২০২৪: সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমালোচিত ‘পুলিশ’ by সুদীপ অধিকারী
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, তানভির আলম, মো. হোসাইন, বেসরকারি চাকরিজীবী ইফতেখার হোসেন, মো. আলতাফ, চা দোকানি মোনোয়ার হোসেন, বাহারুল আলম, ব্যবসায়ী নাসির হোসেন, মাসুদ আলম, জুয়েল হাসান, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আব্দুল মালেক, মো. হাফিজ, ইফতেখার হোসেন, জিয়ায়ুল হকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির অন্তত অর্ধশত মানুষ বলেন, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে গত বছর জুড়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ছিলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। প্রথমে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পুলিশ কমিশনার ও র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর মহাপরিচালকের দায়িত্ব শেষে ২০২০ সালের ১৫ই এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশ প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। চাকরিজীবনে বেতন-ভাতা বাবদ মোট ১ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা উপার্জনের কথা থাকলেও দুর্নীতির মাধ্যমে নিজের, স্ত্রী ও দুই সন্তানের নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক বনেছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। গোপালগঞ্জ জেলার সাহাপুর ইউনিয়নের বৈরাগীটোল গ্রামে তিনি ৬০০ বিঘার সাভানা ইকো রিসোর্ট পাশাপাশি পার্কের চারপাশে আরও ৮০০ বিঘা জমির মালিক বেনজীর। যার পরিচালনার দায়িত্বে নাম ছিল বেনজীর স্ত্রী জিশান মির্জা, বড় মেয়ে ফারহিন রিস্তা বিনতে বেনজীর এবং ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরসহ পরিবারের সদস্যদের। রাজধানীর গুলশানে একদিনে একসঙ্গে চারটি ফ্ল্যাট কিনেন এই পুলিশ মহাপরিদর্শক। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গড়েছেন বাগান বাড়ি। শুধু তাই নয়, অভিযোগ উঠে তার স্ত্রীর নামে প্রায় ১৭০০ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। দেশের বাইরেও রয়েছে সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হওয়ার পরও পুলিশ সদস্যদের সহায়তায় বিদেশে পাড়ি জমায় সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সমালোচিত আরেক পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের সাবেক প্রধান হারুন অর রশিদ। চাওর আছে ডিবি হারুন সাবেক প্রেসিডেন্টের প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকায় প্রেসিডেন্ট রিসোর্টসহ নামে বেনামে দেশ ও দেশের বাইরে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সাধারণ মানুষের ভাষ্য, ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটুয়া বাহিনীর অন্যতম নেতৃত্বদানকারী ছিলেন তিনি। এজন্যই ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে তাকে। এ ছাড়াও পুলিশের সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এসবি) মনিরুল ইসলাম, পিবিআই’র সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশীদ, সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান, ডিএমপি’র সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, আসাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, অতিরিক্ত আইজি ওয়াই এম বেলালুর রহমান, শিল্প পুলিশের প্রধান মাহবুবুর রহমান, ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার খন্দকার নূরুন্নবী, এসএম মেহেদী হাসানসহ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে অন্তত দুইশত পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আটক হয়ে কারাগারে থাকলেও বেশির ভাগ রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
উপরন্তু গত জুলাই বিপ্লবের পর পুলিশ সদস্যরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় পুরোপুরি ভেঙে পরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। লুটপাট, ডাকাতি, ছিনতাই নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে ওঠে নগরবাসীর কাছে। থানায় পুলিশ না থাকায় ডাকাত আতঙ্কে প্রতিটি এলাকায় মানুষ দলবদ্ধ হয়ে মহল্লায় মহল্লায় পাহারা পর্যন্ত বসিয়েছে। দিনে-দুপুরে বেলা খোদ রাজধানীতেই ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে লুটে নেয়া হয়েছে সর্বস্ব। বাসার বাইরে বের হয়ে নিজের গেটের সামনে থেকেই নারীর ওড়না টেনে-হিঁচড়ে ফেলে