জাপানে পারমাণবিক সংকট, বিপর্যয়ের সূচনা by পিটার কাস্টার্স
মানুষ হিসেবে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের বিরোধীরা বছরের পর বছর ভয়ানক বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা করছিলেন, তা সত্য হতে চলেছে জাপান বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। গত ১১ মার্চ ফুকুশিমা-দাইচি সংকট শুরুর পর তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। বিপর্যয়ের শুরু থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে জাপান পারমাণবিক বিকিরণের বিরাট সমস্যায় পড়তে যাচ্ছে। পাশাপাশি জাপানে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার আনুষঙ্গিক ঝুঁকিও রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত চার পারমাণবিক চুল্লির প্রতিটির শীতলীকরণব্যবস্থা সময়মতো সচল করতে পারমাণবিক স্থাপনা মালিক প্রতিষ্ঠান টেপকোর (TEPCO) ব্যর্থতা এখন অনেক স্পষ্ট হওয়ায় এটা আন্তর্জাতিক বিপর্যয়ে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি।
ইউরোপীয় পারমাণবিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩ নম্বর চুল্লির তলায় সম্ভবত জ্বালানি রড ও ধাতুর গলিত বিশালাকার বুদ্বুদ তৈরি হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে এই চুল্লিতেই মিশ্র ইউরেনিয়াম-প্লুটোনিয়াম জ্বালানি রডের অংশ হিসেবে প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত উপাদান এই প্লুটোনিয়াম। অতি নগণ্য পরিমাণ প্লুটোনিয়াম পাকস্থলীতে গেলে কিংবা শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকলে তা মানুষের ফুসফুস, হাড় ও যকৃতে ক্যানসার ঘটাতে পারে। ফুটতে থাকা লাভাজাতীয় বুদ্বুদ একসময় কংক্রিটের তৈরি চুল্লির ভিত্তিস্তম্ভ ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত পোষণ করছেন না। পাশের দিকেও তো বুদ্বুদ নির্গত হয়ে আসতে পারে। একটি চুল্লির টারবাইন কক্ষে এবং সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে ইতিমধ্যে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার বিকিরণ ধরা পড়েছে। একই মাত্রার আতঙ্কজনক খবর হলো, পারমাণবিক স্থাপনার কাছাকাছি চার-পাঁচটি স্থানের মাটিতে প্লুটোনিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
পারমাণবিক সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধি আর ধীরে ধীরে প্রলয়ংকরী রূপ নিতে থাকার মুহূর্তে জাপানি নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের দূরদৃষ্টিহীনতার ব্যাপারে ধীরে হলেও আত্মানুসন্ধান শুরু করেছেন। জাপান ভূমিকম্প ও সুনামিপ্রবণ—এ কথা বিশ্ববাসীর কাছে সুবিদিত। সুনামি জাপানি শব্দ। জাপানের ইতিহাসে রাজধানী টোকিওতে বারবার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। তা ছাড়া অতীতে সুনামির ফলে যে বিপুল জলোচ্ছ্বাস হতো, তাতে উপকূলীয় এলাকায় বসবাস স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ ১৮৯৬ ও ১৯৩৩ সালের সুনামির কথা বলা যায়। জাপানি ভূতাত্ত্বিকদের মতে, তখন যথাক্রমে ৩৮ ও ২৯ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস এসে আঘাত হেনেছিল। গত ১১ মার্চ জাপানের উপকূলে যে জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছে তার উচ্চতা নিশ্চয় ততটা প্রবল ছিল না। তথাপি, ফুকুশিমা-দাইচি পারমাণবিক স্থাপনার কাছে নির্মিত সুরক্ষা দেয়ালের চেয়ে তিন গুণ উঁচু ছিল সেই জলোচ্ছ্বাস। সম্ভাব্য সুনামির প্রভাব মোকাবিলার জন্যই এমন দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় ৪০ বছর আগে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করার সময় খোদ জাপানে সংঘটিত সুনামিগুলোকে বিবেচনায় না এনে সুদূর চিলির ১৯৫৬ সালের সুনামিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনায় সুনামি ভাবনাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সুতরাং, সাগরের পানি ফুকুশিমা-দাইচি বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থাকে নিমজ্জিত করে দিতে পারে, এই সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে জাপানি কর্তৃপক্ষ এই পারমাণবিক বিপর্যয় নিজেরাই প্ররোচিত করেছে, এ কথা তর্কের খাতিরে বলা যেতেই পারে।
