পাকিস্তানে দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাতদের বিরুদ্ধে ইমরান খানের লড়াই by ইকরাম সেহগাল
রানা সানাউল্লাহ |
পাকিস্তানের
বিগত নির্বাচনে তেহরিক-ই-ইনসাফ দলের বিজয়কে মেনে নেয়নি দেশের বিরোধী
রাজনৈতিক দলগুলো। বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকে ‘পাতানো’ আখ্যা দিয়ে ইমরান খান
সরকারের গ্রহণযোগ্যতাকে নস্যাতের চেষ্টা করছে এবং ইমরান খানকে ‘বাছাইকৃত’
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করছে, ‘নির্বাচিত’ হিসেবে নয়।
এই সব করা হচ্ছে কারচুপির কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই।
গণতন্ত্র এখানে অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতার মতো, কার্যকর কোন সিস্টেম নয় যেটা দেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে এবং জনগণের জীবনমানের উন্নতি করবে। পাকিস্তানের গণতন্ত্র দেশের অধিকাংশ জনগণকে অবজ্ঞা করে ক্ষুদ্র একটা ক্ষমতাসীন অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সেই উদ্দেশ্য ঠিক রাখতেই জনগণকে অশিক্ষিত করে রাখা হয়েছে যাতে তারা প্রতিবাদে না নামে এবং দেশের অর্জনে নিজেদের অংশ দাবি করতে না পারে। পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বিখণ্ডিত। যেখানে একটি অংশ পরিচালিত হচ্ছে, এর প্রাথমিক অংশটা চালাচ্ছে সরকার, এবং অন্য অংশটা চলছে প্রাইভেট খাতের মাধ্যমে। দ্বিতীয় অংশটা ভালো কিন্তু শুধু অভিজাত শ্রেণীই সেখানে পড়ার সামর্থ রাখে।
দেশের ঐতিহ্যগত জমিদার সামন্ত এবং উপজাতীয় অভিজাতদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতেই বহু দশক ধরে এই দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে।
অভিজাত শ্রেণী তাদের ক্ষমতাকে সম্পদ অর্জন এবং বিত্ত বৈভবের জীবন কাটানোর জন্য কাজে লাগিয়ে আসছে, দেশের উন্নয়নের জন্য নয়। শিল্পায়ন ভিত্তিক কোন অর্থনীতি এখানে গড়ে তোলা হয়নি কারণ সেখানে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মশক্তি দরকার। বরং ভোক্তা-মুখী একটা অর্থনীতি এখানে দাঁড় করানো হয়েছে, অর্থ ঋণ দেয়ার উপর ভিত্তি করে যেটা গড়ে উঠেছে।
আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ঋণ নেয়া হয়েছে, যেটা অভিজাতদের স্বার্থ ভালোমতোই রক্ষা করেছে। পণ্য উৎপাদন ও সেবা খাতগুলো শেখার আগেই পাকিস্তান একটা ভোক্তা সমাজে রূপ নিয়েছে। দেশে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ এসেছে, তার বিরাট একটা অংশই চলে গেছে ক্ষমতাসীন শ্রেণীর পকেটে।
ঋণের পরিমাণ বেড়ে এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে নিয়মিত ঋণ পরিশোধের জন্য বাজেটের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে এবং দেশের সামাজিক খাত যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দারিদ্র বিমোচন এবং অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি ও শিল্প বিনির্মাণের মতো প্রয়োজনীয় খাতে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না এবং সেগুলো করতে গিয়ে আরও ঋণ ও ধারকর্জ করতে হচ্ছে।
অভিজাত শ্রেণী চুরি করা অর্থের যে পাহাড় গড়েছে, সেটা দিয়ে আমদানি করা পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু এই অর্থের বড় একটা অংশ দেশের বাইরে সরিয়ে নিয়ে বিদেশী অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়েছে এবং বিদেশে সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
অধিকাংশ পাকিস্তানী নাগরিক দরিদ্র, তারা দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা সংখ্যালঘু শ্রেণী চুরি করা অর্থ দিয়ে অস্বাভাবিক ধনী হয়ে গেছে।
বহু দশক ধরে এই অপকর্মগুলো বাধাহীনভাবে চলেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার সততার সাথে ক্রমবর্ধমান ঋণের এই অশুভ চক্রকে পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছে, যেটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দুর্নীতি।
বর্তমান যে জবাবদিহীতার অভিযান শুরু হয়েছে, সেটা শুধু অর্থনীতিকে স্বচ্ছ পথে নিয়ে আসার জন্য এবং চুরি করা অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্যেই জরুরি নয়, বরং দুর্নীতিগ্রস্ততের শাস্তি দেয়ার জন্যও সেটা প্রয়োজন।
একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলা বেশ কিছুকাল ধরে যেটার তদন্ত চলছে – এবং এটা বর্তমান সরকারের আগে থেকেই চলে আসছে – সেটা হলো কিভাবে ভুয়া একাউন্টের মাধ্যমে চুরি করা ও কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ বিদেশে পাঠানো হয়েছে, সেটাকে চিহ্নিত করা।
ভুয়া একাউন্টের বিষয়টি নজরে আসে, যখন অন্য একটি মামলায় বিখ্যাত একটি মানি চেঞ্জারের বিষয়ে অনুসন্ধান করছিল গোয়েন্দা সংস্থা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে, ফেডারেল ইনভেস্টিগেশান এজেন্সি (এফআইএ) কিছু ব্যাংক একাউন্টের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে, যেগুলোর মাধ্যমে বহু বিলিয়ন রুপি লেনদেন করা হয়েছে। তদন্তকারীরা ২৯টি একাউন্টকে চিহ্নিত করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে ৩৫ বিলিয়ন রুপি অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে।
কিন্তু এটা শুধুমাত্র বরফশৈলীর চুড়া মাত্র। ২০১৮ সালে, তদন্তের গতি বাড়ানোর জন্য একটা জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশান টিম (জেআইটি) গঠন করা হয়। জেআইটি তদন্তের শুরুতে আরও ১১,৫০০ ব্যাংক একাউন্ট এবং ৯২৪ জন একাউন্টধারীকে চিহ্নিত করে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারি ও তার পরিবারের সদস্যদের নামও তদন্তে উঠে আসে। এর আগেই বহু বিলিয়ন রুপি মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে যে কোম্পানির নাম উঠে এসেছিল, তাদের সাথে উঠে আসে এম/এস ল্যান্ডমার্কস এবং ন্যাশনাল গ্যাসেস (প্রাইভেট) লিমিটেডের (এম/এস এনজিএস) নাম।
এম/এস ল্যান্ডমার্কসের মালিক হলেন জারদারি, তার বোন ফারিয়াল তালপুর এবং আজরা পেচুহো এখানে অংশীদার। ফেডারেল ইনভেস্টিগেশান এজেন্সি (এফআইএ) যখন ওমনি গ্রুপের মালিকানাধীন খোসকি সুগার মিলসের তল্লাসি চালায়, তখন হার্ডডিস্কে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এই দুটো কোম্পানির তথ্য উদ্ঘাটিত হয়।
জারদারি পরিবার জারদারি উপজাতির প্রধান। এটা নওয়াবশাহ জেলার একটি সিন্ধ-বালুচ উপজাতি গ্রুপ যাদের মালিকানায় রয়েছে হাজার হাজার একর জমি এবং সেখানে কর্মরত কৃষকরা। ১৯৮৫ সাল নাগাদ জারদারি গোষ্ঠির লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০,০০০, এখন যেটা সম্ভবত দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই জনগোষ্ঠি সামন্তবাদী জারদারি পরিবারের জন্য একটা ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করেছে, যেটা তাদের ক্ষমতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
সিন্ধের আরেকটি সামন্তবাদী জমিদার ভুট্টো পরিবারে বিয়ের মাধ্যমে জারদারি পরিবারের অর্থ রোজগারের পথ আরও উন্মুক্ত হয়ে গেছে এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচারও সহজ হয়ে গেছে।
এ রকম শক্তিধর পরিবারের সদস্যদের শুধুমাত্র আদালতে নিয়ে আসাটাও কোন ছোটখাটো অর্জন নয়।
মাদক মামলায় পিএমএল (এন) দলের রানা সানাউল্লাহ’র গ্রেফতারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তার বিরুদ্ধে বহু হত্যা ও মারামারির অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই। অনেকটা আল কানোপের মতোই সে সাক্ষীদের ভয় ভীতি দেখাতো, যাতে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস না পায়।
সম্প্রতি, এন্টি-ন্যার্কোটিক্স ফোর্স (এএনএফ) কিছু মাদক পাচারকারীকে ধরেছে, যারা দাবি করেছে যে, তারা রানার নির্দেশে ‘তহবিল সংগ্রহের’ জন্যই এটা করেছে। এটা মনে করা হচ্ছে যে, যখন রানা সানাউল্লাহকে ফয়সালাবাদ থেকে লাহোরে বহনকারী গাড়িকে আটকানো হয়, তখন গাড়িতে বিপুল পরিমাণ মাদক ছিল।
হত্যা, ঘুষগ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বহুবার ফসকে গেছে রানা। এখন দেখার বিষয়, এ বার কিভাবে সে ছাড়া পায়।
সে ধরা পড়ায় শরীফ পরিবারের জন্য সেটা একটা মহাবিপর্যয়। তাদের মাফিয়া স্টাইলের রাজনৈতিক আমলে রানা সানাউল্লাহ ছিল তাদের অন্যতম প্রধান শক্তি। শরীফরা কিভাবে তাদের এমএনএ এবং এমপিএগুলো ঠিক রাখবে যেখানে রানার অস্ত্র তাদেরকে পাহারা দিচ্ছে না? আরও মারাত্মক হলো, তাদের অপরাধের কতজন সহযোগী/সহকারী এখন ন্যাশনার একাউন্টেবিলিটি ব্যুরোতে গিয়ে তাদের অপরাধের সাক্ষ্য দেবে, যখন তাদের ‘মূল-শক্তি প্রয়োগকারী’ই আটকা পড়ে গেছে?
