আত্মহত্যা সমাধান নয় by মরিয়ম চম্পা
জীবন
অনেক সুন্দর। সেই জীবনকে উপভোগ করতে হবে। দিনের পরে রাত। রাতের পরে দিন।
একইভাবে জীবনে ভালো সময় আসে। খারাপ সময়ও আসে। রাত যত গভীর হয় ভোর তত কাছে
আসে। এ বিষয়গুলো সবাই কম বেশি জানেন।
কিন্তু আবেগের কাছে সবই যেন ফিকে। ধোঁয়াশা। জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণ করে গেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারী, সাভারে গণধর্ষণের শিকার এক নারীসহ আরো অনেকে।
গত ৩রা ডিসেম্বর পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে বাবাকে ডেকে অপমান করায় তা সহ্য করতে না পেরে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অরিত্রি অধিকারী (১৫) আত্মহত্যা করে। ঘটনার দিন দুপুরে অরিত্রি গলায় ফাঁস দেয়। অরিত্রি নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। অরিত্রির বাবা দিলীপ অধিকারী একজন কাস্টসম (সিঅ্যান্ডএফ) ব্যবসায়ী। পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর শান্তিনগরে থাকতো। অরিত্রির বাবা দিলীপ অধিকারী জানান, শিক্ষকদের অভিযোগ অরিত্রি ক্লাস পরীক্ষায় মোবাইলে উত্তর লিখে নিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষকের কাছে তার নকল ধরা পড়ে। এরপর তাকে পরীক্ষায় অংশ নিতে না দিয়ে স্কুল থেকে আমাদের ডেকে পাঠানো হয়। আমি স্কুলের প্রিন্সিপালের রুমে দুঃখ প্রকাশ করতে গেলে তারা অরিত্রিকে টিসি দিয়ে দেবে বলে জানায়। মেয়ের সামনেই আমাকে অনেক কথা শোনায়। মেয়ের সামনেই কেঁদে ফেলি। অরিত্রি হয়তো আমার ওই কান্না-অপমান সহ্য করতে পারেনি। এরপর বাসায় ফিরেই সে তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে।
চলতি বছরের ৮ই জানুয়ারি গণধর্ষণের বিচার না পেয়ে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় এক নারী পোশাক শ্রমিক আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। মাহফুজা নামে ১৬ বছরের এই কিশোরী যে গার্মেন্টে কাজ করতেন সেই প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজারসহ কয়েকজন মিলে রাতের আঁধারে তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। ঘটনার দিন সকালে জামগড়া রূপায়ণ গেট এলাকায় রবিউলের ভাড়া বাড়ি থেকে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচানো অবস্থায় কিশোরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের বোন আফরোজা জানান, রহিম নামের একজন সুপারভাইজার মাহফুজাকে বেশ কিছুদিন ধরে বিরক্ত করছিল। শনিবার রাতে বাসায় ফেরার সময় ওই কারখানার সুপারভাইজার রহিম, লাইন চিপ রিপন, স্বপন ও হৃদয় তার বোনকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এরপর রূপায়ণ মাঠে রাতভর নির্যাতন করে ভোররাতে ছেড়ে দেয়।
ঘটনার পর তার বোন আশুলিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। পুলিশ ঘটনার সত্যতাও খুঁজে পায়। ধর্ষণের ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে এলাকার নাজমুল নামের এক লম্পটের নেতৃত্বে ঘটনার বিচার করে ধর্ষকদের ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পুরো টাকা আত্মসাৎ করতে সালিশকারীরা উল্টো ধর্ষিতার বোন, বাবা ও ধর্ষিতাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলেন। এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করতে শাসিয়ে দেন। এসব নিয়ে সে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। থানা থেকে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন মাহফুজা। একপর্যায়ে বড় বোন বাসার বাইরে গেলে মাহফুজা আত্মহত্যা করে।
৭ই জানুয়ারি পাবনার চাটমোহরে মাদকসেবী স্বামীর ওপর অভিমান করে ফরিদা খাতুন (২৮) নামে এক গৃহবধূ গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সকাল ১০টার দিকে উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের ভাদড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। তিনি ওই গ্রামের মাদকসেবী খোকন হোসেনের স্ত্রী ও তিন সন্তানের জননী। গৃহবধূ ফরিদা খাতুনের স্বামী একজন মাদকসেবী। এর আগে সে মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করার জন্য ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করে। খোকন আবারো মাদক সেবনের টাকা জোগাড়ের জন্য ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করতে চাইলে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। পরে অভিমান করে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে ফরিদা খাতুন।