জাপানের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক সমালোচকেরা সুনামি অথবা ভূমিকম্পের সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে আগেই জাপানি কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিল। আসলে পারমাণবিক চুল্লি বিষয়ে জাপানের যথেষ্ট ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, যার ওপর দাঁড়িয়ে সামনে এগোতে পারতেন দেশটির আরও বিচক্ষণ নীতিনির্ধারকেরা। ২০০৭ সালে কাশিওয়াজাকিতে জাপানের সর্ববৃহৎ পারমাণবিক কেন্দ্র ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে কাজের উদাহরণ হতো। গত কয়েক সপ্তাহে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনের মতে, কাশিওয়াজাকি পারমাণবিক স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছিল একটি সক্রিয় ভূকম্পন অঞ্চলে। দেখা গেল রিখটার স্কেলে ৬.৮ মাত্রার যে ভূমিকম্প সে বছর আঘাত হানে, সেই মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম সেই স্থাপনাটিতে নেই। ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের মতোই কাশিওয়াজাকি পারমাণবিক স্থাপনাটির মালিকানা ছিল টোকিও পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (টেপকো)। টেপকো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ সংস্থা। ২০০৭ সালের দুর্ঘটনার পর জাপানি সরকারের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে টেপকো। যেসব সমস্যাকে টেপকো তেমন আমল করেনি, তাদের অন্যতম হলো তেজস্ক্রিয় পানি নির্গত হয়ে সাগরে পতিত হওয়ার সমস্যা। সুতরাং যথার্থভাবেই দায়ী করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে বিপর্যয়ের পরও যে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে টেপকো কিংবা জাপানি সরকার কেউই দেশটির পারমাণবিক জ্বালানিনীতি পুনর্বিবেচনা করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
ফুকুশিমা বিপর্যয়ের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। পুরো পারমাণবিক লবি (জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিদর্শন সংস্থা এবং দেশটির ক্ষমতাশালী জ্বালানি করপোরেশনগুলো) যেভাবে কাজ করে, সে বিষয়টিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় এটি। ২০০২ সালে জাপানের ১০ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাদের পারমাণবিক চুল্লিতে সংঘটিত দুর্ঘটনা আড়াল করার অভিযোগ ওঠে। এ ধরনের কলঙ্কজনক অনুশীলন শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। তখন জাপান সবে পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করেছে। ২০০২ সালের কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও প্রধান দোষী আবারও সেই টেপকো। ইসাকু সাতো ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ফুকুশিমা জেলার অত্যন্ত জনপ্রিয় গভর্নর ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে টেপকোর মিথ্যাচারিতার ইতিবৃত্ত প্রকাশ পেল। ফরাসি দৈনিক লঁ মঁদ-এর সঙ্গে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ২০০২ সালে টেপকোকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য করা হয় যে পূর্ববর্তী কয়েকটি দুর্ঘটনার ফলে দুটি চুল্লির ক্ষয়ক্ষতির ওপর পরিদর্শন প্রতিবেদনে তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। তা ছাড়া টেপকো শুধু গুরুত্বপূর্ণ দলিলেই মিথ্যা তথ্য দেয়নি, জাপানের পারমাণবিক নিরাপত্তা সংস্থা নিসা যখন এসব মিথ্যাচারের ব্যাপারে অবগত হয়, তখন সেটিও নিশ্চুপ থাকে এবং সত্য প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়। এই কেলেঙ্কারির ফলে সাময়িকভাবে ফুকুশিমার ১ নম্বর চুল্লিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং অন্যান্য জায়গায় আরও ১৬টি চুল্লি পরিদর্শনের পেছনেও কাজ করেছিল। তবে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেনি। তাই বর্তমান বিপর্যয়কে সাতো ‘মানুষের অপরিণামদর্শিতা’ তাড়িত বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা বোধ করেন না। জাপানের পারমাণবিক চুল্লিগুলোর অনেক বয়স হওয়ার ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। জ্বালানি নীতিনির্ধারণে গণতন্ত্রের ঘাটতির ফল তো পাওয়া যাবেই।