এনএবি এবং তাদের আদালতগুলো এখন যে কাজটা করছে, সেটা জারদারিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বিষয় নয়। বরং দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংকে নির্মূল করার জন্যই একটা করা দরকার, যেটা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
আরও বহু কালপ্রিট অবাধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদেরকেও বিচারের সামনে আনতে হবে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। চরম শক্তিধররাই যেখানে দুর্নীতিতে ডুবে আছে, সেখানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার। এর একটা পদক্ষেপ হতে পারে ভুয়া একাউন্ট ও ফার্মগুলোকে নির্মূল করে অর্থের পাচার বন্ধ করা।
সৎভাবে উপার্জিত অর্থ ও করদাতাদের অর্থ রক্ষায় রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অসৎভাবে উপার্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতারণার দায়ে হাজার হাজার অভিজাতদের কারাদণ্ড হওয়া উচিত। তখনই কেবল পাকিস্তান তার চুরি যাওয়া সম্পদ ফিরে পেতে পারে।
>>>লেখক একজন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
এই সব করা হচ্ছে কারচুপির কোন তথ্য প্রমাণ ছাড়াই।
গণতন্ত্র এখানে অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতার মতো, কার্যকর কোন সিস্টেম নয় যেটা দেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে এবং জনগণের জীবনমানের উন্নতি করবে। পাকিস্তানের গণতন্ত্র দেশের অধিকাংশ জনগণকে অবজ্ঞা করে ক্ষুদ্র একটা ক্ষমতাসীন অভিজাত শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
সেই উদ্দেশ্য ঠিক রাখতেই জনগণকে অশিক্ষিত করে রাখা হয়েছে যাতে তারা প্রতিবাদে না নামে এবং দেশের অর্জনে নিজেদের অংশ দাবি করতে না পারে। পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বিখণ্ডিত। যেখানে একটি অংশ পরিচালিত হচ্ছে, এর প্রাথমিক অংশটা চালাচ্ছে সরকার, এবং অন্য অংশটা চলছে প্রাইভেট খাতের মাধ্যমে। দ্বিতীয় অংশটা ভালো কিন্তু শুধু অভিজাত শ্রেণীই সেখানে পড়ার সামর্থ রাখে।
দেশের ঐতিহ্যগত জমিদার সামন্ত এবং উপজাতীয় অভিজাতদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতেই বহু দশক ধরে এই দুই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে।
অভিজাত শ্রেণী তাদের ক্ষমতাকে সম্পদ অর্জন এবং বিত্ত বৈভবের জীবন কাটানোর জন্য কাজে লাগিয়ে আসছে, দেশের উন্নয়নের জন্য নয়। শিল্পায়ন ভিত্তিক কোন অর্থনীতি এখানে গড়ে তোলা হয়নি কারণ সেখানে শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মশক্তি দরকার। বরং ভোক্তা-মুখী একটা অর্থনীতি এখানে দাঁড় করানো হয়েছে, অর্থ ঋণ দেয়ার উপর ভিত্তি করে যেটা গড়ে উঠেছে।
আইএমএফ এবং বিশ্ব ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ঋণ নেয়া হয়েছে, যেটা অভিজাতদের স্বার্থ ভালোমতোই রক্ষা করেছে। পণ্য উৎপাদন ও সেবা খাতগুলো শেখার আগেই পাকিস্তান একটা ভোক্তা সমাজে রূপ নিয়েছে। দেশে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ এসেছে, তার বিরাট একটা অংশই চলে গেছে ক্ষমতাসীন শ্রেণীর পকেটে।
