শেখালেই কি উন্নত মানুষহবে by রুখসানা তাজীন
শিশুরা পরিবেশ থেকে শিখে। এ প্রক্রিয়ায় পরিবার, সমাজের পাশাপাশি যে প্রতিষ্ঠানটির গুরুত্ব খুব বেশি, তা হলো বিদ্যালয়। শিশুরা বিদ্যালয়ে কী শিখবে, কেন শিখবে এবং কীভাবে শিখবে—এ নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। আবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উদ্দেশ্য কি শুধু জ্ঞানের বিকাশ? নাকি শিশুর মানসিক, নৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক—সব ধরনের উন্নয়নের দায়িত্ব বিদ্যালয় নিতে পারে? এই গুরুভার শিক্ষক আর বিদ্যালয়ের হাতে তুলে দিতে অভিভাবকেরা রাজি কি না? শিশুরা শুধু গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি শিখতে বিদ্যালয়ে যাবে, নাকি সবার ওপরে স্থান পাবে কীভাবে ভালো মানুষ হওয়া যায়, সমাজ ও বিশ্বের উপকারে আসা যায় সেই শিক্ষা? প্রশ্নগুলো বিবেচনায় নেওয়া জরুরি।
বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা অর্জন, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, ভালো চাকরি—এমনতরো পার্থিব চাহিদা মেটানোকেই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বিবেচনা করলে এবং শিশুদের মানবিক বিকাশের মতো গুরুত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গণ্ডির বাইরে বিবেচনা করলে তা সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না। পাশ্চাত্যে যখন হতাশাগ্রস্ত ও দিগ্ভ্রান্ত কিশোর-তরুণদের অপরাধ-প্রবণতার স্বরূপ স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত দুই-তিন শতক ধরে এই উপলব্ধিটি জোরদার হচ্ছে। এই প্রবণতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে স্কুলের অভ্যন্তরে হত্যাযজ্ঞের মতো মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দেয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বোধোদয় ঘটে যে শিশু-কিশোরদের মূল্যবোধ আর চরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা হেলাফেলার বিষয় নয়। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এসব দেশে সরকারি পর্যায়ে চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষা, সমাজিক সচেতনতামূলক শিক্ষা, মূল্যবোধ উন্নয়নের শিক্ষা—এমন নানা কার্যক্রমের আওতায় স্কুলে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে। এই বিষয়ে আলাদা শিক্ষানীতি তো রয়েছেই, নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে, যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে নৈতিক এবং চারিত্রিক শিক্ষা প্রদানে সক্ষম হন।
শিশুদের নৈতিক বিকাশ এবং চরিত্র গঠনের কাজটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হতে পারে—শিক্ষকেরা তাঁদের নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, সত্যবাদিতা, সদাচার এসব বিষয়ে ভালো ভালো কথা বলবেন, বাচ্চারা সেটা মন দিয়ে শুনবে, উপলব্ধি করবে এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে। কিন্তু আসলেই কি মানবিক এবং সামাজিক বিকাশের ব্যাপারটি এত সরল এবং ঝামেলাহীন? শিক্ষক যেটাকে ভালো বলবেন, বাচ্চারা কেন সেটাকে ভালো হিসেবে মেনে নেবে, আর মেনে নিলেও তাদের এই জ্ঞান কতদিন স্থায়ী হবে বা নিজেদের জীবনে মূল্যবোধ এবং চরিত্র শিক্ষার সফল প্রয়োগ ঘটানোর জন্য তারা কতটুকু ব্রতী হতে পারবে? মূল্যবোধ বিকাশের শিক্ষা প্রদানে প্রচলিত কিছু মতাদর্শ আছে, যেগুলো নানা সময়ে বিভিন্ন সমাজ অনুসরণ করেছে। যেমন একটা ধারা হচ্ছে, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা সংজ্ঞায়িত না করে বিচারের ভার শিক্ষার্থীর ওপর ছেড়ে দেওয়া।
কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষের কোন ধরনের আচরণ কাম্য সেটা নির্দিষ্ট করে না দিয়ে এই ধারার আওতায় শিক্ষার্থীর নিজস্ব বিচারশক্তির বিকাশকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর উল্টো মতাদর্শ হচ্ছে, শিশুকে সুনির্দিষ্ট করে বোঝাতে হবে ভালো এবং মন্দের স্বরূপ ও পার্থক্য। শ্রেণীকক্ষে, বিদ্যালয়ে, পরিবার ও সমাজে তাদের ব্যবহার এবং আচরণপ্রবণতা কেমন হবে সে বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা প্রতিটি শিশুকে দিতে হবে যাতে তারা ছোট থেকে শিখতে পারে কোন আচরণ কাম্য এবং কোনটা নয়। এর মাঝামাঝি একটা পন্থাও আছে, যেখানে মানবিক গুণাবলিকে চিহ্নিত করে সেটা অর্জনের পথ বাতলে দেওয়া হবে, আবার এর পাশাপাশি শিশুদের নিজের বিচারশক্তি বিকাশের জন্য আত্মসমালোচনামূলক চিন্তা এবং প্রতিফলনের শিক্ষাও দেওয়া হবে।
চরিত্র বা মূল্যবোধ গঠনের শিক্ষায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন শিক্ষকেরা। একজন শিক্ষককে আমরা আজীবন মনে রাখি প্রধানত তিনি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সেটা বিবেচনায় এনে, তিনি আমাদের কেমন পড়িয়েছেন সেটা এখানে মুখ্য ভাবনা হিসেবে কাজ করে না। তেমনি এটাও গ্রহণীয় নয় যে শিক্ষকেরা শিশুদের জন্য ভয়ের উৎস হবেন। শুরুতেই বলেছি, শিশুদের অপার সম্ভাবনার কথা। একজন প্রকৃত শিক্ষক সর্বপ্রথম এই সম্ভাবনার ক্ষেত্রটিতে মনোনিবেশ করেন। শুধু বইয়ের কিছু নির্দিষ্ট বিষয় মুখস্থ করে পরীক্ষায় হুবহু উপস্থাপনের বাইরেও শিশুরা যে কতটুকু ক্ষমতা ধারণ করে সেটা আবিষ্কার করেন একজন ভালো শিক্ষক। বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার পাশাপাশি শিশুদের মধ্যে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার যে স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে, সেটাকে চলমান রূপ দিতে পারেন একজন শিক্ষক।
শ্রেণীকক্ষে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে প্রতিটি শিশুর মানসিক প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়। একজন শিক্ষক পারেন শিশুর অন্তর্নিহিত জগতের খবর বের করে আনতে। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন একটা শিশু শিক্ষকের প্রতি আস্থাশীল হয়ে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে নিরাপদ এবং নিশ্চিত বোধ করবে। এর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে ধৈর্যসহকারে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কথা শোনা এবং তাদের চিন্তাভাবনার আদান-প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।
পরীক্ষার খাতায় শিশুরা পাতার পর পাতা ভরে ফেলছে মানবিক উৎকর্ষের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে আর ভালো মানুষ হওয়ার শপথ ব্যক্ত করে। এখন বোধহয় ভাবার সময় এল, বিদ্যালয়জীবনে অর্জিত নৈতিক শিক্ষাকে আমাদের শিশুরা পরবর্তী জীবনে প্রয়োগ করতে পারছে কি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি শিশু-মননে কোনো স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছে, যাতে তারা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখা আর শিক্ষকদের মুখে শোনা উপদেশবাণীগুলো হূদয়ঙ্গম করে সে অনুযায়ী কাজ করছে? দীর্ঘ সময় এত শ্রম আর অধ্যবসায় ব্যয় করে শিশুরা কি শুধু কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্তই হবে? ওদের ভেতরে সুন্দর মানুষের সুস্থ, সবল যে শিশু গাছগুলো রয়েছে, সেগুলো কেন বিদ্যালয়ের আলো-বাতাস পেয়ে একেকটা বটবৃক্ষে পরিণত হচ্ছে না? মেধার স্ফুরণের পাশাপাশি কেন আমরা মানবিকতার চূড়ান্ত উৎকর্ষ সাধন দেখছি না? শূন্যতা তাহলে কোথায়? কী সেই নিয়ামক, যা ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা আর তার প্রয়োগের সদিচ্ছার মধ্যে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে আছে?
