দূরশিক্ষণ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

সমপ্রতি মন্ত্রিপরিষদ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের সংশোধনী খসড়া অনুমোদন দিয়েছে। এ আইন সংসদে পাস হলে যেকোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন সাপেক্ষে আউটার ক্যাম্পাস স্থাপন এবং দূরশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করতে পারবে। অচিরেই খসড়াটি সংসদে উত্থাপিত হবে।
একজন শিক্ষক এবং সচেতন নাগরিক হিসেবে খবরটি আমার কাছে সুখবর বলে মনে হয়নি। ১৯৯২ সালে যখন সর্বপ্রথম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ার পর দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শুরু হয়, তখন থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছি। কাজের সুবাদে এবং ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য নিয়মিত সংগ্রহ করেছি, পর্যালোচনা করেছি এবং বিষয়গুলো অনুধাবন করার চেষ্টা করেছি। সব বিষয়ের মধ্যে দূরশিক্ষণ কর্মসূচি এবং আউটার ক্যাম্পাস বিষয় দুটি সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয় বলে মনে হয়েছে।
১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় দূরশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমান সরকার দূরশিক্ষণ ও আউটার ক্যাম্পাস স্থাপনের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব গ্রহণ করায় অনেকেই দূরশিক্ষণ কার্যক্রম প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। এ রকম পরিস্থিতিতে হঠাত্ করে মন্ত্রিপরিষদ সম্প্রতি কেন দূরশিক্ষণ কর্মসূচি ‘শর্তসাপেক্ষে’ অনুমোদনের সুযোগ রেখে আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে তা বোধগম্য নয়।
দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে লেখাপড়া করানোর ব্যাপারে নীতিগতভাবে তাদের কোনো আপত্তি থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন। বহু উন্নত ও অনুন্নত দেশে এ পদ্ধতি চালু আছে এবং শিক্ষার উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখছে। উদাহরণস্বরূপ ভারতের জওহরলাল নেহরু উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটিশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ান উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করা যায়। আমাদের দেশে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বহু বছর ধরে বেশ সাফল্যের সঙ্গে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থেকে শিক্ষার মান অটুট রেখে, আধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ করে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের শিক্ষার মান নিয়ে কেউ বড় ধরনের প্রশ্ন ওঠাচ্ছে না।
কিন্তু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দূরশিক্ষণ প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে লেজে-গোবরে অবস্থা সৃষ্টি করে ফেলেছে। এর মূল কারণ, সরকারি তদারকির সম্পূর্ণ অনুপস্থিতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মান নিয়ন্ত্রণে চরম গাফিলতি, অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে দূরশিক্ষণের কারিকুলাম প্রণয়ন, অভিজ্ঞতাহীন কর্মকর্তাদের দিয়ে প্রোগ্রাম পরিচালনা, ইলেকট্রনিক পদ্ধতির ব্যবহার না করা, নিম্নমানের কোর্স ম্যাটারিয়াল এবং সর্বোপরি, অনভিজ্ঞ শিক্ষক ও দুর্বল পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা।
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন দূরশিক্ষণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে আলাপ করে কিছু ভয়ংকর তথ্য পেয়েছি। প্রায় সবাই এক সুরে বলেছেন যে শিক্ষার্থীরা মূলত একটি সার্টিফিকেট চান, লেখাপড়া যা-ই হোক না কেন। কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক দূরশিক্ষণের অন্তঃসারশূন্যতা এবং কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কথা অকপটে জানিয়েছেন। শিক্ষকেরা বলছেন, ছাত্রছাত্রীরা চায় নম্বর (পরীক্ষার খাতায় যা-ই থাকুক না কেন); আর কর্তৃপক্ষ চায় ‘ব্যবসা’।
শিক্ষার সঠিক বিকাশের স্বার্থেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে দূরশিক্ষণ কোনোভাবেই ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। আশা করি, শিক্ষাবিষয়ক সরকারের নীতিনির্ধারকেরা এ বিষয়ে দৃষ্টি দেবেন।
এম এ মাননান, অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
drmannan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.