পশ্চিমবঙ্গে সন্ন্যাসিনী ধর্ষণে প্রতিবাদ কি রাজনৈতিক by জয়ন্ত ঘোষাল
অনেক
দিন পর পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলার প্রত্যন্ত এক এলাকায় গেলাম। মুখ্যমন্ত্রী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রানাঘাট গিয়েছিলাম, যেখানে এক বৃদ্ধা
সন্ন্যাসিনীর উপর অমানবিক অত্যাচার হয়েছে বলে অভিযোগ। রাজধানী দিল্লিতে বসে
রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিকে সব সময় জানা যায় না। স্পর্শ করা যায় না।
অতীতে কখনও প্রণব মুখোপাধ্যায়, কখনও অজিত পাঁজা, কখনও বা বরকত গনিখান
চৌধুরী অথবা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজ্যের
বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের
সঙ্গেও গিয়েছি অনেক জায়গায়। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের জেলা সফর
নতুন নয়। প্রফুল্ল সেন যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনিও তার গাড়িতে করে
সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে জেলা সফরে যেতেন। তাদের সঙ্গে তাস খেলতেন। গান
শুনতেন। কিন্তু, রানাঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার এ বারের সফর
অটলবিহারী বাজপেয়ী-লালকৃষ্ণ আদবানির সঙ্গে অতীতের সফরের অভিজ্ঞতাকেও ছাপিয়ে
গেল। রানাঘাটের ওই এলাকাটি খ্রিস্টান অধ্যুষিত। যদিও এই গ্রামে ২৫
ডিসেম্বর যে ভাবে বড়দিন পালিত হয়, ঠিক সে ভাবে দুর্গাপুজোও হয়। জাতীয় সড়ক
ধরে রানাঘাটে ঢোকার মুখে মমতা প্রথম দেখেন, সার সার লরি দাঁড়িয়ে রয়েছে।
প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন, এখানে কোনও রেলগেট আছে। কিন্তু, পরে তিনি জানতে
পারেন, একটি মিছিল সেখান দিয়ে যাবে বলে সমস্ত লরি আটকে দেওয়া হয়েছে।
লরিগুলির গন্তব্য ভিন্ রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরে বেজায়
অসন্তুষ্ট হন। প্রশ্ন তোলেন, কেন এগুলিকে আটকে রাখা হবে? তার পর পুলিশকে
বকতে বকতে নিজেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেন। তখনও কিন্তু বিক্ষোভের
কোনও আভাস ছিল না। মমতা প্রথমে স্কুলটি পরিদর্শন করলেন। তার পর গেলেন
হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখা করলেন সেই নির্যাতিতা সন্ন্যাসিনীর সঙ্গে।
হাসপাতালে বৈঠক করলেন বিশপদের সঙ্গে। এমনকী, রোম থেকে আসা পাদরি
প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করলেন তিনি। বেরিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গেও কথা
বললেন। এ বার ফেরার সময় হঠাৎই দেখা গেল মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি আটকে দেওয়া হল।
মুখ্যমন্ত্রী যে হেতু কোনও কনভয় ব্যবহার করেন না, তাই সে ভাবে পুলিশের কোনও
কর্ডন ছিল না। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেক অল্পবয়সী ছাত্রছাত্রী যেমন ছিল,
তেমনই অনেক মহিলাও ছিলেন। তারা স্লোগান দিতে লাগলেন, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’।
