নারীনীতি, হুংকার এবং বাউলদের ওপর আক্রমণ by জোবাইদা নাসরীন
গত ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে ৭ মার্চ মন্ত্রিপরিষদে নারীনীতির খসড়া অর্থাৎ জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, ২০১১ অনুমোদন করা হয়। সেই নারীনীতির বিপক্ষে ফজলুল হক আমিনী ৪ এপ্রিল হরতাল ঘোষণা করেন। বিএনপি ও তার শরিক দলের নৈতিক সমর্থন ছিল এই হরতালের প্রতি। বিএনপি জোরেশোরে কিছু বলতে পারছে না, তার কারণ, এ দেশে ৫০ শতাংশ ভোটার নারী। পাছে যদি ভোট নষ্ট হয়!
যে সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছে নারীদের হাতে, পিতার অভিভাবকত্বের পাশাপাশি মায়ের নাম অভিভাবক হিসেবে যোগ করেছে, সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নারীকে যুক্ত করে বাহ্বা পেয়েছে, ধর্ষণের ফলে জন্মগ্রহণকারী শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছে, মায়ের মাধ্যমেও সন্তান নাগরিকত্ব পাওয়ার আইন করেছে আর সেই সরকারের নারীনীতি থেকে ১৪ বছর পর উত্তরাধিকারে সমসম্পত্তির ধারা উঠে গেল! যে সরকার ১৯৯৭ সালেই নারীর এই সম-অধিকারের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেছিল, এখন আর সেভাবে ভাবছে না? দেশ কি তবে ১৪ বছর পিছিয়েই গেল? কিন্তু পরিসংখ্যান আমাদের ভিন্ন তথ্য দেয়। এ দেশে ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সালে নারী এগিয়েছে অনেক দূর—কর্মে, চিন্তায়, বিশ্বাসে, অভিজ্ঞতায়, দক্ষতায়। প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় রাজনীতি দিয়েই লিখিত হবে সেক্যুলার বাংলাদেশের নারীদের ভবিষ্যৎ?
এই আমিনীরা সেই গোষ্ঠী, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা মুক্তিযুদ্ধকালে এ দেশের নারী নির্যাতনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। তারা বলে, যুদ্ধের সময় নারী ধর্ষণে কোনো অপরাধ নেই। তারা ফতোয়ার পক্ষে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যায় এবং সব ক্ষেত্রে নারীর সমসুযোগ এবং সম-অধিকারবিরোধী তারা।
পর পর দেশে চারটি নারীনীতি হয়েছে, ১৯৯৭, ২০০৪, ২০০৮ ও ২০১১ সালে। দেশ কি আসলেই মূল্যবোধের দিক থেকে, সমতার মনোভাব থেকে সরে এসেছে? তা ছাড়া এই আওয়ামী লীগ সরকারই নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে ১৯৯৭ সালের নারীনীতির বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম-সংশ্লিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তাহলে বাংলাদেশকে আরও বেশি ধর্মাশ্রয়ী হিসেবেই দাঁড় করাচ্ছে। সংবিধানের বিভিন্ন ধারার ওপর ভর দিয়ে তৈরি হওয়া নারীনীতির নির্ধারকেরা একবারও খেয়াল করেননি যে সংবিধান ও নারীনীতি সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ২৮ থেকে ৩২-এর ধারার বিভিন্ন উপধারায় নারী-পুরুষের সমতার কথা উল্লেখ থাকলেও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার কীভাবে নারীনীতিতে এখনো আনতে পারল না? আরও প্রশ্ন থাকে যে সরকার কোন কোন হুমকিকে গুরুত্ব দেয় আর কোনটিকে দেয় না।
তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, নারীনীতি নিয়ে এত হইচই, আশা-আকাঙ্ক্ষা, তিনটি ভাগে বিভক্ত ৪৯টি ধারা আঁকড়ে থাকা সেই নারীনীতিতে কোথাও উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন, কিংবা নারীর অধিকার কী হবে, সেই বিষয়ে কোনো ধারা তো দূরে থাক, একটি বাক্যও নেই। তবে দুটো ধারায় এই সম্পর্কে কিছু কথা বলা আছে। তার মধ্যে একটি হলো, জাতীয় অর্থনীতির সব কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় ও সমানাধিকার নিশ্চিতকরণ। সাবহেডে ২৩.৫ ধারায় বলা হয়েছে: সম্পদ কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারি দেওয়া। আরও কিছু দূর গেলে পাওয়া যাবে আরেকটি ধারা, যেটি ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শিরোনামের আরেক সাবহেডের মধ্যে পড়েছে। সেখানে বলা হয়েছে: উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা। এই নারীনীতির সমালোচনা করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলেছেন, এটি একটি পানসে নারীনীতি। বাম দলগুলো প্রশ্ন তুলেছে, এই নীতিতে সমাজের নিপীড়িত ও বঞ্চিত নারীদের কথা নেই। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে, হরতাল হয়েছে। কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। তাহলে সংসদের দুটি আসনের মালিকানাধীন ইসলামি দলগুলোর তুচ্ছ হুমকিতেই সরকার ভয় পেল? আর অন্যান্য সিদ্ধান্তের সময় লোকজন প্রতিবাদ করতে পারে—এই ভয়ে সরকার ভীত হয় না কেন? আসলে সমস্যাটা কোন জায়গায়? সমস্যা যদি ধর্মই হয়, তাহলে তিউনিসিয়া, মরক্কো ও সেনেগালের মতো মুসলিম দেশগুলোতে কীভাবে সম্পত্তিতে সমান অধিকার পেল নারী?
