোকার্বনের ৫০ শতাংশের কম হওয়া চলবে না এবং বাজারজাত করার অধিকার ও সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওয়াইপিএফবির। আমাদের বেলায় যা হতে পারত পেট্রোবাংলার এখতিয়ারের বিষয়।
কিন্তু চুক্তিতে যদি গ্যাসের শত ভাগ মালিকানা আমাদের হাতে থাকত এবং বহুজাতিক কোম্পানি যেমন সাবকনট্রাক্ট দিয়ে কাজ করায়, বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা যদি সেভাবে সাবকনট্রাক্টর দিয়ে কাজ করাত তাহলে কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস একসঙ্গে উত্তোলন করে কস্ট রিকভারি করে নেওয়ার সুযোগ থাকত না, প্রয়োজনও পড়ত না। একই সঙ্গে গ্যাস রপ্তানি করে সোনার ডিম পাড়া হাসকে বিক্রি করার কথাও উঠত না।
প্রশ্ন আসতে পারে দেশে নিশ্চিত বাজার থাকা সত্ত্বেও বহুজাতিক কোম্পানি কেন শুধু শুধু কোটি কোটি ডলার খরচ করে এলএনজি প্লান্ট বানাতে যাবে? বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনলে দেশীয় উত্পাদন খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে আমাদের গ্যাস কিনতে হবে, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি চুক্তি মোতাবেক ১৮০ ডলার সিলিং থাকার কারণে তাদের আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মূল্যে পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস বিক্রি করতে হবে (অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, ৭ জুলাই, প্রথম আলো)। ফলে পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করলে প্রতি হাজার কিউবিক ফিটে তার ‘ক্ষতি’ সাত-আট ডলার করে প্রতি টিসিএফে ক্ষতি সাত-আট বিলিয়ন ডলার। এই টাকা বিনিয়োগ করেই তারা একবার এলএনজি প্লান্ট বানিয়ে ফেলতে পারলে পরবর্তী সময়ে আর এই ক্ষতিটুকু স্বীকার করতে হবে না। কারণ, যদি চার টিসিএফ গ্যাস মেলে এবং তা দেশীয় বাজারে বিক্রি করতে হয়, তাহলে ২৮ থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। কাজেই তাদের পক্ষে সাত-আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চাওয়াই স্বাভাবিক। এবং দেশীয় শিল্পের প্রয়োজনাতিরিক্ত গ্যাস উত্পাদন করলেই পেট্রোবাংলা বাধ্য হবে তাদের এলএনজি আকারে গ্যাস রপ্তানি করতে দিতে!
তিন. ‘এ অবস্থায় সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে বরং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর স্বার্থই সংরক্ষিত হবে, বাংলাদেশের নয়।’
অথচ তেল-গ্যাস কমিটি অথবা যারা বর্তমান পিএসসিকে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বলে মনে করছে তারা কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে রাখার কথা বলছে না, বরং সরকারই ঘোষণা দিয়েছে বিরোধপূর্ণ ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন না করার। (সূত্র: সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান: পেট্রোবাংলা-টাল্লো প্রাথমিক আলোচনা, ৩০ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো) কাজেই গ্যাস রপ্তানি ও মালিকানার ইস্যু নিয়ে তর্ক-বিতর্কের ফলে ভারত-মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে, কথাটি ঠিক নয়। বরং তর্ক-বিতর্ক না করলে একদিকে বিরোধহীন ব্লকের গ্যাস নিয়ে যাবে বহুজাতিক কোম্পানি, অন্যদিকে বিরোধপূর্ণ ব্লকগুলোর গ্যাস নিয়ে যাবে ভারত বা মিয়ানমার অর্থাত্ আম-ছালা দুই-ই যাবে।
বিরোধহীন ব্লকগুলোকে ৮০ শতাংশ বিদেশি মালিকানা ও রপ্তানির সুযোগ রেখে বরাদ্দ বা ইজারা দেওয়ার খোয়াবে মগ্ন থাকলে এবং সমুুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসার কার্যকর উদ্যোগ নিতে না চাইলে গণনজরদারি ও বিতর্কের প্রয়োজন নেই। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নজরদারি ছাড়া আমরা আমাদের সম্পদ রক্ষা করতে ও কাজে লাগাতে পারব না। দুশ্চিন্তার কারণটি সেখানেই।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী।
এক. জনাব জুবায়ের জামান লিখেছেন: ‘... এক দশক ধরে বিপুল ব্যয়ে পরিচালিত অনুসন্ধান আমাদের গ্যাস সম্পদে নতুন কোনো কিছু যোগ করতে পারেনি। বর্তমান পিএসসির আওতায় পরিচালিত অনুসন্ধানেও দ্রুত গ্যাসপ্রাপ্তির আশা করা যায় না, অন্তত আগামী সাত-নয় বছরের মধ্যে তো নয়ই।’
তাহলে আমাদের প্রশ্ন হলো, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ‘মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে’ এ অঞ্চলে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে আগ্রহী হলো কি কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাকে উদ্ধার করার অনুরূপ গ্যাস দায়গ্রস্ত (!) বাংলাদেশকে দয়া করতে, নাকি নিশ্চিত মুনাফার গন্ধ পেয়েই? উত্তরে আমরা প্রথম আলোতেই প্রকাশিত এ কে এম জাকারিয়ার ‘বঙ্গোপসাগর এখন এক লোভনীয় ক্ষেত্র’ (২০ নভেম্বর ২০০৮) লেখার কয়েকটি লাইন পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেব: ‘বঙ্গোপসাগর এখন তেল-গ্যাসের জন্য লোভনীয় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত সমুদ্রে ১০০ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মিয়ানমার সাত টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।... মিয়ানমার তাদের যে তিনটি ব্লকে গ্যাস পাওয়ার কথা ঘোষণা করেছে, সেই ব্লকগুলো বাংলাদেশের ঘোষণা করা ব্লকগুলোর কাছাকাছি এবং অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্লকগুলোর মধ্যে পড়েছে।’ তাহলে জুবায়ের জামান কিসের ভিত্তিতে এবং কার স্বার্থে বলছেন এ অঞ্চল থেকে গ্যাসপ্রাপ্তি অনিশ্চিত এবং বাণিজ্যিকভাবে অলাভজনক?