ফুকুশিমা বিপর্যয় সম্ভব করে তুলল যে মানবিক ব্যর্থতা তা থেকে কী শিক্ষা নিতে হবে? যে বিরাট স্বার্থ (জাপান ও সারা দুনিয়ার পারমাণবিক লবির ক্ষমতা) আজ হুমকির সম্মুখীন, সেই বিবেচনায় যা ঘটতে পারে তা হলো, পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারার জন্য নীতিনির্ধারকেরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দায় অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাইবেন। এর বিপদ ইতিমধ্যে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তাই দেশের ভেতর জনরোষ বাড়তে থাকায় জাপান সরকার বলেছে যে টেপকো জাতীয়করণের চিন্তাভাবনা চলছে। এই বিপর্যয়ের প্রাথমিক দায় বহন করে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আগে জাতীয়করণের এই আগাম পদক্ষেপ একে বাঁচিয়ে দিতে পারে। আরও মৌলিক যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা জরুরি, সেগুলো থেকেও সহজেই দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দিতে পারে এই পদক্ষেপ। শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সমালোচক এবং পারমাণবিক জ্বালানির বিরোধীরা বহু বছর ধরে যুক্তি প্রদর্শন করছেন যে এবারের মতো প্রতিবেশ বিপর্যয় আগেও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ঘটেছে দুবার। প্রথমবার ১৯৫৭ সালে চেরনিয়াবিনস্ক সামরিক-পারমাণবিক স্থাপনায়। আর দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলে বেসামরিক পারমাণবিক স্থাপনায়। আজ হোক কাল হোক, এমন বিপর্যয় অন্যান্য স্থানেও ঘটতে বাধ্য। পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার অব্যাহত রাখার প্রজ্ঞার ব্যাপারে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপনের এটাই কি উপযুক্ত সময় নয়? ফুকুশিমা থেকে বিশ্ববাসী যা শিখতে পারে, তার পুনরুক্তি করছি: পারমাণবিক উৎপাদন সহজাতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, আর পারমাণবিক জ্বালানি বিক্রি করে মুনাফাকারী করপোরেট মালিকেরা তাঁদের স্বাভাবিক স্বার্থেই এই ঝুঁকিকে হালকা করে দেখাতে চান।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি; গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ। পরমাণু উৎপাদনের তাত্ত্বিক পাঠবিষয়ক একটি বইয়ের রচয়িতা।
ইউরোপীয় পারমাণবিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ৩ নম্বর চুল্লির তলায় সম্ভবত জ্বালানি রড ও ধাতুর গলিত বিশালাকার বুদ্বুদ তৈরি হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে এই চুল্লিতেই মিশ্র ইউরেনিয়াম-প্লুটোনিয়াম জ্বালানি রডের অংশ হিসেবে প্লুটোনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত উপাদান এই প্লুটোনিয়াম। অতি নগণ্য পরিমাণ প্লুটোনিয়াম পাকস্থলীতে গেলে কিংবা শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে ঢুকলে তা মানুষের ফুসফুস, হাড় ও যকৃতে ক্যানসার ঘটাতে পারে। ফুটতে থাকা লাভাজাতীয় বুদ্বুদ একসময় কংক্রিটের তৈরি চুল্লির ভিত্তিস্তম্ভ ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত পোষণ করছেন না। পাশের দিকেও তো বুদ্বুদ নির্গত হয়ে আসতে পারে। একটি চুল্লির টারবাইন কক্ষে এবং সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকাগুলোতে ইতিমধ্যে অত্যন্ত উচ্চমাত্রার বিকিরণ ধরা পড়েছে। একই মাত্রার আতঙ্কজনক খবর হলো, পারমাণবিক স্থাপনার কাছাকাছি চার-পাঁচটি স্থানের মাটিতে প্লুটোনিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।
