অকার্যকর মেগা সিটি -গার্ডিয়ানের রিপোর্ট
বর্ষা
মৌসুম সমাগত। বাংলাদেশে এ সময় টানা বৃষ্টি হয়। এক মাসে কয়েকবার পানিতে
নিমজ্জিত হয় ঢাকা শহর। ধারণক্ষমতার চেয়ে পানির চাপ বেশি থাকায় ড্রেনগুলো
বন্ধ হয়ে যায়। শহরের নিম্ন এলাকা পানিতে এমনভাবে সয়লাব থাকে যে, দেখে মনে
হয় সেটা একটি বাথটাব। এ নিয়ে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো আক্ষেপ করে শিরোনাম
করে ‘ঢাকা আন্ডারওয়াটার এগেইন’ (আবারো পানির নিচে ঢাকা)। রাস্তার পাশে এ
সময় নেমে পড়েন পয়ঃপ্রণালী পরিষ্কারকারীরা। তাদের কেউ কেউ ম্যানহোলের ভেতর
বাঁশের লাঠি ঢুকিয়ে দিয়ে চেষ্টা করেন পানি চলাচলের পথ ঠিক করতে। অন্যরা তো
অর্ধনগ্ন হয়ে তরল গাদে নেমে পড়েন। খালি হাতে তারা সেখান থেকে তুলে আনেন
থলথলে আঁঠালো কাদার মতো ময়লা। গত বছর গলা পরিমাণ ময়লার ভেতর এসব শ্রমিক
ডুবে কাজ করার ছবি ভাইরাল হয় বিশ্বজুড়ে। তখন এ কাজটিকে বিশ্বমিডিয়া বিশ্বের
সবচেয়ে জঘন্য কাজ আখ্যায়িত করে। আসন্ন বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে দীর্ঘ এক
প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছে লন্ডনের অনলাইন দ্য গার্ডিয়ান। ইউএন হ্যাবিটেটের
মতে, বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ ঢাকা। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে
বসবাস করছে ৪৪ হাজার ৫০০ মানুষ। তার ওপর প্রতিদিন গ্রাম থেকে আসা মানুষের
সংখ্যা বাড়ছে। এমন চাপের মুখে আক্ষরিক অর্থেই রাজধানী শহর ভেঙে পড়ছে। একই
অবস্থা হচ্ছে পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালীর। এগুলো পরিষ্কার করেন যেসব শ্রমিক তাদের
মাসিক আয় প্রায় ২২৫ পাউন্ড। তারা স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে এসব পরিষ্কার করেন।
আর বসবাস করেন নাজুক অবকাঠামোতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাচ্ছন্দ্যে কোনো
স্থানে যে পরিমাণ মানুষ বাস করতে পারেন তার চেয়ে বেশি মানুষ যদি বসবাস করেন
তাহলে তাকে ঘনবসতিপূর্ণ বা ‘ওভারপপুলেশন’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই হিসাবে
ঢাকা হতে পারে পাঠ্যবইয়ের উদাহরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স
বিভাগের প্রজেক্ট পরিচালক প্রফেসর নুরুন নবী বলেছেন, বিশ্বে ঢাকার চেয়ে
আকারে বড় অনেক শহর আছে। কিন্তু আপনি যদি ঢাকা শহরের চরিত্র ও প্রকৃতি
সম্পর্কে কথা বলেন, সেক্ষেত্রে ঢাকা হলো দ্রুত বেড়ে ওঠা এক মেগাসিটি। এটা
হলো জনসংখ্যার দিক থেকে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন পরিচ্ছন্নকর্মীর বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়। তাদের একজন সুজন লাল রাউত। তিনি কয়েক দশক ধরে ঢাকায় সুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করেন। এ সময়ে অনেক বিপর্যয় দেখেছেন তিনি। তার মধ্যে ২০০৮ সালের ট্র্যাজেডি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ওই সময় যথারীতি ভারি বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে যায়। তখন রামপুরায় আটকে থাকা পানি চলাচলের জন্য সুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেয়া হয় সাত শ্রমিককে। সাধারণত শ্রমিকরা এসব কাজ করতে যখন নামেন তখন তাদের শরীর উপর থেকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, যাতে পানির তীব্র স্রোত তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে বা ডুবে না যান। কিন্তু ওই গ্রুপটি কাজে ছিল নতুন। সুজন বলেন, তারা জানতেন না কীভাবে বিপদ মোকাবিলা করতে হয়। ওই পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করতে হয়। সুয়ারেজের পানিতে ডুবে যান ওই শ্রমিকরা। পথযাত্রীরা হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে রাস্তা খুঁড়ে তাদের তিন শ্রমিককে মৃত অবস্থায় বের করে আনেন। আরো চারজনকে পাওয়া যায় গুরুতর আহত অবস্থায়। তাদের মধ্যে একজন পরবর্তীতে হাসপাতালে মারা যান। সুজন বলেন, ওই দুর্ঘটনা আমাদের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। কয়েক মাস ধরে আমরা ড্রেনের ভেতর তাকাতেও ভয় পেতাম। সুজন জানান, বাংলাদেশ সরকার ঢাকা শহর সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার চেষ্টা করছে। তবে এখন পর্যন্ত সে কাজে প্রত্যাশানুযায়ী সফল হয়ে ওঠতে পারেনি।
এই কাজ করতে আমি বাধ্য: বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম। ড্রেন বা নর্দমা পরিষ্কারকদের বেশিরভাগও মুসলিম। কিন্তু সুজন একজন হিন্দু। তার ওপর তিনি একজন দলিত। পুরো এশিয়াজুড়ে তারা ‘অচ্ছুৎ’ হিসেবেই পরিচিত। এই সমপ্রদায়ের বেশিরভাগকেই দাসোচিত কাজ করতে দেখা যায়। এমনিতে তাদের অবমাননা করে ‘মেথর’ (যারা বিষ্ঠা পরিষ্কার করে) বলেও ডাকা হয়। ৪০ বছর বয়সী সুজন জানান, তার পূর্বপুরুষরাও তার মতো একই কাজ করতো। একই ধারায় তিনিও এই কাজ করে চলেছেন। তিনি বলেন, আমার আর কোনো কাজ করার দক্ষতা নেই। আমাকে একটা পরিবার সামলাতে হয়। সন্তানদের শিক্ষার দিক দেখতে হয়। মাস শেষে বাড়ি ভাড়াসহ বিল পরিশোধ করতে হয়। আমি জানি যে, এই কাজ আমার জন্য অসম্মান ও মর্যাদাহানি বয়ে আনে। কিন্তু, আমি এই কাজ করতে বাধ্য।
এই কাজে কৃতজ্ঞতা নেই, আছে ঝুঁকি। সমপ্রতি একটি মলশোধনী ট্যাংক পরিষ্কার করার সময় ট্যাংকটি বিস্ফোরিত হয়ে সুজনের এক বন্ধু নিহত হয়। তাদেরকে কাজ করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয় না। সুজন বলেন, আমাদেরকে শুধু কাজ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাই আমরা লোকজন ঠিক করে যত দ্রুত সম্ভব তা শেষ করার চেষ্টা করি। এসবের পাশাপাশি স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি তো আছেই। সুজন বলেন, নর্দমাগুলো পচা, বিষাক্ত ময়লায় ভর্তি থাকে। সেগুলো পরিষ্কার করতে গেলে স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। বিশেষ করে, চামড়াজনিত সমস্যায় ভুগতে হয় পরিষ্কারকারীদের। বেশিরভাগ সময় তারা এই সমস্যা বোঝে না। তারা হয়তো স্থানীয় মদ কিনবে, গিলবে, কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করবে, একসময় ঘুমিয়ে পড়বে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিরতরে বিদায় নেবে।
বসবাসের অযোগ্য শহর: বর্তমানে ঢাকার রাস্তায় খালি রাস্তা অনেকটা অমাবস্যার চাঁদের মতো হলেও সবসময় এমনটা ছিল না। অধ্যাপক নুরুন নবী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে, ’৬০-এর দশকে ঢাকার খালি রাস্তায় গাড়ি চালানো যেত। শহরের পুরাতন অংশে মোঘল আমলের খালগুলোতে মানুষজন গোসল করতে পারতো। তবে উন্নয়নের খাতিরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। খালগুলো ভরাট হয়েছে। আর এতে করে নষ্ট হয়েছে নিষ্কাশনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসের। বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতন, বাংলাদেশও দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার হয়েছে। সৌভাগ্যের খোঁজে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ রাজধানীতে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু তাদের জায়গা দেয়ার মতন অবকাঠামো তৈরি হয়নি। আর ঢাকা ব্যতিত ভিন্ন শহরগুলোতে বিনিয়োগের তীব্র অভাব এই সংকট আরো প্রকট করে তুলেছে। নবী বলেন, আপনি ভারতে যান, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। সেখানে আপনি কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদসহ বাস করার মতো অনেক শহর পাবেন। আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু এখানে, আমাদের কাছে এখনো (বাস করার জন্য) কেবল ঢাকাই আছে।