দুই. মডেল পিএসসিতে এলএনজি করে রপ্তানি করার বিধান রাখা প্রসঙ্গে তিনি ‘ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ’ এই অনুসন্ধানের কাজে বহুজাতিক কোম্পানিকে বাজারজাত করার নিশ্চয়তা প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন:
‘... তাই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে গ্যাস বাজারজাতকরণ/রপ্তানি একটি যৌক্তিক প্রস্তাব। তবে তাও আবিষ্কৃত গ্যাসের আকারের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণত গভীর সমুদ্র এলাকায় চার থেকে পাঁচ টিসিএফের নিচের কোনো গ্যাসক্ষেত্রের জন্য এলএনজি প্লান্ট স্থাপন বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক বলে বিবেচিত হয় না। এখানে উল্লেখ্য, পিএসসি মোতাবেক গ্যাসের যেকোনো রপ্তানির ক্ষেত্রে পেট্রোবাংলা বা দেশে তৃতীয় কোনো ব্যবহারকারী/পক্ষ গ্যাস কিনতে অপারগতা প্রকাশ করলেই কেবল পেট্রোবাংলার সম্মত শর্তে এলএনজি হিসেবে রপ্তানির সুযোগ আসবে।’
প্রথম কথা হলো, মিয়ানমার যেখানে আমাদের ব্লকগুলোর পাশেই তিনটি ব্লক থেকে সাত টিসিএফ গ্যাসপ্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে, তাহলে জুবায়ের জামান সাহেব কেন মনে করছেন এলএনজি প্লান্ট লাভজনক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্র চার থেকে পাঁচ টিসিএফ গ্যাস আমরা আমাদের তিনটি ব্লক থেকে পাব না? আবারও বলি, কার স্বার্থে?
দ্বিতীয় কথা হলো, পেট্রোবাংলা প্রথম দাবিদার ঠিকই, কিন্তু তার জন্য মডেল পিএসসির আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪ অনুসারে তাকে দুটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এক. তাকে গভীর সমুদ্র থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস পরিবহন করে আনতে পারতে হবে এবং দুই. উত্তোলিত গ্যাস ব্যবহার করতে পারতে হবে।
এখন আবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ দেখে বহুজাতিক কোম্পানি যদি এলএনজি প্লান্ট স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং যদি বাংলাদেশ দৈনিক যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করতে পারবে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন শুরু করে, তাহলে পরিবহনের পাইপলাইনহীন অবস্থায় এবং আমাদের অবদমিত শিল্প খাত সেই পরিমাণ গ্যাস সঙ্গে সঙ্গে ব্যবহার করতে অক্ষম হবে। এই দুটি কারণে চুক্তি অনুসারে আমরা বাধ্য হব বহুজাতিক কোম্পানিকে এলএনজি বানিয়ে গ্যাস বিদেশে রপ্তানি করার অনুমতি দিতে।
এই রপ্তানি কিন্তু আমরা করছি না, করছে কোম্পানি। এবং করছে আমাদের প্রাপ্য গ্যাস থেকেই। রপ্তানির বিষয়টি ছাড়াও, আর্টিক্যাল ১৫.৫.৪ অনুসারে বাজারজাতযোগ্য গ্যাসের ২০ শতাংশের বেশি আমরা পাব না অর্থাত্ অন্তত ৮০ ভাগ গ্যাসের মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির। অথচ আমাদের মতো দেশ বলিভিয়ার হাইড্রোকার্বন আইন ২০০৫-এ বলা আছে, বলিভিয়ার মালিকানা কোনোভাবেই উত্তোলিত হাইড্রোকার্বনের ৫০ শতাংশের কম হওয়া চলবে না এবং বাজারজাত করার অধিকার ও সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওয়াইপিএফবির। আমাদের বেলায় যা হতে পারত পেট্রোবাংলার এখতিয়ারের বিষয়।