নারীনীতিকে কেন্দ্র করে নারীর বিরুদ্ধে যখন দেশে হুংকার চলছে, তখনই রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে জোর করে লালনভক্ত ২৮ জন বাউলের চুল, গোঁফ কামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দেশে বাউলসংস্কৃতির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সমাজের সব ধরনের সমতার ভিত্তি। তাই বাউলদের ওপর আক্রমণ আমাদের জানান দেয়, এ ধরনের আক্রমণের শিকার আমি-আপনি যে কেউই হতে পারি। প্রগতিবিরোধী লোকজন শুধু আমিনীর দলে নয়, আশপাশের অনেক জায়গায়ই আছে। কারও জীবনাচরণ কারও অপছন্দ হতেই পারে, তাই বলে তার ওপর আঘাত করা হবে কেন? এবং পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পারি, হামলাকারীরা অনেকেই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের। বছর কয়েক আগেও এ দেশে বাউল-ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। সরকার যখন আমিনীদের হুংকারকে অগ্রাহ্য করে নারীনীতি বাস্তবায়ন করতে চাইছে, তখন এই অসাম্প্রদায়িক বাউলদের ওপর আক্রমণ একভাবে সেই আমিনীদেরই সামনে নিয়ে আসে।
আজ প্রয়োজন নারী-পুরুষের সম্মিলিত লড়াই। যে লড়াই সম-অধিকারের পক্ষে, সব ধরনের সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে। আশা করি, সরকার অবিলম্বে রাজবাড়ীতে বাউলদের ওপর যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার ও বিচার করবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
যে সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছে নারীদের হাতে, পিতার অভিভাবকত্বের পাশাপাশি মায়ের নাম অভিভাবক হিসেবে যোগ করেছে, সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে নারীকে যুক্ত করে বাহ্বা পেয়েছে, ধর্ষণের ফলে জন্মগ্রহণকারী শিশুর দায়িত্ব রাষ্ট্র গ্রহণ করার ঘোষণা দিয়েছে, মায়ের মাধ্যমেও সন্তান নাগরিকত্ব পাওয়ার আইন করেছে আর সেই সরকারের নারীনীতি থেকে ১৪ বছর পর উত্তরাধিকারে সমসম্পত্তির ধারা উঠে গেল! যে সরকার ১৯৯৭ সালেই নারীর এই সম-অধিকারের প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেছিল, এখন আর সেভাবে ভাবছে না? দেশ কি তবে ১৪ বছর পিছিয়েই গেল? কিন্তু পরিসংখ্যান আমাদের ভিন্ন তথ্য দেয়। এ দেশে ১৯৯৭ থেকে ২০১১ সালে নারী এগিয়েছে অনেক দূর—কর্মে, চিন্তায়, বিশ্বাসে, অভিজ্ঞতায়, দক্ষতায়। প্রশ্ন হলো, শেষ পর্যন্ত ধর্মীয় রাজনীতি দিয়েই লিখিত হবে সেক্যুলার বাংলাদেশের নারীদের ভবিষ্যৎ?
