ভারতের আদালত যেখানে পথ দেখাল! by কামাল আহমেদ
ভারতের
সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ের কারণে ২৪ মার্চ, মঙ্গলবারকে অনেকে দেশটির জন্য
একটি নতুন দিনের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। আমি অবশ্য তার চেয়েও এক ধাপ
এগিয়ে বলতে চাই যে এটি বিশ্বব্যাপী মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য একটি
উজ্জ্বল দিন। কথাটি এভাবে বলতে চাওয়ার কারণ একটাই, তা হলো, এই উপমহাদেশের
সব কটি দেশেই ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায় ও আচারবিধির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
তা ছাড়া যাঁরাই মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের
কাছে ভারতের আইনের ছাত্রী, শ্রেয়া সিংঘালের আইনি লড়াইয়ের সাফল্য এক বড়
অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
যে আইনি লড়াইয়ে শ্রেয়া বিজয়ী হলেন, তার কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬(ক) ধারা। ২০০৯ সালে তৈরি আইনটির ওই ধারার অধীনে শ্রেয়া নিজে কখনো ভোগান্তির শিকার হননি। কিন্তু, ভারতে বেশ কয়েকটি ঘটনায় কলেজছাত্রী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পর্যন্ত অনেকেই ওই কালো আইনের শিকার হয়ে জেল খেটেছেন। আইনের ওই ধারায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশের জন্য তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ওই আইনেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কার্টুন ফেসবুকে প্রকাশের দায়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মুখোপাধ্যায়কে জেলে যেতে হয়েছে। অবশ্য, কলকাতার হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্য সরকারকে এ জন্য আগেই তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। মুম্বাইতে একটি উগ্রপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী, শিবসেনার একজন নেতা বালঠাকরের মৃত্যুতে দুই দিন ধরে সবকিছু বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়ে ফেসবুকে সমালোচনা করার জন্য ২০১২ সালে দুই তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁদের দুজনের মধ্যে একজনের অপরাধ ছিল অন্যজনের মন্তব্যটি পছন্দ করা (লাইক দেওয়া)।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬(ক) ধারা অসাংবিধানিক এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে একটি বাধা। আদালত আরও বলেছেন যে জনগণের জানার (তথ্য পাওয়ার) অধিকার এই ধারায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী রায়টি ২০০ পৃষ্ঠার এবং তাতে অনলাইনে সেন্সরশিপ সম্পর্কে আরও কিছু বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে (গার্ডিয়ান, ২৪ মার্চ ২০১৫)। ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। তবে শিবসেনা তাদের ভাষায় ইন্টারনেটের ‘অপব্যবহার’ বন্ধের জন্য এই আইনটি রেখে দেওয়ার পক্ষে। সরকারপক্ষের আইনজীবীরা অবশ্য আদালতে স্বীকার করে নেন যে পুলিশ আইনটির অপপ্রয়োগ করেছে। আইনটি যাঁরা করেছিলেন, সেই কংগ্রেসের এক নেতা, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী, মনীষ তেওয়ারি বলেছেন যে আইনটি ‘নিপীড়নের হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়েছিল’।
বিশ্বব্যাপী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিশেষ করে গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেটে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের মাত্রা বিবেচনায় একটি সূচক প্রকাশ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ফ্রিডম হাউস। ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিরিখে ভারত হচ্ছে সেই গোত্রভুক্ত, যেসব দেশ আংশিক স্বাধীন। বাংলাদেশের অবস্থানও ওই একই গোত্রে। তবে সংখ্যামান বা পয়েন্টের দিক থেকে ভারতের পয়েন্ট আড়াই আর বাংলাদেশের অবস্থা চার। গত বছর বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল সাড়ে তিন, কিন্তু এ বছরের প্রথম তিন মাসেই তা নেমে গেছে (ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৫, ফ্রিডম হাউস)। পয়েন্ট যত কম, দেশটির নাগরিেকরা তত বেশি স্বাধীন।
ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা যে ভারতের চেয়ে খারাপ, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের রচিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যে সংশোধিত রূপ আওয়ামী লীগ ও তার ডান (জাতীয় পার্টি) এবং বামপন্থী (ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ) শরিকেরা ২০১৩ সালে করেছে, তা এই আইনকে আরও বেশি নিবর্তনমূলক কালো আইনে রূপান্তরিত করেছে। [ভারতের আইনের ৬৬(ক) ধারার অনুরূপ ধারাটি বাংলাদেশে ৫৭ ধারা হিসেবে পরিচিত] জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তরুণ শিক্ষক অস্ট্রেলিয়ায় বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তীক্ষ্ণ সমালোচনা করে ফেসবুকে মন্তব্য করেছিলেন, তাঁকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সাজা দিয়ে তাঁর নির্বাসন স্থায়ী করে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষককেও ফেসবুকে একই ধরনের মন্তব্যের জন্য একইভাবে জেলের ভাত খেতে হয়েছে। এমনকি, যেদিন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এই যুগান্তকারী রায় হয়, সেদিনও সিরাজগঞ্জে এক কিশোরের বিরুদ্ধে একই ধরনের অপরাধের জন্য একটি মামলা হয়েছে। ফেসবুকে সরকারপ্রধান বা অন্য রাজনীতিকদের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা, কার্টুন প্রকাশ এবং বিরূপ মন্তব্যের জন্য আরও কতজনকে এ ধরনের সাজা ও হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে, তার কোনো নির্ভুল হিসাব পাওয়া যায় না। তবে, তথ্য অধিকার ও বাক্স্বাধীনতা বিষয়ে কাজ করে এমন একটি বৈশ্বিক সংগঠন, আর্টিকেল নাইন্টিন–এর বাংলাদেশ শাখার হিসাব অনুযায়ী শুধু ২০১৪ সালেই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অন্তত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফেসবুকের বাইরে বিরোধী মতের রাজনীতিবিদ এম কে আনোয়ার রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে এই আইনে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন এবং মামলা এখনো বিচারাধীন। একইভাবে একুশে টিভির স্বত্বাধিকারী এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় এই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এবং পরে অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের। আইনটির অপব্যবহারের তালিকা বেশ দীর্ঘই বলতে হবে।
ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের উদ্ভাবক, ব্রিটেনের স্যার টিম বার্নার্স লি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থায় অবাধ স্বাধীনতার অন্যতম প্রবক্তা। তাঁর মতে, ওই স্বাধীনতা নেট ব্যবহারকারীর একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তির এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখন গণতন্ত্রের আবশ্যিক হাতিয়ার। আমাদের মন্ত্রীরা যদি দয়া করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন কিংবা বিরোধী নেতা মিলিব্যান্ডের ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্টগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নেন, তাহলে দেখতে পাবেন, প্রতিদিন তাঁদের স্বদেশি নাগরিকেরা ওই নেতাদের কীভাবে তুলাধোনা করছেন, এমনকি গালিও দিচ্ছেন। কিন্তু ওই সমালোচনাকে যদি তাঁরা অপরাধ গণ্য করতেন, তাহলে তাঁদের কারাগারগুলোয় আর অন্য কোনো অপরাধীর ঠাঁই হতো না। কংগ্রেস নেতা মনীষ তেওয়ারির মতো বিরোধী দলে যাওয়ার পর নিজেদের করা আইনের অপব্যবহারের জন্য মাথার চুল ছেঁড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং, কালো বিধানগুলো বাতিল করাই সহজ। অবশ্য, চাইলে পরে আদালতও বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে পারে।
কেননা, বছর দুয়েক ধরে আমাদের হাইকোর্টেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা একটি মামলা সরকারের জবাবের অপেক্ষায় পড়ে আছে। মানবাধিকার সংগঠন, বাংলাদেশ িলগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)–এর নথিতে দেখা যায় যে, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের কারণে সরকার তা বন্ধ করে দিলে আরাফাত হোসেন খান নামে একজন নাগরিক তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেছিলেন। ওই রিটে কোেনা অন্তর্বর্তী আদেশ না হলেও ৫৭ ধারাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তার কারণ দর্শানোর জন্য সরকারের প্রতি আদেশ জারি হয়েছিল।
