একই নাটকের পুনঃপ্রচার by বিশ্বজিৎ চৌধুরী
যেন
একই নাটকের পুনঃপ্রচার। দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বিষয় একই। ঘটনাস্থল ও দুই
পরিচালকের নামও অভিন্ন। শুধু দু-একটি চরিত্রের উপস্থিতির হেরফের হতে পারে,
কিন্তু দুই বছরের ব্যবধানে যে দুটি দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল চট্টগ্রামের মানুষ,
তাতে নতুনত্ব নেই কোনো।
২০১৩ সালের ২৪ জুন পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি এলাকায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুটি পক্ষ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। যুবলীগের নেতা হেলালউদ্দিন চৌধুরী ওরফে বাবর ও ছাত্রলীগের নেতা সাইফুল আলম ওরফে লিমনের নেতৃত্বে দুই দলের সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছিল দুজনের। নিহত ব্যক্তিদের একজন ছাত্রলীগের সদস্য হলেও অন্যজন এলাকারই একটি শিশু, খেলতে এসে ঘটনার শিকার হয়েছিল সে।
দুই বছর আগের সেই ঘটনা ভুলতে বসেছিলাম আমরা। কিন্তু সেই একই বিষয় নিয়ে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি নতুন করে মনে করিয়ে দিল পুরোনো দিনটিকে। ১২ অক্টোবর সেই সিআরবি এলাকায় আবার প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুটি গ্রুপ। নগরের তুলনামূলক নির্জন সিআরবি এলাকা আরও একবার কেঁপে উঠেছে গুলির শব্দে। ভীতি-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মধ্যে। ২০১৩ আর ২০১৫—দুই বছরের ব্যবধানে দুটি ঘটনাই ঘটেছে একই স্বার্থকে কেন্দ্র করে। রেলওয়ের টেন্ডার দখল। লিমন বলেছেন, ‘সিআরবিতে বাবর এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। সম্প্রতি আমি ও আমার বন্ধু গোফরান সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার রেললাইন মেরামতের কাজ পেয়েছি। বাবরের দাবি হলো, সেই কাজ আমরা করতে পারব না।’
একসময় বাবর ও লিমনের নামের আগে পদবি হিসেবে ব্যবহার করা হতো যথাক্রমে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ২০১৩ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর এই দুজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে কমিটি থেকে। কিন্তু পদ-পদবি থেকে বাদ পড়লেও ক্ষমতার দাপট যে তাঁদের এতটুকু কমেনি, ১২ অক্টোবরের ঘটনা তার বড় প্রমাণ।
ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে ‘আজীবন বহিষ্কৃত’ ব্যক্তির নামের আগে পত্রপত্রিকায় ‘ছাত্রলীগ নেতা’ পদবি ব্যবহার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ছাত্রলীগের পরিচয় উল্লেখ করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতৃদ্বয়ের এই ক্ষোভ ও পরামর্শ যুক্তিসংগত। কিন্তু এত বড় সংঘর্ষের ঘটনায় আটক হয়ে, দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েও যাঁরা টেন্ডার দখলের জন্য লড়াই করেন এবং সেই টেন্ডার বাগিয়েও নিতে পারেন, তখন এটা মনে হওয়া কি স্বাভাবিক নয় যে কাগজে-কলমে বহিষ্কৃত হলেও তাঁরা দলের কোনো না কোনো নেতার সমর্থন বা আশীর্বাদপুষ্ট? সর্ষের ভেতেরই যদি ভূত থাকে, তাহলে ভূত তাড়াবে কে?