স্কুলে আমাদের বাচ্চারা যতটুকুই নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে, সেটা আসলে আত্মস্থ করতে পারছে না। অনুভব করতে পারছে না কেন তাদের ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিঃস্বার্থভাবে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করার সুফল কী, কেন ও কীভাবে সহমর্মিতা, সহনশীলতা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ ও পরমত সহিষ্ণুতা সমাজে শান্তি নিশ্চিত করতে পারে, এ বিষয়ে শিশুদের মনোজগতের গভীরে কোনো আত্মজিজ্ঞাসা সৃষ্টি করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সফল হচ্ছে না। চরিত্র গঠন আর নৈতিক শিক্ষাকে পরোক্ষভাবে বিবেচনা করার প্রবণতা থেকে বের না হয়ে আমরা শুধু শূন্য আশা করেই যাচ্ছি যে, বাচ্চারা প্রাকৃতিকভাবে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে, এ জন্য তাদের কোনো শিক্ষা বা প্রণোদনার দরকার নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করলে আমরা একটা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ আর মানবিক গুণসম্পন্ন একটা সৎ, যোগ্য নাগরিক গোষ্ঠীর স্বপ্নও দেখতে পারি না।
রুখসানা তাজীন: অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে উচ্চশিক্ষারত।
বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা অর্জন, পরীক্ষায় ভালো ফলাফল, ভালো চাকরি—এমনতরো পার্থিব চাহিদা মেটানোকেই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য বিবেচনা করলে এবং শিশুদের মানবিক বিকাশের মতো গুরুত্বকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গণ্ডির বাইরে বিবেচনা করলে তা সমাজের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না। পাশ্চাত্যে যখন হতাশাগ্রস্ত ও দিগ্ভ্রান্ত কিশোর-তরুণদের অপরাধ-প্রবণতার স্বরূপ স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত দুই-তিন শতক ধরে এই উপলব্ধিটি জোরদার হচ্ছে। এই প্রবণতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে স্কুলের অভ্যন্তরে হত্যাযজ্ঞের মতো মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দেয়। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বোধোদয় ঘটে যে শিশু-কিশোরদের মূল্যবোধ আর চরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা হেলাফেলার বিষয় নয়। আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এসব দেশে সরকারি পর্যায়ে চরিত্র গঠনমূলক শিক্ষা, সমাজিক সচেতনতামূলক শিক্ষা, মূল্যবোধ উন্নয়নের শিক্ষা—এমন নানা কার্যক্রমের আওতায় স্কুলে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োগ ঘটানো হচ্ছে। এই বিষয়ে আলাদা শিক্ষানীতি তো রয়েছেই, নির্দিষ্ট পাঠ্যক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং অন্যান্য উপকরণ সরবরাহের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে, যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে নৈতিক এবং চারিত্রিক শিক্ষা প্রদানে সক্ষম হন।
শিশুদের নৈতিক বিকাশ এবং চরিত্র গঠনের কাজটি আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হতে পারে—শিক্ষকেরা তাঁদের নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, সত্যবাদিতা, সদাচার এসব বিষয়ে ভালো ভালো কথা বলবেন, বাচ্চারা সেটা মন দিয়ে শুনবে, উপলব্ধি করবে এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করবে। কিন্তু আসলেই কি মানবিক এবং সামাজিক বিকাশের ব্যাপারটি এত সরল এবং ঝামেলাহীন? শিক্ষক যেটাকে ভালো বলবেন, বাচ্চারা কেন সেটাকে ভালো হিসেবে মেনে নেবে, আর মেনে নিলেও তাদের এই জ্ঞান কতদিন স্থায়ী হবে বা নিজেদের জীবনে মূল্যবোধ এবং চরিত্র শিক্ষার সফল প্রয়োগ ঘটানোর জন্য তারা কতটুকু ব্রতী হতে পারবে? মূল্যবোধ বিকাশের শিক্ষা প্রদানে প্রচলিত কিছু মতাদর্শ আছে, যেগুলো নানা সময়ে বিভিন্ন সমাজ অনুসরণ করেছে। যেমন একটা ধারা হচ্ছে, কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা সংজ্ঞায়িত না করে বিচারের ভার শিক্ষার্থীর ওপর ছেড়ে দেওয়া।
কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে মানুষের কোন ধরনের আচরণ কাম্য সেটা নির্দিষ্ট করে না দিয়ে এই ধারার আওতায় শিক্ষার্থীর নিজস্ব বিচারশক্তির বিকাশকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর উল্টো মতাদর্শ হচ্ছে, শিশুকে সুনির্দিষ্ট করে বোঝাতে হবে ভালো এবং মন্দের স্বরূপ ও পার্থক্য। শ্রেণীকক্ষে, বিদ্যালয়ে, পরিবার ও সমাজে তাদের ব্যবহার এবং আচরণপ্রবণতা কেমন হবে সে বিষয়ে একটা পরিষ্কার ধারণা প্রতিটি শিশুকে দিতে হবে যাতে তারা ছোট থেকে শিখতে পারে কোন আচরণ কাম্য এবং কোনটা নয়। এর মাঝামাঝি একটা পন্থাও আছে, যেখানে মানবিক গুণাবলিকে চিহ্নিত করে সেটা অর্জনের পথ বাতলে দেওয়া হবে, আবার এর পাশাপাশি শিশুদের নিজের বিচারশক্তি বিকাশের জন্য আত্মসমালোচনামূলক চিন্তা এবং প্রতিফলনের শিক্ষাও দেওয়া হবে।