সরকার এখনো ওই রুলের কোনো জবাব দেয়নি এবং মামলাটিও আর এগোয়নি। সে কারণেই প্রশ্ন জাগে, ভারতবাসীর মতো কপাল কি আমাদের হবে?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
যে আইনি লড়াইয়ে শ্রেয়া বিজয়ী হলেন, তার কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬(ক) ধারা। ২০০৯ সালে তৈরি আইনটির ওই ধারার অধীনে শ্রেয়া নিজে কখনো ভোগান্তির শিকার হননি। কিন্তু, ভারতে বেশ কয়েকটি ঘটনায় কলেজছাত্রী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পর্যন্ত অনেকেই ওই কালো আইনের শিকার হয়ে জেল খেটেছেন। আইনের ওই ধারায় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় আপত্তিকর মন্তব্য প্রকাশের জন্য তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ওই আইনেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি কার্টুন ফেসবুকে প্রকাশের দায়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মুখোপাধ্যায়কে জেলে যেতে হয়েছে। অবশ্য, কলকাতার হাইকোর্টের নির্দেশে রাজ্য সরকারকে এ জন্য আগেই তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে। মুম্বাইতে একটি উগ্রপন্থী হিন্দু গোষ্ঠী, শিবসেনার একজন নেতা বালঠাকরের মৃত্যুতে দুই দিন ধরে সবকিছু বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তের বিষয়ে ফেসবুকে সমালোচনা করার জন্য ২০১২ সালে দুই তরুণীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁদের দুজনের মধ্যে একজনের অপরাধ ছিল অন্যজনের মন্তব্যটি পছন্দ করা (লাইক দেওয়া)।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬(ক) ধারা অসাংবিধানিক এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে একটি বাধা। আদালত আরও বলেছেন যে জনগণের জানার (তথ্য পাওয়ার) অধিকার এই ধারায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী রায়টি ২০০ পৃষ্ঠার এবং তাতে অনলাইনে সেন্সরশিপ সম্পর্কে আরও কিছু বিষয়ে দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে (গার্ডিয়ান, ২৪ মার্চ ২০১৫)। ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে। তবে শিবসেনা তাদের ভাষায় ইন্টারনেটের ‘অপব্যবহার’ বন্ধের জন্য এই আইনটি রেখে দেওয়ার পক্ষে। সরকারপক্ষের আইনজীবীরা অবশ্য আদালতে স্বীকার করে নেন যে পুলিশ আইনটির অপপ্রয়োগ করেছে। আইনটি যাঁরা করেছিলেন, সেই কংগ্রেসের এক নেতা, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী, মনীষ তেওয়ারি বলেছেন যে আইনটি ‘নিপীড়নের হাতিয়ারে রূপান্তরিত হয়েছিল’।
বিশ্বব্যাপী মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিশেষ করে গণমাধ্যম এবং ইন্টারনেটে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের মাত্রা বিবেচনায় একটি সূচক প্রকাশ করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ফ্রিডম হাউস। ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিরিখে ভারত হচ্ছে সেই গোত্রভুক্ত, যেসব দেশ আংশিক স্বাধীন। বাংলাদেশের অবস্থানও ওই একই গোত্রে। তবে সংখ্যামান বা পয়েন্টের দিক থেকে ভারতের পয়েন্ট আড়াই আর বাংলাদেশের অবস্থা চার। গত বছর বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল সাড়ে তিন, কিন্তু এ বছরের প্রথম তিন মাসেই তা নেমে গেছে (ফ্রিডম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড ২০১৫, ফ্রিডম হাউস)। পয়েন্ট যত কম, দেশটির নাগরিেকরা তত বেশি স্বাধীন।
ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে বাংলাদেশের পরিস্থিতিটা যে ভারতের চেয়ে খারাপ, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের রচিত তথ্যপ্রযুক্তি আইনের যে সংশোধিত রূপ আওয়ামী লীগ ও তার ডান (জাতীয় পার্টি) এবং বামপন্থী (ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ) শরিকেরা ২০১৩ সালে করেছে, তা এই আইনকে আরও বেশি নিবর্তনমূলক কালো আইনে রূপান্তরিত করেছে। [ভারতের আইনের ৬৬(ক) ধারার অনুরূপ ধারাটি বাংলাদেশে ৫৭ ধারা হিসেবে পরিচিত] জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে তরুণ শিক্ষক