আর কিছু লোক স্লোগান দিলেন, ‘সিবিআই তদন্ত চাই।’ পাদরিরা এসে বললেন,
ম্যাডাম, আপনি এখান থেকে চলে যান। আর জেলা পুলিশের কর্তারাও বললেন, আপনি
বেরিয়ে যান। বিক্ষোভে মাত্র দু’-চার জন রয়েছেন, তাদের সরিয়ে দেব আমরা।
কিন্তু মমতা তখন ধনুকভাঙা পণ করলেন। গাড়িতে রাখা মাইক নিয়ে বললেন, “আন্দোলন
থেকে উঠে এসেছি আমি। পুলিশের সাহায্য নিয়ে আমি বেরিয়ে যাব না। থাকতে হলে
থাকব। সারা রাত থাকব। সিপিএম ও বিজেপি যৌথ ভাবে এই বিক্ষোভ করছে। আমি সরছি
না এখান থেকে।” তখন পাদরিরা পড়ে গেলেন ফ্যাসাদে। তারা মমতার কাছে এসে ক্ষমা
চাইছেন, আমরা দুঃখিত, আমরা এটা নিয়ে রাজনীতি করতে চাইছি না। উল্টো যে
প্রধান পাদরি ছিলেন, তিনি মমতারই গাড়ির উপর দাঁড়িয়ে হাতে মাইক নিয়ে ঘোষণা
করলেন, আপনারা শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিল করছিলেন। শান্তিপূর্ণ ভাবে যে ভাবে
শুরু হয়েছিল, সে ভাবেই শেষ হওয়া উচিত। আপনারা সরে যান। কিন্তু
বিক্ষোভকারীরা গেলেন না। পাদরিরা মমতাকে জানালেন, ঠিক ছিল কোনও দলের নয়,
সমস্ত সাধারণ মানুষ হাতে মোমবাতি নিয়ে মিছিল করবেন। সকলে চেতনাসভা করবে। আর
দোষীদের শাস্তির দাবি জানাবে। এরই মধ্যে স্থানীয় বিধায়ক, জেলা পরিষদের
সভাপতিও এসে গিয়েছেন। উত্তেজনা তখন এমন জায়গায় পৌঁছায়, মনে হচ্ছিল
বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে তৃণমূলের মারামারি শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু, মমতা
গাড়িচালককে উল্টো বললেন, স্টার্ট বন্ধ করে দিতে। গাড়ির স্টার্ট চালু
থাকলে বরং মনে হতে পারে, আমি চলে যাব। কিন্তু পাদরিদের অনুরোধের পরেও ভিড়
কিছুতেই সরছে না। তখন মমতা তৃণমূলের কর্মীদেরই শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
মাইকে ঘোষণা করলেন, আমি চাইছি না বিক্ষোভকারীদের প্ররোচনায় কেউ পা দিক।
তোমরা মারামারি কোরো না। পুলিশকেও বললেন, লাঠিচার্জ করবেন না। তাতেও
পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় পাদরিরাই বললেন, আমরা তা হলে চলে যাচ্ছি
চেতনাসভায়। তারা চলে যাওয়ার পর মমতা গাড়ি স্টার্ট দিলেন। কিন্তু বিক্ষোভ
তখনও চলছিল। মমতা শিবিরের আপাত ভাবে মনে হচ্ছে, সূর্যকান্ত মিশ্র সেখানে
ঘুরে এসেছেন। বিজেপিও এটি নিয়ে রাজনীতি করছে। বিজেপি ও সিপিএম উভয়ে এটিকে
রাজনৈতিক চাল হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু, মমতা তার পাল্টা স্লোগান
তুললেন, বিজেপি-সিপিএম গো ব্যাক। মমতা দেখিয়ে দিলেন, লড়াকু মমতা এখনও মরে
যায়নি। বুঝিয়ে দিলেন, বিরোধীরা রাজনীতি করলেও এটি আসলে একটি মানবিক বিষয়।
সিপিএমের জমানাতেও এ ধরনের ঘটনা আমি প্রচুর দেখেছি। বানতলার ধর্ষণের ঘটনা
ঘটেছে। সেই সময় মমতা রাইটার্সে এসেছিলেন। আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ
করেন। রানাঘাট থেকে কলকাতায় ফেরার পথে মাঝে একটি জায়গায় গাড়ি থামল।
হরিণঘাটা। সেখানে মোহনপুর ফাঁড়িতে গেলেন মমতা। গিয়ে দেখলেন তিনটি ছেলে
