অনেক কাঁটা সরিয়ে

বিশ্বকাপ কতজনকেই তো কত কিছু দিচ্ছে। কাউকে ইতিহাসের অংশ বানিয়ে দিচ্ছে, কাউকে দিচ্ছে তারকাখ্যাতি। লিওনেল মেসি, মেসুত ওজিল বা টমাস মুলারদের মতো তারকাখ্যাতি নেলসন ভালদেস পাননি। তবে ব্যক্তিগত কিছু না পেলেও পুরো দলের সঙ্গে তিনিও হয়ে গেছেন ইতিহাসের অংশ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠেছে তাঁর দেশ প্যারাগুয়ে।
শুধু কি বিশ্বকাপ, আসলে ফুটবলই ভালদেসকে অনেক দিয়েছে। বিশ্বকাপ তো চার বছরে একবার আসে। বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই টুর্নামেন্টের আগেই প্যারাগুয়ের এই স্ট্রাইকারের জীবনে ফুল ফুটিয়েছে ফুটবল। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে ফুটবল গৃহহীন ভালদেসকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছে। দিয়েছে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার নিশ্চিত নির্ভরতা।
প্যারাগুয়ের কাগুয়াজুতে জন্ম নেওয়া ভালদেসকে ছোটবেলা থেকেই লড়তে হয়েছে ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে। গরিব মা-বাবার সন্তান, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে জন্ম নেওয়ায় ছোট্টবেলায়ই জীবনসংগ্রামে নেমে পড়তে হয় ভালদেসকে। শৈশবের উদ্দীপনা নিয়ে অন্যরা যখন নিয়মিত স্কুলে যেত, ভালদেস দূরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ত—‘ইস্, যদি আমিও পারতাম!’ বিকেলে সমবয়সীরা যখন ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ত, ছোট্ট ভালদেসকে করতে হতো দুমুঠো খাবারের অন্বেষণ।
কিন্তু এর মধ্যেও ফুটবল তাঁকে টানত চুম্বকের মতো। ফুটবলের টানে প্যারাগুয়ের টিমবিয়েত্রে ক্লাবের আশপাশে ঘুরঘুর করত ১৫ বছর বয়সী ভালদেস। স্টেডিয়ামে বাক্স কুড়াতেন, তা বিক্রি করেই মিটত ক্ষুধা। আর রাতে ঘুমটাও হতো স্টেডিয়ামের ভেতরেই। এভাবেই ক্লাবটার সঙ্গে এক ধরনের সখ্য গড়ে ওঠে ভালদেসের। এক দিন টিমবিয়েত্রে ক্লাবে একজন নিরাপত্তাকর্মীর প্রয়োজন পড়ে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ ভাবে, ছেলেটা যখন স্টেডিয়ামেই ঘুমায়, সে-ই তো কাজটা করতে পারে!
কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে খেলতেও শুরু করে ছেলেটি। রাতে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করে, দিনের বেলা সময় পেলেই বল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ে। আস্তে আস্তে ফুটতে থাকে ছেলেটির ফুটবল-প্রতিভাও। একসময় সুযোগ পেয়ে যান এই ক্লাবেরই যুবদলে। সেই শুরু ভালদেসের, এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
জীবনে যা কিছু সুযোগ পেয়েছেন, সেটিই কাজে লাগিয়েছেন ঠিকমতো। বদলে গেছে জীবনটাই। একদিন যে ভালদেস একমুঠো খাবারের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতেন, সেই তিনিই এখন যা ইচ্ছে খেতে পারেন, যেখানে ইচ্ছে যেতে পারেন। একদিন যে ভালদেস একটু শান্তিতে ঘুমানোর জন্য উষ্ণ একটা জায়গা খুঁজতেন, সেই ভালদেসের এখন ঘুমানোর জায়গার অভাব নেই।
এই সবকিছুই ভালদেসকে দিয়েছে ফুটবল। ফুটবলের ঋণ ভালদেস কখনোই ভুলবেন না, ‘আমার জীবনে যা কিছু পেয়েছি, তা ফুটবলের কল্যাণেই। ফুটবলের কাছে আমি ঋণী।’ ফুটবলের মতো জীবনে যে কষ্টের পথ ফেলে এসেছেন পেছনে, সেটাও ভুলতে চান না ভালদেস। ফেলে আসা এই কণ্টকাকীর্ণ পথই যে তাঁর প্রেরণা, ‘কষ্টের এই জীবন নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। অনেক মানুষ বা অনেক ফুটবলারের চেয়েই আলাদা হলেও এটাই আমাকে গর্বিত করে। আমাকে ভালো কিছু করতে উৎসাহ দেয়।’

No comments

Powered by Blogger.