এদিকে ২০১৮ সালে প্রথম ১১ মাসে ঢাবিতে ৯ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। শুধু গত বছরের ১২ থেকে ১৬ই নভেম্বরের মধ্যেই আত্মহত্যা করেছেন ৩ শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন একজন। প্রেমঘটিত কারণ, পারিবারিক অভাব-অনটন, বেকারত্ব, একাডেমিক চাপসহ বিভিন্ন বিষণ্নতার কারণে আত্মহননের মতো জঘন্য পথ বেছে নিয়েছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরকে আরো কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। এ ছাড়া হল ও বিভাগসমূহে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি নজর দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ব পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে বছরে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে ৬০ হাজার জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা ২০২০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে আত্মহত্যার সংখ্যা হবে বছরে সাড়ে ১৫ লাখ। পৃথিবীতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি (বছরে প্রতি লাখে ২৯ জন)। ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সব মানসিক রোগের ৫০ শতাংশ শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের আগে আর ৭৫ শতাংশই শুরু হয় ২৫ বছর বয়সের আগে! অর্থাৎ বিষণ্নতা থেকে শুরু করে আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগগুলো এই বয়সেই বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১১ থেকে ২৫ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘মেন্টাল হেলথ স্ট্যাটাস অব অ্যাডলসেনস ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া: এভিডেন্স ফর অ্যাকশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ৭ শতাংশ ছেলে ও ৬ শতাংশ মেয়ে। বাংলাদেশে আগে থেকে আত্মহত্যার কল্পনা করে ৮ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। কল্পনায় আত্মহত্যার বিষয়টি ঘুরপাক খায় ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে।
আত্মহত্যা বিষয়ে সংবাদকর্মীদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন
আত্মহত্যার খারাপ দিক সম্পর্কে জনগণকে জানান। আত্মহত্যা কোনো সমাধান ‘নয়’ লেখার সময় তা মাথায় রাখুন। একই সঙ্গে আত্মহত্যাকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপন করে, এমন ভাষা পরিহার করুন। পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশে আত্মহত্যার খবর ছাপাবেন না। আবার ঘটনার অযৌক্তিক পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক। লেখায় আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টার রগরগে বর্ণনা দেবেন না। যে স্থানে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বর্ণনা দেয়া থেকেও বিরত থাকুন। বুঝেশুনে শিরোনাম দিন। স্থির বা ভিডিওচিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন। তারকাদের আত্মহত্যার খবর উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিন। আত্মহত্যায় মৃতের স্বজনদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। কোথায় ও কীভাবে সাহায্য চাইতে হবে, সে তথ্য দিন। খোদ সংবাদকর্মীরা আত্মহত্যার খবর থেকে প্রভাবিত হতে পারেন। তা-ও মাথায় রাখুন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করছেন ২১-৩০ বছর বয়সীরা। এর মধ্যেও নারীর সংখ্যা বেশি।
বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে, প্রতিবছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছেন। এর বাইরে আছে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়া, রেললাইনে ঝাঁপ দেয়া। তাদের হিসাবে, এর বাইরে দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে যত রোগী ভর্তি হয়, তার সর্বোচ্চ ২০ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া লোকজন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ আত্মহত্যার ৯৭০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে নারীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন এবং ইভটিজিং-এর ঘটনা বাড়ায় অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন।
বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২০০। জেলা পর্যায়েই মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। শুধু ২২টি মেডিকেল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পাবনার হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে যত লোক আত্মহত্যা করেন, তার অন্তত ১০ গুণ লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যান। কিন্তু তারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। সঠিক মানসিক চিকিৎসা না হলে তাদের বড় একটি অংশ আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, কিছু লোক থাকে প্রকৃতিগতভাবেই তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বা মনোভাব থাকে। এটা হতে পারে শিক্ষা জীবনের কোনো অপ্রাপ্তি, কিশোর জীবনে তার প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করা হলে, কোনো বঞ্চনার শিকার হওয়া থেকে শুরু করে নানান কারণে। এ ছাড়া সমাজ জীবনে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণেও হতে পারে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সকল সংস্থাকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। একক মাত্র ব্যক্তি দ্বারা এর সমাধান সম্ভব নয়। চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, এলাকার মাতব্বর, মসজিদের ইমাম, সাংবাদিক, পুলিশ প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ভূমিকা আছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যার দিকে বেশি ঝোঁকে। তারা যেন কোনোভাবে এদিকে ধাবিত না হয় বা সুযোগ না পায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে যারা আত্মহত্যা করে তারা তাদের জীবনের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না বলেই হতাশা থেকে আত্মহত্যা করে। এরমধ্যে মাত্রাগত এবং ধরনগত পার্থক্য আছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে যাদের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর তারা আত্মহত্যা করে। কারণ একজন নারী ধর্ষিত হয়ে বিচার পাবে না। বাইরে মুখ দেখাতে পারবে না। ছোট ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিসে তারা মুখ দেখাতে পারবে না বলেই জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে আত্মসম্মানের ভয়ে আত্মহত্যা করে।
আমাদের প্রত্যেকের জীবন এক রকম নয়। তারা এমন একটি পর্যায়ে যায় যে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে স্বস্তি পাবে তাই এটা করে। তারা যে এটা খুব খুশি মনে করছে তা কিন্তু নয়। এটা যার যার প্রয়োজনে সে সে করছে। আত্মহত্যা বন্ধে প্রথম কথা হচ্ছে আইনের শাসন থাকতে হবে। আমাদের দেশে সব আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। একজন ধর্ষিতা কেনো আত্মহত্যা করছে? কারণ সে দেশের প্রচলিত আইনের কাছে সঠিক বিচার পাচ্ছে না তাই। যদি সে বিচারিক প্রশাসনের কাছে বিচার পেতেন তাহলে আত্মহত্যা করতেন না।
কিন্তু আবেগের কাছে সবই যেন ফিকে। ধোঁয়াশা। জীবন দিয়ে সেটা প্রমাণ করে গেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রি অধিকারী, সাভারে গণধর্ষণের শিকার এক নারীসহ আরো অনেকে।
গত ৩রা ডিসেম্বর পরীক্ষায় নকল করার অভিযোগে বাবাকে ডেকে অপমান করায় তা সহ্য করতে না পেরে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অরিত্রি অধিকারী (১৫) আত্মহত্যা করে। ঘটনার দিন দুপুরে অরিত্রি গলায় ফাঁস দেয়। অরিত্রি নবম শ্রেণির ছাত্রী ছিল। অরিত্রির বাবা দিলীপ অধিকারী একজন কাস্টসম (সিঅ্যান্ডএফ) ব্যবসায়ী। পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর শান্তিনগরে থাকতো। অরিত্রির বাবা দিলীপ অধিকারী জানান, শিক্ষকদের অভিযোগ অরিত্রি ক্লাস পরীক্ষায় মোবাইলে উত্তর লিখে নিয়ে গিয়েছিল। শিক্ষকের কাছে তার নকল ধরা পড়ে। এরপর তাকে পরীক্ষায় অংশ নিতে না দিয়ে স্কুল থেকে আমাদের ডেকে পাঠানো হয়। আমি স্কুলের প্রিন্সিপালের রুমে দুঃখ প্রকাশ করতে গেলে তারা অরিত্রিকে টিসি দিয়ে দেবে বলে জানায়। মেয়ের সামনেই আমাকে অনেক কথা শোনায়। মেয়ের সামনেই কেঁদে ফেলি। অরিত্রি হয়তো আমার ওই কান্না-অপমান সহ্য করতে পারেনি। এরপর বাসায় ফিরেই সে তার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করে।
চলতি বছরের ৮ই জানুয়ারি গণধর্ষণের বিচার না পেয়ে আশুলিয়ার জামগড়া এলাকায় এক নারী পোশাক শ্রমিক আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছে। মাহফুজা নামে ১৬ বছরের এই কিশোরী যে গার্মেন্টে কাজ করতেন সেই প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজারসহ কয়েকজন মিলে রাতের আঁধারে তাকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে। ঘটনার দিন সকালে জামগড়া রূপায়ণ গেট এলাকায় রবিউলের ভাড়া বাড়ি থেকে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচানো অবস্থায় কিশোরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহতের বোন আফরোজা জানান, রহিম নামের একজন সুপারভাইজার মাহফুজাকে বেশ কিছুদিন ধরে বিরক্ত করছিল। শনিবার রাতে বাসায় ফেরার সময় ওই কারখানার সুপারভাইজার রহিম, লাইন চিপ রিপন, স্বপন ও হৃদয় তার বোনকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এরপর রূপায়ণ মাঠে রাতভর নির্যাতন করে ভোররাতে ছেড়ে দেয়।