নবী জানান, ঢাকায় বেশ কয়েকটি সংগঠন ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী। আর এ কারনে ব্যবস্থাপনা মূলত বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হচ্ছে প্রধান বাধাগুলোর একটি। ঢাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য বর্তমানে সাতটি ভিন্ন সরকারি বিভাগ কাজ করছে। এই সংগঠনগুলো একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর এক হাস্যকর খেলায় মেতে থাকে। এদের মধ্যে রয়েছেন শহরের দুই মেয়রও। গত জুলাইয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন রাস্তায় হাটুপানিতে দাঁড়িয়ে বলেন, ওয়াসা(ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড সুয়েজ অথরিটি) এর জন্য দায়ী কিন্তু তাদেরকে তেমন একটাব কাজে দেখা যায়না। পালটা জবাবে, ওয়াসা খোকনের ওপর দোষ চাপায়। অন্যদিকে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ক্রোধ নিয়ে এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করে বসেন, কেউ আমাকে বলুন সমাধান কি?
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম খান বলেন, নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক উৎসের স্বল্পতা থাকায় সরকারকে কয়েক কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইন ব্যবহার করে পানি শহরের বাইরে বের করতে হয়। এছাড়া তিনি জনবহুলতাকেও দোষ দেন। তিনি বলেন, আগে আমরা ৬০ লাখ মানুষের জন্য কাজ করতাম। কিন্ত এখন আমাদের ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জন্য কাজ করতে হয়। আর একারণে পানি ধারনের প্রাকৃতিক উৎস ও ড্রেন সিস্টেম ধংস হয়ে যাচ্ছে। সেখানে স্থাপিত হচ্ছে বসতবাড়ি। ২০১৩ সালে ঢাকায় খাল খননের একটি চুক্তি করা হয়। তবে সে কাজে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এদিকে, বহুদিন ধরে ভুগলেও পরিবর্তন আসছেনা ড্রেন পরিষ্কারকের ভাগ্যে। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঢাকা শহর যত বড় হচ্ছে এখানে অসমতাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুজনের জানান, তার সমপ্রদায় মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মের লোক দিয়েই ভরা। তিনি বলেন, কেউ আমাদের দুর্দশার কথা শুনতে আসেনা, সাংবাদিকরাও না। তার মেয়েরা স্কুলে পড়ে। অথচ তাদেরকে বন্ধুদের কাছে বাবার পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয়। সুজন বলেন, আমার সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারে। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই তাদের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয়। নয়তো তারা অপমানিত হতে পারে বা তাদেরকে সবাই এড়িয়ে চলতে পারে। সুজন বলেন, ‘পুরো সিস্টেম আমাদের বিপক্ষে। আমাদের উন্নতির বিপক্ষে, আমাদের উন্নয়নের বিপক্ষে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সমপ্রদায়ের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।’
