আয়নাঘরে মাইকেল চাকমা: ৫ বছরে নির্যাতনের ভয়াবহ বর্ণনা by রাশিম মোল্লা
যেভাবে গুম হন মাইকেল চাকমা: ২০১৯ সালের ৯ই এপ্রিল ইউপিডিএফ’র মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর থেকে বাসে ধানমণ্ডির কলাবাগানে নামেন। এরপর সেখান থেকে এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে নামেন। মেইন রোড পার হয়ে ফোনে উক্ত ব্যবসায়ীর নির্দেশনা মতো যেতে থাকি। হঠাৎ একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে বসা এক ভদ্রলোক তার নাম ধরে ডাকে। এমন সময় ৫-৭ জন লোক তাকে জাপটে ধরে। তাকে ধরার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা এক লোক (সাদা শার্ট পরিহিত) তাড়াতাড়ি গাড়ি পাঠান, তাড়াতাড়ি গাড়ি পাঠান বলে অন্য একজনকে ফোনে নির্দেশ দিতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে একটা মাইক্রোবাস চলে আসে। মুহূর্তেই তাকে গাড়িতে তুলে হাতকড়া পরায় এবং কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে।
৭-৯ বর্গফুটের রুমে অবর্ণনীয় অত্যাচার করতো: বিভিন্ন রাস্তায় চক্কর দিয়ে সন্ধ্যায় তাকে একটি বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন এটি থানা হবে। পরে বুঝতে পারেন এটি থানা না। একদম নীরব নিস্তব্ধ। ৭-৯ বর্গফুটের একটি রুমে তাকে আটকে রাখা হয়। রুমের ভেতরে হাতকড়া ও চেখের বাঁধন খুলে দেয়। রুমের ভেতরে ছোট্ট একটি টয়লেট ছিল। টয়লেটের কাছে একটি পানির কল ছিল। ওই কল ব্যবহার করেই সবকিছু করতে হতো। সেখানে পাশাপাশি তিনটা রুম ছিল। শেষের কোণার রুমে একজন লোক ছিল। ওই লোককে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে উল্টো দিকে ঘুরে বসে থাকতে বলা হয়। রাত ৯টার দিকে একজন লোক এসে আবার কালো কাপড় দিয়ে তার চোখ বেঁধে দেয়। তার উপর একটা কালো কাপড়ের লম্বা টুপিও পরিয়ে দেয়। তার উপর আরেকটা কালো কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। এরপর কাছাকাছি অন্য একটি রুমে নিয়ে একটা চেয়ারে বসতে দেয়া হয়। তার ডান পাশে এবং সামনে ৩-৪ জন লোক বসা ছিল। সেখানে তাকে বিশৃঙ্খলভাবে একেকজন একেকটা প্রশ্ন করতে থাকে। ইউপিডিএফ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রশ্ন করার পর আবার তাকে রুমে নিয়ে আসা হয়। পরের দিন ১০ই এপ্রিল সকালে নাস্তা খাওয়ার পর আবারো চোখ বেঁধে, লম্বা কালো টুপি পরিয়ে পাশের একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। রাতের খাবার খেয়ে ১৫-২০ মিনিট পর রাতের আজান হয়। এরইমধ্যে হঠাৎ এক ব্যক্তি এসে তাকে ঘুম থেকে তুলে আবারো হাতকড়া লাগিয়ে চোখ বেঁধে কালো টুপি পরিয়ে দেয়। হঠাৎ বাইরে একটি গাড়ির শব্দ শুনতে পাই। আমাকে ওই গাড়িতে তোলার পর খুলে দেয়া হয় মাথার কালো টুপি। তবে কিছুক্ষণ পর তাদের সঙ্গে নিয়ে আসা টুপি পরিয়ে চোখ বেঁধে দেয়। এরপর কিছুক্ষণ পর আমাকে অন্য একটা গাড়িতে তোলা হয়। এ সময় গাড়িতে উচ্চ শব্দে গান বাজানো হয়। গানের উচ্চ শব্দে বাইরের কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না। ভাঙাচোরা, উঁচু-নিচু