বন্দি। মমতাকে দেখেই তারা কাঁদতে শুরু করে। তারা বলে, ডানকুনি থেকে এসে লাল
পতাকা উড়িয়েছিল বলে তাদের ধরে রাখা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের মতে, ভিড়ের
মধ্যে তারা উত্তেজনা ছড়াচ্ছিল। মমতা শুনে ছেলেগুলিকে বললেন, লাল পতাকা নিয়ে
দুষ্টুমি করেছ, সেটা কিছু নয়। কিন্তু প্ররোচনা দিয়েছ কেন? ছেলেগুলি বলল,
তারা পরীক্ষা দিতে এসেছিল। এর পর মমতা থানার ইন-চার্জকে ওদের ছেড়ে দিতে
বললেন। ছাড়া পাওয়ার পর মমতা তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা খেয়েছো? ওরা বলে,
না। মমতা তার পর এক হাজার টাকা ওদের হাতে দিয়ে বললেন, পেট ভরে খেয়ে নাও। আর
অন্য কোনও দলের প্ররোচনায় পড়ো না। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রানাঘাট সফরে এসে
কিন্তু একটি বিষয় মনে হচ্ছে, কোথায় পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়নের পথে যাবে, ভবিষ্যত্
গড়ার কাজে নিযুক্ত হবে! কিন্তু, কলকাতা ফিরতে ফিরতে মনের মধ্যে প্রশ্ন
উঠল, এই মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ কী? স্কুল থেকেই কি বিক্ষোভের প্রশিক্ষণ শুরু
হচ্ছে? তা হলে তাদের পড়াশোনা, জীবনের অন্যান্য অগ্রাধিকারের কী হবে? সিপিএম
জমানায় গোটা রাজ্যে যা হয়েছে, এই জমানাতেও একই জিনিস হচ্ছে। গোটা রাজ্য
যেন আগ্নেয়গিরি হয়ে রয়েছে। যে কোনও ঘটনা ঘটুক, সেটি আর অরাজনৈতিক ভাবে দেখা
হয় না। হয় সেটি তৃণমূলের, না হয় বিজেপি-র বা সিপিএমের। অন্য রাজ্যে
সাম্প্রদায়িক বা জাতপাতের মেরুকরণ দেখি। পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতির মেরুকরণ।
বস্তুত, এই মমতাই এক দিন বিরোধী নেত্রী হিসেবে সাধারণ মানুষের
ক্ষোভ-বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছেন। সেই ক্ষোভকে পরিণত করেছেন রাজনৈতিক
বিক্ষোভে। রাজনৈতিক পালাবদল ঘটিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু, মমতা ক্ষমতায়
আসার তিন বছর পরে স্বাভাবিক ভাবেই শাসক দলকে ঘিরে ক্ষোভ ও অসন্তোষের জন্ম
হয়েছে। নানা জায়গায় নানা কারণে বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। আর এখন এর ফয়দা তুলতে
সচেষ্ট হচ্ছে সিপিএম এবং বিজেপি। এক বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনীর উপরে নৃশংস
অত্যাচারের ঘটনার পরে যে বিক্ষোভ ক্রমেই ঝড়ের আকার নিচ্ছে তা নিঃসন্দেহে
মমতার বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু, অতীতের মতো এই জমানাতেও বিরোধীরা এই নাগরিক
বিক্ষোভে রাজনীতির রং লাগাতে সচেষ্ট। এই পরিস্থিতি দেখে অনেকে বলতেই পারেন,
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কিন্তু এতে আখেরে পশ্চিমবঙ্গের কী হচ্ছে?
পশ্চিমবঙ্গ কোথায় যাচ্ছে? এই পরিস্থিতির কি বদল হবে না? এর থেকে সত্যিই কি
মুক্তি নেই? এটা ভাবতে ভাবতেই ফিরলাম কলকাতায়। জয়ন্ত ঘোষাল: নয়া দিল্লি
ব্যুরো চিফ, আনন্দবাজার পত্রিকা
No comments