চরমপন্থায় না, আত্মঘাতী বোমায় হ্যাঁ

২০০৫ সালে জেএমবির আত্মঘাতী গাড়িবোমা
হামলায় নিহত হন দুই বিচারক
সজীব ওয়াজেদ জয় এবং আওয়ামী লীগের আরও অনেকেই এখনো বাংলাদেশের সংকটের জন্য প্রধানত বিএনপি-জামায়াতকেই দুষে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রিয় স্লোগান জয় বাংলার অবমাননার জন্য প্রধানত পঁচাত্তর-পরবর্তী কুশীলবেরাই দায়ী। কিন্তু জয় বাংলা বলে টেন্ডার বাক্স ছিনতাই-সংস্কৃতি বন্ধ না করলে একে আর স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করা কষ্টসাধ্য থেকে যাবে। যারা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে, তারা পাকিস্তানের এজেন্ট—এ ধরনের বাতচিত দিয়ে শত্রু ও শত্রুতার বিষয় ভুলভাবে চিত্রিত হচ্ছে। যেখানে আঘাত হানার বিষয়, যেখানে মনোযোগ দেওয়ার বিষয়, তা আড়ালে চাপা পড়ছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার শর্তে বিএনপি ও জামায়াতের দফারফা করতে গিয়ে সমাজ-রাষ্ট্রের দফারফা ঘটছে। ৯৯টি দেশের মধ্যে আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত ৯২তম র্যাংকিং নিয়ে এর আগে আলোচনা করেছি। এবার আরও একটি বিপর্যয় বা উৎকণ্ঠার খবর। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জরিপ সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের যাত্রা শুরু ২০০২ সালে। তারা নানা বিষয়ে গ্লোবাল অ্যাটিচুড পর্যবেক্ষণ করে থাকে। ১৪টি দেশের ওপর পরিচালিত একটি জরিপে দেখানো হয়েছে, যে রাষ্ট্রে মুসলিম জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য, সেখানে উগ্রপন্থার প্রতি মনোভাবটা কেমন। এই সংস্থার বর্তমান প্রেসিডেন্ট অ্যালান মুরে জাঁদরেল সাংবাদিক। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল-এর ওয়াশিংটন ব্যুরো চিফ হিসেবে তাঁর এক দশকের দায়িত্ব পালনকালে ব্যুরো তিনবার পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছে। পিউর সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা গেছে, ইসলামি চরমপন্থার উত্থান বাংলাদেশের জনগণ চায় না। বরং তাদের কোনো সম্ভাব্য শাসনে তারা বিচলিত। আবার এই জরিপেই ইঙ্গিত পাচ্ছি যে, আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও পরমতসহিষ্ণুতার অভাবের কারণে বাংলাদেশ সমাজ নতুন করে কোনো রেডিক্যালাইজেশনের গহ্বরে প্রবেশ করছে কি না। ইসলামের পক্ষে আত্মঘাতী বোমা হামলা কি সমর্থনযোগ্য? এর উত্তরে বাংলাদেশের মানুষ যা বলেছে, তাতে আমি হতভম্ব। সাধারণ বিবেচনায় এটা গ্রহণযোগ্য নয়।
৩৩ ভাগ বলেছে, মাঝেমধ্যে এর দরকার আছে। ১৪ ভাগ বলেছে, প্রায়ই এটা দরকার। আরও ১৪ ভাগ বলেছে, বিরল ক্ষেত্রে এটা দরকার। আবার ৩৩ ভাগ বলেছে, কখনো এটা সমর্থনযোগ্য নয়। তবে মোটামুটি ৪৭ ভাগ মানুষ কমবেশি আত্মঘাতী বোমা হামলার পক্ষে মতামত দিয়েছে। অথচ পাকিস্তানে এটা মাত্র ৩ ভাগ। সে দেশের ৮৩ ভাগই বলেছে, এটা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। তাহলে কি পাকিস্তানিরা আত্মঘাতী বোমা হামলায় রক্তাক্ত হওয়ার পরে একে না বলতে শিখেছে, আর বাংলাদেশের মানুষ এখনো এই দানবীয় সন্ত্রাসের ভুক্তভোগী নয় বলে এত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ একে সমর্থন দিতে পেরেছে? তালেবান, যাদের কারণে পাকিস্তানে এখনো রক্তগঙ্গা বইছে, পিউ প্রতিবেদন বলেছে, তালেবানের প্রতি পাকিস্তানিদের কোনো ভালোবাসা নেই। ফ্যাক্ট ট্যাংক হিসেবে পরিচিত পিউ ২০০২ থেকে আত্মঘাতী বোমা হামলার বিষয়ে জরিপ করছে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে এবারই প্রথম তারা জরিপভুক্ত করেছে। কেন করল এবং কেন এমন ফল এল দুটোই চিন্তার বিষয়। পাকিস্তানকে ২০০২ থেকেই তারা নিয়মিত জরিপভুক্ত রেখেছে। আর এর ফলাফলটা চমকপ্রদ, যা থেকে আমরা পাঠ নিতে পারি। ইসলাম রক্ষায় বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানোর পক্ষে পাকিস্তানিরা ২০০৪ সালে সর্বোচ্চ ৪১ ভাগ মত দিয়েছিল। বাংলাদেশে তখন তালেবান-দরদি বিএনপি-জামায়াতের শাসন চলছে। তবে পাকিস্তানিদের ক্রমাগত মোহভঙ্গ ঘটেছে। এখন যেটা আতঙ্কজনক সেটা হলো, বাংলাদেশিরা এ ক্ষেত্রে কেবল পাকিস্তানই নয়, ১৩টি মুসলিম দেশের মধ্যেই শীর্ষে। এমনকি ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের চেয়ে বাংলাদেশ ১ ভাগ বেশি। পশ্চিম তীরের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি। প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ‘কিছু লোক মনে করে যে ইসলামকে তার শত্রুদের কাছ থেকে রক্ষার জন্য বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আত্মঘাতী বোমা ও অন্যান্য ধরনের সহিংসতার দরকার রয়েছে।
অন্যরা বিশ্বাস করেন কারণ যা-ই হোক না কেন, এ ধরনের সহিংসতা কখনোই জায়েজ নয়। আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন যে ইসলাম রক্ষায় এ ধরনের সহিংসতা প্রায়ই জায়েজ, মাঝেমধ্যে জায়েজ, প্রকৃতপক্ষেই জায়েজ কিংবা কখনোই জায়েজ নয়?’ এটা আশার বিষয় যে, ৬৬ ভাগ আল-কায়েদার বিরুদ্ধে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। তবে ২৩ ভাগ অনুকূলেও মত দিয়েছে। ৫৬ ভাগ লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে, আবার ২৮ ভাগ তাদের অনুকূলে এবং ১৬ ভাগের কাছে সংগঠনটি অজানা বলে প্রকাশ পেয়েছে। সংসদ নির্বাচনে জিতে হামাস ২০০৭ থেকে গাজা উপত্যকা শাসন করছে। ২০ জুলাই নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৫০০ ছাড়ানোর পরে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটা অনিশ্চিত অস্ত্রবিরতিও কার্যকর করা অসম্ভব মেন হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি আমাদের জনগণের মনোভাবে বড় পরিবর্তন এল কি না, সেটাও ভাবার বিষয়। কারণ, পিউ জরিপে ফিলিস্তিনিদের ৬২ ভাগ যখন ‘উগ্রপন্থীদের’ পক্ষে, তখন ৫৬ ভাগ বাংলাদেশি হামাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ২৯ ভাগ অনুকূলে। আর ১৫ ভাগের কাছে হামাস অজানা। আমাদের ৮৫ ভাগ উত্তরদাতা হামাস সম্পর্কেও মন্তব্য করতে সক্ষম, এটা ইঙ্গিত দেয় জরিপটা গড়পড়তা উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে করা হয়েছে। ১ জুলাই প্রকাশিত ওই জরিপে বলা হয়েছে, ইসলামি চরমপন্থার বিরুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের উদ্বেগ অনেক বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় লেবাননে চলতি বছরে ৮১ থেকে ৯২ ভাগ, তিউনিসিয়ায় ৭১ থেকে ৮০, মিসর ৬৯ থেকে ৭৫, জর্ডান ৫৪ থেকে ৬২ ভাগ, এবং তুরস্কের মানুষের মধ্যে ইসলামি উগ্রপন্থার প্রতি ৩৭ থেকে ৫০ ভাগ মানুষের উদ্বেগ বেড়েছে। এশিয়ার চারটি মুসলিম দেশকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এটা আশার বিষয়, ইসলামি চরমপন্থার প্রতি অনাস্থা প্রকাশে বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। এমনকি আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশিরা এ বিষয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। ২৫ ভাগ অসচেতন, কিন্তু ৬৯ ভাগই উদ্বিগ্ন। পাকিস্তানে অসচেতন ১৪ ভাগ, উদ্বিগ্ন ৬৬ ভাগ, মালয়েশিয়ায় ২৪ ভাগ অসচেতন, ৬৩ ভাগ উদ্বিগ্ন এবং ইন্দোনেশিয়ায় ৫৫ ভাগ অসচেতন ও ৩৯ ভাগ উদ্বিগ্ন। পিউ প্রতিবেদনও বাংলাদেশিদের আত্মঘাতী বোমাপ্রীতি অবাক করেছে। পিউ তার ২৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলেছে, ‘টুইন টাওয়ার ধ্বংসের (৯/১১) এক দশকের বেশি সময়ের পরে আত্মঘাতী বোমা হামলার ওপর মুসলিম দেশগুলোতে সমর্থন অনেক কমেছে।