ঋণের পরিমাণ বেড়ে এমন একটা পর্যায়ে চলে গেছে যে নিয়মিত ঋণ পরিশোধের জন্য বাজেটের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে এবং দেশের সামাজিক খাত যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, দারিদ্র বিমোচন এবং অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি ও শিল্প বিনির্মাণের মতো প্রয়োজনীয় খাতে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন, সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না এবং সেগুলো করতে গিয়ে আরও ঋণ ও ধারকর্জ করতে হচ্ছে।
অভিজাত শ্রেণী চুরি করা অর্থের যে পাহাড় গড়েছে, সেটা দিয়ে আমদানি করা পণ্য ব্যবহারের মাধ্যমে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে। কিন্তু এই অর্থের বড় একটা অংশ দেশের বাইরে সরিয়ে নিয়ে বিদেশী অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়েছে এবং বিদেশে সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে।
অধিকাংশ পাকিস্তানী নাগরিক দরিদ্র, তারা দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে। কিন্তু ক্ষুদ্র একটা সংখ্যালঘু শ্রেণী চুরি করা অর্থ দিয়ে অস্বাভাবিক ধনী হয়ে গেছে।
বহু দশক ধরে এই অপকর্মগুলো বাধাহীনভাবে চলেছে। কিন্তু বর্তমান সরকার সততার সাথে ক্রমবর্ধমান ঋণের এই অশুভ চক্রকে পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করছে, যেটার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে দুর্নীতি।
বর্তমান যে জবাবদিহীতার অভিযান শুরু হয়েছে, সেটা শুধু অর্থনীতিকে স্বচ্ছ পথে নিয়ে আসার জন্য এবং চুরি করা অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্যেই জরুরি নয়, বরং দুর্নীতিগ্রস্ততের শাস্তি দেয়ার জন্যও সেটা প্রয়োজন।
একটা গুরুত্বপূর্ণ মামলা বেশ কিছুকাল ধরে যেটার তদন্ত চলছে – এবং এটা বর্তমান সরকারের আগে থেকেই চলে আসছে – সেটা হলো কিভাবে ভুয়া একাউন্টের মাধ্যমে চুরি করা ও কর ফাঁকি দিয়ে অর্থ বিদেশে পাঠানো হয়েছে, সেটাকে চিহ্নিত করা।
ভুয়া একাউন্টের বিষয়টি নজরে আসে, যখন অন্য একটি মামলায় বিখ্যাত একটি মানি চেঞ্জারের বিষয়ে অনুসন্ধান করছিল গোয়েন্দা সংস্থা। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে, ফেডারেল ইনভেস্টিগেশান এজেন্সি (এফআইএ) কিছু ব্যাংক একাউন্টের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে, যেগুলোর মাধ্যমে বহু বিলিয়ন রুপি লেনদেন করা হয়েছে। তদন্তকারীরা ২৯টি একাউন্টকে চিহ্নিত করেছে, যেগুলোর মাধ্যমে ৩৫ বিলিয়ন রুপি অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে।
কিন্তু এটা শুধুমাত্র বরফশৈলীর চুড়া মাত্র। ২০১৮ সালে, তদন্তের গতি বাড়ানোর জন্য একটা জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশান টিম (জেআইটি) গঠন করা হয়। জেআইটি তদন্তের শুরুতে আরও ১১,৫০০ ব্যাংক একাউন্ট এবং ৯২৪ জন একাউন্টধারীকে চিহ্নিত করে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ জারদারি ও তার পরিবারের সদস্যদের নামও তদন্তে উঠে আসে। এর আগেই বহু বিলিয়ন রুপি মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে যে কোম্পানির নাম উঠে এসেছিল, তাদের সাথে উঠে আসে এম/এস ল্যান্ডমার্কস এবং ন্যাশনাল গ্যাসেস (প্রাইভেট) লিমিটেডের (এম/এস এনজিএস) নাম।
এম/এস ল্যান্ডমার্কসের মালিক হলেন জারদারি, তার বোন ফারিয়াল তালপুর এবং আজরা পেচুহো এখানে অংশীদার। ফেডারেল ইনভেস্টিগেশান এজেন্সি (এফআইএ) যখন ওমনি গ্রুপের মালিকানাধীন খোসকি সুগার মিলসের তল্লাসি চালায়, তখন হার্ডডিস্কে প্রাপ্ত তথ্য থেকে এই দুটো কোম্পানির তথ্য উদ্ঘাটিত হয়।