পারমাণবিক সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধি আর ধীরে ধীরে প্রলয়ংকরী রূপ নিতে থাকার মুহূর্তে জাপানি নীতিনির্ধারকেরা তাঁদের দূরদৃষ্টিহীনতার ব্যাপারে ধীরে হলেও আত্মানুসন্ধান শুরু করেছেন। জাপান ভূমিকম্প ও সুনামিপ্রবণ—এ কথা বিশ্ববাসীর কাছে সুবিদিত। সুনামি জাপানি শব্দ। জাপানের ইতিহাসে রাজধানী টোকিওতে বারবার ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। তা ছাড়া অতীতে সুনামির ফলে যে বিপুল জলোচ্ছ্বাস হতো, তাতে উপকূলীয় এলাকায় বসবাস স্বাভাবিকভাবেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। উদাহরণস্বরূপ ১৮৯৬ ও ১৯৩৩ সালের সুনামির কথা বলা যায়। জাপানি ভূতাত্ত্বিকদের মতে, তখন যথাক্রমে ৩৮ ও ২৯ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস এসে আঘাত হেনেছিল। গত ১১ মার্চ জাপানের উপকূলে যে জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছে তার উচ্চতা নিশ্চয় ততটা প্রবল ছিল না। তথাপি, ফুকুশিমা-দাইচি পারমাণবিক স্থাপনার কাছে নির্মিত সুরক্ষা দেয়ালের চেয়ে তিন গুণ উঁচু ছিল সেই জলোচ্ছ্বাস। সম্ভাব্য সুনামির প্রভাব মোকাবিলার জন্যই এমন দেয়াল তৈরি করা হয়েছিল। প্রায় ৪০ বছর আগে এই স্থাপনাটি নির্মাণ করার সময় খোদ জাপানে সংঘটিত সুনামিগুলোকে বিবেচনায় না এনে সুদূর চিলির ১৯৫৬ সালের সুনামিকে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। ২০০৬ সাল পর্যন্ত পারমাণবিক চুল্লির নিরাপত্তার ব্যাপারে সরকারি নির্দেশনায় সুনামি ভাবনাকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে। সুতরাং, সাগরের পানি ফুকুশিমা-দাইচি বিদ্যুৎ উৎপাদনব্যবস্থাকে নিমজ্জিত করে দিতে পারে, এই সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করার মাধ্যমে জাপানি কর্তৃপক্ষ এই পারমাণবিক বিপর্যয় নিজেরাই প্ররোচিত করেছে, এ কথা তর্কের খাতিরে বলা যেতেই পারে।
জাপানের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক সমালোচকেরা সুনামি অথবা ভূমিকম্পের সম্ভাব্য হুমকির বিষয়ে আগেই জাপানি কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেছিল। আসলে পারমাণবিক চুল্লি বিষয়ে জাপানের যথেষ্ট ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, যার ওপর দাঁড়িয়ে সামনে এগোতে পারতেন দেশটির আরও বিচক্ষণ নীতিনির্ধারকেরা। ২০০৭ সালে কাশিওয়াজাকিতে জাপানের সর্ববৃহৎ পারমাণবিক কেন্দ্র ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে কাজের উদাহরণ হতো। গত কয়েক সপ্তাহে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনের মতে, কাশিওয়াজাকি পারমাণবিক স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছিল একটি সক্রিয় ভূকম্পন অঞ্চলে। দেখা গেল রিখটার স্কেলে ৬.৮ মাত্রার যে ভূমিকম্প সে বছর আঘাত হানে, সেই মাত্রার ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম সেই স্থাপনাটিতে নেই। ফুকুশিমা পারমাণবিক কেন্দ্রের মতোই কাশিওয়াজাকি পারমাণবিক স্থাপনাটির মালিকানা ছিল টোকিও পাওয়ার সাপ্লাই কোম্পানির (টেপকো)। টেপকো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিদ্যুৎ সংস্থা। ২০০৭ সালের দুর্ঘটনার পর জাপানি সরকারের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে টেপকো। যেসব সমস্যাকে টেপকো তেমন আমল করেনি, তাদের অন্যতম হলো তেজস্ক্রিয় পানি নির্গত হয়ে সাগরে পতিত হওয়ার সমস্যা। সুতরাং যথার্থভাবেই দায়ী করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে বিপর্যয়ের পরও যে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে টেপকো কিংবা জাপানি সরকার কেউই দেশটির পারমাণবিক জ্বালানিনীতি পুনর্বিবেচনা করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