অস্ট্রেলিয়ায় বসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি তীক্ষ্ণ সমালোচনা করে ফেসবুকে মন্তব্য করেছিলেন, তাঁকে তাঁর অনুপস্থিতিতেই রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে সাজা দিয়ে তাঁর নির্বাসন স্থায়ী করে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন শিক্ষককেও ফেসবুকে একই ধরনের মন্তব্যের জন্য একইভাবে জেলের ভাত খেতে হয়েছে। এমনকি, যেদিন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে এই যুগান্তকারী রায় হয়, সেদিনও সিরাজগঞ্জে এক কিশোরের বিরুদ্ধে একই ধরনের অপরাধের জন্য একটি মামলা হয়েছে। ফেসবুকে সরকারপ্রধান বা অন্য রাজনীতিকদের নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করা, কার্টুন প্রকাশ এবং বিরূপ মন্তব্যের জন্য আরও কতজনকে এ ধরনের সাজা ও হয়রানির মুখে পড়তে হয়েছে, তার কোনো নির্ভুল হিসাব পাওয়া যায় না। তবে, তথ্য অধিকার ও বাক্স্বাধীনতা বিষয়ে কাজ করে এমন একটি বৈশ্বিক সংগঠন, আর্টিকেল নাইন্টিন–এর বাংলাদেশ শাখার হিসাব অনুযায়ী শুধু ২০১৪ সালেই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে অন্তত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ফেসবুকের বাইরে বিরোধী মতের রাজনীতিবিদ এম কে আনোয়ার রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে এই আইনে গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন এবং মামলা এখনো বিচারাধীন। একইভাবে একুশে টিভির স্বত্বাধিকারী এবং প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানকে প্রথমে গ্রেপ্তার করা হয় এই তথ্যপ্রযুক্তি আইনে এবং পরে অভিযোগ আনা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের। আইনটির অপব্যবহারের তালিকা বেশ দীর্ঘই বলতে হবে।
ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থা ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের উদ্ভাবক, ব্রিটেনের স্যার টিম বার্নার্স লি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগব্যবস্থায় অবাধ স্বাধীনতার অন্যতম প্রবক্তা। তাঁর মতে, ওই স্বাধীনতা নেট ব্যবহারকারীর একটি মৌলিক মানবাধিকার এবং সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠান কোনো ব্যক্তির এই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো এখন গণতন্ত্রের আবশ্যিক হাতিয়ার। আমাদের মন্ত্রীরা যদি দয়া করে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন কিংবা বিরোধী নেতা মিলিব্যান্ডের ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্টগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নেন, তাহলে দেখতে পাবেন, প্রতিদিন তাঁদের স্বদেশি নাগরিকেরা ওই নেতাদের কীভাবে তুলাধোনা করছেন, এমনকি গালিও দিচ্ছেন। কিন্তু ওই সমালোচনাকে যদি তাঁরা অপরাধ গণ্য করতেন, তাহলে তাঁদের কারাগারগুলোয় আর অন্য কোনো অপরাধীর ঠাঁই হতো না। কংগ্রেস নেতা মনীষ তেওয়ারির মতো বিরোধী দলে যাওয়ার পর নিজেদের করা আইনের অপব্যবহারের জন্য মাথার চুল ছেঁড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বরং, কালো বিধানগুলো বাতিল করাই সহজ। অবশ্য, চাইলে পরে আদালতও বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে পারে।
কেননা, বছর দুয়েক ধরে আমাদের হাইকোর্টেও তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা একটি মামলা সরকারের জবাবের অপেক্ষায় পড়ে আছে। মানবাধিকার সংগঠন, বাংলাদেশ িলগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)–এর নথিতে দেখা যায় যে, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশের কারণে সরকার তা বন্ধ করে দিলে আরাফাত হোসেন খান নামে একজন নাগরিক তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার সাংবিধানিক বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেছিলেন। ওই রিটে কোেনা অন্তর্বর্তী আদেশ না হলেও ৫৭ ধারাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তার কারণ দর্শানোর জন্য সরকারের প্রতি আদেশ জারি হয়েছিল।
সরকার এখনো ওই রুলের কোনো জবাব দেয়নি এবং মামলাটিও আর এগোয়নি। সে কারণেই প্রশ্ন জাগে, ভারতবাসীর মতো কপাল কি আমাদের হবে?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments