‘উন্নয়নের জোয়ার’ তবু পানিবন্দী চট্টগ্রামবাসী by শরিফুজ্জামান ও সুজন ঘোষ

যে শহরে ‘উন্নয়নের জোয়ার’ বইছে, সেই শহরের মানুষ পানিবন্দী কেন?
চট্টগ্রাম শহরের নাগরিকদের সুবিধা-অসুবিধা যাঁদের দেখার দায়িত্ব, তাঁদের কেউ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না৷ তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই শহরের উন্নয়নে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকার ৩৫টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে৷ তবে ১ নম্বর সমস্যা জলাবদ্ধতা নিয়ে কোনো প্রকল্প নেই৷
উন্নয়নের বিবরণ লেখা বিলবোর্ড ও ব্যানারে ছেয়ে গেছে শহর৷ ওপরে তাকালেই উন্নয়নের তথ্য, নিচে তাকালে দুর্গন্ধময় কাদাপানি৷ এ পরিস্থিতিতে বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ শহরবাসী৷

নগর পরিকল্পনাবিদেরা জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান করতে না পারার জন্য সিটি করপোরেশন ও মেয়রের ভূমিকাকে দায়ী করেছেন। তাঁরা বলছেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি ১৯৯৫ সালে প্রণীত ২০ বছরের নগর মহাপরিকল্পনায় ছিল। কিন্তু এটি বাস্তবায়নে বা অর্থ সংগ্রহে বর্তমান মেয়রের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের ইস্ট-ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ সিকান্দর খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণ ধারণা হচ্ছে, রাজনৈতিক কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি সরকার। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। তবে মেয়রকে এই প্রকল্পের অনুমোদন পেতে বিশেষ উদ্যোগ নিতে দেখিনি। তিনি উৎসাহী কিন্তু আশাবাদী নন।’
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে দায়িত্বশীল সংস্থা সিটি করপোরেশন সরকারের কাছে টাকা চায়নি বা নিতে পারেনি৷ এটি একধরনের ব্যর্থতা৷
গতকাল যোগাযোগ করা হলেও মেয়র মন্জুর আলমের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি৷ তবে ১০ মে প্রথম আলোকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছাড়া শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন করা সম্ভব নয়।’ এটা বাস্তবািয়ত না হওয়ার কারণ সম্পর্কে মেয়র কাউকে দায়ী না করলেও অর্থের অভাবের কথা উল্লেখ করেন৷
সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নগরবাসীর ভোট পাওয়ার জন্য মেয়র যেসব অঙ্গীকার করেছিলেন, তার প্রথমটিই ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন করা। অথচ মেয়াদের চার বছর পার হলেও ১ নম্বর অঙ্গীকার পূরণে তাঁর কোনো উদ্যোগ নেই৷
মেয়রের এই উদ্যোগহীনতার শিকার হয়ে নগরবাসী গত শুক্রবার ও গতকাল ছিলেন পানিবন্দী। মেয়র আর এক বছর মেয়াদের মধ্যে এ সমস্যা সমাধান করে ফেলবেন, এটা কেউ বিশ্বাস করেন না। মেয়র বিরোধী দল বিএনপির নেতা হওয়ায় সরকারের সহায়তা পাননি—এমন কথা কেউ কেউ বলে থাকেন৷ তবে মেয়র নিজের মুখে এ কথা বলেন না৷
চট্টগ্রামের উন্নয়নে যে ৩৫টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৩১টির কাজ শেষ পর্যায়ে৷ এগুলোর একটিও সিটি করপোরেশনের নয়, জলাবদ্ধতা নিরসনের সঙ্গেও এসবের কোনো সম্পর্ক নেই৷ সরকার এসব কাজ করাচ্ছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) মাধ্যমে৷ এই সিডিএর চেয়ারম্যান অবশ্য মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম৷
গতকাল যোগাযোগ করা হলে আবদুচ ছালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনগতভাবে ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সিটি করপোরেশন। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে করপোরেশন আমাদের কিছুই জানায়নি। তার পরও সিডিএর পক্ষ থেকে জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করতে এবং সমাধান খঁুজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি কাজ শুরু করেছে।’
তবে ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন। এগুলোকে সম্পৃক্ত করতে সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নেয়নি বলে মন্তব্য করেন সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার৷
সিটি করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, বহদ্দারহাটের বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী পর্যন্ত নতুন খাল খননে ২৯৭ কোটি টাকায় একটি প্রকল্প নেওয়ার কথা৷ কিন্তু গত দুই বছরেও মেয়র সরকারের কাছ থেকে এটি অনুমোদন নিতে পারেননি।
এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী আলী আশরাফ বলেন, মেয়র দুই বছর আগে নতুন খাল খননের প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠালেও অনুমোদনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেননি। তাঁর প্রশ্ন, তার আগের দুই বছর মেয়র কী করেছেন?
সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, করপোরেশন গত চার বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ১৪৭ কোটি টাকা খরচ করেছে৷ নালা-নর্দমা থেকে মাটি উত্তোলন ও অপসারণ, নালা-নর্দমা নির্মাণ, বিভিন্ন খালে ৩২ কিলোমিটার অংশে প্রতিরোধ দেয়াল নির্মাণ ও খননযন্ত্র কিনতে এই টাকা খরচ হয়েছে৷ বহদ্দারহাট থেকে ডোম খাল পর্যন্ত সাড়ে আট কোটি টাকায় সংযোগ খাল তৈরির কাজ চলছে। এগুলো অবশ্য নিয়মিত কাজের অংশ৷
বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও জলাবদ্ধতা নিরসনবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যসচিব আনোয়ার হোছাইন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছুতেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছি না। নালা-নর্দমা ও খাল দিয়ে বৃষ্টির পানি দ্রুত অপসারণ হচ্ছে না।’
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক স্বপন কুমার পালিত বলেন, বেপরোয়া দখলের ফলে চট্টগ্রাম নগরে খালের পরিমাণ কমেছে। অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও ভবন নির্মাণের কারণে বিদ্যমান খালগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ নষ্ট হয়ে গেছে। এতে খালগুলো দিয়ে ১০ ভাগের এক ভাগও পানি প্রবাহিত হতে পারে না।

No comments

Powered by Blogger.