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বেশ কয়েকজন পরিচ্ছন্নকর্মীর বিষয়ে তথ্য তুলে ধরা হয়। তাদের একজন সুজন লাল রাউত। তিনি কয়েক দশক ধরে ঢাকায় সুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করেন। এ সময়ে অনেক বিপর্যয় দেখেছেন তিনি। তার মধ্যে ২০০৮ সালের ট্র্যাজেডি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। ওই সময় যথারীতি ভারি বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে যায়। তখন রামপুরায় আটকে থাকা পানি চলাচলের জন্য সুয়ারেজ লাইন পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেয়া হয় সাত শ্রমিককে। সাধারণত শ্রমিকরা এসব কাজ করতে যখন নামেন তখন তাদের শরীর উপর থেকে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়, যাতে পানির তীব্র স্রোত তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে না পারে বা ডুবে না যান। কিন্তু ওই গ্রুপটি কাজে ছিল নতুন। সুজন বলেন, তারা জানতেন না কীভাবে বিপদ মোকাবিলা করতে হয়। ওই পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করতে হয়। সুয়ারেজের পানিতে ডুবে যান ওই শ্রমিকরা। পথযাত্রীরা হাতুড়ি আর শাবল দিয়ে রাস্তা খুঁড়ে তাদের তিন শ্রমিককে মৃত অবস্থায় বের করে আনেন। আরো চারজনকে পাওয়া যায় গুরুতর আহত অবস্থায়। তাদের মধ্যে একজন পরবর্তীতে হাসপাতালে মারা যান। সুজন বলেন, ওই দুর্ঘটনা আমাদের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। কয়েক মাস ধরে আমরা ড্রেনের ভেতর তাকাতেও ভয় পেতাম। সুজন জানান, বাংলাদেশ সরকার ঢাকা শহর সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার চেষ্টা করছে। তবে এখন পর্যন্ত সে কাজে প্রত্যাশানুযায়ী সফল হয়ে ওঠতে পারেনি।
এই কাজ করতে আমি বাধ্য: বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলিম। ড্রেন বা নর্দমা পরিষ্কারকদের বেশিরভাগও মুসলিম। কিন্তু সুজন একজন হিন্দু। তার ওপর তিনি একজন দলিত। পুরো এশিয়াজুড়ে তারা ‘অচ্ছুৎ’ হিসেবেই পরিচিত। এই সমপ্রদায়ের বেশিরভাগকেই দাসোচিত কাজ করতে দেখা যায়। এমনিতে তাদের অবমাননা করে ‘মেথর’ (যারা বিষ্ঠা পরিষ্কার করে) বলেও ডাকা হয়। ৪০ বছর বয়সী সুজন জানান, তার পূর্বপুরুষরাও তার মতো একই কাজ করতো। একই ধারায় তিনিও এই কাজ করে চলেছেন। তিনি বলেন, আমার আর কোনো কাজ করার দক্ষতা নেই। আমাকে একটা পরিবার সামলাতে হয়। সন্তানদের শিক্ষার দিক দেখতে হয়। মাস শেষে বাড়ি ভাড়াসহ বিল পরিশোধ করতে হয়। আমি জানি যে, এই কাজ আমার জন্য অসম্মান ও মর্যাদাহানি বয়ে আনে। কিন্তু, আমি এই কাজ করতে বাধ্য।
এই কাজে কৃতজ্ঞতা নেই, আছে ঝুঁকি। সমপ্রতি একটি মলশোধনী ট্যাংক পরিষ্কার করার সময় ট্যাংকটি বিস্ফোরিত হয়ে সুজনের এক বন্ধু নিহত হয়। তাদেরকে কাজ করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিও সরবরাহ করা হয় না। সুজন বলেন, আমাদেরকে শুধু কাজ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। তাই আমরা লোকজন ঠিক করে যত দ্রুত সম্ভব তা শেষ করার চেষ্টা করি। এসবের পাশাপাশি স্বাস্থ্যজনিত ঝুঁকি তো আছেই। সুজন বলেন, নর্দমাগুলো পচা, বিষাক্ত ময়লায় ভর্তি থাকে। সেগুলো পরিষ্কার করতে গেলে স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পড়ার সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। বিশেষ করে, চামড়াজনিত সমস্যায় ভুগতে হয় পরিষ্কারকারীদের। বেশিরভাগ সময় তারা এই সমস্যা বোঝে না। তারা হয়তো স্থানীয় মদ কিনবে, গিলবে, কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন বোধ করবে, একসময় ঘুমিয়ে পড়বে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চিরতরে বিদায় নেবে।
বসবাসের অযোগ্য শহর: বর্তমানে ঢাকার রাস্তায় খালি রাস্তা অনেকটা অমাবস্যার চাঁদের মতো হলেও সবসময় এমনটা ছিল না। অধ্যাপক নুরুন নবী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের আগে, ’৬০-এর দশকে ঢাকার খালি রাস্তায় গাড়ি চালানো যেত। শহরের পুরাতন অংশে মোঘল আমলের খালগুলোতে মানুষজন গোসল করতে পারতো। তবে উন্নয়নের খাতিরে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। খালগুলো ভরাট হয়েছে। আর এতে করে নষ্ট হয়েছে নিষ্কাশনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসের। বিশ্বের