চরিত্র বা মূল্যবোধ গঠনের শিক্ষায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন শিক্ষকেরা। একজন শিক্ষককে আমরা আজীবন মনে রাখি প্রধানত তিনি মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন সেটা বিবেচনায় এনে, তিনি আমাদের কেমন পড়িয়েছেন সেটা এখানে মুখ্য ভাবনা হিসেবে কাজ করে না। তেমনি এটাও গ্রহণীয় নয় যে শিক্ষকেরা শিশুদের জন্য ভয়ের উৎস হবেন। শুরুতেই বলেছি, শিশুদের অপার সম্ভাবনার কথা। একজন প্রকৃত শিক্ষক সর্বপ্রথম এই সম্ভাবনার ক্ষেত্রটিতে মনোনিবেশ করেন। শুধু বইয়ের কিছু নির্দিষ্ট বিষয় মুখস্থ করে পরীক্ষায় হুবহু উপস্থাপনের বাইরেও শিশুরা যে কতটুকু ক্ষমতা ধারণ করে সেটা আবিষ্কার করেন একজন ভালো শিক্ষক। বিষয়ভিত্তিক দক্ষতার পাশাপাশি শিশুদের মধ্যে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার যে স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে, সেটাকে চলমান রূপ দিতে পারেন একজন শিক্ষক।
শ্রেণীকক্ষে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে প্রতিটি শিশুর মানসিক প্রয়োজনের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয়। একজন শিক্ষক পারেন শিশুর অন্তর্নিহিত জগতের খবর বের করে আনতে। আর এটা তখনই সম্ভব, যখন একটা শিশু শিক্ষকের প্রতি আস্থাশীল হয়ে নিজেকে পুরোপুরি মেলে ধরতে নিরাপদ এবং নিশ্চিত বোধ করবে। এর জন্য সবচেয়ে প্রয়োজন শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে ধৈর্যসহকারে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কথা শোনা এবং তাদের চিন্তাভাবনার আদান-প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।
পরীক্ষার খাতায় শিশুরা পাতার পর পাতা ভরে ফেলছে মানবিক উৎকর্ষের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে আর ভালো মানুষ হওয়ার শপথ ব্যক্ত করে। এখন বোধহয় ভাবার সময় এল, বিদ্যালয়জীবনে অর্জিত নৈতিক শিক্ষাকে আমাদের শিশুরা পরবর্তী জীবনে প্রয়োগ করতে পারছে কি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি শিশু-মননে কোনো স্থায়ী প্রভাব ফেলতে সক্ষম হচ্ছে, যাতে তারা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখা আর শিক্ষকদের মুখে শোনা উপদেশবাণীগুলো হূদয়ঙ্গম করে সে অনুযায়ী কাজ করছে? দীর্ঘ সময় এত শ্রম আর অধ্যবসায় ব্যয় করে শিশুরা কি শুধু কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্তই হবে? ওদের ভেতরে সুন্দর মানুষের সুস্থ, সবল যে শিশু গাছগুলো রয়েছে, সেগুলো কেন বিদ্যালয়ের আলো-বাতাস পেয়ে একেকটা বটবৃক্ষে পরিণত হচ্ছে না? মেধার স্ফুরণের পাশাপাশি কেন আমরা মানবিকতার চূড়ান্ত উৎকর্ষ সাধন দেখছি না? শূন্যতা তাহলে কোথায়? কী সেই নিয়ামক, যা ভালো মানুষ হওয়ার শিক্ষা আর তার প্রয়োগের সদিচ্ছার মধ্যে বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে ঝুলে আছে?
স্কুলে আমাদের বাচ্চারা যতটুকুই নৈতিক শিক্ষা পাচ্ছে, সেটা আসলে আত্মস্থ করতে পারছে না। অনুভব করতে পারছে না কেন তাদের ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি নিঃস্বার্থভাবে নিজের দায়িত্বটুকু পালন করার সুফল কী, কেন ও কীভাবে সহমর্মিতা, সহনশীলতা, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাপোষণ ও পরমত সহিষ্ণুতা সমাজে শান্তি নিশ্চিত করতে পারে, এ বিষয়ে শিশুদের মনোজগতের গভীরে কোনো আত্মজিজ্ঞাসা সৃষ্টি করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সফল হচ্ছে না। চরিত্র গঠন আর নৈতিক শিক্ষাকে পরোক্ষভাবে বিবেচনা করার প্রবণতা থেকে বের না হয়ে আমরা শুধু শূন্য আশা করেই যাচ্ছি যে, বাচ্চারা প্রাকৃতিকভাবে সুনাগরিক হয়ে গড়ে উঠবে, এ জন্য তাদের কোনো শিক্ষা বা প্রণোদনার দরকার নেই। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করলে আমরা একটা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ আর মানবিক গুণসম্পন্ন একটা সৎ, যোগ্য নাগরিক গোষ্ঠীর স্বপ্নও দেখতে পারি না।
রুখসানা তাজীন: অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে উচ্চশিক্ষারত।
No comments