এখন ছাত্রলীগ বা যুবলীগের ভাবমূর্তি নিষ্কলুষ রাখতে হলে নিঃস্বার্থ আদর্শবান নেতা-কর্মীদেরই তো খুঁজে বের করা উচিত বহিষ্কৃত নেতা-কর্মীরা দলের কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইন্ধন পাচ্ছেন কি না, কেন তাঁরা আইন ও বিচারের আওতায় আসছেন না, কেন এখনো তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন টেন্ডার–বাণিজ্য! এমনকি দলের হাইকমান্ডও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের বর্তমান কমিটির সদস্যদের ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন। তাতে সংঘর্ষে জড়িত নেতা-কর্মীদের (দলে আছেন বা বহিষ্কৃত) পেছনে কারও সমর্থন বা ইন্ধন আছে কি না, তা বেরিয়ে আসবে। ছাত্রলীগের ‘বহিষ্কৃত’ নেতা লিমন স্বীকার করেছেন যে তিনি রেলের রাস্তা মেরামতের সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন। কী পেশাদারি যোগ্যতাবলে তিনি এই বড় অঙ্কের মেরামতকাজের ঠিকাদারি পেলেন, তা-ও তো তদন্ত করে দেখতে পারেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
কয়েক দিন আগে টাঙ্গাইলের মধুপুরে বনে নিয়ে গিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণের জন্য ছাত্রলীগের আরিফ হোসেন নামের এক তরুণকে অভিযুক্ত করা হলে মধুপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বলেছেন, ‘আরিফকে সভাপতি করে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেটি এখনো পাস হয়নি।’ অপকর্মের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে কখনো ‘বহিষ্কৃত’, কখনো বা ‘অননুমোদিত’ ইত্যাদি যুক্তি হয়তো সংশ্লিষ্ট নেতারা তুলে ধরছেন, কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের মন থেকে এই সংগঠনের নেতিবাচক ভাবমূর্তি মুছে ফেলা যাচ্ছে না।
২০১৩ সালের ঘটনার বিচার হলে ২০১৫ সালে নতুন করে সংঘর্ষের ঘটনা যে ঘটত না, এ কথা আজ নিঃসংশয়ে বলা যায়। কিন্তু আগের ঘটনায় জোড়া খুনের মামলার তদন্তে ২৭ মাসেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। তখন কোতোয়ালি থানার একজন উপপরিদর্শক বাদী হয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৮৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩০-৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন। সংঘর্ষে নিহত সাজু পালিতের মা-ও দায়ের করেছিলেন হত্যা মামলা। বাবর-লিমনসহ ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তবে শনাক্ত করতে পারেনি অস্ত্রধারী এবং উদ্ধার হয়নি সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্র। ঘটনার চার মাসের মাথায় উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যান ৫৬ আসামি। সেই সময় (২০১৩) ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হলে ৪৪ জনকে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন বিচারক। এত অল্প সময়ে আসামিদের কাছ থেকে হত্যার কারণ বের করা যাবে কি না—এ নিয়ে তখন সংশয় প্রকাশ করেছিলেন আইন বিশেষজ্ঞরা। মহানগর আদালতের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুস সাত্তার তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এ ধরনের হত্যা মামলার জন্য এক দিনের রিমান্ড যথেষ্ট নয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে আসামিদের কাছ থেকে জোড়া খুনের কারণ বের করা সম্ভব হবে না। অথচ চুরির মামলার আসামিরও পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।’
এ বক্তব্য যে সঠিক ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ জুনের ঘটনায় আটক সবাই বেরিয়ে এসেছেন জামিনে। এসে নতুন করে সংঘর্ষে জড়ানোর শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করেছেন। সেবারের ঘটনায় তবু ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ, কিন্তু এবার (১২ অক্টোবর) একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি তারা, এমনকি শনাক্তও করতে পারেনি কাউকে। পত্রপত্রিকায় ধারালো অস্ত্রসহ সংঘর্ষে লিপ্ত তরুণদের ছবি ছাপা হয়েছে, কিন্তু কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলছেন, ‘তারা কারা, শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জনপ্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছেন। জেলা প্রশাসক বলেছেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করা হবে। পুরো ব্যাপারটিই কেমন যেন ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ বলে মনে হচ্ছে।
সংঘর্ষের সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। সেখানে চারটি ফাঁকা গুলি করে বিবদমান দুই পক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে তারা। কিন্তু কাউকে আটক করার চেষ্টা করেছে, এমন কোনো তথ্য দেননি প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকেরা। বরং এবারের সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, এতেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন তাঁরা।