ঘটনার পর তার বোন আশুলিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। পুলিশ ঘটনার সত্যতাও খুঁজে পায়। ধর্ষণের ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে এলাকার নাজমুল নামের এক লম্পটের নেতৃত্বে ঘটনার বিচার করে ধর্ষকদের ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পুরো টাকা আত্মসাৎ করতে সালিশকারীরা উল্টো ধর্ষিতার বোন, বাবা ও ধর্ষিতাকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছিলেন। এ নিয়ে আর বাড়াবাড়ি না করতে শাসিয়ে দেন। এসব নিয়ে সে মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। থানা থেকে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন মাহফুজা। একপর্যায়ে বড় বোন বাসার বাইরে গেলে মাহফুজা আত্মহত্যা করে।
৭ই জানুয়ারি পাবনার চাটমোহরে মাদকসেবী স্বামীর ওপর অভিমান করে ফরিদা খাতুন (২৮) নামে এক গৃহবধূ গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে। সকাল ১০টার দিকে উপজেলার মথুরাপুর ইউনিয়নের ভাদড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। তিনি ওই গ্রামের মাদকসেবী খোকন হোসেনের স্ত্রী ও তিন সন্তানের জননী। গৃহবধূ ফরিদা খাতুনের স্বামী একজন মাদকসেবী। এর আগে সে মাদক সেবনের টাকা জোগাড় করার জন্য ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করে। খোকন আবারো মাদক সেবনের টাকা জোগাড়ের জন্য ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করতে চাইলে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়। পরে অভিমান করে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে ফরিদা খাতুন।
এদিকে ২০১৮ সালে প্রথম ১১ মাসে ঢাবিতে ৯ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০০৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। শুধু গত বছরের ১২ থেকে ১৬ই নভেম্বরের মধ্যেই আত্মহত্যা করেছেন ৩ শিক্ষার্থী। এ ছাড়াও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন একজন। প্রেমঘটিত কারণ, পারিবারিক অভাব-অনটন, বেকারত্ব, একাডেমিক চাপসহ বিভিন্ন বিষণ্নতার কারণে আত্মহননের মতো জঘন্য পথ বেছে নিয়েছেন তারা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দপ্তরকে আরো কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন। এ ছাড়া হল ও বিভাগসমূহে হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি নজর দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিশ্ব পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে বছরে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে ৬০ হাজার জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা ২০২০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে আত্মহত্যার সংখ্যা হবে বছরে সাড়ে ১৫ লাখ। পৃথিবীতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যু দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি (বছরে প্রতি লাখে ২৯ জন)। ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সব মানসিক রোগের ৫০ শতাংশ শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের আগে আর ৭৫ শতাংশই শুরু হয় ২৫ বছর বয়সের আগে! অর্থাৎ বিষণ্নতা থেকে শুরু করে আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগগুলো এই বয়সেই বেশি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার হন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী। তাদের বেশির ভাগের বয়স ১১ থেকে ২৫ বছর। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত ‘মেন্টাল হেলথ স্ট্যাটাস অব অ্যাডলসেনস ইন সাউথ-ইস্ট এশিয়া: এভিডেন্স ফর অ্যাকশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ৭ শতাংশ ছেলে ও ৬ শতাংশ মেয়ে। বাংলাদেশে আগে থেকে আত্মহত্যার কল্পনা করে ৮ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। কল্পনায় আত্মহত্যার বিষয়টি ঘুরপাক খায় ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে।
আত্মহত্যা বিষয়ে সংবাদকর্মীদের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন
আত্মহত্যার খারাপ দিক সম্পর্কে জনগণকে জানান। আত্মহত্যা কোনো সমাধান ‘নয়’ লেখার সময় তা মাথায় রাখুন। একই সঙ্গে আত্মহত্যাকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপন করে, এমন ভাষা পরিহার করুন। পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশে আত্মহত্যার খবর ছাপাবেন না। আবার ঘটনার অযৌক্তিক পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক। লেখায় আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টার রগরগে বর্ণনা দেবেন না। যে স্থানে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বর্ণনা দেয়া থেকেও বিরত থাকুন। বুঝেশুনে শিরোনাম দিন। স্থির বা ভিডিওচিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন। তারকাদের আত্মহত্যার খবর উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিন। আত্মহত্যায় মৃতের স্বজনদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন। কোথায় ও কীভাবে সাহায্য চাইতে হবে, সে তথ্য দিন। খোদ সংবাদকর্মীরা আত্মহত্যার খবর থেকে প্রভাবিত হতে পারেন। তা-ও মাথায় রাখুন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করছেন ২১-৩০ বছর বয়সীরা। এর মধ্যেও নারীর সংখ্যা বেশি।
বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে, প্রতিবছর ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে গড়ে ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছেন। এর বাইরে আছে ঘুমের ওষুধ খাওয়া, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়া, রেললাইনে ঝাঁপ দেয়া। তাদের হিসাবে, এর বাইরে দেশের বড় বড় হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে যত রোগী ভর্তি হয়, তার সর্বোচ্চ ২০ ভাগ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়া লোকজন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ আত্মহত্যার ৯৭০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে নারীদের বেশি আত্মহত্যার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন এবং ইভটিজিং-এর ঘটনা বাড়ায় অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন।
বাংলাদেশে মানসিক রোগের চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২০০। জেলা পর্যায়েই মানসিক রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। শুধু ২২টি মেডিকেল কলেজ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও পাবনার হাসপাতালে মানসিক রোগের চিকিৎসা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে যত লোক আত্মহত্যা করেন, তার অন্তত ১০ গুণ লোক আত্মহত্যার চেষ্টা করে বেঁচে যান। কিন্তু তারা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। সঠিক মানসিক চিকিৎসা না হলে তাদের বড় একটি অংশ আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা করতে পারেন।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, কিছু লোক থাকে প্রকৃতিগতভাবেই তাদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বা মনোভাব থাকে। এটা হতে পারে শিক্ষা জীবনের কোনো অপ্রাপ্তি, কিশোর জীবনে তার প্রতি কোনো অন্যায় আচরণ করা হলে, কোনো বঞ্চনার শিকার হওয়া থেকে শুরু করে নানান কারণে। এ ছাড়া সমাজ জীবনে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণেও হতে পারে। তাই আত্মহত্যা প্রতিরোধে সকল সংস্থাকে যার যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। একক মাত্র ব্যক্তি দ্বারা এর সমাধান সম্ভব নয়। চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, এলাকার মাতব্বর, মসজিদের ইমাম, সাংবাদিক, পুলিশ প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো ভূমিকা আছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা আত্মহত্যার দিকে বেশি ঝোঁকে। তারা যেন কোনোভাবে এদিকে ধাবিত না হয় বা সুযোগ না পায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে যারা আত্মহত্যা করে তারা তাদের জীবনের সামনে কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পায় না বলেই হতাশা থেকে আত্মহত্যা করে। এরমধ্যে মাত্রাগত এবং ধরনগত পার্থক্য আছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে যাদের আত্মসম্মানবোধ খুব প্রখর তারা আত্মহত্যা করে। কারণ একজন নারী ধর্ষিত হয়ে বিচার পাবে না। বাইরে মুখ দেখাতে পারবে না। ছোট ভাইবোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিসে তারা মুখ দেখাতে পারবে না বলেই জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে আত্মসম্মানের ভয়ে আত্মহত্যা করে।
আমাদের প্রত্যেকের জীবন এক রকম নয়। তারা এমন একটি পর্যায়ে যায় যে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে স্বস্তি পাবে তাই এটা করে। তারা যে এটা খুব খুশি মনে করছে তা কিন্তু নয়। এটা যার যার প্রয়োজনে সে সে করছে। আত্মহত্যা বন্ধে প্রথম কথা হচ্ছে আইনের শাসন থাকতে হবে। আমাদের দেশে সব আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই। একজন ধর্ষিতা কেনো আত্মহত্যা করছে? কারণ সে দেশের প্রচলিত আইনের কাছে সঠিক বিচার পাচ্ছে না তাই। যদি সে বিচারিক প্রশাসনের কাছে বিচার পেতেন তাহলে আত্মহত্যা করতেন না।
No comments