জারদারি পরিবার জারদারি উপজাতির প্রধান। এটা নওয়াবশাহ জেলার একটি সিন্ধ-বালুচ উপজাতি গ্রুপ যাদের মালিকানায় রয়েছে হাজার হাজার একর জমি এবং সেখানে কর্মরত কৃষকরা। ১৯৮৫ সাল নাগাদ জারদারি গোষ্ঠির লোকসংখ্যা ছিল প্রায় ৭০,০০০, এখন যেটা সম্ভবত দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই জনগোষ্ঠি সামন্তবাদী জারদারি পরিবারের জন্য একটা ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করেছে, যেটা তাদের ক্ষমতাকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
সিন্ধের আরেকটি সামন্তবাদী জমিদার ভুট্টো পরিবারে বিয়ের মাধ্যমে জারদারি পরিবারের অর্থ রোজগারের পথ আরও উন্মুক্ত হয়ে গেছে এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচারও সহজ হয়ে গেছে।
এ রকম শক্তিধর পরিবারের সদস্যদের শুধুমাত্র আদালতে নিয়ে আসাটাও কোন ছোটখাটো অর্জন নয়।
মাদক মামলায় পিএমএল (এন) দলের রানা সানাউল্লাহ’র গ্রেফতারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তার বিরুদ্ধে বহু হত্যা ও মারামারির অভিযোগ রয়েছে, কিন্তু যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই। অনেকটা আল কানোপের মতোই সে সাক্ষীদের ভয় ভীতি দেখাতো, যাতে কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস না পায়।
সম্প্রতি, এন্টি-ন্যার্কোটিক্স ফোর্স (এএনএফ) কিছু মাদক পাচারকারীকে ধরেছে, যারা দাবি করেছে যে, তারা রানার নির্দেশে ‘তহবিল সংগ্রহের’ জন্যই এটা করেছে। এটা মনে করা হচ্ছে যে, যখন রানা সানাউল্লাহকে ফয়সালাবাদ থেকে লাহোরে বহনকারী গাড়িকে আটকানো হয়, তখন গাড়িতে বিপুল পরিমাণ মাদক ছিল।
হত্যা, ঘুষগ্রহণ ও দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বহুবার ফসকে গেছে রানা। এখন দেখার বিষয়, এ বার কিভাবে সে ছাড়া পায়।
সে ধরা পড়ায় শরীফ পরিবারের জন্য সেটা একটা মহাবিপর্যয়। তাদের মাফিয়া স্টাইলের রাজনৈতিক আমলে রানা সানাউল্লাহ ছিল তাদের অন্যতম প্রধান শক্তি। শরীফরা কিভাবে তাদের এমএনএ এবং এমপিএগুলো ঠিক রাখবে যেখানে রানার অস্ত্র তাদেরকে পাহারা দিচ্ছে না? আরও মারাত্মক হলো, তাদের অপরাধের কতজন সহযোগী/সহকারী এখন ন্যাশনার একাউন্টেবিলিটি ব্যুরোতে গিয়ে তাদের অপরাধের সাক্ষ্য দেবে, যখন তাদের ‘মূল-শক্তি প্রয়োগকারী’ই আটকা পড়ে গেছে?
এনএবি এবং তাদের আদালতগুলো এখন যে কাজটা করছে, সেটা জারদারিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার বিষয় নয়। বরং দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংকে নির্মূল করার জন্যই একটা করা দরকার, যেটা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
আরও বহু কালপ্রিট অবাধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এদেরকেও বিচারের সামনে আনতে হবে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। চরম শক্তিধররাই যেখানে দুর্নীতিতে ডুবে আছে, সেখানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার। এর একটা পদক্ষেপ হতে পারে ভুয়া একাউন্ট ও ফার্মগুলোকে নির্মূল করে অর্থের পাচার বন্ধ করা।
সৎভাবে উপার্জিত অর্থ ও করদাতাদের অর্থ রক্ষায় রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অসৎভাবে উপার্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। প্রতারণার দায়ে হাজার হাজার অভিজাতদের কারাদণ্ড হওয়া উচিত। তখনই কেবল পাকিস্তান তার চুরি যাওয়া সম্পদ ফিরে পেতে পারে।
>>>লেখক একজন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
No comments