পুলিশ কি সেদিন দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখিয়েছে? ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের ক্যাডারদের ধরপাকড় করেও শেষ পর্যন্ত আটকে রাখা যাবে না—এমন কোনো ধারণা কি তাদের মধ্যে কাজ করেছে? আমরা জানি না। তবে এটা জানি, বিভিন্ন সরকারের আমলে দলীয় সন্ত্রাসীরা যে ক্ষতি দলের করেছে, প্রতিপক্ষও ততটা করতে পারেনি। এই সহজ বিষয়টি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় উচ্চপর্যায়ের নেতারা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারেন, ততই ভালো। তবে ঘটনাচক্রে আমাদের এক কবি-ছড়াকার বন্ধুর একটি ছড়ার দুটি লাইন বারবার মনে পড়ছে: ‘ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছি শেষে/ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না কেউ।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
২০১৩ সালের ২৪ জুন পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি এলাকায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুটি পক্ষ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। যুবলীগের নেতা হেলালউদ্দিন চৌধুরী ওরফে বাবর ও ছাত্রলীগের নেতা সাইফুল আলম ওরফে লিমনের নেতৃত্বে দুই দলের সশস্ত্র সংঘর্ষে প্রাণহানি ঘটেছিল দুজনের। নিহত ব্যক্তিদের একজন ছাত্রলীগের সদস্য হলেও অন্যজন এলাকারই একটি শিশু, খেলতে এসে ঘটনার শিকার হয়েছিল সে।
দুই বছর আগের সেই ঘটনা ভুলতে বসেছিলাম আমরা। কিন্তু সেই একই বিষয় নিয়ে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি নতুন করে মনে করিয়ে দিল পুরোনো দিনটিকে। ১২ অক্টোবর সেই সিআরবি এলাকায় আবার প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিল ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুটি গ্রুপ। নগরের তুলনামূলক নির্জন সিআরবি এলাকা আরও একবার কেঁপে উঠেছে গুলির শব্দে। ভীতি-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মধ্যে। ২০১৩ আর ২০১৫—দুই বছরের ব্যবধানে দুটি ঘটনাই ঘটেছে একই স্বার্থকে কেন্দ্র করে। রেলওয়ের টেন্ডার দখল। লিমন বলেছেন, ‘সিআরবিতে বাবর এককভাবে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। সম্প্রতি আমি ও আমার বন্ধু গোফরান সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার রেললাইন মেরামতের কাজ পেয়েছি। বাবরের দাবি হলো, সেই কাজ আমরা করতে পারব না।’
একসময় বাবর ও লিমনের নামের আগে পদবি হিসেবে ব্যবহার করা হতো যথাক্রমে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ২০১৩ সালের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর এই দুজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে কমিটি থেকে। কিন্তু পদ-পদবি থেকে বাদ পড়লেও ক্ষমতার দাপট যে তাঁদের এতটুকু কমেনি, ১২ অক্টোবরের ঘটনা তার বড় প্রমাণ।
ছাত্রলীগ চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে ‘আজীবন বহিষ্কৃত’ ব্যক্তির নামের আগে পত্রপত্রিকায় ‘ছাত্রলীগ নেতা’ পদবি ব্যবহার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ছাত্রলীগের পরিচয় উল্লেখ করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আরও সতর্ক হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। ছাত্রলীগ নেতৃদ্বয়ের এই ক্ষোভ ও পরামর্শ যুক্তিসংগত। কিন্তু এত বড় সংঘর্ষের ঘটনায় আটক হয়ে, দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েও যাঁরা টেন্ডার দখলের জন্য লড়াই করেন এবং সেই টেন্ডার বাগিয়েও নিতে পারেন, তখন এটা মনে হওয়া কি স্বাভাবিক নয় যে কাগজে-কলমে বহিষ্কৃত হলেও তাঁরা দলের কোনো না কোনো নেতার সমর্থন বা আশীর্বাদপুষ্ট? সর্ষের ভেতেরই যদি ভূত থাকে, তাহলে ভূত তাড়াবে কে?
এখন ছাত্রলীগ বা যুবলীগের ভাবমূর্তি নিষ্কলুষ রাখতে হলে নিঃস্বার্থ আদর্শবান নেতা-কর্মীদেরই তো খুঁজে বের করা উচিত বহিষ্কৃত নেতা-কর্মীরা দলের কোনো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইন্ধন পাচ্ছেন কি না, কেন তাঁরা আইন ও বিচারের আওতায় আসছেন না, কেন এখনো তাঁরাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন টেন্ডার–বাণিজ্য! এমনকি দলের হাইকমান্ডও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের বর্তমান কমিটির সদস্যদের ডেকে নিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইতে পারেন। তাতে সংঘর্ষে জড়িত নেতা-কর্মীদের (দলে আছেন বা বহিষ্কৃত) পেছনে কারও সমর্থন বা ইন্ধন আছে কি না, তা বেরিয়ে আসবে। ছাত্রলীগের ‘বহিষ্কৃত’ নেতা লিমন স্বীকার করেছেন যে তিনি রেলের রাস্তা মেরামতের সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার কাজ পেয়েছেন। কী পেশাদারি যোগ্যতাবলে তিনি এই বড় অঙ্কের মেরামতকাজের ঠিকাদারি পেলেন, তা-ও তো তদন্ত করে দেখতে পারেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা।
