যেভাবে ফজলুল করিম প্রধান বিচারপতি হন -সুরেন্দ্র কুমার সিনহা
সাবেক
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বই ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিম’ ইতিমধ্যে
দেশজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি করেছে। বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি আলোচনা করেছেন
বিচারপতি ফজলুল করিমের প্রধান বিচারপতি হওয়ার ক্ষেত্রে নিজের ভূমিকার
বিষয়টি। বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম হলো ‘প্রধান বিচারপতি হিসেবে ফজলুল
করিমের নিয়োগ’। সেখানকার সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠকদের জন্য তুলে দেয়া হলো।
এসকে সিনহা লিখেছেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনের অবসরে যাওয়ার কথা ২০০৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর। বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলাম ও মোহাম্মদ ফজলুল করিম তার জ্যেষ্ঠ হলেও তিনিই দেশের ১৬তম প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তোফাজ্জল ইসলাম হন ১৭তম প্রধান বিচারপতি। তিনি শপথ গ্রহণ করেন ২০০৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর।
অবসরে যান ২০১০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসের জন্য প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
তোফাজ্জল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি যে বেঞ্চে হয়েছিল, সেই বেঞ্চে প্রধান ছিলেন। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফজলুল করিমকে ডিঙ্গিয়ে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল।
ফজলুল করিম পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হওয়ার ক্ষেত্রে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। একমাত্র যে বিষয়টি তার পক্ষে ছিল সেটি হলো তিনি ছিলেন হাইকোর্ট ডিভিশনের তৃতীয় বিচারক যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানি করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে ছিলেন। তারপরও ওই আপিলের শুনানিতে তৃতীয় বিচারক হিসেবে তার ওপরই আস্থা রাখা হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতির পদ অনেক আগ থেকেই রাজনৈতিক করে ফেলা হয়েছে। ফলে শাসক দলের রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বাইরে কেউ প্রধান বিচারপতি হবেন এমনটা ছিল অচিন্তনীয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানির কারণে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও প্রধান বিচারপতি করা হয়নি। তার চেয়ে কনিষ্ঠ বিচারপতি এমএম রুহুল আমিনকে করা হয়েছিল।
কিন্তু টানা দু’ বার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হলেও নিজের পদে অটল থেকে কাজ করছিলেন ফজলুল করিম। তার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হওয়া। কারণ তার শ্বশুর বিচারপতি ইমাম উদ্দিনও প্রধান বিচারপতি ছিলেন। দেশের ১৮তম বিচারপতি হতে তিনি সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
ওদিকে বিচারপতি এবিএম খাইরুল হকও প্রধান বিচারপতি হতে চান। অথচ, তিনি আপিল বিভাগে এসেছেন মাত্র কয়েক মাস হলো। তার পক্ষে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি ছিল সেটি হলো পঞ্চম সংশোধনী মামলা ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল আবেদনের রায় তিনি দিয়েছিলেন।
ফজলুল করিম ছিলেন একজন ব্যারিস্টার। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও ছিলেন ব্যারিস্টার। তাদের মধ্যে বিশেষ যোগাযোগ ছিল। তবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় শফিক আহমেদের ক্ষমতা ছিল সামান্যই। যদিও সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীই মূলত এক্ষেত্রে একচ্ছত্র এখতিয়ার ভোগ করেন।