ফুকুশিমা বিপর্যয়ের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। পুরো পারমাণবিক লবি (জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিদর্শন সংস্থা এবং দেশটির ক্ষমতাশালী জ্বালানি করপোরেশনগুলো) যেভাবে কাজ করে, সে বিষয়টিকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় এটি। ২০০২ সালে জাপানের ১০ বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাদের পারমাণবিক চুল্লিতে সংঘটিত দুর্ঘটনা আড়াল করার অভিযোগ ওঠে। এ ধরনের কলঙ্কজনক অনুশীলন শুরু হয় ১৯৭০-এর দশকে। তখন জাপান সবে পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করেছে। ২০০২ সালের কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রেও প্রধান দোষী আবারও সেই টেপকো। ইসাকু সাতো ১৯৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ফুকুশিমা জেলার অত্যন্ত জনপ্রিয় গভর্নর ছিলেন। তাঁর কাছ থেকে টেপকোর মিথ্যাচারিতার ইতিবৃত্ত প্রকাশ পেল। ফরাসি দৈনিক লঁ মঁদ-এর সঙ্গে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ২০০২ সালে টেপকোকে স্বীকার করে নিতে বাধ্য করা হয় যে পূর্ববর্তী কয়েকটি দুর্ঘটনার ফলে দুটি চুল্লির ক্ষয়ক্ষতির ওপর পরিদর্শন প্রতিবেদনে তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। তা ছাড়া টেপকো শুধু গুরুত্বপূর্ণ দলিলেই মিথ্যা তথ্য দেয়নি, জাপানের পারমাণবিক নিরাপত্তা সংস্থা নিসা যখন এসব মিথ্যাচারের ব্যাপারে অবগত হয়, তখন সেটিও নিশ্চুপ থাকে এবং সত্য প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়। এই কেলেঙ্কারির ফলে সাময়িকভাবে ফুকুশিমার ১ নম্বর চুল্লিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং অন্যান্য জায়গায় আরও ১৬টি চুল্লি পরিদর্শনের পেছনেও কাজ করেছিল। তবে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেনি। তাই বর্তমান বিপর্যয়কে সাতো ‘মানুষের অপরিণামদর্শিতা’ তাড়িত বলে আখ্যায়িত করতে দ্বিধা বোধ করেন না। জাপানের পারমাণবিক চুল্লিগুলোর অনেক বয়স হওয়ার ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যাচ্ছে। জ্বালানি নীতিনির্ধারণে গণতন্ত্রের ঘাটতির ফল তো পাওয়া যাবেই।
ফুকুশিমা বিপর্যয় সম্ভব করে তুলল যে মানবিক ব্যর্থতা তা থেকে কী শিক্ষা নিতে হবে? যে বিরাট স্বার্থ (জাপান ও সারা দুনিয়ার পারমাণবিক লবির ক্ষমতা) আজ হুমকির সম্মুখীন, সেই বিবেচনায় যা ঘটতে পারে তা হলো, পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারার জন্য নীতিনির্ধারকেরা ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দায় অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাইবেন। এর বিপদ ইতিমধ্যে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তাই দেশের ভেতর জনরোষ বাড়তে থাকায় জাপান সরকার বলেছে যে টেপকো জাতীয়করণের চিন্তাভাবনা চলছে। এই বিপর্যয়ের প্রাথমিক দায় বহন করে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার আগে জাতীয়করণের এই আগাম পদক্ষেপ একে বাঁচিয়ে দিতে পারে। আরও মৌলিক যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করা জরুরি, সেগুলো থেকেও সহজেই দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দিতে পারে এই পদক্ষেপ। শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সমালোচক এবং পারমাণবিক জ্বালানির বিরোধীরা বহু বছর ধরে যুক্তি প্রদর্শন করছেন যে এবারের মতো প্রতিবেশ বিপর্যয় আগেও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ঘটেছে দুবার। প্রথমবার ১৯৫৭ সালে চেরনিয়াবিনস্ক সামরিক-পারমাণবিক স্থাপনায়। আর দ্বিতীয়বার ১৯৮৬ সালে চেরনোবিলে বেসামরিক পারমাণবিক স্থাপনায়। আজ হোক কাল হোক, এমন বিপর্যয় অন্যান্য স্থানেও ঘটতে বাধ্য। পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহার অব্যাহত রাখার প্রজ্ঞার ব্যাপারে মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপনের এটাই কি উপযুক্ত সময় নয়? ফুকুশিমা থেকে বিশ্ববাসী যা শিখতে পারে, তার পুনরুক্তি করছি: পারমাণবিক উৎপাদন সহজাতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ, আর পারমাণবিক জ্বালানি বিক্রি করে মুনাফাকারী করপোরেট মালিকেরা তাঁদের স্বাভাবিক স্বার্থেই এই ঝুঁকিকে হালকা করে দেখাতে চান।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: আহসান হাবীব
ড. পিটার কাস্টার্স: প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধি; গবেষক ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ। পরমাণু উৎপাদনের তাত্ত্বিক পাঠবিষয়ক একটি বইয়ের রচয়িতা।
No comments