ও আকা-বাঁকা পথ দিয়ে এক ঘণ্টার মতো সময় চলার পর গাড়িটি থামে। চারদিক নীরব, নিস্তব্ধ। আমাকে একটি ঘরে নিয়ে যায়। আমি উত্তেজিত হয়ে তাদের সঙ্গে আমাকে এখানে আনার কারণ জানতে চাই। এ সময় তারা আমার সঙ্গে কথা না বললেও শারীরিক নির্যাতন করে। একজন একটি শক্ত লাঠি দিয়ে আমার পেটে গুঁতো দেয়। আরেকজন কথা বলতে গেলে মুখের ভেতর ৫-৬ ইঞ্চি বাঁশের মতো লম্বা কিছু ঢুকিয়ে দিতো। একপর্যায়ে তারা চলে যায় এবং আমাকে রুমে নিয়ে যায়। অনেক পুরোনো ভবন, টিনশেডের ছাউনি। ওই রুমে আমার জন্য ৩/৭ ফিটের একটি চকি রাখা ছিল। শরীর অনেক ক্লান্ত থাকায় ঘুমিয়ে পড়ি। তিনদিন পর পাশের অন্য একটি বন্দিশালায় নেয়া হয়। ভবনটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। রুমের দেয়ালগুলো অসমান, ছোট ছোট বিশৃঙ্খল ঢেউয়ের মতো। এই ভবনে দশটির মতো রুম ছিল। একটা রুমে একজনকেই রাখা হতো। পাশের রুমে অন্য বন্দির শব্দ শোনা যেতো। এই ভবনের ১১৩ ও ১১৬ নম্বর রুমে আমাকে এক বছরের অধিক সময় রাখা হয়। আমার চুল-দাড়ি বড় হয়ে যায়। আয়নাঘরে (গোপন বন্দিশালায়) প্রথম দিকে খাবার কিছুটা ভালো থাকলেও পরবর্তীতে খাবারের মান খুব খারাপ হয়। বাসি-পচা খাবারও দিতো। মাসের পর মাস খাবার অনুপযোগী তরকারি দেয়া হয়েছে। সে সময় তরকারি ছাড়া শুধু ভাত খেয়ে দিন পার করেছি। ঠিকমতো ঘুমাতে দিতো না। যখন ঘুমাতে চেষ্টা করতাম, তখন ফ্যান বন্ধ করে দিতো। গরমের সময় যে ফ্যান চালু করলে বেশি গরম লাগে সে ধরনের ফ্যান চালু করে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতো। লোহার দরজায় বাড়ি দিয়ে ঘুম ভেঙে দিতো। এভাবে কয়েকটা বছর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ভীষণ অত্যাচার চালিয়েছে। শুধু তাই নয় ডিউটিম্যানদের দিয়ে খারাপ ব্যবহার করানো হতো। প্রতিকার চাইলে আরও বেশি অত্যাচার করতো। ওই সময়ের দিনগুলো ভয়ঙ্কর রকমের অসহনীয় ছিল। ওখানে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয় মনে করতাম। প্রায়ই মৃত্যুর প্রতীক্ষায় থাকতাম। শরীরের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। একপর্যায়ে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি।
গত ৬ই আগস্ট মধ্য রাতের পর আনুমানিক ৩টার দিকে আমাকে ঘুম থেকে তোলা হয়। হাতকড়া ও চোখ বেঁধে গাড়িতে তোলা হয়। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি থামে। আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে জোরে জোরে হাটিয়ে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তি শুয়ে পড়তে বলে। আধা ঘণ্টার আগে ওঠার চেষ্টা করলে গুলি করার হুমকি দেয়। আধাঘণ্টা শুয়ে থাকার পর বসার চেষ্টা করি। ভয় ছিল এই বুঝি এক্ষুনি গুলি করে মারবে। কিন্তু গুলি করছে না। সাহস করে চোখের বাঁধন খুলি। পাঁচ বছর তিন মাস পর এই প্রথম বাইরের আলো দেখা, পৃথিবী দেখা। চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখি। কিন্তু কাউকে দেখতে পাই না। সামনে শুধু সেগুন গাছের বন। এভাবেই মুক্ত হন তিনি।
No comments