ফজলুল করিম এমনকি দু’বার আমার বাসায় আসেন যাতে আমি তাকে প্রধান বিচারপতি হতে সহায়তা করি। শেষ পর্যন্ত তিনি কিভাবে যেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান বাবুকে বোঝাতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যা-ই হোক না কেন, চট্টগ্রামের মানুষদের মধ্যে নিজেদের বন্ধুর প্রতি সফট কর্নার থাকে।
আখতারুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীকে ফজলুল করিমের পক্ষে আনতে সফল হন। সরকারের মধ্যেও অবশ্য দ্বিধা ছিল। একদিকে এবিএম খাইরুল হক ছিলেন আপিল বিভাগের খুবই কনিষ্ঠ বিচারক। ফজলুল করিম অপরদিকে আখতারুজ্জামানের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী অবদি পৌঁছে যান। মাঝখানে আরো দুই বিচারপতি ছিলেন, যারা বিবেচনাতেই ছিলেন না।
একেবারে শেষ মুহূর্তে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আমার টেলিফোনে আলাপ হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় আমি ফজলুল করিমকে জানাই যে আজকে রাত হবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ আজই সিদ্ধান্ত হবে কাকে বানানো হবে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি। আমি তাকে বললাম যে, রাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবো তাকে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ঠিক আগে শফিক আহমেদ রাত ১১টার দিকে আমাকে ফোন দেন। তিনি আমার মাধ্যমে ফজলুল করিমের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেতে চান যে, যদি তাকে প্রধান বিচারপতি বানানো হয়, তাহলে তিনি সরকারকে বিব্রত করার মতো কিছু করবেন না। আমি রাত সাড়ে ১১টার দিকে তড়িঘড়ি করে ফজলুল করিমের বাসার দিকে ছুটলাম। দেখলাম তিনি স্ত্রীসহ ড্রয়িং কক্ষে বসে আছেন।
ভালো সংবাদ পেয়ে তিনি নিঃসন্দেহে খুশি ছিলেন। আমি তখন তাকে আইনমন্ত্রীর বার্তা জানালাম। ফজলুল করিম শারীরিকভাবে বেশ নাজুক ছিলেন। কিন্তু তিনি সেদিন এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে আমি বাসায় প্রবেশ করার পরপরই তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আমি তাকে না দাঁড়াতে অনুরোধ করি। তিনি আমার ডান হাত ধরে বললেন, ‘আমি সবসময় তোমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো দেখেছি। তুমি আমাকে যা করতে বলবে আমি তা-ই করবো।’
আমি তার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম, কোনো পদের জন্য তার উচিত হবে না নিজেকে ছোট করা। এই পদ তো মর্যাদাপূর্ণ। সেখানে দাঁড়িয়েই আমি ফজলুল করিমের আশ্বাসের কথা আইনমন্ত্রীকে জানালাম। এরপর আমার ফোন দিয়ে তাদের মধ্যে কথা হলো।
অবশেষে তিনি প্রধান বিচারপতি হলেন। দায়িত্ব নেয়ার পরপর তিনি কিছু আইনজীবীকে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস ও খসরুজ্জামান। কিন্তু দ্রুতই পত্রিকায় প্রতিবেদন আসে যে, এদের দু’জনের বিরুদ্ধেই ছাত্র থাকাকালে ফৌজদারি রেকর্ড ছিল। যদিও সেসব ছিল রাজনৈতিক মামলা। তারপরও প্রধান বিচারপতি এই দুইজনকে শপথ গ্রহণের আমন্ত্রণ পাঠাননি।
আমি, আইনমন্ত্রী, সরকার ও অন্য যারা তার জন্য সুপারিশ করেছিল তাদের জন্য বিষয়টি বেশ বিব্রতকর ছিল। সরকার বেশ বিরক্ত ছিল এই ঘটনায়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আমিসহ একদল বিচারক কয়েকদিন পর দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলাম এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। অরিয়েন্টেশনের পর আমি প্রধান বিচারপতিকে কয়েক মিনিটের জন্য জরুরি আলোচনা করতে আমার কক্ষে আসার অনুরোধ করলাম।
আমি তাকে অনুরোধ করলাম তিনি যাতে ওই দুই বিচারকের নিয়োগ নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। আর তাদেরকে গ্রহণ করে আমাদেরকে এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন। আমি তাকে সেই রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম যখন তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি সরকারকে বিব্রত করবেন না। প্রধান বিচারপতি বেশ উচ্চকণ্ঠে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে অস্বীকৃতি জানালেন।