এই আমিনীরা সেই গোষ্ঠী, যারা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা মুক্তিযুদ্ধকালে এ দেশের নারী নির্যাতনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। তারা বলে, যুদ্ধের সময় নারী ধর্ষণে কোনো অপরাধ নেই। তারা ফতোয়ার পক্ষে সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যায় এবং সব ক্ষেত্রে নারীর সমসুযোগ এবং সম-অধিকারবিরোধী তারা।
পর পর দেশে চারটি নারীনীতি হয়েছে, ১৯৯৭, ২০০৪, ২০০৮ ও ২০১১ সালে। দেশ কি আসলেই মূল্যবোধের দিক থেকে, সমতার মনোভাব থেকে সরে এসেছে? তা ছাড়া এই আওয়ামী লীগ সরকারই নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে ১৯৯৭ সালের নারীনীতির বাস্তবায়ন করবে। কিন্তু কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম-সংশ্লিষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তাহলে বাংলাদেশকে আরও বেশি ধর্মাশ্রয়ী হিসেবেই দাঁড় করাচ্ছে। সংবিধানের বিভিন্ন ধারার ওপর ভর দিয়ে তৈরি হওয়া নারীনীতির নির্ধারকেরা একবারও খেয়াল করেননি যে সংবিধান ও নারীনীতি সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ২৮ থেকে ৩২-এর ধারার বিভিন্ন উপধারায় নারী-পুরুষের সমতার কথা উল্লেখ থাকলেও উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমানাধিকার কীভাবে নারীনীতিতে এখনো আনতে পারল না? আরও প্রশ্ন থাকে যে সরকার কোন কোন হুমকিকে গুরুত্ব দেয় আর কোনটিকে দেয় না।
তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, নারীনীতি নিয়ে এত হইচই, আশা-আকাঙ্ক্ষা, তিনটি ভাগে বিভক্ত ৪৯টি ধারা আঁকড়ে থাকা সেই নারীনীতিতে কোথাও উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন, কিংবা নারীর অধিকার কী হবে, সেই বিষয়ে কোনো ধারা তো দূরে থাক, একটি বাক্যও নেই। তবে দুটো ধারায় এই সম্পর্কে কিছু কথা বলা আছে। তার মধ্যে একটি হলো, জাতীয় অর্থনীতির সব কর্মকাণ্ডে নারীর সক্রিয় ও সমানাধিকার নিশ্চিতকরণ। সাবহেডে ২৩.৫ ধারায় বলা হয়েছে: সম্পদ কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারি দেওয়া। আরও কিছু দূর গেলে পাওয়া যাবে আরেকটি ধারা, যেটি ‘নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন’ শিরোনামের আরেক সাবহেডের মধ্যে পড়েছে। সেখানে বলা হয়েছে: উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা। এই নারীনীতির সমালোচনা করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ বলেছেন, এটি একটি পানসে নারীনীতি। বাম দলগুলো প্রশ্ন তুলেছে, এই নীতিতে সমাজের নিপীড়িত ও বঞ্চিত নারীদের কথা নেই। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে, হরতাল হয়েছে। কিন্তু সরকার সিদ্ধান্ত পাল্টায়নি। তাহলে সংসদের দুটি আসনের মালিকানাধীন ইসলামি দলগুলোর তুচ্ছ হুমকিতেই সরকার ভয় পেল? আর অন্যান্য সিদ্ধান্তের সময় লোকজন প্রতিবাদ করতে পারে—এই ভয়ে সরকার ভীত হয় না কেন? আসলে সমস্যাটা কোন জায়গায়? সমস্যা যদি ধর্মই হয়, তাহলে তিউনিসিয়া, মরক্কো ও সেনেগালের মতো মুসলিম দেশগুলোতে কীভাবে সম্পত্তিতে সমান অধিকার পেল নারী?
নারীনীতিকে কেন্দ্র করে নারীর বিরুদ্ধে যখন দেশে হুংকার চলছে, তখনই রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে জোর করে লালনভক্ত ২৮ জন বাউলের চুল, গোঁফ কামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ দেশে বাউলসংস্কৃতির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে সমাজের সব ধরনের সমতার ভিত্তি। তাই বাউলদের ওপর আক্রমণ আমাদের জানান দেয়, এ ধরনের আক্রমণের শিকার আমি-আপনি যে কেউই হতে পারি। প্রগতিবিরোধী লোকজন শুধু আমিনীর দলে নয়, আশপাশের অনেক জায়গায়ই আছে। কারও জীবনাচরণ কারও অপছন্দ হতেই পারে, তাই বলে তার ওপর আঘাত করা হবে কেন? এবং পত্রিকা থেকে আমরা জানতে পারি, হামলাকারীরা অনেকেই ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের। বছর কয়েক আগেও এ দেশে বাউল-ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। সরকার যখন আমিনীদের হুংকারকে অগ্রাহ্য করে নারীনীতি বাস্তবায়ন করতে চাইছে, তখন এই অসাম্প্রদায়িক বাউলদের ওপর আক্রমণ একভাবে সেই আমিনীদেরই সামনে নিয়ে আসে।
আজ প্রয়োজন নারী-পুরুষের সম্মিলিত লড়াই। যে লড়াই সম-অধিকারের পক্ষে, সব ধরনের সাম্প্রদায়িক নিপীড়নের বিরুদ্ধে। আশা করি, সরকার অবিলম্বে রাজবাড়ীতে বাউলদের ওপর যারা হামলা চালিয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার ও বিচার করবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com
No comments