অন্যান্য অংশের মতন, বাংলাদেশও দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়নের শিকার হয়েছে। সৌভাগ্যের খোঁজে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ রাজধানীতে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু তাদের জায়গা দেয়ার মতন অবকাঠামো তৈরি হয়নি। আর ঢাকা ব্যতিত ভিন্ন শহরগুলোতে বিনিয়োগের তীব্র অভাব এই সংকট আরো প্রকট করে তুলেছে। নবী বলেন, আপনি ভারতে যান, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ। সেখানে আপনি কলকাতা, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদসহ বাস করার মতো অনেক শহর পাবেন। আপনি বেঁচে থাকতে পারবেন। কিন্তু এখানে, আমাদের কাছে এখনো (বাস করার জন্য) কেবল ঢাকাই আছে।
নবী জানান, ঢাকায় বেশ কয়েকটি সংগঠন ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী। আর এ কারনে ব্যবস্থাপনা মূলত বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। তিনি বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব হচ্ছে প্রধান বাধাগুলোর একটি। ঢাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য বর্তমানে সাতটি ভিন্ন সরকারি বিভাগ কাজ করছে। এই সংগঠনগুলো একপক্ষ অপরপক্ষের ওপর দোষ চাপানোর এক হাস্যকর খেলায় মেতে থাকে। এদের মধ্যে রয়েছেন শহরের দুই মেয়রও। গত জুলাইয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাইদ খোকন রাস্তায় হাটুপানিতে দাঁড়িয়ে বলেন, ওয়াসা(ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড সুয়েজ অথরিটি) এর জন্য দায়ী কিন্তু তাদেরকে তেমন একটাব কাজে দেখা যায়না। পালটা জবাবে, ওয়াসা খোকনের ওপর দোষ চাপায়। অন্যদিকে, উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আনিসুল হক ক্রোধ নিয়ে এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করে বসেন, কেউ আমাকে বলুন সমাধান কি?
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম খান বলেন, নিষ্কাশনের প্রাকৃতিক উৎসের স্বল্পতা থাকায় সরকারকে কয়েক কিলোমিটার লম্বা পাইপলাইন ব্যবহার করে পানি শহরের বাইরে বের করতে হয়। এছাড়া তিনি জনবহুলতাকেও দোষ দেন। তিনি বলেন, আগে আমরা ৬০ লাখ মানুষের জন্য কাজ করতাম। কিন্ত এখন আমাদের ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের জন্য কাজ করতে হয়। আর একারণে পানি ধারনের প্রাকৃতিক উৎস ও ড্রেন সিস্টেম ধংস হয়ে যাচ্ছে। সেখানে স্থাপিত হচ্ছে বসতবাড়ি। ২০১৩ সালে ঢাকায় খাল খননের একটি চুক্তি করা হয়। তবে সে কাজে এখন পর্যন্ত তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
এদিকে, বহুদিন ধরে ভুগলেও পরিবর্তন আসছেনা ড্রেন পরিষ্কারকের ভাগ্যে। এ থেকে বোঝা যায় যে, ঢাকা শহর যত বড় হচ্ছে এখানে অসমতাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুজনের জানান, তার সমপ্রদায় মুসলিম ও হিন্দু উভয় ধর্মের লোক দিয়েই ভরা। তিনি বলেন, কেউ আমাদের দুর্দশার কথা শুনতে আসেনা, সাংবাদিকরাও না। তার মেয়েরা স্কুলে পড়ে। অথচ তাদেরকে বন্ধুদের কাছে বাবার পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয়। সুজন বলেন, আমার সন্তানেরা স্কুলে যেতে পারে। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই তাদের আসল পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয়। নয়তো তারা অপমানিত হতে পারে বা তাদেরকে সবাই এড়িয়ে চলতে পারে। সুজন বলেন, ‘পুরো সিস্টেম আমাদের বিপক্ষে। আমাদের উন্নতির বিপক্ষে, আমাদের উন্নয়নের বিপক্ষে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সমপ্রদায়ের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি।’
No comments