আজিমপুরে কান্না আরশিনগরের হালচিত্র by আরিফুল ইসলাম
জয়নাল আবেদিন বলেন, আজিমপুর কবরস্থান থেকেই ঘাস সংগ্রহ করি। অন্য কোথাও যাই না। কারণ অনেকে ঘাসের মধ্যে সার ও বিষ দিয়ে থাকেন। সেগুলো খেয়ে যদি গরু মারা যায়। তখন খামারিরা আমাকে বিশ্বাস করবে না। ঘাস কিনবে না।
কাউকে কোনো টাকা-পয়সা বা চাঁদা দিতে হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো আমার কাছে কেউ চাঁদা বা টাকা-পয়সা দাবি করেনি। আমি নিজেই গরিব মানুষ, কে আর আমার কাছে টাকা চাইবে। চাইলেও তো আমি দিতে পারবো না। চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। ছেলে মাদ্রাসায় পড়ে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে আমার দিনগুলো।
শুক্রবার আজিমপুর কবরস্থানে সরজমিন দুপুর ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত অবস্থান করে দেখা গেছে, প্রবেশ পথের ১ নম্বর ও ২ নম্বর গেটে ভিক্ষুকদের কেউ বসে বা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কেউ আবার মেডিকেলের কাগজ নিয়ে সাহায্যের জন্য হাত পাতছেন। অনেক মহিলা কোলে বাচ্চা নিয়ে বসে রয়েছেন সাহায্যের জন্য। এভাবে বৃদ্ধ থেকে শুরু করে যুবক বয়সের নারী ও পুরুষের দেখা মিলবে প্রবেশ পথের রাস্তা ধরে যতদূর যাবেন। অনেকে মৃত মানুষের কবর জিয়ারত করতে আসছেন। কেউ আসেন মা-বাবার কবরে, কেউ ছেলে-মেয়ের, কেউ বা নিকট আত্মীয়স্বজনের কবর জিয়ারত করতে। শুক্রবার জুমার দিন হওয়ায় অন্যান্য দিনের তুলনায় মানুষজন বেশি আসেন।
লালবাগের বাসিন্দা তারিক হোসেন মায়ের কবরে এসেছেন। তিন বছর আগে তার মা স্ট্রোক করে মারা যান। প্রতি শুক্রবার তিনি জুমার নামাজ পড়ে আজিমপুর কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশে এসে দোয়া করেন। মায়ের স্মৃতিচারণ করতে করতে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
জাকি উদ্দীন রুপু নামে একজন বলেন, ভাবীর কবরে এসেছি দোয়া করতে। ভাতিজা আর আমার ছেলেকে নিয়ে এসেছি যেন তারা তাদের পূর্বপুরুষদের কবর ভুলে না যায়। এখন থেকে কবরস্থানে এনে দোয়া করা শিক্ষা দিলে ভবিষ্যতে তারা এই ধারা বজায় রাখবে।
বাবুল হোসেন এসেছেন মিরপুর থেকে। তিনি সাহায্যের জন্য মানুষের কাছে অন্য সবার মতো হাত পাতছেন না। তিনি কিছু মানুষের কাছে গিয়ে তার পেটে টিউমারের অপারেশনের মেডিকেলের কাগজপত্র দেখিয়ে সাহায্য চাচ্ছেন। সানি নামে পুরান ঢাকার এক যুবক বলেন, এখানে টাকা একটু বেশি দিলেই সামনের দিকে কবর দেয়া যায়। আমি এক বছর আগে বাবার কবরের জন্য জায়গা দেখতে চাইলে আমাকে পিছনের দিকে নতুন কবরস্থানের শেষের দিকে একদম দেয়া হয়। তবে এই কবরস্থানের একজন বলেন যদি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেশি দেন। তাহলে একদম সামনের সারিতে কবর দিতে পারবেন বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
আজিমপুর কবরস্থানের দায়িত্বে থাকা নাজমুল হুদা বলেন, এখানে কবরের জন্য ১ হাজার ৬৯২ টাকা পরিশোধ করতে হয়। কবর ইট দিয়ে প্লাস্টার করতে চাইলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক অফিস থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। সরকারি কবরস্থান হওয়ায় এখানে বিধিনিষেধ তেমন দেয়া হয় না।
উল্লেখ্য, ২৭ একর জমির ওপর আজিমপুর কবরস্থান ঢাকার পুরানো কবরস্থান। মোগল যুগে শায়েস্তা খাঁর আমলে সপ্তদশ শতাব্দীতে কবরস্থানটি চালু হয়। কবরস্থানটি পাশাপাশি দুইটি স্থানে রয়েছে। পুরাতন কবরস্থানটির জায়গা ছোট। নতুন কবরস্থানটি অনেক বড়। নতুন কবরস্থানে এখন কবর দেয়া হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন দরপত্রের মাধ্যমে প্রতি বছর একজন ঠিকাদার নিযুক্ত করে কবর দেয়ার কাজটি করে। কবর দেয়ার জন্য ব্যবহৃত বাঁশ ও চাটাই নির্দিষ্ট ঠিকাদার সরবরাহ করে। মৃত ব্যক্তির পরিবারের পক্ষ থেকে বাঁশ ও চাটাইয়ের মূল্য ঠিকাদারকে পরিশোধ করতে হয়। এজন্য সিটি করপোরেশন থেকে বাঁশ ও চাটাইয়ের একটি মূল্য বেঁধে দেয়া হয়েছে।
No comments