বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ নিয়ে কিছু ভ্রান্তির উত্তর by শামসুল আলম
আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস-২০১৬ উপলক্ষে
গত ১৩ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’ (বাপা) ও ‘জাতীয়
নদী রক্ষা আন্দোলন’ বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বিষয়ে কিছু কথা বলেছে,
যার খবর ১৪ মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় ‘বদ্বীপ পরিকল্পনা নদীর জন্য অশনিসংকেত’
শিরোনামে প্রকাশিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয় ‘… দেশের বিশেষজ্ঞদের
যুক্ত না করে শুধু বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তৈরি করা হচ্ছে বদ্বীপ
পরিকল্পনা-২১০০। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তা দেশের নদীগুলোর জন্য নতুন
অশনিসংকেত হিসেবে দেখা দেবে। …ষাটের দশকে সবুজ বিপ্লবের নামে ভুল
পরিকল্পনায় দেশে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ তৈরি করা হয়েছিল। ওই পরিকল্পনা
বাস্তবায়নের পর দেশের বেশির ভাগ উপকূলীয় নদী আজ মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এখন
আবারও বিদেশি বিশেষজ্ঞনির্ভর বদ্বীপ পরিকল্পনা (ডেল্টা প্ল্যান) নিয়ে
এগোচ্ছে সরকার। নেদারল্যান্ডসের বদ্বীপের আদলে করা ওই পরিকল্পনা বাংলাদেশের
জন্য কখনোই বাস্তবসম্মত হবে না। বরং দেশের যে নদীগুলো কোনোমতে টিকে আছে,
তা চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে।’ সংবাদ পর্যালোচনায় একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বিষয়ে সংস্থা দুটির তথ্যের ঘাটতি রয়েছে, যে
কারণে বক্তব্য অনুমাননির্ভর হয়েছে প্রতীয়মান হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে,
জনমানসের ভ্রান্তি দূর করতে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ নিয়ে কিছু কথা
বলা দরকার: বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল বদ্বীপপ্রধান (ডেল্টাইক) দেশ, যা
প্রধানত পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীবাহিত পলিমাটি দিয়ে গঠিত পৃথিবীর
বৃহত্তম বদ্বীপ। এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশে
শতকরা ৮০ ভাগ এলাকা এই নদীগুলোর প্লাবনভূমিতে অবস্থিত। এ দেশের মানুষের
জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি এ নদী ও তার প্লাবনভূমিসমূহ।
বাংলাদেশের জন্য পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। কারণ, একদিকে
বর্ষাকালে প্রচুর পানি ও পলি নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ধাবিত হয়, যার ফলে
অসংখ্য চর গড়ে ওঠে। অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যায় না।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করায় অর্থাৎ পানিসম্পদ
ব্যবস্থায় মানবসৃষ্ট পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ায় প্রাকৃতিক পানিচক্র বাধাগ্রস্ত
হচ্ছে। এতে পানির গুণগত মান ও প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে, লবণাক্ততা বেড়ে
যাচ্ছে। মিঠা পানির স্বল্পতা ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। সে কারণে বাংলাদেশের জন্য
সার্বিকভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে তৈরি করা হয়েছে এই বদ্বীপ
রূপকল্প (ডেল্টা ভিশন)। এই রূপকল্প অর্জনে কৃষি, মৎস্য, শিল্প, বনায়ন, পানি
ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন—সব খাতকে বিবেচনায় রেখে একটি সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি
পরিকল্পনা প্রয়োজন। সামগ্রিক বদ্বীপ পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্যই হলো,
প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব হ্রাস করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
বিবেচনায় রেখে কৃষি, পানিসম্পদ, ভূমি, শিল্প, বনায়ন, মৎস্য সম্পদ প্রভৃতিকে
গুরুত্ব প্রদানপূর্বক সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুষ্ঠু
পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, খাদ্যনিরাপত্তা ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি
নিশ্চিত করা এবং সে লক্ষ্যে ধাপে ধাপে বাস্তবসম্মত একটি সমন্বিত
দীর্ঘমেয়াদি (৫০ থেকে ১০০ বছর) মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের
কর্মকৌশল নির্ধারণ করা। এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কার্যক্রম মার্চ ২০১৪ থেকে
শুরু হয়েছে এবং ডিসেম্বর ২০১৬-তে তা সম্পন্ন হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ
উদ্যোগের আওতায় ইতিমধ্যে সম্পাদিত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলো হচ্ছে: (ক)
সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বেসরকারি খাতের
অবদান নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে ডেল্টা ভিশন ও লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে এবং
সংশ্লিষ্ট কার্যাবলি শনাক্ত ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে; (খ) বদ্বীপ
পরিকল্পনা-সংশ্লিষ্ট ১৯টি সহায়ক গবেষণাপত্র তৈরি করা হয়েছে, যার আলোকে একটি
জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলা হয়েছে; (গ) পৃথকভাবে পানিসম্পদ খাতে গত ৬০ বছরে