দিয়ে কেড়ে নিয়েছে যাওয়া হয়েছে ব্যাগ। একের পর এক মানুুষকে রাস্তায় ফেলে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। থানা লুটের অস্ত্র নিয়ে দু’গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধ চললেও পুলিশ কর্মকর্তারা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। তাইতো পুলিশ সদস্যদের চাঙ্গা করতে ঝড়ের গতিতে চলছে বদলি ও পদায়ন। গত ৫ই আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের প্রায় ৯০ শতাংশ সদস্যের কর্মস্থল পরিবর্তন করা হয়েছে। শুধু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশেরই ১৮ হাজারের বেশি সদস্যকে বদলি করা হয়েছে। এরপরও আগের মতো পুলিশকে কাছে পাচ্ছে না মানুষ। সাধারণ মানুষের ভেতরে সেই আগের আস্থা ফেরাতে পারেনি পুলিশ সদস্যরা।
এসব বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, জুলাই-আগস্টের ঘটনা পুলিশের জন্য লজ্জার। এ লজ্জাজনক ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের ৭২ ঘণ্টা আগেও যদি তখনকার নেতৃত্বে থাকা পুলিশ অফিসাররা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতেন, তাহলে অনেকের জীবন রক্ষা হতো। পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদেরও জীবন রক্ষা হতো। কিন্তু এরূপ সিদ্ধান্ত তখন নেয়া হয়নি। পুলিশে গত ১৫ বছরে যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তারা কি ভূমিকা রেখেছিলেন, তারা কি কর্মকাণ্ড করলেন যে, এ দেশের মানুষ পুলিশের প্রতি এত ত্যক্তবিরক্ত হলো। যার বহিঃপ্রকাশ ৪৪ পুলিশ সদস্যকে জীবন দিতে হলো, শত শত সহকর্মীকে নানাভাবে ক্ষতবিক্ষত হতে হলো। সঙ্গে পুলিশের থানা, ফাঁড়ি, অস্ত্র লুট হয়ে গেল। ডিএমপি কমিশনার বলেন, এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজেদের পুলিশ অফিসার পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করছি। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে এরূপ পুলিশ এ দেশের মানুষ দেখতে চাননি। আন্দোলনে হাজার ছাত্র-জনতার মৃত্যু দুঃখের গাঁথা রচনা করেছে। আমরা স্বাধীন দেশের পুলিশ। কী কারণে মানুষের এত ক্ষোভ পুলিশের ওপরে? পুলিশ এখনো এক ধরনের মানসিক ট্রমার মধ্যে রয়েছে। এই ট্রমা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। বের হয়ে আসার জন্য একটাই উপায়, নিজেদের মনোবল ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষকে সেবা দিতে হবে। সেবা দেয়ার মাধ্যমেই একমাত্র পুলিশের হারানো ইমেজ বা গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবো।
বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, পুলিশ সদস্যরা একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে পুলিশকে এমন কঠিন অবস্থায় আর কখনো পড়তে হয়নি। ৫ই আগস্টের আগে পুলিশ হয়ে পড়েছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের লাঠিয়াল। অতীতের কতিপয় উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তার কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আর এজন্যই পুলিশকে জনরোষের শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের নেতৃত্বস্তর ভেঙে পড়ে এবং জন আস্থা থেকে ছিটকে পড়ে। সাধারণ মানুষ তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। এ ছাড়াও বদলি হওয়া পুলিশের রাজধানীর বস্তি, ঘুপচি ও অলিগলি না চেনা ছাড়াও পরিচিত লোকদের মাধ্যমে অপরাধ জগতে তারা নতুন সোর্স এখনো তৈরি করতে পারেনি। ফলে সোর্স নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়েছে। ফলে আসামি ধরা বা মামলার তদন্তে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাই আমরা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে একজন কনস্টেবল পর্যন্ত যোগাযোগ বাড়িয়েছি। তাদের মনোবল ফেরানোর চেষ্টা করছি। এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পুলিশকে সুসংগঠিত করা, তাদের মনোবল ফিরিয়ে আনা ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা। প্রত্যেকটি থানায় নাগরিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই কাজ করছেন। পুলিশ যাতে আর কখনো জনবিরোধী অবস্থানে ফিরে যেতে না পারে, সেই লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
অপরদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, ঢাকার প্রায় সব পুলিশকে আমরা চেঞ্জ করছি। তাদের কিন্তু অলিগলি চিনতে সময় লাগবে। তাদের ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে কিছুটা সময় লাগছে।
No comments