তবে পরবর্তীতে তার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক অতটা তিক্ত হয়নি। তিনি সাত মাস ২১ দিনের জন্য পদে ছিলেন। এরপর এবিএম খাইরুল হক প্রধান বিচারপতি হলে ওই দুই আইনজীবী বিচারপতি হন।
এসকে সিনহা লিখেছেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনের অবসরে যাওয়ার কথা ২০০৯ সালের ২২শে ডিসেম্বর। বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলাম ও মোহাম্মদ ফজলুল করিম তার জ্যেষ্ঠ হলেও তিনিই দেশের ১৬তম প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। তোফাজ্জল ইসলাম হন ১৭তম প্রধান বিচারপতি। তিনি শপথ গ্রহণ করেন ২০০৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর।
অবসরে যান ২০১০ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ মাত্র দুই মাসের জন্য প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
তোফাজ্জল ইসলামকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি যে বেঞ্চে হয়েছিল, সেই বেঞ্চে প্রধান ছিলেন। জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফজলুল করিমকে ডিঙ্গিয়ে তাকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছিল।
ফজলুল করিম পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হওয়ার ক্ষেত্রে ভীষণ আগ্রহী ছিলেন। একমাত্র যে বিষয়টি তার পক্ষে ছিল সেটি হলো তিনি ছিলেন হাইকোর্ট ডিভিশনের তৃতীয় বিচারক যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানি করেছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে ছিলেন। তারপরও ওই আপিলের শুনানিতে তৃতীয় বিচারক হিসেবে তার ওপরই আস্থা রাখা হয়েছিল।
প্রধান বিচারপতির পদ অনেক আগ থেকেই রাজনৈতিক করে ফেলা হয়েছে। ফলে শাসক দলের রাজনৈতিক ধ্যানধারণার বাইরে কেউ প্রধান বিচারপতি হবেন এমনটা ছিল অচিন্তনীয়। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানির কারণে তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও প্রধান বিচারপতি করা হয়নি। তার চেয়ে কনিষ্ঠ বিচারপতি এমএম রুহুল আমিনকে করা হয়েছিল।
কিন্তু টানা দু’ বার জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন হলেও নিজের পদে অটল থেকে কাজ করছিলেন ফজলুল করিম। তার একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হওয়া। কারণ তার শ্বশুর বিচারপতি ইমাম উদ্দিনও প্রধান বিচারপতি ছিলেন। দেশের ১৮তম বিচারপতি হতে তিনি সর্বত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
ওদিকে বিচারপতি এবিএম খাইরুল হকও প্রধান বিচারপতি হতে চান। অথচ, তিনি আপিল বিভাগে এসেছেন মাত্র কয়েক মাস হলো। তার পক্ষে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি ছিল সেটি হলো পঞ্চম সংশোধনী মামলা ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল আবেদনের রায় তিনি দিয়েছিলেন।
ফজলুল করিম ছিলেন একজন ব্যারিস্টার। আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদও ছিলেন ব্যারিস্টার। তাদের মধ্যে বিশেষ যোগাযোগ ছিল। তবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়ায় শফিক আহমেদের ক্ষমতা ছিল সামান্যই। যদিও সংবিধানে প্রেসিডেন্টের হাতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীই মূলত এক্ষেত্রে একচ্ছত্র এখতিয়ার ভোগ করেন।
ফজলুল করিম এমনকি দু’বার আমার বাসায় আসেন যাতে আমি তাকে প্রধান বিচারপতি হতে সহায়তা করি। শেষ পর্যন্ত তিনি কিভাবে যেন চট্টগ্রামের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান বাবুকে বোঝাতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য যা-ই হোক না কেন, চট্টগ্রামের মানুষদের মধ্যে নিজেদের বন্ধুর প্রতি সফট কর্নার থাকে।