কয়েক দিন আগে টাঙ্গাইলের মধুপুরে বনে নিয়ে গিয়ে এক তরুণীকে ধর্ষণের জন্য ছাত্রলীগের আরিফ হোসেন নামের এক তরুণকে অভিযুক্ত করা হলে মধুপুর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বলেছেন, ‘আরিফকে সভাপতি করে ইউনিয়ন ছাত্রলীগের যে কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেটি এখনো পাস হয়নি।’ অপকর্মের দায়ে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীদের ব্যাপারে কখনো ‘বহিষ্কৃত’, কখনো বা ‘অননুমোদিত’ ইত্যাদি যুক্তি হয়তো সংশ্লিষ্ট নেতারা তুলে ধরছেন, কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের মন থেকে এই সংগঠনের নেতিবাচক ভাবমূর্তি মুছে ফেলা যাচ্ছে না।
২০১৩ সালের ঘটনার বিচার হলে ২০১৫ সালে নতুন করে সংঘর্ষের ঘটনা যে ঘটত না, এ কথা আজ নিঃসংশয়ে বলা যায়। কিন্তু আগের ঘটনায় জোড়া খুনের মামলার তদন্তে ২৭ মাসেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। তখন কোতোয়ালি থানার একজন উপপরিদর্শক বাদী হয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৮৭ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৩০-৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেছিলেন। সংঘর্ষে নিহত সাজু পালিতের মা-ও দায়ের করেছিলেন হত্যা মামলা। বাবর-লিমনসহ ৫৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তবে শনাক্ত করতে পারেনি অস্ত্রধারী এবং উদ্ধার হয়নি সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্র। ঘটনার চার মাসের মাথায় উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে যান ৫৬ আসামি। সেই সময় (২০১৩) ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করা হলে ৪৪ জনকে এক দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন বিচারক। এত অল্প সময়ে আসামিদের কাছ থেকে হত্যার কারণ বের করা যাবে কি না—এ নিয়ে তখন সংশয় প্রকাশ করেছিলেন আইন বিশেষজ্ঞরা। মহানগর আদালতের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুস সাত্তার তখন প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘এ ধরনের হত্যা মামলার জন্য এক দিনের রিমান্ড যথেষ্ট নয়। এত অল্প সময়ের মধ্যে আসামিদের কাছ থেকে জোড়া খুনের কারণ বের করা সম্ভব হবে না। অথচ চুরির মামলার আসামিরও পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।’
এ বক্তব্য যে সঠিক ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ জুনের ঘটনায় আটক সবাই বেরিয়ে এসেছেন জামিনে। এসে নতুন করে সংঘর্ষে জড়ানোর শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করেছেন। সেবারের ঘটনায় তবু ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ, কিন্তু এবার (১২ অক্টোবর) একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি তারা, এমনকি শনাক্তও করতে পারেনি কাউকে। পত্রপত্রিকায় ধারালো অস্ত্রসহ সংঘর্ষে লিপ্ত তরুণদের ছবি ছাপা হয়েছে, কিন্তু কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলছেন, ‘তারা কারা, শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’ এ নিয়ে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জনপ্রতিনিধিরা প্রশ্ন তুলেছেন। জেলা প্রশাসক বলেছেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে অস্ত্রধারীদের শনাক্ত করা হবে। পুরো ব্যাপারটিই কেমন যেন ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ বলে মনে হচ্ছে।
সংঘর্ষের সময় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল। সেখানে চারটি ফাঁকা গুলি করে বিবদমান দুই পক্ষকে সরিয়ে দিয়েছে তারা। কিন্তু কাউকে আটক করার চেষ্টা করেছে, এমন কোনো তথ্য দেননি প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকেরা। বরং এবারের সংঘর্ষের ঘটনায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, এতেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন তাঁরা।
পুলিশ কি সেদিন দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখিয়েছে? ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠনের ক্যাডারদের ধরপাকড় করেও শেষ পর্যন্ত আটকে রাখা যাবে না—এমন কোনো ধারণা কি তাদের মধ্যে কাজ করেছে? আমরা জানি না। তবে এটা জানি, বিভিন্ন সরকারের আমলে দলীয় সন্ত্রাসীরা যে ক্ষতি দলের করেছে, প্রতিপক্ষও ততটা করতে পারেনি। এই সহজ বিষয়টি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় উচ্চপর্যায়ের নেতারা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারেন, ততই ভালো। তবে ঘটনাচক্রে আমাদের এক কবি-ছড়াকার বন্ধুর একটি ছড়ার দুটি লাইন বারবার মনে পড়ছে: ‘ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছি শেষে/ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না কেউ।’
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
No comments