গৃহীত পদক্ষেপসমূহের বিস্তারিত পর্যালোচনা করে অর্জিত জ্ঞান থেকে ভবিষ্যৎ
করণীয় ঠিক করা হচ্ছে; (ঘ) জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও
নগরায়ণ বিবেচনা করে ভবিষ্যতের বিভিন্ন রূপকল্প প্রক্ষেপণ করা হয়েছে; (ঙ)
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সম্ভাব্য পরিবর্তিত পটভূমিগুলো কী হতে পারে,
বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে তা প্রণয়ন করা হচ্ছে। (চ) সংশ্লিষ্ট
ভিত্তিস্তর জ্ঞান ও ভবিষ্যতের বিভিন্ন রূপকল্প বিবেচনায় শুষ্ক মৌসুমে পানি
সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, বর্ষা মৌসুমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, পানি ও ভূমির লবণাক্ততা
নিয়ন্ত্রণসহ পানিসম্পদ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন খাতের চ্যালেঞ্জসমূহ চিহ্নিত
করা হয়েছে; (ছ) চিহ্নিত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় কৌশল নির্ধারণের কাজ চলছে;
(জ) দীর্ঘমেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ডেল্টা কমিশন অ্যান্ড ডেল্টা ফান্ড
বিষয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে; (ঝ) বদ্বীপ পরিকল্পনার আওতায় বাস্তব
প্রয়োজন অনুযায়ী বিনিয়োগ প্রকল্প তৈরির কার্যক্রম চলমান রয়েছে; এবং
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পারস্পরিক সহযোগিতার
লক্ষ্যে গত ১৬ জুন, ২০১৫ তারিখে বাংলাদেশ সরকার, নেদারল্যান্ডস সরকার এবং
বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (আইডিএ) ও ইন্টারন্যাশনাল
ফিন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং ২০৩০ পানিসম্পদ গ্রুপের (ডব্লিউআরজি)
মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। কর্মপরিকল্পনা মোতাবেক আগামী
সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ প্রণয়ন সম্পন্ন হবে।
অর্থাৎ যে পরিকল্পনার খসড়াই এখনো তৈরি হয়নি, তাকে কি দেশের নদীর জন্য
অশনিসংকেত হিসেবে মন্তব্য করা যায়? এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সঙ্গে
সম্পর্কযুক্ত পরামর্শকসমূহের মধ্যে দেশীয় পরামর্শকের সংখ্যাই বেশি।
মহাপরিকল্পনা দলিল প্রণয়নের কাজটি দেশের প্রথিতযশা পরামর্শক দলের মাধ্যমে
সম্পন্ন করা হচ্ছে, এরা সবাই বাংলাদেশি। যাঁরা এ দেশের পরিবর্তনশীল বদ্বীপ ও
সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিতে অভিজ্ঞ। নেদারল্যান্ডস বিশ্বে বদ্বীপ ব্যবস্থাপনায়
সর্বজনস্বীকৃত একটি দেশ। তাদের কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল
বদ্বীপ প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে সম্পূর্ণ দেশীয় পরিবেশ ও প্রতিবেশ বিবেচনায় এ
পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে।
এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রতিটি ধাপে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষক, অ্যাকাডেমিক, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে, যেমন সিইজিআইএস, ডব্লিউএআরপিও, বুয়েট ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশেষজ্ঞদের এতে কাজে লাগানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কর্মশালা, আলোচনা সভা ও মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি, মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি এবং সর্বোপরি দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি দেশীয় বিশেষজ্ঞ প্যানেল রয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনার প্রতিটি বিষয় উল্লিখিত তিনটি কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার সঙ্গে যদি সরকারের ‘রূপকল্প ২০৪০’ অর্জিত হয়, তাহলে তা আমাদের উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখবে। ফলে এতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ নেই, এ কথা একদমই ঠিক নয়।
এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রতিটি ধাপে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষক, অ্যাকাডেমিক, পেশাজীবী ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে, যেমন সিইজিআইএস, ডব্লিউএআরপিও, বুয়েট ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিশেষজ্ঞদের এতে কাজে লাগানো হচ্ছে। এ লক্ষ্যে ঢাকা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কর্মশালা, আলোচনা সভা ও মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে এ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি, মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে একটি ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি এবং সর্বোপরি দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি দেশীয় বিশেষজ্ঞ প্যানেল রয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনার প্রতিটি বিষয় উল্লিখিত তিনটি কমিটির কাছে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার সঙ্গে যদি সরকারের ‘রূপকল্প ২০৪০’ অর্জিত হয়, তাহলে তা আমাদের উন্নত দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখবে। ফলে এতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ নেই, এ কথা একদমই ঠিক নয়।
No comments