আখতারুজ্জামান প্রধানমন্ত্রীকে ফজলুল করিমের পক্ষে আনতে সফল হন। সরকারের মধ্যেও অবশ্য দ্বিধা ছিল। একদিকে এবিএম খাইরুল হক ছিলেন আপিল বিভাগের খুবই কনিষ্ঠ বিচারক। ফজলুল করিম অপরদিকে আখতারুজ্জামানের সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী অবদি পৌঁছে যান। মাঝখানে আরো দুই বিচারপতি ছিলেন, যারা বিবেচনাতেই ছিলেন না।
একেবারে শেষ মুহূর্তে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে আমার টেলিফোনে আলাপ হয়। ওইদিন সন্ধ্যায় আমি ফজলুল করিমকে জানাই যে আজকে রাত হবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারণ আজই সিদ্ধান্ত হবে কাকে বানানো হবে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি। আমি তাকে বললাম যে, রাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবো তাকে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ঠিক আগে শফিক আহমেদ রাত ১১টার দিকে আমাকে ফোন দেন। তিনি আমার মাধ্যমে ফজলুল করিমের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেতে চান যে, যদি তাকে প্রধান বিচারপতি বানানো হয়, তাহলে তিনি সরকারকে বিব্রত করার মতো কিছু করবেন না। আমি রাত সাড়ে ১১টার দিকে তড়িঘড়ি করে ফজলুল করিমের বাসার দিকে ছুটলাম। দেখলাম তিনি স্ত্রীসহ ড্রয়িং কক্ষে বসে আছেন।
ভালো সংবাদ পেয়ে তিনি নিঃসন্দেহে খুশি ছিলেন। আমি তখন তাকে আইনমন্ত্রীর বার্তা জানালাম। ফজলুল করিম শারীরিকভাবে বেশ নাজুক ছিলেন। কিন্তু তিনি সেদিন এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে আমি বাসায় প্রবেশ করার পরপরই তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আমি তাকে না দাঁড়াতে অনুরোধ করি। তিনি আমার ডান হাত ধরে বললেন, ‘আমি সবসময় তোমাকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো দেখেছি। তুমি আমাকে যা করতে বলবে আমি তা-ই করবো।’
আমি তার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলাম। আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম, কোনো পদের জন্য তার উচিত হবে না নিজেকে ছোট করা। এই পদ তো মর্যাদাপূর্ণ। সেখানে দাঁড়িয়েই আমি ফজলুল করিমের আশ্বাসের কথা আইনমন্ত্রীকে জানালাম। এরপর আমার ফোন দিয়ে তাদের মধ্যে কথা হলো।
অবশেষে তিনি প্রধান বিচারপতি হলেন। দায়িত্ব নেয়ার পরপর তিনি কিছু আইনজীবীকে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করলেন। এদের মধ্যে ছিলেন মোহাম্মদ রুহুল কুদ্দুস ও খসরুজ্জামান। কিন্তু দ্রুতই পত্রিকায় প্রতিবেদন আসে যে, এদের দু’জনের বিরুদ্ধেই ছাত্র থাকাকালে ফৌজদারি রেকর্ড ছিল। যদিও সেসব ছিল রাজনৈতিক মামলা। তারপরও প্রধান বিচারপতি এই দুইজনকে শপথ গ্রহণের আমন্ত্রণ পাঠাননি।
আমি, আইনমন্ত্রী, সরকার ও অন্য যারা তার জন্য সুপারিশ করেছিল তাদের জন্য বিষয়টি বেশ বিব্রতকর ছিল। সরকার বেশ বিরক্ত ছিল এই ঘটনায়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আমিসহ একদল বিচারক কয়েকদিন পর দক্ষিণ কোরিয়ায় গেলাম এক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। অরিয়েন্টেশনের পর আমি প্রধান বিচারপতিকে কয়েক মিনিটের জন্য জরুরি আলোচনা করতে আমার কক্ষে আসার অনুরোধ করলাম।
আমি তাকে অনুরোধ করলাম তিনি যাতে ওই দুই বিচারকের নিয়োগ নিয়ে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। আর তাদেরকে গ্রহণ করে আমাদেরকে এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেন। আমি তাকে সেই রাতের কথা স্মরণ করিয়ে দিলাম যখন তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি সরকারকে বিব্রত করবেন না। প্রধান বিচারপতি বেশ উচ্চকণ্ঠে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে অস্বীকৃতি জানালেন।
তবে পরবর্তীতে তার সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক অতটা তিক্ত হয়নি। তিনি সাত মাস ২১ দিনের জন্য পদে ছিলেন। এরপর এবিএম খাইরুল হক প্রধান বিচারপতি হলে ওই দুই আইনজীবী বিচারপতি হন।
No comments