তবে মালয়েশিয়ায় যেখানে ১৮ ভাগ আত্মঘাতী বোমা হামলাকে জায়েজ মনে করে, সেখানে বাংলাদেশ অনেক ওপরে। ২০০৫ সালে লেবাননি প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরির হত্যাকাণ্ডের পরই কেবল এর প্রতি সমর্থন এখন সে দেশে ২৯-এ নেমেছে। ২০০২ সালে ৭৪ ভাগ লেবাননি বোমা-সমর্থক ছিল। একই বছরে আম্মানে তিনটি হোটেলে হামলার পর ৫৭ ভাগ জর্ডানির সমর্থনটা আজ ১৫ ভাগে নেমেছে। পাকিস্তানে বেনজির হত্যার আগেই তা হ্রাস পাচ্ছিল। তবে এক দশক আগে ৪১ ভাগ পাকিস্তানি বলেছিল, তারা আত্মঘাতী বোমাকে জায়েজ মনে করে। পিউ প্রতিবেদন যেটি বলেনি, সেটা হলো বাংলাদেশে কেন এটা বেড়ে গেল? এক দশক আগের পাকিস্তানকেও অতিক্রম করার একটা অর্থ দাঁড়ায়, আমাদের ৪৭ ভাগ মানুষ এক দশক আগের পাকিস্তানি মানসিকতাকে ধারণ করছে। এই পরিহাস সহ্য করা আরও কঠিন যে গত বছরেও ফিলিস্তিনিদের ৬২ ভাগ, যারা এর সমর্থক ছিল এবং এই মুহূর্তেও ইসরায়েলি তাণ্ডবের শিকার, তারাও এর ওপর সমর্থন তুলে নিজেদের বাংলাদেশিদের নিচে নামিয়েছে। তাই সার্বিক বিচারে এটা একটা বিরাট প্রশ্ন যে আমাদের হলোটা কী। বাংলাদেশ তো বাংলা ভাই ও ইসলামি জঙ্গিদের হাতে কম রক্ত ঝরতে দেখেনি। যাচাই না করে এমন বিপজ্জনক ফলাফলকে ধ্রুব সত্য মনে করার যুক্তি নেই। আবার অভ্যাসগত উন্মাদনায় নাকচ করারও সুযোগ নেই। মাদ্রাসাশিক্ষা সংস্কারে বিমুখ অথবা অসমর্থ সরকার এবং নাগরিক সমাজকে এই ভয়ংকর পূর্বাভাস নিয়ে নিশ্চয় ভাবতে হবে। বিএনপি ও জামায়াতকে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করে ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। এটা কারও কারও বা কতিপয়ের কাছে মসনদ বিলাসের রক্ষাকবচ। কিন্তু এই জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে প্রতিপক্ষকে জব্দ করতে পারলেই নিশ্চিন্ত ঘুম দেওয়া যায় না। আরও অনেক ভয়ংকর সমস্যা সমাজের দেহে ছড়িয়ে পড়াটা ক্ষমতাসীনদের টিকে থাকার কৌশলগত হিম্মতের ওপর নির্ভর করে না। আইনের শাসনের সূচকে বাংলাদেশের নিকৃষ্ট ৯২তম অবস্থানে অধঃপতিত হওয়া এবং এই পিউ জরিপের ফলাফলের যে বিপদ, তার মধ্যে একটা পরিষ্কার যোগসূত্র দেখতে পাই। ২০১৪ সালের ১৪ এপিল থেকে ১১ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের এক হাজার ব্যক্তির মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পিউর পক্ষে ওই জরিপ পরিচালনা করেছে প্রিন্সটন রিসার্চ।স্বনামধন্য জরিপ সংস্থা গ্যালাপের সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু কোহাট প্রিন্সটন রিসার্চ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা। এই পিউ জরিপের তিনিই পরিচালক। তাঁর কাছে উত্তরদাতাদের শিক্ষা ও তাদের পেশা-সংক্রান্ত প্রশ্ন জানতে চেয়ে গত সপ্তাহে ই-মেইল করেছিলাম।উত্তর পাইনি। তবে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে মার্কিন চোখে উদারনৈতিক মুসলিম দেশের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশের পরিচয়টা এই জরিপ চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.