কিন্তু চুক্তিতে যদি গ্যাসের শত ভাগ মালিকানা আমাদের হাতে থাকত এবং বহুজাতিক কোম্পানি যেমন সাবকনট্রাক্ট দিয়ে কাজ করায়, বাপেক্স বা পেট্রোবাংলা যদি সেভাবে সাবকনট্রাক্টর দিয়ে কাজ করাত তাহলে কিন্তু প্রয়োজনের চেয়ে বেশি পরিমাণ গ্যাস একসঙ্গে উত্তোলন করে কস্ট রিকভারি করে নেওয়ার সুযোগ থাকত না, প্রয়োজনও পড়ত না। একই সঙ্গে গ্যাস রপ্তানি করে সোনার ডিম পাড়া হাসকে বিক্রি করার কথাও উঠত না।
প্রশ্ন আসতে পারে দেশে নিশ্চিত বাজার থাকা সত্ত্বেও বহুজাতিক কোম্পানি কেন শুধু শুধু কোটি কোটি ডলার খরচ করে এলএনজি প্লান্ট বানাতে যাবে? বহুজাতিক কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনলে দেশীয় উত্পাদন খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে আমাদের গ্যাস কিনতে হবে, এ কথা যেমন সত্য, তেমনি চুক্তি মোতাবেক ১৮০ ডলার সিলিং থাকার কারণে তাদের আন্তর্জাতিক মূল্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মূল্যে পেট্রোবাংলার কাছে গ্যাস বিক্রি করতে হবে (অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, ৭ জুলাই, প্রথম আলো)। ফলে পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রি করলে প্রতি হাজার কিউবিক ফিটে তার ‘ক্ষতি’ সাত-আট ডলার করে প্রতি টিসিএফে ক্ষতি সাত-আট বিলিয়ন ডলার। এই টাকা বিনিয়োগ করেই তারা একবার এলএনজি প্লান্ট বানিয়ে ফেলতে পারলে পরবর্তী সময়ে আর এই ক্ষতিটুকু স্বীকার করতে হবে না। কারণ, যদি চার টিসিএফ গ্যাস মেলে এবং তা দেশীয় বাজারে বিক্রি করতে হয়, তাহলে ২৮ থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। কাজেই তাদের পক্ষে সাত-আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চাওয়াই স্বাভাবিক। এবং দেশীয় শিল্পের প্রয়োজনাতিরিক্ত গ্যাস উত্পাদন করলেই পেট্রোবাংলা বাধ্য হবে তাদের এলএনজি আকারে গ্যাস রপ্তানি করতে দিতে!
তিন. ‘এ অবস্থায় সাগরবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু না করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে বরং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর স্বার্থই সংরক্ষিত হবে, বাংলাদেশের নয়।’
অথচ তেল-গ্যাস কমিটি অথবা যারা বর্তমান পিএসসিকে জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে বলে মনে করছে তারা কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে রাখার কথা বলছে না, বরং সরকারই ঘোষণা দিয়েছে বিরোধপূর্ণ ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন না করার। (সূত্র: সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান: পেট্রোবাংলা-টাল্লো প্রাথমিক আলোচনা, ৩০ সেপ্টেম্বর, প্রথম আলো) কাজেই গ্যাস রপ্তানি ও মালিকানার ইস্যু নিয়ে তর্ক-বিতর্কের ফলে ভারত-মিয়ানমারের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে, কথাটি ঠিক নয়। বরং তর্ক-বিতর্ক না করলে একদিকে বিরোধহীন ব্লকের গ্যাস নিয়ে যাবে বহুজাতিক কোম্পানি, অন্যদিকে বিরোধপূর্ণ ব্লকগুলোর গ্যাস নিয়ে যাবে ভারত বা মিয়ানমার অর্থাত্ আম-ছালা দুই-ই যাবে।
বিরোধহীন ব্লকগুলোকে ৮০ শতাংশ বিদেশি মালিকানা ও রপ্তানির সুযোগ রেখে বরাদ্দ বা ইজারা দেওয়ার খোয়াবে মগ্ন থাকলে এবং সমুুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসার কার্যকর উদ্যোগ নিতে না চাইলে গণনজরদারি ও বিতর্কের প্রয়োজন নেই। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ রক্ষার নজরদারি ছাড়া আমরা আমাদের সম্পদ রক্ষা করতে ও কাজে লাগাতে পারব না। দুশ্চিন্তার কারণটি সেখানেই।
কল্লোল মোস্তফা: প্রকৌশলী।
No comments